Skip to main content

আল কুরআনের আলোকে উত্তরাধিকারের বিধান - সম্পদের কল্যাণমূলক সুষম বণ্টন বিধি

আল কুরআনের আলোকে উত্তরাধিকারের বিধান - সম্পদের কল্যাণমূলক সুষম বণ্টন বিধিঃ

আল কুরআনের আলোকে উত্তরাধিকারের বিধান বইটি এ বিষয়ে ‘ফারায়েজ’ নামে প্রচলিত বইসমূহের চেয়ে ব্যতিক্রমধর্মীঃ



একটি উপস্থাপনা। প্রচলিত ফারায়েজ বা মুসলিম উত্তরাধিকার বণ্টন বিধিকে আল কুরআনের আলোকে পর্যালোচনা করলে এতে কুরআনে বর্ণিত বণ্টন বিধির সাথে অনেক মৌলিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। প্রচলিত ফারায়েজের উপর ভিত্তি করে এ বিষয়ে গাণিতিক অসঙ্গতিসহ সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে মানবিক দিকটিকে উপেক্ষা করার অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ধর্মীয় আবেগের ভিত্তিতে এরূপ প্রশ্ন উত্থাপনকে ধর্ম বিরুদ্ধতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং দায়সারা পর্যায়ের জবাব দেয়ার চেষ্টা করা হয়, যাতে প্রকৃতপক্ষে উত্থাপিত অভিযোগের যথার্থ সমাধান পাওয়া যায় না। এই প্রেক্ষিতে বইটিতে বস্তুত কুরআনে উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধির বিস্তারিত দিক কী এবং কেন তা যৌক্তিক, তা তুলে ধরা হয়েছে।
মৃত্যুর পূর্বেই সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে ন্যায়সঙ্গতভাবে ওয়াসিয়্যাত করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। উত্তরাধিকার বণ্টন বিধির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারা হলো, এতে নির্ধারিত উত্তরাধিকার প্রাপকদের মধ্যে নির্ধারিত হারে বণ্টন করতে হবে মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত ও ঋণ পরিশোধের পরে। অথচ প্রচলিত ভুল ব্যাখ্যার কারণে ওয়াসিয়্যাতের বিধানকে বাধ্যতামূলক হিসেবে কার্যকর করা হয় না এবং যাদের জন্য উত্তরাধিকারের নির্ধারিত অংশ আছে তাদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করা হয় না। তাই বইটিতে ওয়াসিয়্যাতের যৌক্তিকতা ও আবশ্যকতা সম্পর্কেও বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
বইটিতে উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধির প্রাসঙ্গিক শব্দ ও ধারণাগুলোর বিস্তারিত পর্যালোচনামূলক উপস্থাপনার মাধ্যমে কে কোন অবস্থায় বা কোন শর্তে কতটুকু পাবে তার বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে যে ফতোয়া বা মাসয়ালার কারণে উত্তরাধিকার বণ্টনের ক্ষেত্রে ইয়াতীম নাতিদেরকে বঞ্চিত করা হয়, কুরআনের আলোকে তার পর্যালোচনা করা হয়েছে। এ পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, ইয়াতীম নাতিদেরকে বঞ্চিত করার নীতি কুরআনসম্মত নয়। গবেষণামূলক তথ্যের মাধ্যমে দাদা-দাদী বা নানা-নানী এবং ইয়াতীম নাতির অংশ নির্ণয়ের উপায় সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।
উত্তরাধিকারের বিধানের কুরআনভিত্তিক উপস্থাপন হিসেবে বইটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে। আয়াতভিত্তিক যাচাইয়ের মাধ্যমে এতে কোনো ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি চিহ্নিত হলে পরবর্তী সংস্করণে তা সংশোধন করা হবে, ইনশাআল্লাহ।

ভূমিকাঃ
কারো মৃত্যু আসন্ন হলে বা বার্ধক্যের পরিণত অবস্থায় তার উপর পিতা-মাতা ও নিকটতম আত্মীয়দের জন্য ওয়াসিয়্যাত করা বাধ্যতামূলক (ফরযিয়াত)।
ওয়াসিয়্যাতের ব্যাপারে কুরআনে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার পরিস্থিতি ও ন্যায়সঙ্গত বিবেচনার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো ন্যুনতম পরিমাণ বা কাকে কতটুকু দিতে হবে তার সীমাবদ্ধতা বা সুনির্দিষ্টকরণ নেই।
মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাতের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন করা সঙ্গত নয়। তবে যদি ওয়াসিয়্যাতকারীর পক্ষ থেকে কোনো পক্ষপাতিত্ব বা কাউকে অন্যায্যভাবে বঞ্চিত করার আশংকা হয়, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতা করে দেয়াতে কোনো দোষ নেই।
ওয়াসিয়্যাত কার্যকর করার ক্ষেত্রে মূল দুইজন সাক্ষীর সাক্ষ্যের মাধ্যমে যাদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়েছে তাদের মধ্যকার বা তাদের সপক্ষে আপত্তিকারীদের মধ্য থেকে অগ্রাধিকারের যোগ্য দুইজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিলে ঐ ওয়াসিয়্যাত রহিত হয়ে যাবে তথা কার্যকর হবে না, বরং সম্পূর্ণ সম্পত্তি উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুসারে হিসেবে বণ্টিত হবে।
বিধবা নারীদের জন্য আল্লাহ স্বয়ং একটি ওয়াসিয়্যাত করেছেন যে, তাদেরকে এক বছর ভরণপোষণ দিতে হবে এবং ঘর থেকে বের করে দেয়া যাবে না।
মৃত্যু পরবর্তী সম্পদের উত্তরাধিকার (তুরাস) বণ্টন হবে ওয়াসিয়্যাত (যদি থাকে) ও ঋণ (যদি থাকে) পরিশোধের পর।

সমাজ কল্যাণে কে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে তা বিবেচনায় নির্বাহী কর্তৃপক্ষের হাতে উত্তরাধিকার বণ্টন করার অবকাশ না রেখে বরং আল্লাহ স্বয়ং সম্পদের মূল ওয়ারিস এবং তাদের প্রাপ্য অংশ নির্ধারিত করে দিয়েছেন।
উত্তরাধিকার সম্পর্কিত আয়াতসমূহে বর্ণিত অংশগুলো হচ্ছে আনুপাতিক / তুলনামুলক ভগ্নাংশ অর্থাৎ বণ্টনের ক্ষেত্রে নরমালাইজেশন করার নির্দেশনা রয়েছে।
উত্তরাধিকারে যার জন্য যে আনুুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারিত করা হয়েছে সেটাই তার প্রাপ্য অধিকার। আর এ থেকে পরোক্ষভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় একজন ব্যক্তির প্রতি অন্যদের আনুপাতিক দায়িত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
প্রচলিত ফারায়েজ বা মুসলিম উত্তরাধিকার বণ্টন বিধিতে কুরআনে বর্ণিত বণ্টন বিধির সাথে মৌলিক নীতিগত পার্থক্য রয়েছে। এর ফলে আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের কল্যাণ থেকে সমাজ বঞ্চিত হচ্ছে।
উত্তরাধিকার বণ্টনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক ভিন্নমানের জিনিস ভিন্নভাবে বণ্টিত হবে। তারপর ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজন সাপেক্ষে নিজেদের মধ্যে ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে অথবা সমবায় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সম্পদের অখ-ত্বের উপযোগিতা (Utility) সমন্বয় করতে পারবে।
কুরআনে নির্ধারিত কোনো ওয়ারিস (উত্তরাধিকারী) জীবিত থাকলে অন্য কেউ পাবে না এবং ঐ ওয়ারিসদের মধ্যে সম্পূর্ণ উত্তরাধিকার বন্টিত হবে।
কুরআনে ওয়ারিস হিসেবে যাদের অংশ নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে তাদেরকে মাওয়ালিয়া (নির্দিষ্ট ওয়ারিস) এবং আক্বরাবূন (নিকটতম আত্মীয়) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আক্বরাবূন সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন থেকে বুঝা যায়, আক্বরাবূন দুই শ্রেণিতে বিভক্ত। প্রত্যক্ষ আক্বরাবূন এবং আপেক্ষিক আক্বরাবূন। মৃত ব্যক্তির প্রত্যক্ষ আক্বরাবূনের মাধ্যমে সম্পর্কসূত্রের ভিত্তিতে যাদেরকে আক্বরাবূন হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে তারাই হচ্ছে আপেক্ষিক আক্বরাবূন। আপেক্ষিক আক্বরাবূন বস্তুত যে প্রত্যক্ষ আক্বরাবূনের মাধ্যমে সম্পর্কসূত্রের ভিত্তিতে মৃত ব্যক্তির আক্বরাবূন হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে সেই প্রত্যক্ষ আক্বরাবূনের প্রাপ্য অংশের স্থলাভিষিক্ত হয়। অর্থাৎ এরূপ প্রত্যক্ষ আক্বরাবূন জীবিত থাকলে যা পেতো তা-ই আপেক্ষিক আক্বরাবূনের প্রাপ্য। তাই ক্ষেত্রবিশেষে ইয়াতীম নাতি-নাতিনকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার রীতি কুরআনসম্মত নীতি নয়।
কুরআন অনুযায়ী নির্ধারিত ওয়ারিসদের কেউই জীবিত না থাকলে সে অবস্থায় উত্তরাধিকারের বণ্টন হবে উলিল আমরের (Central Authority) সিদ্ধান্ত অনুসারে। এক্ষেত্রে তারা কুরআনে বর্ণিত ওয়ারিসদের শ্রেণিবিভাগের শিক্ষা অনুসারে দূরবর্তী ওয়ারিস নির্ধারণ করে উত্তরাধিকার বণ্টন করতে পারেন।
কুরআনে যাদেরকে ওয়ারিস হিসেবে নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে তাদের বাহিরের আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও মিসকীন যদি উত্তরাধিকার বণ্টনকালে উপস্থিত হয় তাহলে তাদের সাথে ভদ্রোচিত কথা বলতে হবে এবং তাদেরকে বণ্টিত সম্পদ থেকে উপজীবিকাস্বরূপ কিছু দিতে হবে।
অধ্যায় ১: ওয়াসিয়্যাত ও উত্তরাধিকারের বিধানের গুরুত্ব এবং বইটি রচনার উদ্দেশ্য
ওয়াসিয়্যাতের বিধান ও উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি কুরআনে উল্লেখিত দুটি বাধ্যতামূলক বিধান। এ বিধানের ভিত্তিমূল হিসেবে যে মূলনীতি জানানো হয়েছে তা হলো: আল্লাহর কিতাবে রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়গণ একে অপরের প্রতি অগ্রাধিকারী (৮:৭৫, ৩৩:৬)। একে অন্যের উত্তরাধিকার হরণ করা অত্যন্ত অসঙ্গত কর্ম তথা গর্হিত অপরাধ (৮৯:১৭-২০)। বলপ্রয়োগপূর্বক নারীদের সম্পদের ওয়ারিস হওয়া বা ভোগদখল করা কোনোক্রমেই বৈধ নয় (৪:১৯)।

কুরআনে ওয়াসিয়্যাতের বিধান সম্পর্কিত আয়াতসমূহ হচ্ছে ২:১৮০-১৮২, ৫:১০৬-১০৮, ২:২৪০ এবং উত্তরাধিকারের (তুরাস) নির্ধারিত বণ্টন বিধি সম্পর্কিত আয়াতসমূহ হচ্ছে: ৪:৩৩, ৪:৭-১৪, ৪:১৭৬।
৪:১১-১২ আয়াতে চারবার বলা হয়েছে যে, উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি কার্যকর হবে ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণের পরে। আর উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির প্রসঙ্গে ৪:১৩-১৪ আয়াতে বলা হয়েছে যে, তা লংঘন করলে জাহান্নামে যেতে হবে এবং চিরকাল থাকতে হবে।
উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে ৪:১১ আয়াতে বলা হয়েছে ‘তোমরা জান না তোমাদের পিতাগণ ও পুত্রগণের মধ্যে কে তোমাদের (সমাজের) জন্য উপকার করার দিক থেকে অধিক নিকটবর্তী হবে? এটি (উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি) আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ফরজ। নিশ্চয় আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাবিজ্ঞ।’ ৪:১২ আয়াতে বলা হয়েছে ‘এটি (উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি) আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ওয়াসিয়্যাত। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সহনশীল’। ৪:১৭৬ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য (উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি) স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন, পাছে তোমরা বিভ্রান্ত হবে। আর আল্লাহ সর্ব বিষয়ে জ্ঞানী’।
বর্তমানে উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধি মুসলিম সমাজে সুন্নী আইন ও শিয়া আইন ইত্যাদি নামে বিভিন্নভাবে প্রচলিত রয়েছে। উত্তরাধিকারের বিভিন্ন বণ্টন বিধির ক্ষেত্রে কিছু আপত্তি এবং তার কিছু জবাবও প্রচলিত রয়েছে। যেমন কুরআনে উত্তরাধিকারের বিষয়ে সুস্পষ্ট, সম্পূর্ণ, সুসমঞ্জস ও যৌক্তিক বণ্টন বিধি রয়েছে কিনা? এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উত্থাপিত প্রশ্ন হলো, কুরআনে প্রদত্ত বন্টনবিধির অংশগুলোর যোগফল কখনো কখনো সমস্তের চেয়ে কম বা বেশি হয়ে যায় কেন? এটা কি কোনোরূপ গাণিতিক ত্রুটি? প্রচলিত আউল ও রদ্দনীতি কি একটি আসমানী বিধানের কৃত্রিম সংশোধনমূলক ব্যবস্থা হিসেবে প্রবর্তিত হয়েছে? প্রচলিত আছে যে, উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির মাধ্যমে ওয়াসিয়্যাতের বিধান রহিত হয়ে গেছে। আরেকটি প্রচলিত কথা হচ্ছে, উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বন্টন বিধিতে ইয়াতীম নাতি তার দাদার সম্পদে নিজ চাচার উপস্থিতিতে ওয়ারিস হওয়ার সুযোগ নেই। বলা হয় যে, এ অবস্থায় তাকে ওয়ারিস গণ্য করলে তা হবে কুরআনের বিধানের লংঘন। পক্ষান্তরে মৃত ব্যক্তির পিতার অবর্তমানে মৃত ব্যক্তির দাদা (অর্থাৎ নাতির সম্পদে দাদা) উত্তরাধিকার পাবে, এক্ষেত্রে তার চাচা জীবিত থাকা কোনো সমস্যা নয়। মনে করা হয় যে, এটাই কুরআনের বিধান অনুসারে স্বাভাবিক ব্যবস্থা।
বইটি রচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে এ সকল আপত্তি অভিযোগের প্রকৃত সমাধান নির্ণয়সহ প্রচলিত উত্তরাধিকার বন্টনবিধিতে কুরআনে প্রদত্ত বন্টনবিধির সাথে কোনো সাংঘর্ষিকতা আছে কিনা এবং সেই কারণে কুরআনের মাধ্যমে যার জন্য যা দেয়া হয়েছে, সে কোনোভাবে তা থেকে বঞ্চিত হয় কিনা তা যাচাই করা। এভাবে কুরআনে বর্ণিত উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বন্টনবিধি অনুযায়ী কার প্রাপ্য কতটুকু তা বুঝে নেয়ার মাধ্যমে প্রত্যেকের যথার্থ অধিকার পরিপূরণের ব্যবস্থা করা এবং সমাজ কল্যাণের সর্বোত্তম ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত করা। সেই সাথে কুরআনে প্রদত্ত উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বন্টনবিধি লংঘন করলে জাহান্নামে যেতে হবে বিধায় তা থেকে সতর্ক থাকা ও সতর্ক করা।

ওয়্যাসিয়্যাত ও উত্তরাধিকারের বিধানের তাৎপর্য ও উদ্দেশ্যঃ

মৃত ব্যক্তির সম্পদ বন্টনের ব্যবস্থা হিসাবে ওয়াসিয়্যাতের বিধানই প্রাথমিক গুরুত্বসম্পন্ন (সূরা বাকারা ২:১৮০-১৮২)। ওয়াসিয়্যাতের মাধ্যমেই প্রত্যেক ব্যক্তির বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে তার জন্য যথাযথ অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব। যেমন: এর মাধ্যমে কোনো সন্তান কম বয়সী বা অপ্রতিষ্ঠিত থাকলে তাকে অধিক সম্পদ দেয়া যেতে পারে। কিন্তু যদি কেউ ওয়াসিয়্যাত না করে থাকে বা যদি তার ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণের পর কোনো সম্পদ থাকে তাহলে ঐ অবশিষ্ট সম্পদের ক্ষেত্রেই উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি প্রযোজ্য (সূরা নিসা ৪: ১১-১২)। উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধিতে দুটি পুত্র তাদের বয়স, সম্পদ ইত্যাদির পার্থক্য সত্ত্বেও পরস্পরের সমান অংশ পাবে। কিন্তু পুত্র, কন্যা, স্বামী/স্ত্রী, পিতা, মাতা, ভাই, বোন এক শ্রেণি অন্য শ্রেণি থেকে ভিন্ন ভিন্ন নির্ধারিত অনুপাতে পাবে, সকল শ্রেণি সমানুপাতে পাবে না। উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধিতে আল্লাহ যার জন্য যে আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণ করেছেন সেটাই তার প্রাপ্য অধিকার। যেমন বিবাহের ক্ষেত্রে স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামীকে দেনমোহর দিতে হয় না, বরং আল্লাহর আইন অনুযায়ী বিয়ের শর্ত হিসেবে স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে দেনমোহর দেয়া আবশ্যিক দায়িত্ব তথা স্ত্রীলোকের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ অধিকার; উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির বিষয়টিও অনুরূপ। ওয়াসিয়্যাত ও উত্তরাধিকারের বিধানের উদ্দেশ্য হচ্ছে সামাজিক ভারসাম্যের প্রাকৃতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। একজন ব্যক্তি তার জীবিতকালে তার উপার্জিত বা প্রাপ্ত সম্পদের আমানতদার মালিক এবং তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যে, সে তার মৃত্যুর পূর্বে তার সম্পদের বিষয়ে ওয়াসিয়্যাত করে যাবে। কিন্তু তার মৃত্যুর পর তার পরিত্যক্ত সম্পদ মহাবিশে^র যাবতীয় সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহর ওয়াসিয়্যাত (তথা উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি) অনুযায়ী (মৃত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধ, মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও উত্তরাধিকারের বিধান পালনার্থে) বন্টিত হবে।
উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা লাভের ক্ষেত্রে সূরা নিসা ৪:১১ আয়াতের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য।  আয়াতটিতে বলা হয়েছে যে, তোমরা জানো না, তোমাদের সমাজকল্যাণের জন্য তোমাদের পিতা-মাতা ও তোমাদের পুত্র-কন্যার মধ্যে কে উপকার সাধনে অধিক নিকটবর্তী হবে? অর্থাৎ যখন ওয়াসিয়্যাতের পর কোনো সম্পদ অবশিষ্ট থাকবে তখন ঐ সম্পদে কারো প্রত্যক্ষ অধিকার না থাকায় সমাজ কল্যাণের প্রাকৃতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য তার বন্টননীতি কি হবে তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব হতো না, তাই আল্লাহ উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির মাধ্যমে তা বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন।

উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির মাধ্যমে পরোক্ষভাবে একটা শর্তসাপেক্ষ দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমন: উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুসারে, এক পুত্র পাবে দুই কন্যার সমানুপাতিক। এর মাধ্যমে পরোক্ষভাবে এ নির্দেশনা পাওয়া যায় যে, আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যশীল বিধান হচ্ছে, যদি পিতা-মাতা সন্তানের উপর নির্ভরশীল হয় সে অবস্থায় তাঁদের সেবা ও সহযোগিতা করতে সক্ষম হলে একটি পুত্রকে দুইটি কন্যার সমানুপাতে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তবে অধিকার ও দায়িত্বের এই অনুপাতের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো, দুটি পুত্র তাদের বয়স ও সামর্থ্যের পার্থক্য সত্ত্বেও পরস্পর সমানুপাতে উত্তরাধিকার লাভ করে, যেখানে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অবশ্যই ঐ পার্থক্য একটি বাস্তব অনুঘটকে (ঋধপঃড়ৎ) পরিণত হবে। উত্তরাধিকারের প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে মোটাদাগে প্রাপকের শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছে (পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, স্বামী, স্ত্রী, ভাই, বোন), কিন্তু একই শ্রেণির সদস্যদের মধ্যে বিভিন্ন অবস্থার তারতম্য (যেমন, বয়স ও সামর্থ্য) অনুসারে পার্থক্য করা হয়নি। কারণ এক্ষেত্রে এরূপ তারতম্যের কোনো সুনির্দিষ্টতা নেই বরং তা পরিস্থিতি সাপেক্ষ বিষয় বিধায় তা স্থায়ী বিধানে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে অনুপযোগী। এরূপ বাস্তবসম্মত তারতম্য বিবেচনায় সম্পদের বণ্টন নিশ্চিত করার ব্যবস্থাপনা হিসেবে উত্তরাধিকারের বিধানে প্রথমে ওয়াসিয়্যাতের বিধান পরিপূরণের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

বিবেক বুদ্ধি অনুযায়ী ওয়াসিয়্যাত ও উত্তরাধিকারের বন্টন বিধিঃ
বিবেক বুদ্ধি অনুযায়ী বুঝা যায় যে, কোনো ব্যক্তির স্বাভাবিক মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসলে সে তার নিকটতম আত্মীয়দের জন্য ওয়াসিয়্যাত করে যাওয়া উচিত। কারণ সে বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে তার সম্পদ থেকে কাকে কতটুকু দিতে হবে তা নির্ধারণ করতে পারবে। কিন্তু নিকটতম আত্মীয়দের মধ্যে কে কে গণ্য হবে তা সর্বসম্মতিক্রমে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। আর যদি কারো ওয়াসিয়্যাত না থাকে অথবা ওয়াসিয়্যাতের পরবর্তীতেও কোনো সম্পদ অবশিষ্ট থাকে তাহলে এক্ষেত্রে দুইটি ব্যবস্থার একটি অবলম্বন করা প্রয়োজন হতো। হয়তো এক্ষেত্রে তার সকল উত্তরাধিকারীকে তা সমানভাবে দিতে হতো। নয়তো তাদের শ্রেণিবিন্যাস করে প্রত্যেক শ্রেণির সকল সদস্যকে সমান হারে কিন্তু এক শ্রেণির তুলনায় অন্য শ্রেণিকে অসমান হারে দিতে হতো। কিন্তু উত্তরাধিকারী কাদেরকে নির্ধারণ করা হবে তা সর্বসম্মতিক্রমে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। এছাড়া উত্তরাধিকারীদেরকে সমান হারে দিলে তা কি বেশি যৌক্তিক হবে না তাদের শ্রেণিবিভাগ করলে তা বেশি যৌক্তিক হবে তাও সর্বসম্মতিক্রমে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। আর যদি শ্রেণিবিভাগ করা হয় তবে কোন শ্রেণিকে কতটুকু দিতে হবে তাও সর্বসম্মতিক্রমে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। যদি কোনোভাবে আত্মীয়দের শ্রেণিবিভাগ ও শ্রেণিগত নৈকট্যের তারতম্য নির্ধারণ ছাড়া এবং প্রাধিকারের ভিত্তিতে কোনো বাধ্যতামূলক বিধান নির্ধারণ ছাড়া উত্তরাধিকারের বণ্টনের বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে উলিল আমরের (Central Authority) উপর ছেড়ে দেয়া হতো যে, মৃত ব্যক্তির বিভিন্ন আত্মীয়দের বাস্তব অবস্থা সাপেক্ষে উলিল আমর (Central Authority) তা বণ্টন করবেন, তবে তাও বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি করতো। সুতরাং বিবেক বুদ্ধি অনুযায়ী, উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধি আল্লাহ কর্তৃক সরাসরি নির্ধারিত হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধিতে রসূলের ভূমিকাঃ
উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধির শেষ আয়াতটিতে (৪:১৭৬) বলা হয়েছে, আল্লাহ তোমাদের জন্য স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন, পাছে তোমরা বিভ্রান্ত হবে। সুতরাং উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি কুরআনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ৪:১৩ আয়াতে উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধিকে ‘হুদুদুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং কুরআনে উল্লেখিত ‘হুদুদুল্লাহ’ এর আওতায় থাকা কোনো ওয়ারিসকে বাদ দেয়া যাবে না এবং তাদের মধ্যকার কেউ থাকা অবস্থায় অন্য কাউকে ওয়ারিস হিসেবে যোগ করা যাবে না এবং তাদের কাউকে তার প্রাপ্য অংশের চেয়ে কম বা বেশি দেওয়া যাবে না।

৪:১৩ আয়াতে কুরআনে প্রদত্ত উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধিকে ‘হুদুদুল্লাহ’ হিসেবে উল্লেখ করার পর আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্যের বিষয় বলা হয়েছে। হুদুদুল্লাহর বাস্তবায়ন হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য। আর হুদুদুল্লাহর আওতায় থাকা কোনো ওয়ারিস যদি না থাকে সে অবস্থায় মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদের ব্যবস্থাপনা বা বণ্টন কিভাবে হবে সেক্ষেত্রে রসূলের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া হচ্ছে রসূলের আনুগত্য। অন্য কথায় এরূপ সম্পদের ব্যবস্থাপনা বা বণ্টন রসূলের নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে হবে। এক্ষেত্রে তিনি কুরআনে বর্ণিত বণ্টন বিধির ছায়া অবলম্বনে অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে তা বণ্টন করতে পারেন অথবা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে অন্য কোনো ব্যবস্থাপনা করতে পারেন। যখন যেখানে রসূল উপস্থিত থাকবেন না তখন সেখানে নির্বাহী দায়-দায়িত্ব পালনকারী কর্তৃপক্ষ হচ্ছেন ‘উলিল আমর’ অর্থাৎ মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্বের অধিকারী দায়িত্বশীল (Central Authority) । সুতরাং বর্তমানে রসূলের আনুগত্যের নির্দেশ সম্বলিত ধারাটির রূপান্তরিত প্রয়োগক্ষেত্র হচ্ছে ‘উলিল আমরের আনুগত্য’।

যার ক্ষেত্রে কুরআন নির্ধারিত কোনো ওয়ারিস নেই তার পরিত্যক্ত সম্পদের ব্যবস্থাপনা

যার ক্ষেত্রে কুরআন নির্ধারিত কোনো ওয়ারিস নেই তার পরিত্যক্ত সম্পদ কুরআন নির্ধারিত ওয়ারিসদের মধ্যে নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী বন্টনের সুযোগ নেই তথা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় সেটার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব মুসলিম উম্মাহর উলিল আমরের তথা সামষ্টিক বিষয়াদির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের (Central Authority) উপর ন্যস্ত হবে। অর্থাৎ এমতাবস্থায় তা মুসলিম উম্মাহর বাইতুল মালের অংশ হবে অথবা উলিল আমর কুরআনে থাকা ওয়ারিসদের মধ্যে নির্ধারিত বণ্টন বিধির ধরন থেকে প্রাপ্ত শিক্ষার আলোকে মৃত ব্যক্তির দূরবর্তী আত্মীয়গণের মধ্যে আত্মীয়তার নৈকট্যের মাত্রা অনুসারে ও কুরআনে বর্ণিত বন্টনবিধির ছায়া অবলম্বনে বন্টন করে দিতে পারবেন। অথবা মৃত ব্যক্তির দূরবর্তী আত্মীয়দের বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় পরামর্শক্রমে বণ্টন করতে এবং প্রয়োজনে বৃহত্তর সমাজ কল্যাণার্থে একটি অংশ পরিগ্রহণ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে যে বন্টনবিধি অনুসরণ করা হবে তা হচ্ছে নির্বাহী বন্টনবিধি। এভাবে যাদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হবে তারা নির্বাহী বন্টনবিধির ভিত্তিতে ওয়ারিস হবে কিন্তু তারা মাওয়ালিয়া (নির্দিষ্ট ওয়ারিস) হিসাবে গণ্য হবে না। কারণ কুরআনের মাধ্যমে যারা মাওয়ালিয়া হিসাবে সাব্যস্ত হয়েছে তারা এর বাইরে রয়েছেন।

হিজড়াদের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধির প্রয়োগঃ
উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধি অনুসারে প্রত্যেক উত্তরাধিকারী 'যাকার' (পুরুষ) বা 'উনছা' (নারী) হিসেবেই পরিগণিত হবে, এতে কাউকে 'না নারী না পুরুষ' হিসেবে চিহ্নিত করার অবকাশ নেই। সুতরাং হিজড়াদের মধ্য থেকে কাউকে নারী হিসেবে এবং কাউকে পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের মধ্যে উত্তরাধিকার বণ্টিত হবে। এক্ষেত্রে যার মধ্যে প্রকাশিত লক্ষণের বেশি মাত্রা নারীদের মতো তাকে নারী হিসেবে এবং যার মধ্যে প্রকাশিত বেশি মাত্রা পুরুষদের মতো তাকে পুরুষ হিসেবে সাব্যস্ত করা যেতে পারে। বিশেষ করে তাদের লৈঙ্গিক লক্ষণ বিবেচনার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। বস্তুত যে বিষয়ে কোনো এক ধরনের বিধান নির্দিষ্ট করে দিলে তা ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতায় সমান কল্যাণকর হতো না, সেরূপ বিষয়ে কুরআনে কোনো এক ধরনের বিধান নির্দিষ্ট না করে বরং সেক্ষেত্রে বাস্তবভিত্তিক বিভিন্ন পরিবর্তনশীল সিদ্ধান্ত গ্রহণের অবকাশ রাখা হয়েছে। আর তাই এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার বিষয়টি কুরআনে নির্দেশিত পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ নীতির উপর ভিত্তি করে সম্পাদিত হবে।

সূরা নিসার ৭ থেকে ১৪ আয়াতের বক্তব্যধারা ও বণ্টন বিধি লংঘনের দন্ডঃ
৪:৭ থেকে ৪:১৪ পর্যন্ত আয়াতগুলো একই বক্তব্যের কাঠামোবদ্ধ নয় বা একটি অন্যটির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত বাক্য বিন্যাসে গঠিত একক বক্তব্য নয়। কিন্তু এ বক্তব্যগুলোর মধ্যে একটি পারস্পরিক যোগসূত্র রয়েছে যা তাদের পূর্বাপর বক্তব্য প্রসঙ্গের সম্পর্ক থেকে সুস্পষ্ট হয়। বক্তব্যগুলোর স্বাতন্ত্র্য আবিষ্কার করা প্রয়োজন যেন একটিকে অন্যটির অংশ হিসেবে ব্যাখ্যা করা না হয়, আবার বক্তব্যগুলোর যোগসূত্র অনুধাবন করা প্রয়োজন যেন বক্তব্যগুলোর ধারাক্রমিক অবস্থানের কারণ অনুধাবন করা যায় এবং আন্তঃপ্রাসঙ্গিক তথ্যের সমন্বয় সাধন করা যায় তথা একটি বিষয়ের নিয়ামক/ প্রভাবক একাধিক স্বতন্ত্র ও সুসমঞ্জস বক্তব্যের সব নির্দেশনা যথানিয়মে বাস্তবায়ন করা যায়।

৪:৭ আয়াতের মাধ্যমে ৪:৬ পর্যন্ত আয়াতের বক্তব্য থেকে স্বতন্ত্র একটি বক্তব্য শুরু হয়েছে। ৪:৭ আয়াত থেকে শুরু হওয়া বক্তব্য ৪:৯ আয়াতে সমাপ্ত হয়েছে। ৪:১০ আয়াত একটি স্বতন্ত্র বক্তব্য। তারপর ৪:১১ থেকে ৪:১৪ আয়াত একটি স্বতন্ত্র বক্তব্য। তারপর ৪:১৫ আয়াত থেকে আরেকটি বক্তব্য শুরু হয়েছে যা ৪:১৪ পর্যন্তকার আয়াতের সাথে ‘ওয়া’ দিয়ে জুড়ে দেয়া হয়েছে এবং এর মাধ্যমে কিছু বিধান লংঘনের ক্ষেত্রে পার্থিব সুনির্দিষ্ট দন্ডবিধি উল্লেখ করা হয়েছে। উত্তরাধিকারের বিধান লংঘন করলে মুসলিম উম্মাহর ক্ষমতা থাকলে ক্ষমতা প্রয়োগ করে তা সংশোধন করে দেবে এবং বিধান লংঘনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্বাহী পর্যায়ে কোনো দন্ডবিধি আরোপ করবে, যা আল্লাহ সাংবিধানিকভাবে (তথা কুরআনের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে) নির্দিষ্ট করে দেননি। আবার যদি কখনো কোনো ক্ষেত্রে কোনো ধরনের দন্ড দেয়ার প্রয়োজন বোধ না করা হয় তাহলে দন্ড ছাড়াই শুধু সংশোধন করে দেয়া হবে। উলিল আমর শব্দের অর্থই হলো এ ধরনের কিছু নির্বাহী বিষয় আছে। তবে যা নিতান্ত ধর্মীয় বিষয়, সামাজিক বিষয় নয়, তাই একে রাষ্ট্রীয় আইনরূপে প্রবর্তন (নির্বাহী সংবিধানরূপে প্রবর্তন) করা হয় না, তার জন্য কোনো ধরনের নির্বাহী দন্ডবিধি প্রণীত হবে না, যেমন সালাত সম্পাদন না করার জন্য। উত্তরাধিকারের বিধান লংঘন করলে তার জন্য সাংবিধানিকভাবে (কুরআনের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে) কোনো দন্ডবিধি নির্দিষ্ট করা হয়নি। তবে এর সাথে সম্পদের ব্যবস্থাপনা জড়িত বিধায় তা নিতান্ত ধর্মীয় বিষয় নয়। তাই প্রয়োজনসাপেক্ষে এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় আইন প্রবর্তন করা যেতে পারে। কিন্তু যতক্ষণ এ সম্পর্কিত রাষ্ট্রীয় আইন প্রবর্তিত করা হবে না ততক্ষণ এটি ধর্মীয় বিষয় হিসেবেই বিবেচিত, তাই দন্ডবিধির প্রশ্ন নেই। অন্যদিকে সালাত নিতান্ত ধর্মীয় বিষয়, তা পারস্পরিক লেনদেনের বিষয় নয়, তাই সালাত সম্পাদন না করার জন্য কখনো রাষ্ট্রীয় আইন করা যেতে পারে না। যাকাতের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অনুদান ঘটলেও তা সালাতের মতই শুধু ধর্মীয় কাঠামো-সংশ্লিষ্ট, সর্বজনীন বিষয় নয়, তাই যারা সালাত ও যাকাত করবে তারাই ধর্মীয় ভাই (৯:৫, ৯:১১, ৯৮:৫)। তাই যাকাত প্রদান না করার ক্ষেত্রেও কোনো রাষ্ট্রীয় দন্ডবিধি প্রবর্তন করা যেতে পারে না। সালাত ও যাকাত অস্বীকারকারী বা অস্বীকারের পর্যায়ভুক্ত পরিত্যাগকারীকে ধর্মীয় ভ্রাতৃত্বের পরিধি বহির্ভূত বিবেচনা করা যেতে পারে, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।
রাষ্ট্রীয় আইনে উত্তরাধিকারের বিধান যদি যথাযথ না হয় সেক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহর করণীয়
রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় আইনের বাস্তবায়ন ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং এক্ষেত্রে আইনের সংস্কারের জন্য নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টা চালু রাখতে হবে এবং সঠিক ব্যবস্থার প্রবর্তনের পূর্বে অন্তর্র্বতীকালে নিজের অংশে হ্রাসবৃদ্ধি ঘটলে হ্রাসের ক্ষেত্রে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অংশের ক্ষেত্রে যার অংশ থেকে যতটুকু নিজের অংশে এসে যায়, তাকে স্বেচ্ছায় দানের মাধ্যমে তা প্রত্যর্পণ করতে হবে।

বইটির মৌলিক আলোচ্য বিষয়ঃ
এ বইটির মৌলিক আলোচ্য বিষয় হচ্ছে আল কুরআনে ওয়াসিয়াতের বিধান, উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি এবং ফারায়েজ বা প্রচলিত মুসলিম উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি ও তার সাথে কুরআনে বর্ণিত বণ্টন বিধির তুলনামূলক আলোচনা। বইটিতে আয়াতসমূহের সমন্বিত তথ্য ও ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং তুলনামূলক যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে বিভিন্ন ধারা উপধারার ক্ষেত্রে প্রকৃত উপলব্ধিতে পৌঁছার চেষ্টা করা হয়েছে। কুরআনে বর্ণিত উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধির যৌক্তিকতা, সামঞ্জস্য ও কল্যাণ সম্পর্কেও যথাসম্ভব আলোচনা করা হয়েছে।

অধ্যায় ২ ওয়াসিয়্যাতের বিধান সম্পর্কিত আয়াতসমূহঃ
সূরা বাকারা ২:১৮০-১৮২
كُتِبَ  عَلَيْكُمْ  إِذَا  حَضَرَ  أَحَدَكُمُ  الْمَوْتُ  إِن  تَرَكَ  خَيْرًا  الْوَصِيَّةُ  لِلْوَالِدَيْنِ  وَالْأَقْرَبِينَ  بِالْمَعْرُوفِ  حَقًّا  عَلَى  الْمُتَّقِينَ
২:১৮০ :: তোমাদের উপর বিধিবদ্ধ করা হলো যে, তোমাদের মধ্য থেকে কারো মৃত্যু সন্নিকটে এসে গেলে যদি সে সম্পদ রেখে যায় তবে সে তার পিতা-মাতার জন্য এবং অন্য নিকটতম আত্মীয়দের জন্য ন্যায়সঙ্গত ওয়াসিয়্যাত করতে হবে। এটা আল্লাহ সচেতনদের উপর দায়িত্ব।

فَمَن  بَدَّلَهُ  بَعْدَ  مَا  سَمِعَهُ  فَإِنَّمَا  إِثْمُهُ  عَلَى  الَّذِينَ  يُبَدِّلُونَهُ  إِنَّ  اللَّهَ  سَمِيعٌ  عَلِيمٌ
২:১৮১ :: তারপর যে ব্যক্তি তা শুনার পর সেটাকে (তথা ওয়াসিয়্যাতকে) বদলে দেয়, তবে সেটার (তথা বদল করার) অপরাধ বদলকারীদের উপর বর্তাবে। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

فَمَنْ  خَافَ  مِن  مُّوصٍ  جَنَفًا  أَوْ  إِثْمًا  فَأَصْلَحَ  بَيْنَهُمْ  فَلَا  إِثْمَ  عَلَيْهِ  إِنَّ  اللَّهَ  غَفُورٌ  رَّحِيمٌ
২:১৮২ :: তবে যে ব্যক্তি ওয়াসিয়্যাতকারী কর্তৃক পক্ষপাতিত্ব হয়েছে বা/এবং (বঞ্চিত করার) অপরাধ হয়েছে বলে আশংকা করে, তারপর সে তাদের মধ্যে(১) বিষয়টি সংশোধন করে দেয় তাহলে এতে তার অপরাধ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াশীল।
(১) অর্থাৎ প্রথম পর্যায়ে ওয়াসিয়্যাতকারী ও ওয়াসিয়্যাতকৃতদের মধ্যে। যদি ওয়াসিয়্যাতকারীর মৃত্যু ঘটে তবে ওয়াসিয়্যাতকৃত বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে।

সূরা মায়িদাহ ৫:১০৬-১০৮
يَا  أَيُّهَا  الَّذِينَ  آمَنُوا  شَهَادَةُ  بَيْنِكُمْ  إِذَا  حَضَرَ  أَحَدَكُمُ  الْمَوْتُ  حِينَ  الْوَصِيَّةِ  اثْنَانِ  ذَوَا  عَدْلٍ  مِّنكُمْ  أَوْ  آخَرَانِ  مِنْ  غَيْرِكُمْ  إِنْ  أَنتُمْ  ضَرَبْتُمْ  فِي  الْأَرْضِ  فَأَصَابَتْكُم  مُّصِيبَةُ  الْمَوْتِ  تَحْبِسُونَهُمَا  مِن  بَعْدِ  الصَّلَاةِ  فَيُقْسِمَانِ  بِاللَّهِ  إِنِ  ارْتَبْتُمْ  لَا  نَشْتَرِي  بِهِ  ثَمَنًا  وَلَوْ  كَانَ  ذَا  قُرْبَىٰ  وَلَا  نَكْتُمُ  شَهَادَةَ  اللَّهِ  إِنَّا  إِذًا  لَّمِنَ  الْآثِمِينَ
৫:১০৬ :: হে মু’মিনগণ, যখন তোমাদের মধ্য থেকে কারো মৃত্যু সন্নিকটে এসে যায় তখন তোমরা ওয়াসিয়্যাত করার সময় তোমাদের মধ্য থেকে দুইজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখো। অথবা যদি তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং এ অবস্থায় তোমাদের কাছে মৃত্যুর মুসিবত এসে পড়ে তাহলে (তোমাদের নিজেদের মধ্যকার লোক না পেলে) তোমাদের বাইরের (তথা অন্য অঞ্চলের) দুইজনকে সাক্ষী রাখো। তাদের দুইজনকে সালাতের পরে অপেক্ষমান রাখবে। যদি তোমরা সন্দেহ করো তবে তারা উভয়ে আল্লাহর নামে কসম করবে: আমরা কোনো মূল্যেই তা (তথা সাক্ষ্য) বিক্রয় করবো না, যদিও আত্মীয় হয় আর আমরা আল্লাহর নির্দেশিত সাক্ষ্যকে গোপন করবো না। নিশ্চয় তাহলে আমরা অপরাধীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।

فَإِنْ  عُثِرَ  عَلَىٰ  أَنَّهُمَا  اسْتَحَقَّا  إِثْمًا  فَآخَرَانِ  يَقُومَانِ  مَقَامَهُمَا  مِنَ  الَّذِينَ  اسْتَحَقَّ  عَلَيْهِمُ  الْأَوْلَيَانِ  فَيُقْسِمَانِ  بِاللَّهِ  لَشَهَادَتُنَا  أَحَقُّ  مِن  شَهَادَتِهِمَا  وَمَا  اعْتَدَيْنَا  إِنَّا  إِذًا  لَّمِنَ  الظَّالِمِينَ
৫:১০৭ :: তারপর যদি লক্ষণ পাওয়া যায় যে, তারা দুজন অপরাধমূলক দাবি করেছে (তথা সাক্ষ্যে হেরফের করেছে), তাহলে তাদের দুজনের দাবিগত অবস্থানের বিপরীতে অন্য দুজন দাঁড়াবে, যারা হবে তাদের (সাক্ষ্যের) বিপক্ষে অধিকার(২)  দাবিকারীদের মধ্য থেকে এবং ঘনিষ্ঠতর/অগ্রাধিকারী(৩)। তারপর তারা আল্লাহর নামে কসম করবে: আমাদের সাক্ষ্য তাদের দুইজনের সাক্ষ্যের চেয়ে অধিক যথাযথ। আর আমরা সীমালংঘন করিনি। নিশ্চয় তাহলে আমরা যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।
(২) তথা পরিত্যক্ত সম্পদের অধিকার বা সাক্ষ্যের অধিকার।

(৩) তথা মৃত ব্যক্তির আত্মীয়তায় ও উত্তরাধিকারের প্রশ্নে অগ্রাধিকারী। [বা সfক্ষ্যদানের অধিক উপযুক্ত]
ذَٰلِكَ  أَدْنَىٰ  أَن  يَأْتُوا  بِالشَّهَادَةِ  عَلَىٰ  وَجْهِهَا  أَوْ  يَخَافُوا  أَن  تُرَدَّ  أَيْمَانٌ  بَعْدَ  أَيْمَانِهِمْ  وَاتَّقُوا  اللَّهَ  وَاسْمَعُوا  وَاللَّهُ  لَا  يَهْدِي  الْقَوْمَ  الْفَاسِقِينَ
৫:১০৮ :: এ পদ্ধতিই (এ সম্ভাবনার) নিকটতম যে, তারা সঠিক রূপেই সাক্ষ্য দিবে অথবা তারা ভয় করবে যে, তাদের শপথের পরে(৪) তাদের শপথকে(৫) রদ করা হবে। আর তোমরা আল্লাহ সচেতন হও এবং (যথানিয়মে) শুনো। আর নিশ্চয় আল্লাহ নীতি বিচ্যুত সম্প্রদায়কে পথনির্দেশ করেন না।
(৪) তথা পরবর্তী দুইজন সাক্ষীর শপথের পরে।
(৫) তথা পূর্ববর্তী মূল দুইজন সাক্ষীর শপথকে।

সূরা বাকারা ২:২৪০
وَالَّذِينَ  يُتَوَفَّوْنَ  مِنكُمْ  وَيَذَرُونَ  أَزْوَاجًا  وَصِيَّةً  لِّأَزْوَاجِهِم  مَّتَاعًا  إِلَى  الْحَوْلِ  غَيْرَ  إِخْرَاجٍ  فَإِنْ  خَرَجْنَ  فَلَا  جُنَاحَ  عَلَيْكُمْ  فِي  مَا  فَعَلْنَ  فِي  أَنفُسِهِنَّ  مِن  مَّعْرُوفٍ  وَاللَّهُ  عَزِيزٌ  حَكِيمٌ
২:২৪০ :: তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদের স্ত্রীদেরকে রেখে মৃত্যুবরণ করে তাদের স্ত্রীদের বিষয়ে (মৃত স্বামীর পরিবার পরিজন বা সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি) ওয়াসিয়্যাত হচ্ছে, এক বছর পর্যন্ত তাদের স্ত্রীদেরকে ভরণ পোষণ দিতে হবে এবং ঘর থেকে বের করে দেয়া যাবে না। তবে যদি তারা নিজেরাই বেরিয়ে যায় তাহলে সেক্ষেত্রে তারা ন্যায়সঙ্গতভাবে নিজেদের ক্ষেত্রে যা করে সে বিষয়ে তোমাদের দোষ নেই। আর আল্লাহ মহাশক্তিমান, মহাবিজ্ঞ।
অধ্যায় ৩ : আল কুরআনে ওয়াসিয়্যাতের বিধান
ওয়াসিয়্যাত শব্দের শব্দমূল হচ্ছে ‘ওয়াও সদ ইয়া’। ওয়াসিয়্যাত শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘বিশেষ বিষয়ে বিশেষ নির্দেশ, স্বীয় মৃত্যু পরবর্তীতে সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে অগ্রিম নির্দেশনা’। ওয়াসিয়্যাত শব্দটি বিভিন্ন শব্দরূপে কুরআনে যেসব স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো। আয়াত রেফারেন্সের প্রথম সংখ্যাটি সূরা নম্বর, দ্বিতীয় অংশটি আয়াত নম্বর এবং তৃতীয় অংশটি আয়াতের মধ্যে শব্দের ক্রমিক সংখ্যা নিদের্শক।

(১) ওয়াসিয়্যাত শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৮ স্থানে: ২:১৮০:১০, ২:২৪০:৬, ৪:১১:৫১, ৪:১২:২১, ৪:১২:৪৫, ৪:১২:৭৬, ৪:১২:৮৩, ৫:১০৬:১১।
(২) ওয়াসসা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ২, অর্থ: পরিস্থিতি নির্বিশেষে মৌলিক নির্দেশ দেয়া) ব্যবহৃত হয়েছে ১১ স্থানে: ২:১৩২:১, ৪:১৩১:৯, ৬:১৪৪:২১, ৬:১৫১:৩৯, ৬:১৫২:৩২, ৬:১৫৩:১৪, ২৯:৮:১, ৩১:১৪:১, ৪২:১৩:৬, ৪২:১৩:১৩, ৪৬:১৫:১।
(৩) তাওসিয়াহ (ক্রিয়াবিশেষ্য, ক্রিয়ারূপ ২, অর্থ: পরিস্থিতি নির্বিশেষে মৌলিক নির্দেশ) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৩৬:৫০:৩।
(৪) আওসা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৪, অর্থ: বিশেষ বিষয়ে বা বিশেষ পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কিত আগাম নির্দেশ দেয়া) ব্যবহৃত হয়েছে ৬ স্থানে: ৪:১১:১, ৪:১১:৫২, ৪:১২:২২, ৪:১২:৪৬, ৪:১২:৭৭, ১৯:৩১:৬।
(৫) মূসিন (কর্তৃবিশেষ্য, ক্রিয়ারূপ ৪, অর্থ: বিশেষ পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কিত আগাম নির্দেশকারী, স্বীয় মৃত্যু পরবর্তীতে সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে অগ্রিম নির্দেশনাকারী, ওয়াসিয়্যাতকারী) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ২:১৮২:৪।
(৬) তাওয়াসাও (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৬, অর্থ: পরস্পরকে উপদেশ দেয়া) ব্যবহৃত হয়েছে ৫ স্থানে: ৫১:৫৩:১, ৯০:১৭:৬, ৯০:১৭:৮, ১০৩:৩:৬, ১০৩:৩:৮।
কুরআনে ওয়াসিয়্যাতের বিধান সম্পর্কিত আয়াতসমূহ থেকে এ বিষয়ে যা বুঝা যায় তার বিভিন্ন দিক নিম্নে আলোচনা করা হলো।

ওয়াসিয়্যাতের বিধান একটি বাধ্যতামূলক বিধানঃ
সূরা বাকারা ২:১৮০-১৮২ আয়াতে ওয়াসিয়্যাতকে বাধ্যতামূলক হিসেবে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে এবং সূরা মায়িদাহ ৫:১০৬-১০৮ আয়াতে ওয়াসিয়্যাতের সাক্ষ্য সম্পর্কিত বিধান বর্ণিত হয়েছে। ওয়াসিয়্যাতকে বাধ্যতামূলক করার কারণ অনুধাবন করা প্রত্যেক বিবেকবান মানুষের জন্য অত্যন্ত সহজ একটি বিষয়। যাঁর সম্পদ তিনি যদি ন্যায়সঙ্গতভাবে তথা বাস্তব অবস্থার ন্যায়সঙ্গত বিবেচনার ভিত্তিতে তাঁর পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়দের জন্য ওয়াসিয়্যাত করে যান তবে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস পাবে, সম্পদের সুষম বণ্টন হবে এবং প্রত্যেকে যথাযথভাবে প্রয়োজনীয় সম্পদের উপযোগিতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ পাবে। এক্ষেত্রে ন্যায়সঙ্গত বিবেচনা ওয়াসিয়্যাতকারীর বিবেকের উপর নির্ভরশীল এবং বাস্তব অবস্থার পরিপেক্ষিতে নিজ বিবেকের অনুসরণই তার করণীয়। ওয়াসিয়্যাতের ব্যবস্থা না থাকার অপকারিতা তথা ওয়াসিয়্যাতের উপকারিতা একটি অত্যন্ত স্বত:সিদ্ধ স্পষ্ট বিষয়।

ওয়াসিয়্যাতের বিধান এবং উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির তুলনামূলক অবস্থান।

সূরা বাকারায় ওয়াসিয়্যাতকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং সূরা নিসায় উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধিকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একটি দাবি করা হয় যে, প্রথমে ওয়াসিয়্যাতের বিধানকে ফরজ করা হয়েছিলো এবং পরে উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধিকে ফরজ করা হয়েছে এবং এভাবে পরেরটি প্রথমটিকে রহিত করে দিয়েছে। অর্থাৎ উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি নাজিলের পর ওয়াসিয়্যাতের বিধান রহিত হয়ে গেছে। অথচ উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির আয়াত ৪:১১ ও ৪:১২তে একবার, দুইবার নয়; বরং পরপর চারবার বলা হয়েছে যে, উত্তরাধিকারের বণ্টন হবে ওয়াসিয়্যাতের দাবি পূরণ এবং ঋণ পরিশোধের পরে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ওয়াসিয়াতের বিধান এবং উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি পরস্পর সাংঘর্ষিক নয় এবং একটি অন্যটিকে রহিত করে না এবং ওয়াসিয়্যাতের পরে থাকা অবশিষ্ট সম্পদেই উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি ফরজ হিসেবে কার্যকর হবে। সুতরাং ওয়াসিয়্যাতের বিধানকে রহিত বলা একটি বিভ্রান্তি ছাড়া কিছু নয়। বরং আল কুরআন স্ববিরোধমুক্ত, এর কোনো আয়াত কখনো মানছুখ (রহিত) হয়নি।
যদি কারো আকস্মিক মৃত্যু হয় এবং এজন্য ওয়াসিয়্যাত করা সম্ভব না হয় অথবা যদি কেউ ওয়াসিয়্যাত করা ছাড়াই মৃত্যুবরণ করে, সেক্ষেত্রে ওয়াসিয়্যাত না থাকার কারণে সম্পূর্ণ সম্পদ উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী বণ্টিত হবে।

ওয়াসিয়্যাতের ক্ষেত্রে ন্যায়নীতির শর্তঃ
ওয়াসিয়্যাত বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং শর্ত দেয়া হয়েছে ওয়াসিয়্যাত করতে হবে ন্যায়সঙ্গতভাবে (বিল মা’রূফ)। আর ওয়াসিয়্যাতকারী যেভাবে ওয়াসিয়্যাত করেছে তাতে কোনো পরিবর্তন করা অপরাধ এবং যারা তা করবে তারা এ অপরাধে অপরাধী হবে। ওয়াসিয়্যাত করার ক্ষেত্রে ন্যায়নীতি বজায় রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে এ স্বীকৃতি নিহিত রয়েছে যে, মানুষ ইচ্ছা করলে তার পক্ষে ন্যায়নীতি বজায় রেখে ওয়াসিয়্যাত করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ওয়াসিয়্যাতকারীকে তার পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়দের মধ্যে প্রত্যেকের বাস্তব অবস্থা বিবেচনা সাপেক্ষে কার জন্য কতটুকু ওয়াসিয়্যাত করা ন্যায়সঙ্গত হবে তা নির্ধারণের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। সুতরাং ওয়াসিয়্যাতকারীকে সাবধান থাকতে হবে, যেন সে ন্যায়নীতির লঙ্ঘন না করে। পিতা-মাতা ও নিকটতম আত্মীয়দের বাস্তব অবস্থার তারতম্য বিবেচনায় যাকে যেভাবে দেয়া কল্যাণকর ও সঙ্গত হয় সেদিকে লক্ষ্য না রেখে কারো প্রতি পক্ষপাতিত্বের কারণে তাকে বেশি দিলে বা কারো প্রতি মনোমালিন্যের কারণে তাকে বঞ্চিত করলে তা ন্যায়সঙ্গত ওয়াসিয়্যাত হবে না।
ন্যায়সঙ্গত সমঝোতার নির্দোষ প্রয়াস
যদি কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ আশংকা করে যে, ওয়াসিয়্যাতের ক্ষেত্রে ওয়াসিয়্যাতকারীর পক্ষ থেকে কোনো পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে বা কাউকে তার ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করার অপরাধ হয়েছে, তাহলে সে প্রথম পর্যায়ে ওয়াসিয়্যাতকারীর এবং ওয়াসিয়্যাতকৃতদের মধ্যে এবং (ইতোমধ্যে ওয়াসিয়্যাতকারীর মৃত্যু হলে) দ্বিতীয় পর্যায়ে ওয়াসিয়্যাতকৃত বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে বিষয়টি উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে একটা সমঝোতায় পৌঁছালে এতে ঐ মীমাংসাকারীর উপর কোনো পাপ বা অপরাধ বর্তাবে না।
ওয়াসিয়্যাতের ক্ষেত্রে কার জন্য কী ওয়াসিয়্যাত করবে বা কাকে কতটুকু দিতে হবে তা নির্দিষ্ট নয় বরং তা ওয়াসিয়্যাতকারীর স্বীয় ন্যায়সঙ্গত বিবেচনার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এমতাবস্থায় ওয়াসিয়্যাতের ক্ষেত্রে কাকে কতটুকু দিলে তার প্রতি পক্ষপাতিত্ব হয় বা কাকে কতটুকু দিলে তার ন্যায্য পাওনা থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয় সেটা গাণিতিকভাবে নির্দিষ্ট করে দেয়ার মতো কোনো বিষয় নয় বরং এটা একটা পরিস্থিতি সাপেক্ষ বিষয় এবং মানুষ তার বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে।
ওয়াসিয়্যাতকারীর নিকটতম আত্মীয়দের পক্ষ থেকে ওয়াসিয়্যাকারীর ওয়াসিয়্যাতে পক্ষপাতিত্বের বা কাউকে ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাস্তব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে ওয়াসিয়্যাত শ্রবণকারী বা যে কোনো শুভাকাক্সক্ষী ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে বিষয়টির সংশোধনের জন্য প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে পারেন। কুরআনে এই অনুমতি এবং নির্দেশনা স্পষ্ট।

নিজ ওয়াসিয়্যাতের সংশোধনঃ
ওয়াসিয়্যাতকারীর ওয়াসিয়্যাতে ন্যায়নীতির লঙ্ঘন হয়েছে বলে আশংকা করলে আশংকাকারী ব্যক্তি তা সংশোধনের জন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতা করে দেয়াতে দোষ নেই। এটি থেকে স্পষ্ট যে, কেউ দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বা নিজের কাছে বাস্তব পরিস্থিতিগত পরিবর্তন বা কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণে ওয়াসিয়্যাতের সংশোধন প্রয়োজন বলে অনুভূত হলে ওয়াসিয়্যাতকারীর জীবদ্দশায় তার দ্বারাই নিজ ওয়াসিয়্যাতের সংশোধন করা যেতে পারে।

যাদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করা বাধ্যতামূলকঃ
২:১৮০-১৮২ আয়াতে যাদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে তারা হলো ‘পিতা-মাতা এবং অন্য নিকটতম আত্মীয়স্বজন’। এ বিষয়ে ব্যবহৃত শব্দ হচ্ছে ‘লিল ওয়ালিদায়নি ওয়াল আক্বরাবীনা’। ওয়ালিদায়ন শব্দের অর্থ হচ্ছে পিতা-মাতা। আর আক্বরাবূন শব্দটি এসেছে ‘ক্বারীব’ শব্দ থেকে। ক্বারীব শব্দের অর্থ ‘নিকটবর্তী’। আক্বরাবূন শব্দের অর্থ ‘সবচেয়ে নিকটবর্তী’। ‘আক্বরাবূন’ শব্দটি কুরআনের ৭ স্থানে ‘সবচেয়ে নিকটবর্তী আত্মীয়’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে: ২:১৮০:১২, ২:২১৫:১০, ৪:৭:৬, ৪:৭:১২, ৪:৩৩:৭, ৪:১৩৫:১৪, ২৬:২১৪:৩।

সূরা নিসা ৪:১১-১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে যাদের জন্য উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি দেয়া হয়েছে ৪:৭ আয়াতে তাদেরকেই পরস্পরের আক্বরাবূন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং ‘সবচেয়ে নিকটবর্তী আত্মীয়’ অর্থে ‘আক্বরাবীন’ হচ্ছে পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, স্বামী/স্ত্রী, ভাই, বোন।
পুত্র-কন্যা এর মতো পৌত্র-পৌত্রী, দৌহিত্র-দৌহিত্রীও পুত্র-কন্যা তুল্য হিসেবে এবং পিতা-মাতার মতো দাদা-দাদী, নানা-নানীও পিতা-মাতা তুল্য হিসেবে আক্বরাবূন এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন ১২:৬ আয়াতে নবী ইয়াকুবের উক্তিতে নবী ইবরাহীম ও ইসহাককে নবী ইউসুফের দুইজন পিতৃপুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়েছে ‘আবাওয়ায়কা’ তথা ‘তোমার দুই পিতৃপুরুষ’। অন্য কথায় নবী ইউসুফের দাদা (ইসহাক) ও দাদার পিতাকে (ইবরাহীম) তাঁর দুইজন পিতৃপুরুষ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া ৪:২২-২৩ আয়াতে বিবাহ সম্পর্কিত বিধি-নিষেধ উল্লেখ করার ক্ষেত্রে ‘আবাউ’ শব্দের মধ্যে পিতা, দাদা, নানা প্রমুখ এবং ‘উম্মাহাত’ শব্দের মধ্যে মাতা, দাদী, নানী প্রমুখ এবং ‘বানাত’ শব্দের মধ্যে কন্যা, পৌত্রী, দৌহিত্রী প্রমুখ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

সুতরাং ‘আক্বরাবূন’ হচ্ছেন পিতা, মাতা, দাদা, দাদী, নানা, নানী, পুত্র, কন্যা, পৌত্র, পৌত্রী, দৌহিত্র, দৌহিত্রী, স্বামী/স্ত্রী, ভাই, বোন। পিতা-মাতা আক্বরাবূন হলেও তাঁদের কথা প্রথমে স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করায় ‘লিল ওয়ালিদায়নি ওয়াল আক্বরবাীন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘পিতা-মাতা ও অন্যান্য নিকটতম আত্মীয়দের জন্য’।

পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়রা ছাড়া অন্যান্য সাধারণ আত্মীয়দের জন্য বা অন্য কারো জন্য ওয়াসিয়্যাত করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়নি, সুতরাং তা ঐচ্ছিক। নিকটতম আত্মীয়দের পাশাপাশি অন্যদের জন্যও ওয়াসিয়্যাত করার ক্ষেত্রে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে নিকটতম আত্মীয়দের সকলে স্বচ্ছল হলে এবং সে অবস্থায় সম্পদ অন্য কারো জন্য ওয়াসিয়্যাত করতে হলে অবশ্যই নিকটতম আত্মীয়দের অনাপত্তি/সম্মতি গ্রহণ করতে হবে। তাদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করাকে বাধ্যতামূলক করার কারণে তাদেরকে অগ্রাহ্য না করাই বাঞ্ছনীয়। বরং তারা যদি অনাপত্তি ও সম্মতি জানায় সে ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ সম্পদ অন্য কারো জন্য ওয়াসিয়্যাত করা সঙ্গত হবে, অন্যথায় নয়।
এক নজরে যাদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করা বাধ্যতামূলকঃ
পিতা, মাতা
দাদা/ দাদার পিতা
নানা/ নানার পিতা
দাদী/ দাদীর মাতা
নানী/ নানীর মাতা
পুত্র/ পুত্রগণ
কন্যা/ কন্যাগণ
পুত্রের পুত্র (পৌত্র/ পোতা)
কন্যার পুত্র (দৌহিত্র/ নাতি)
পুত্রের কন্যা (পৌত্রী/ পুতিন)
কন্যার কন্যা (দৌহিত্রী/ নাতিন)
স্ত্রীর ক্ষেত্রে স্বামী
স্বামীর ক্ষেত্রে স্ত্রী
ভাই., বোন

উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির দ্বারা ওয়াসিয়্যাতের বিধান মানছুখ (রহিত) হওয়ার দাবি সঠিক নয়
প্রচলিত ধারণা হচ্ছে ৪:১১-১২ আয়াতের দ্বারা ২:১৮০-১৮২ আয়াত মানছুখ (রহিত) হয়ে গেছে। অর্থাৎ উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির মাধ্যমে ওয়াসিয়্যাতের বিধান রহিত হয়ে গেছে। এ বিষয়ে একটি যুক্তি হচ্ছে, যেহেতু ৪:১১ আয়াত ‘ইউসীকুমুল্লাহু’ (আল্লাহ তোমাদেরকে ওয়াসিয়াত করছেন) বাক্যাংশ দ্বারা শুরু হয়েছে এবং ৪:১২ আয়াতেও বলা হয়েছে ‘ওয়াসিয়াতাম মিনাল্লাহ’ (এটা আল্লাহর ওয়াসিয়্যাত), তাই এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ যাদের জন্য উত্তরাধিকারের অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন বা যাদেরকে ওয়ারিস করেছেন তাদের জন্য কোনো ওয়াসিয়্যাত করা যাবে না। অর্থাৎ দাবি করা হয় যে, বর্তমানে ওয়ারিসদের জন্য ওয়াসিয়্যাত বৈধ নয়।
আবার কেউ কেউ মনে করেন, ওয়াসিয়্যাতের বিধান হাদীস দ্বারা রহিত হয়েছে। হাদীস থেকে জানা যায় যে, ওয়ারিসদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করা যাবে না তবে ওয়ারিস ছাড়া অন্যদের জন্য নিজ সম্পদের এক তৃতীয়াংশ বা এক চতুর্থাংশ ওয়াসিয়্যাত করা যাবে।

ওয়াসিয়্যাতের বিধান রহিত হওয়ার প্রচলিত দাবির উত্তর হচ্ছে, ৪:১১ ও ৪:১২ আয়াতে আল্লাহ চারবার বলেছেন, উত্তরাধিকার বন্টিত হবে ওয়াসিয়্যাতের দাবি পুরণ ও ঋণ পরিশোধের পর। তাই এ আয়াতগুলোতে ওয়াসিয়্যাতকে বা ওয়ারিসদের জন্য ওয়াসিয়্যাতকে অবৈধ করা হয়নি। বরং ২:১৮০-১৮২ আয়াত অনুসারে পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়দের জন্য তথা ওয়ারিসদের জন্যই ওয়াসিয়্যাত করাকে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। সুতরাং এ অবস্থায় ওয়ারিসদের জন্য ওয়াসিয়্যাত রহিত হয়ে গেছে তবে ওয়ারিস ছাড়া অন্যদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করা যাবে এরূপ দাবি করা আয়াতের বিধানকে অগ্রাহ্য করার শামিল।

আর হাদীস দ্বারা ওয়াসিয়্যাতের বিধান ওয়ারিসদের জন্য রহিত হওয়ার দাবিও একটি অসঙ্গত দাবি। কারণ রসূলের কাজ ছিলো কুরআনের অনুসরণ করা,(৬) কুরআনের কোনো বিধানকে রহিত করা নয়। আর আল্লাহ কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে একটি বিধান দিবেন অথচ কুরআন বহির্ভুত ওহীয়ে গায়রে মাতলুর (অপঠিত ওহী) মাধ্যমে তা রহিত করবেন যে রহিতকারী তথ্যটি হাদীস থেকে পাওয়া যাবে, এটি কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য দাবি নয়। কারণ নিশ্চিত তথ্যকে কোনো অনিশ্চিত তথ্যের দ্বারা রহিত করা একটি অযৌক্তিক পদ্ধতি। আর নিশ্চয় আল্লাহ অযৌক্তিক পদ্ধতিতে কাজ করার ত্রুটি থেকে পবিত্র।
(৬) আপনার রবের কাছ থেকে আপনার প্রতি যা ওহী হয়েছে আপনি তারই অনুসরণ করুন, তিনি ছাড়া অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই এবং অংশীবাদীদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন। ৬:১০৬
হে নবী বলুন, “... আমি আমার প্রতি যা ওহী করা হয় শুধু তারই অনুসরণ করি। আর আমি তো এক স্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র।” ৪৬:৯

যদি এ কথা সঠিকও হয় যে, রসূলুল্লাহ (সালামুন আলাইহি) কোনো ব্যক্তিকে তার বিশেষ পরিস্থিতিসাপেক্ষে এক তৃতীয়াংশের বেশি বা এক চতুর্থাংশের বেশি ওয়াসিয়্যাত করতে নিষেধ করেছিলেন, তবে তা ঐ ব্যক্তির সাথেই সংশ্লিষ্ট এবং সে নিষেধাজ্ঞার কারণ তার ওয়ারিস যেন ঐ ওয়াসিয়্যাতের কারণে বঞ্চিত না হয়। অন্যদিকে ওয়ারিসদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সম্পত্তিও ওয়াসিয়্যাত করা যাবে। কিন্তু ওয়ারিসদেরকে বঞ্চিত করে বা তাদের সম্মতি ছাড়া অন্যদের জন্য সম্পূর্ণ সম্পত্তি ওয়াসিয়্যাত করা বৈধ নয়। কারণ আল্লাহ ওয়ারিসদের মধ্যে বণ্টনের জন্য ওয়াসিয়্যাত করাকে স্বাভাবিক মৃত্যুর সন্নিকটে থাকা ব্যক্তির উপর বাধ্যতামূলক করেছেন।

যদি ওয়ারিসদের জন্য কৃত ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণের পর কোনো সম্পদ অবশিষ্ট না থাকে তাহলে উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী উত্তরাধিকার বন্টিত হবে না। এক তৃতীয়াংশের বেশি বা এক চতুর্থাংশের বেশি ওয়াসিয়্যাত করতে নিষেধ করার হাদীসটি থেকে এ শিক্ষা নেয়া যায় যে, ওয়ারিস ছাড়া অন্যদের জন্য কোনো নফল ওয়াসিয়্যাত করলে তা যেন এক তৃতীয়াংশের বেশি বা এক চতুর্থাংশের বেশি না হয়। এছাড়া সম্পত্তি যদি অত্যন্ত কম হয়, তবে শুধুমাত্র ওয়ারিসদের জন্যই ওয়াসিয়্যাত করা একটি স্বাভাবিক বিষয়।

ওয়ারিসদের জন্য সমস্ত সম্পদ ওয়াসিয়্যাত করা উত্তম নাকি অংশবিশেষ উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী বণ্টনের জন্য রেখে দেওয়া উত্তম?
ওয়াসিয়্যাতের পরে যা থাকবে তা উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী বণ্টিত হবে। এটি অত্যন্ত যৌক্তিক একটি ব্যবস্থাপনা। ওয়ারিসদের জন্য সমস্ত সম্পদ ওয়াসিয়্যাত করার চেয়ে অংশবিশেষ উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী বণ্টনের জন্য রেখে দেওয়া উত্তম। কারণ এটা স্বত:সিদ্ধ বাস্তবতা যে, সমস্ত সম্পদ ওয়াসিয়্যাত করে গেলে ওয়াসিয়্যাতকারীর নিজস্ব জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার আশংকাকে উপেক্ষা করা যায় না।
মৃত্যু নিকটবর্তী ব্যক্তির উপর ওয়াসিয়্যাত করাকে বাধ্যতামূলক করা কিন্তু এজন্য লিখিত দলিলকে বাধ্যতামূলক না করার কারণ।

মৃত্যু নিকটবর্তী ব্যক্তির উপর ওয়াসিয়্যাত করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কারণ যখন স্বাভাবিকভাবে বুঝা যায় যে, কোনো ব্যক্তি মৃত্যু নিকটবর্তী অবস্থায় রয়েছে, তখন সে ঐ সময়ের বাস্তবতার  প্রেক্ষিতে ওয়াসিয়্যাত করতে পারবে। অন্যদিকে তুলনামূলক মধ্যবয়স্কদের উপর বা সম্পূর্ণ সুস্থ সবল অবস্থায় ওয়াসিয়্যাত করাকে বাধ্যতামূলক করা হলে পরবর্তী বাস্তব পরিস্থিতিগত বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তনের ফলে কৃত ওয়াসিয়্যাত ত্রুটিপূর্ণ হয়েছে বলে সাব্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকতো। সুতরাং মধ্যবয়স্কদের উপর বা সম্পূর্ণ সুস্থ সবল অবস্থায় ওয়াসিয়্যাত বাধ্যতামূলক করা হয়নি, বরং তারা ওয়াসিয়্যাত করা ঐচ্ছিক বিষয়।

২:২৮২ আয়াত অনুযায়ী দাঈন বা ঋণের ক্ষেত্রে লিখিত প্রমাণ ও দুইজন সাক্ষী রাখাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু ৫:১০৬ আয়াত অনুযায়ী ওয়াসিয়্যাতের ক্ষেত্রে শুধু দুইজন সাক্ষী রাখাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ২:১০৮০-১৮১ আয়াত থেকেও বুঝা যায় যে, মৌখিক ওয়াসিয়্যাতকে যথেষ্ট সাব্যস্ত করা হয়েছে, লিখিত প্রমাণকে বাধ্যতামূলক করা হয়নি। এর কারণ হতে পারে মৃত্যু আসন্ন ব্যক্তির কৃত ওয়াসিয়্যাত লিখিতভাবে করাকে বাধ্যতামূলক করা হলে তা সাধারণত বাস্তবসম্মত হতো না, যেমন: অনেক ব্যক্তি নিজে শিক্ষিত নাও হতে পারে অথবা অসুস্থ অবস্থায় থাকা এবং আশেপাশে লিখে দেওয়ার মতো ব্যক্তির উপস্থিত না থাকার সম্ভাবনা ইত্যাদি। তবে ২:২৮২ আয়াতের শিক্ষানুসারে বলা যায় যে, যদিও বাস্তবসম্মত কারণে বাধ্যতামূলক করা হয়নি, তবুও সুযোগ থাকলে লিখিতভাবে ওয়াসিয়্যাত করাই স্বাভাবিক এবং কার্যকারিতার জন্য উত্তম। আর কুরআনের সার্বিক শিক্ষানুসারে যেখানে অধিক উপযুক্ত, অধিক মঙ্গলজনক এবং অধিক ন্যায়সঙ্গক উপায় অবলম্বন করা সম্ভব, সেখানে তা কার্যকর করাই উত্তমকর্ম সম্পাদনকারী স্রষ্টা-সচেতন বিশ্বাসীদের করণীয়। 

ওয়াসিয়্যাতের বিষয়ে দুইজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখার নির্দেশঃ
৫:১০৬ আয়াতে ওয়াসিয়্যাত করার বিষয়ে দুইজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং ওয়াসিয়্যাতের বিধানের একটি অন্যতম ধারা হচ্ছে ওয়াসিয়্যাতের বিষয়ে দুইজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখতে হবে।
ভ্রমণ অবস্থায় দুর্ঘটনাজনিত মুত্যু এসে পড়লে এবং নিজ অঞ্চলের লোক না পেলে অন্য অঞ্চলের দুইজনকে সাক্ষী রাখার নির্দেশ।

৫:১০৬ আয়াতে ওয়াসিয়্যাতের বিষয়ে সাক্ষী রাখার নির্দেশের দ্বিতীয় ধারা হচ্ছে যদি নিজ এলাকা থেকে দূরদেশে বা প্রবাসে ভ্রমণ করা কালে মৃত্যুর মুসিবত এসে পড়ে তথা অপ্রত্যাশিত হঠাৎ মৃত্যু এসে পড়ে এবং এ অবস্থায় নিজ অঞ্চলের লোক পাওয়া না যায় তাহলে অন্য অঞ্চলের বা প্রবাসী দুইজনকে সাক্ষী রাখতে হবে।

ওয়াসিয়্যাতের বিষয়ে সাক্ষ্য গ্রহণ বা ওয়াসিয়্যাতের ভিত্তিতে বণ্টনের সময় ও স্থান
৫:১০৬ আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, ওয়াসিয়্যাতের বিষয়ে যে দুইজন ব্যক্তি সাক্ষী তাদেরকে সালাতের পরে অপেক্ষমান রাখতে হবে অর্থাৎ সালাতের পরে সাক্ষ্য গ্রহণ ও ওয়াসিয়্যাতের ভিত্তিতে বণ্টন করতে হবে। সুতরাং ওয়াসিয়্যাতের বিষয়ে সাক্ষ্য গ্রহণ বা ওয়াসিয়্যাতের ভিত্তিতে বণ্টনের সময় হচ্ছে সালাতের পরে। এ থেকে এটাও বুঝা যায় যে, সালাতের স্থান (মসজিদ) শুধু আনুষ্ঠানিক সালাতের জন্যই নির্ধারিত নয়, বরং উলিল আমরের  (Central Authority)  কার্যালয় হিসাবে সেখানে সালাতের পরে উত্তরাধিকারের বণ্টনের ক্ষেত্রেও এর ব্যবহারিক গুরুত্ব রয়েছে। অর্থাৎ মসজিদ একই সাথে বহুবিধ মাত্রার কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুও বটে।

সাক্ষীদের বিষয়ে সন্দেহ তৈরি হলে তাদের শপথঃ
৫:১০৬ আয়াতের শেষ নির্দেশনা হলো, যদি সাক্ষীদের বিষয়ে সন্দেহ তৈরি হয় তাহলে তারা আল্লাহর নামে কসম করে বলবে যে, আমরা কোনো মূল্যেই সাক্ষ্য গোপন করবো না, যদিও এর মাধ্যমে উপকারভোগী আমাদের আত্মীয় হয় এবং আল্লাহর নির্দেশিত সাক্ষ্যকে গোপন করবো না। নিশ্চয় এগুলো করলে আমরা অপরাধীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো। এই সাক্ষ্যের ভাষা এই সচেতনতার শিক্ষা প্রদান করে যে, আত্মীয়তার বন্ধন যেন ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে কোনো পক্ষপাতমূলক অন্যায় সাক্ষ্য ও আচরণকে প্রভাবিত না করে। মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়াই কেবল নয়, জানার পরে সত্য সাক্ষ্য গোপন করাও অবৈধ।

মূল দুইজন সাক্ষীর সাক্ষ্যকে আপত্তিকারীদের অন্তর্ভুক্ত দুইজন সাক্ষীর সাক্ষ্যের মাধ্যমে রদ করাঃ
৫:১০৭-১০৮ আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, যদি সাক্ষীদ্বয় সাক্ষ্য হেরফের করার অপরাধে জড়িত হয়েছে বলে লক্ষণ পাওয়া যায় তাহলে এমন দুইজন ব্যক্তি মূল দুইজন সাক্ষীর দাবিগত অবস্থানের বিপরীতে সাক্ষ্য দিতে দাঁড়াবে যারা তাদের সাক্ষ্যের বিপক্ষে (পরিত্যক্ত সম্পদের বা সাক্ষ্যদানের) অধিকার দাবিকারীদের অন্তর্ভুক্ত এবং যারা মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অধিক ঘনিষ্ঠ/অগ্রাধিকারী বা মূল সাক্ষীদ্বয়ের সাক্ষ্যে গরমিল চিহ্নিত করতে পারার প্রেক্ষিতে সাক্ষ্যদানের অধিক যোগ্য। আপত্তিকারীদের অন্তর্ভুক্ত এই দুইজন সাক্ষীকে আল্লাহর নামে কসম করে বলতে হবে, আমাদের সাক্ষ্য তাদের দুইজনের সাক্ষ্যের চেয়ে অধিক যথাযথ। আর আমরা সীমালংঘন করিনি। নিশ্চয় তা করলে আমরা যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।
এভাবে আপত্তিকারীদের অন্তর্ভুক্ত দুইজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিলে মূল দুইজন সাক্ষীর সাক্ষ্যকে অগ্রাহ্য করা হবে। অর্থাৎ এরূপ পাল্টাপাল্টি দুই ধরনের সাক্ষ্যের প্রেক্ষিতে ঐ ওয়াসিয়্যাত রহিত হয়ে যাবে। মূল দুইজন সাক্ষীর সাক্ষ্য রহিত হওয়ার কারণে তাদের সাক্ষ্যের উপর ভিত্তিশীল ওয়াসিয়্যাতকে হুবহু বাস্তবায়ন করা যাবে না। বরং এ অবস্থায় ঐ দাবিকৃত ওয়াসিয়্যাতের মাধ্যমে যাদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়েছে তাদের ন্যায়সঙ্গত স্বার্থরক্ষার উপযোগী করে তার মীমাংসা করা যেতে পারে। কেননা মূল দুইজন সাক্ষীর সাক্ষ্যের প্রতি আপত্তির প্রেক্ষিতে পরবর্তী দুইজন সাক্ষীর সাক্ষ্যকে অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এছাড়া ২:১৮২ আয়াতে ওয়াসিয়্যাতকারীর ওয়াসিয়্যাতের মাধ্যমে কোনো পক্ষপাতিত্ব বা বঞ্চিত করার পাপ হয়েছে বলে আশংকা করলে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতা করে দেয়ার মধ্যে কোনো দোষ নেই বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু যদি কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতা সম্ভব না হয় তাহলে মৃত ব্যক্তির সমস্ত পরিত্যক্ত সম্পত্তি উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী বণ্টন করতে হবে।

বিধবাদের জন্য একটি বিশেষ ওয়াসিয়্যাত এবং তা পরিপূরণের আবশ্যকতাঃ
২:২৪০ আয়াতে আল্লাহতায়ালা বিধবাদের জন্য একটি ওয়াসিয়্যাত করেছেন তথা বিশেষ নির্দেশ দিয়েছেন। তা হলো: বিধবা নারীদেরকে তাদের গৃহ থেকে তথা মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্ব থেকে তারা যে গৃহে বসবাস করছিলো তা থেকে এক বছর পর্যন্ত বের করে দেয়া যাবে না। সেটি তাদের নিজেদের গৃহ হোক বা তাদেরকে বসবাস করতে দেয়া স্টাফ কোয়ার্টার হোক উভয় ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের পুনর্বাসনের সুব্যবস্থার জন্য পর্যাপ্ত সময় সুযোগ লাভ করবে। এ একবছর সময়কালে তাদেরকে ভরণ পোষণও দিতে হবে। এ ওয়াসিয়্যাতকে কে কার্যকর করতে হবে তা উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। কুরআনের সাধারণ শিক্ষা অনুসারে বুঝা যায় যে, এটি প্রাথমিকভাবে মৃত ব্যক্তির পরিবার পরিজনের দায়িত্ব এবং প্রয়োজনসাপেক্ষে বৃহৎ পরিসরে সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর এ দায়িত্ব অর্পিত হবে। ২:১৩৪ আয়াত অনুযায়ী বিধবা নারীদের সাধারণ ইদ্দাত (প্রতীক্ষার সময়কাল) ৪ মাস ১০ দিন, তবে ৬৫:৪ আয়াত অনুযায়ী গর্ভবতী হলে সেক্ষেত্রে ইদ্দাত হলো সন্তান প্রসব করা পর্যন্ত। ইদ্দাতকাল পূর্ণ হলে ১ বছর সময়ের আগেও বিধবা নারী স্বেচ্ছায় বের হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে তারা বেরিয়ে গেলে এবং নিজেদের জন্য ন্যায়সঙ্গতভাবে কিছু করার সিদ্ধান্ত নিলে (যেমন বিবাহ ও নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা) তাতে অন্যরা দোষী হবে না। অন্য কথায় ইদ্দাত শেষে কিন্তু এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে কোনো বিধবা নারী সম্পূর্ণ নিজ ইচ্ছায় বের হয়ে গেলে সেক্ষেত্রে এক বছর পূর্ণ হতে বাকি থাকা সময়সীমাতে তাদেরকে পূর্ব গৃহে থাকতে দেয়া ও ভরণপোষণ দেয়ার বাধ্যবাধকতা প্রযোজ্য হবে না।
২:২৪০ আয়াতটির প্রচলিত অনুবাদ ও ব্যাখ্যা হচ্ছে, এখানে যারা মৃত্যুবরণ করে তাদেরকে নিজেদের স্ত্রীদের বিষয়ে এক বছরের ভরণ পোষনের জন্য পরিবারের সদস্যদের কাছে ওয়াসিয়্যাত করে যাওয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ অনুবাদ বা ব্যাখ্যাটি সঠিক নয়। কারণ যে আয়াতে মৃত্যু আসন্ন ব্যক্তির উপর ওয়াসিয়্যাত করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে (২:১৮০) সেটির বাক্য বিন্যাস হলো, কুতিবা আলাইকুম ইযা হাদারা আহাদুকুমুল মাওতু...’’(যখন তোমাদের কেউ মৃত্যুর সন্নিকটে হাজির হয় তখন তার উপর বিধিবদ্ধ করা হলো যে, .....)। কারো উপর কিছু বাধ্যতামূলক করার ক্ষেত্রে আরবি ভাষায় ও কুরআনে এরূপ বাক্য বিন্যাসই অবলম্বন করা হয়। পক্ষান্তরে ২:২৪০ আয়াতে বলা হয়েছে, ওয়াল্লাযীনা ইউতাওয়াফফাওনা মিনকুম ওয়া ইয়াযারূনা আজজওয়াজান.....(আর যারা তাদের স্ত্রীদেরকে ছেড়ে মৃত্যুবরণ করে তথা যারা মৃত্যুবরণ করে এবং তাদের স্ত্রীরা জীবিত থাকে,.......) । আয়াতটিতে যারা স্ত্রী রেখে মারা যাবে তাদের সাথে সম্পর্কিত করে কিছু বলা হয়েছে কিন্তু তাদের উপর কোনো দায়িত্ব বলা হয়নি। আয়াতটির পরবর্তী অংশে উল্লেখিত হয়েছে ওয়াসিয়াতাল লিআজওয়াজিহিম (তাদের স্ত্রীদের জন্য ওয়াসিয়্যাত)। অর্থাৎ আয়াতটিতে তাদের স্ত্রীদের বিষয়ে কিছু বলা হয়েছে এবং যা বলা হয়েছে তা হলো ‘ওয়াসিয়্যাত’। অন্য কথায়, তাদের স্ত্রীদের জন্য ‘ওয়াসিয়্যাত’ হিসেবে কিছু বলা হয়েছে। কথাটির সহজ তাৎপর্য হলো তাদের স্ত্রীদের জন্য ওয়াসিয়্যাত উপস্থাপন/প্রদান করা হয়েছে। বাক্যটিতে ‘ওয়াসিয়্যাত’ শব্দটি কর্ম (Object)  হিসেবে রয়েছে। বাক্যটিতে ‘ওয়াসিয়্যাত’ শব্দটির মাধ্যমে তাদের স্ত্রীদের জন্য কী রয়েছে বা কী দেয়া হয়েছে?- এ প্রশ্নটিরই উত্তর (কর্ম/Object) উল্লেখ করা হয়েছে। ‘ওয়াসিয়্যাত’ শব্দের একটি অর্থ হলো ‘বিশেষ নির্দেশ’। বাক্যটিতে ওয়াসিয়্যাতের ‘কর্তা’ (Subject)  কে, তা সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু ওয়াসিয়্যাত হচ্ছে/ ওয়াসিয়্যাত করা হলো ..... বক্তব্যভঙ্গি থেকে স্বত:সিদ্ধভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এটি আল্লাহর ওয়াসিয়্যাত বা বিশেষ নির্দেশ।
আল্লাহর ওয়াসিয়্যাত’ শব্দটি কারো কারো জানা নাও থাকতে পারে। তাই উল্লেখ্য যে, ৪:১১ আয়াতে উত্তরাধিকার বণ্টন সম্পর্কিত বক্তব্য শুরু করা হয়েছে ‘ইউসীকুমুল্লাহু’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ তোমাদেরকে ওয়াসিয়্যাত করছেন’ বক্তব্যের মাধ্যমে এবং ৪:১২ আয়াতে উত্তরাধিকারের নির্ধারিত সম্পূর্ণ বণ্টন বিধিকেই চিহ্নিত করা হয়েছে ওয়াসিয়্যাতাম মিনাল্লাহ বা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ওয়াসিয়্যাত হিসেবে। এ আলোচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এ বিষয়টি স্পষ্ট করা যে, ২:২৪০ আয়াতে প্রদত্ত বিধান বিধবা নারীদেরকে মৃত ব্যক্তির অন্যান্য ওয়ারিসরা বা সমাজ ও রাষ্ট্র এক বছর ভরণ পোষণ দিতে হবে, অবশ্য যদি এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে তারা ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজেদেরকে নতুন বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ করে তবে এই ভরণ পোষণ এক বছর পূর্ণ হওয়ার প্রয়োজন হবে না বরং তারা নতুন বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া পর্যন্ত হলেই চলবে- এটি হচ্ছে আল্লাহর ওয়াসিয়্যাত।
সুতরাং মৃত ব্যক্তিকে তার স্ত্রীর জন্য ওয়াসিয়্যাত করার আদেশ দেয়া হয়েছে, তাই মৃত ব্যক্তি এরূপ ওয়াসিয়্যাত করে গেলে তা বাস্তবায়ন করা হবে, অন্যথায় বাস্তবায়ন করা হবে না; এ ধারণাটি সঠিক নয়। বরং প্রত্যেক বিধবার ক্ষেত্রে এ ওয়াসিয়্যাত বা বিশেষ নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে হবে।

বিধবাদেরকে এক বছর ভরণপোষণ দেয়া এবং ঘর থেকে বের করে না দেয়ার বিধান রহিত হওয়ার দাবি সঠিক নয়ঃ

প্রচলিত একটি দাবি হচ্ছে ২:২৪০ আয়াতটি ২:২৩৪ আয়াত এবং ৪:১২ আয়াতের মাধ্যমে মানছুখ বা রহিত হয়ে গেছে। অর্থাৎ বিধবাদেরকে এক বছর ভরণপোষণ দেয়া এবং ঘর থেকে বের করে না দেয়ার বিধান রহিত হয়ে গেছে। নিম্নে বিষয়টি পর্যালোচনা করা হলো।
২:২৩৪ আয়াত দ্বারা ২:২৪০ আয়াতটি রহিত হয়েছে কিনা তা বুঝার জন্য নিচে ২:২৩৪ আয়াতের অনুবাদ উল্লেখ করা হলো।
২:২৩৪ :: তোমাদের মধ্য হতে যারা স্ত্রীদেরকে রেখে মারা যাবে সে অবস্থায় স্ত্রীরা নিজেদেরকে চার মাস দশ দিন অপেক্ষায় রাখবে। তারপর যখন তাদের (ইদ্দাতের) নির্ধারিত শেষ সীমায় পৌঁছে, তখন তারা নিজেদের সম্বন্ধে ন্যায়সঙ্গতভাবে যা করবে তাতে তোমাদের কোনো দোষ নেই। আর তোমরা যা কিছু করছো আল্লাহ সে বিষয়ে পরিজ্ঞাত।
আয়াতটিতে (২:২৩৪) বিধান দেয়া হয়েছে যে, বিধবাদের ইদ্দাতকাল চারমাস দশদিন। এরপর তারা অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। এ আয়াতটির মাধ্যমে ২:২৪০ আয়াতে বর্ণিত বিধবাকে এক বছরের ভরণপোষণের জন্য যে বিধানটি দেয়া হয়েছে তা রহিত হয়ে গেছে বলে দাবি করা সঠিক নয়। কারণ দুটি বিষয় পরস্পর স্বতন্ত্র। এছাড়া ইদ্দাতকাল শেষ হলে যদি এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে বিধবা নারী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তাহলে ভরণ পোষণ এক বছর পূর্ণ করা লাগবে না বরং নতুন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া পর্যন্ত হলেই চলবে, তাও ২:২৪০ আয়াতে স্পষ্ট করা হয়েছে। এমতাবস্থায় দুটি আয়াত পরস্পর সম্পূরক, আয়াতদ্বয়ে কোনো বৈপরীত্য নেই, সুতরাং এর একটি দ্বারা অন্যটি রহিত হওয়ার মতবাদটি আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।

৪:১২ আয়াতে বর্ণিত উত্তরাধিকার বণ্টন বিধিতে বিধবা নারীকে উত্তরাধিকারের অংশীদার করাতে ২:২৪০ আয়াতটি রহিত হয়ে গেছে বলে কৃত দাবিটিও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ দেনমোহর দেয়ার পাশাপাশি যেমন স্বামীর উপর ভরণপোষনের দায়িত্ব থাকে, এর একটি অন্যটিকে রহিত করে না; তেমনি বিধবা নারী তার স্বামীর উত্তরাধিকার পাওয়া সত্তে¦ও স্বতন্ত্রভাবে এক বছরের ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকার রাখে, এর একটি অন্যটিকে রহিত করে না। উভয়টি আল্লাহর বিধান, এর কোনোটিই রহিত নয় এবং তাই উভয় বিধানই কার্যকর বা বাস্তবায়ন করা অত্যাবশ্যক।

ওয়াসিয়্যাত প্রসঙ্গে শেষ কথাঃ
পরিশেষে বলা যায় যে, ওয়াসিয়্যাতের বিধান এবং উত্তরাধিকারের বিধান উভয়টি ফরজ বা বাধ্যতামূলক হিসেবে বাস্তবায়ন করতে হবে। উত্তরাধিকারের বিধানের পরে ওয়াসিয়্যাতের বিধান রহিত হয়ে যাওয়ার মতবাদ একটি ভ্রান্ত মতবাদ। বরং ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণের পরে উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি কার্যকর করার নির্দেশ দেয়া হযেছে। বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, পুত্র-কন্যা, পৌত্র-পৌত্রী, দৌহিত্র-দৌহিত্রী, স্বামী/স্ত্রী এবং ভাই-বোনদের জন্য ন্যায়সঙ্গতভাবে এবং দুইজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে সাক্ষী রেখে ওয়াসিয়্যাত করতে হবে। যদি ওয়াসিয়্যাতকারী ওয়াসিয়্যাতের ক্ষেত্রে কারো প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেছে বা কাউকে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করেছে বলে আশংকা হয়, সেক্ষেত্রে অন্যরা কোনো মীমাংসার জন্য ভূমিকা রাখলে তথা উদ্বুদ্ধ করলে তা দোষনীয় নয়। সঠিক সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ওয়াসিয়্যাতকে কার্যকর করতে হবে, সঠিক সাক্ষ্য প্রমাণ না পেলে দাবিকৃত ওয়াসিয়্যাত কার্যকর হবে না, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতা করে দেয়ার মাধ্যমে ওয়াসিয়্যাতের সংশোধিত রূপ কার্যকর করা যাবে এবং সমঝোতা সম্ভব না হলে মৃতের সমস্ত পরিত্যক্ত সম্পদ উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী বণ্টন করতে হবে। অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসন, সম্পদের সুষম বণ্টন, সামাজিক বিবাদ বিসম্বাদ হ্রাস করা এবং ব্যাপক সমাজ কল্যাণের জন্য কুরআনে প্রদত্ত ওয়াসিয়্যাতের বিধান পরিপালন করা অত্যাবশ্যক।

অধ্যায় ৪ : উত্তরাধিকারের (তুরাস) বিধান সম্বলিত আয়াতসমূহের অনুবাদঃ
وَالَّذِينَ  آمَنُوا  مِن  بَعْدُ  وَهَاجَرُوا  وَجَاهَدُوا  مَعَكُمْ  فَأُولَـٰئِكَ  مِنكُمْ  وَأُولُو  الْأَرْحَامِ  بَعْضُهُمْ  أَوْلَىٰ  بِبَعْضٍ  فِي  كِتَابِ  اللَّهِ  إِنَّ  اللَّهَ  بِكُلِّ  شَيْءٍ  عَلِيمٌ
৮:৭৫ :: আর যারা পরবর্তী পর্যায়ে ঈমান এনেছে এবং হিজরত করেছে এবং তোমাদের সাথে জিহাদ করেছে, তারা তোমাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর বিধান অনুসারে রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়গণ একে অপরের প্রতি অগ্রাধিকারী। নিশ্চয় আল্লাহ প্রতিটি বিষয়ে জ্ঞানী।
النَّبِيُّ  أَوْلَىٰ  بِالْمُؤْمِنِينَ  مِنْ  أَنفُسِهِمْ  وَأَزْوَاجُهُ  أُمَّهَاتُهُمْ  وَأُولُو  الْأَرْحَامِ  بَعْضُهُمْ  أَوْلَىٰ  بِبَعْضٍ  فِي  كِتَابِ  اللَّهِ  مِنَ  الْمُؤْمِنِينَ  وَالْمُهَاجِرِينَ  إِلَّا  أَن  تَفْعَلُوا  إِلَىٰ  أَوْلِيَائِكُم  مَّعْرُوفًا  كَانَ  ذَٰلِكَ  فِي  الْكِتَابِ  مَسْطُورًا
৩৩:৬ :: আর নবী মু’মিনদের প্রতি তাদের নিজেদের চেয়ে ঘনিষ্ঠতর এবং তাঁর স্ত্রীগণ তাদের মাতাস্বরূপ। আল্লাহর বিধান অনুসারে মু’মিনগণ ও মুহাজিরদের চেয়ে রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়গণ একে অপরের প্রতি অগ্রাধিকারী। তবে এটা ভিন্ন বিষয় যে, তোমরা তোমাদের বন্ধু-বান্ধবের প্রতি ভাল কিছু (তথা অনুদান ও ওয়াসিয়্যাত) করবে। এটি বিধানে লিপিবদ্ধ।
كَلَّا  بَل  لَّا  تُكْرِمُونَ  الْيَتِيمَ
৮৯:১৭ :: কখনো না। বরং তোমরা ইয়াতীমদেরকে সম্মানজনক আচরণ কর না।
وَلَا  تَحَاضُّونَ  عَلَىٰ  طَعَامِ  الْمِسْكِينِ
৮৯:১৮ :: আর তোমরা অভাবগ্রস্তদের অন্ন সংস্থান করার(৭) বিষয়ে উৎসাহিত কর না।
(৭) এখানে অন্ন সংস্থান একটি প্রতীকি অর্থবহ, যা সামগ্রিকভাবে কল্যাণ করার নির্দেশক।
وَتَأْكُلُونَ  التُّرَاثَ  أَكْلًا  لَّمًّا
৮৯:১৯ :: আর তোমরা (অন্যের) উত্তরাধিকারকে নির্বিচারে গ্রাস করে থাক।
وَتُحِبُّونَ  الْمَالَ  حُبًّا  جَمًّا
৮৯:২০ :: আর তোমরা সম্পদকে মাত্রাতিরিক্ত ভালবাস।
يَا  أَيُّهَا  الَّذِينَ  آمَنُوا  لَا  يَحِلُّ  لَكُمْ  أَن  تَرِثُوا  النِّسَاءَ  كَرْهًا  وَلَا  تَعْضُلُوهُنَّ  لِتَذْهَبُوا  بِبَعْضِ  مَا  آتَيْتُمُوهُنَّ  إِلَّا  أَن  يَأْتِينَ  بِفَاحِشَةٍ  مُّبَيِّنَةٍ  وَعَاشِرُوهُنَّ  بِالْمَعْرُوفِ  فَإِن  كَرِهْتُمُوهُنَّ  فَعَسَىٰ  أَن  تَكْرَهُوا  شَيْئًا  وَيَجْعَلَ  اللَّهُ  فِيهِ  خَيْرًا  كَثِيرًا
৪:১৯ :: হে মু’মিনগণ, তোমাদের জন্য বলপ্রয়োগপূর্বক নারীদের ওয়ারিস হওয়া বৈধ নয়। আর তোমরা তাদেরকে (দেনমোহরবাবদ) যা দিয়েছো তার কোনো অংশ কেড়ে নেয়ার জন্য তাদেরকে (সামাজিক কর্মকা-ে) বাধা দিও না। কিন্তু তারা স্পষ্ট অশ্লীলতায় জড়িত হলে(৮)। আর তোমরা তাদের সাথে জীবন যাপন করো ন্যায়সঙ্গতভাবে। যদি তোমরা কোনো কারণে তাদেরকে অপছন্দ কর, তাহলে হতে পারে যে, তোমরা অপছন্দ করছো এমন এক সত্তাকে (তথা নিজের স্ত্রীকে) অথচ আল্লাহ রেখেছেন তার মধ্যে অনেক কল্যাণ।
(৮) (বাধা দিতে ও দেনমোহরের অংশবিশেষ ফেরত নিয়ে তালাক দিতে পারবে)
وَلِكُلٍّ  جَعَلْنَا  مَوَالِيَ  مِمَّا  تَرَكَ  الْوَالِدَانِ  وَالْأَقْرَبُونَ  وَالَّذِينَ  عَقَدَتْ  أَيْمَانُكُمْ  فَآتُوهُمْ  نَصِيبَهُمْ  إِنَّ  اللَّهَ  كَانَ  عَلَىٰ  كُلِّ  شَيْءٍ  شَهِيدًا
৪:৩৩ :: পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়গণ যা ছেড়ে যায় তার প্রত্যেকটির জন্য আমি নির্দিষ্ট উত্তরাধিকারী নির্ধারণ করে দিয়েছি। আর যাদেরকে তোমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছো,(৯) তাদেরকে তাদের প্রাপ্য অংশ দিয়ে দাও। নিশ্চয় আল্লাহ সব বিষয়ে স্বাক্ষী।
(৯) আক্ষরিকভাবে, ‘যাদেরকে তোমাদের ডানহাত প্রতিশ্রুতি দিয়েছে’। এর মধ্যে রয়েছে: (ক) ‘মা মালাকাত আইমান’ (সামগ্রিক ভরণপোষণ ও নিরাপত্তাদানের প্রতিশ্রুতিপূর্বক যাদেরকে পূর্ণ সময় অধীনস্ত রাখা হয়েছে), (খ) নির্দিষ্ট বা শর্তভিত্তিক পারিশ্রমিক/পারিতোষিকের বিনিময়ে নিযুক্ত কর্মচারী বা সেবক, (গ) যাদেরকে কোনো অনুদান দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। এরা উত্তরাধিকারের প্রাপক নয়। তাই তাদেরকে জীবদ্দশায় অনুদান দিতে হবে অথবা তাদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করা যাবে।
لِّلرِّجَالِ  نَصِيبٌ  مِّمَّا  تَرَكَ  الْوَالِدَانِ  وَالْأَقْرَبُونَ  وَلِلنِّسَاءِ  نَصِيبٌ  مِّمَّا  تَرَكَ  الْوَالِدَانِ  وَالْأَقْرَبُونَ  مِمَّا  قَلَّ  مِنْهُ  أَوْ  كَثُرَ  نَصِيبًا  مَّفْرُوضًا
৪:৭ :: পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়গণ যা রেখে যায় তা থেকে পুরুষদেরও অংশ আছে এবং পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়গণ যা রেখে যায় তা থেকে নারীদেরও অংশ আছে। তা থেকে কম হোক বা বেশি হোক, নির্ধারিত হারে প্রাপ্য অংশ।
وَإِذَا  حَضَرَ  الْقِسْمَةَ  أُولُو  الْقُرْبَىٰ  وَالْيَتَامَىٰ  وَالْمَسَاكِينُ  فَارْزُقُوهُم  مِّنْهُ  وَقُولُوا  لَهُمْ  قَوْلًا  مَّعْرُوفًا
৪:৮ :: আর যদি (উত্তরাধিকার) বন্টনের সময় আত্মীয় স্বজন,(১০) ইয়াতীম ও অভাবগ্রস্তরা উপস্থিত হয়, তবে তাদেরকে তা থেকে কিছু দিবে এবং তাদের সাথে সদ্ভাবে কথা বলবে।
(১০) তথা উত্তরাধিকারী নয় এমন আত্মীয় স্বজন [উলুল কুরবা]।
وَلْيَخْشَ  الَّذِينَ  لَوْ  تَرَكُوا  مِنْ  خَلْفِهِمْ  ذُرِّيَّةً  ضِعَافًا  خَافُوا  عَلَيْهِمْ  فَلْيَتَّقُوا  اللَّهَ  وَلْيَقُولُوا  قَوْلًا  سَدِيدًا
৪:৯ :: আর তারা যেন ভয় করে যে, যদি তারা তাদের পেছনে দুর্বল-অসহায় সন্তানাদি রেখে যেতো তবে তারা তাদের বিষয়ে উদ্বিগ্ন হতো, সুতরাং তারা যেন আল্লাহ সচেতন হয় এবং সঙ্গত কথা বলে।
إِنَّ  الَّذِينَ  يَأْكُلُونَ  أَمْوَالَ  الْيَتَامَىٰ  ظُلْمًا  إِنَّمَا  يَأْكُلُونَ  فِي  بُطُونِهِمْ  نَارًا  وَسَيَصْلَوْنَ  سَعِيرًا
৪:১০ :: নিশ্চয় যারা যুলুম সহকারে(১১)  ইয়াতীমের মালসম্পদ ভক্ষণ করে, বস্তুত তারা তাদের পেটে আগুন খাচ্ছে, আর শীঘ্রই তারা জ্বলন্ত আগুনে জ্বলবে।
(১১) অর্থাৎ অন্যায়ভাবে
يُوصِيكُمُ  اللَّهُ  فِي  أَوْلَادِكُمْ  لِلذَّكَرِ  مِثْلُ  حَظِّ  الْأُنثَيَيْنِ  فَإِن  كُنَّ  نِسَاءً  فَوْقَ  اثْنَتَيْنِ  فَلَهُنَّ  ثُلُثَا  مَا  تَرَكَ  وَإِن  كَانَتْ  وَاحِدَةً  فَلَهَا  النِّصْفُ  وَلِأَبَوَيْهِ  لِكُلِّ  وَاحِدٍ  مِّنْهُمَا  السُّدُسُ  مِمَّا  تَرَكَ  إِن  كَانَ  لَهُ  وَلَدٌ  فَإِن  لَّمْ  يَكُن  لَّهُ  وَلَدٌ  وَوَرِثَهُ  أَبَوَاهُ  فَلِأُمِّهِ  الثُّلُثُ  فَإِن  كَانَ  لَهُ  إِخْوَةٌ  فَلِأُمِّهِ  السُّدُسُ  مِن  بَعْدِ  وَصِيَّةٍ  يُوصِي  بِهَا  أَوْ  دَيْنٍ  آبَاؤُكُمْ  وَأَبْنَاؤُكُمْ  لَا  تَدْرُونَ  أَيُّهُمْ  أَقْرَبُ  لَكُمْ  نَفْعًا  فَرِيضَةً  مِّنَ  اللَّهِ  إِنَّ  اللَّهَ  كَانَ  عَلِيمًا  حَكِيمًا
৪:১১ :: আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের মধ্যকার (উত্তরাধিকার বণ্টন) বিষয়ে ওয়াসিয়্যাত করছেন: এক পুরুষের জন্য দুই নারীর অংশের অনুরূপ। তারপর (পরবর্তী ধারা হলো), যদি তারা (তথা সন্তানরা) হয় নারীরাই, অন্যুন দুই (তথা দুইয়ের বেশি বা অন্তত দুইজন), তাহলে তাদের জন্য যা সে (তথা মৃত ব্যক্তি) ছেড়ে গিয়েছে তার তিন ভাগের দুই ভাগ (২/৩)। আর যদি সে (তথা সন্তান) হয় একজনই (নারী), তাহলে তার জন্য দুই ভাগের এক ভাগ (১/২)।
আর তার (তথা মৃত ব্যক্তির) পিতা-মাতা দুইজনের মধ্য থেকে প্রত্যেকের জন্য (/তাদের দুইজনের মধ্য থেকে যেই থাকুক তার জন্য) যা সে ছেড়ে গিয়েছে তা থেকে ছয় ভাগের এক ভাগ (১/৬), যদি তার কোনো সন্তান থাকে। তবে যদি তার কোনো সন্তান না থাকে আর তার পিতা-মাতা তার উত্তরাধিকারী হয়, তাহলে তার মাতার জন্য তিন ভাগের এক ভাগ (১/৩)। তবে যদি তার ভাই-বোন থাকে, তাহলে তার মাতার জন্য ছয় ভাগের এক ভাগ (১/৬)। (এভাবে উত্তরাধিকার বণ্টন করতে হবে) তার কৃত ওয়াসিয়্যাতের দাবি পূরণ বা/এবং ঋণ পরিশোধের পরে।
তোমরা জানো না তোমাদের পিতাগণ ও পুত্রগণের মধ্যে কে তোমাদের জন্য উপকার সাধনে অধিক নিকটবর্তী হবে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি আবশ্যিক বিধান। নিশ্চয় আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাবিজ্ঞ।
وَلَكُمْ  نِصْفُ  مَا  تَرَكَ  أَزْوَاجُكُمْ  إِن  لَّمْ  يَكُن  لَّهُنَّ  وَلَدٌ  فَإِن  كَانَ  لَهُنَّ  وَلَدٌ  فَلَكُمُ  الرُّبُعُ  مِمَّا  تَرَكْنَ  مِن  بَعْدِ  وَصِيَّةٍ  يُوصِينَ  بِهَا  أَوْ  دَيْنٍ  وَلَهُنَّ  الرُّبُعُ  مِمَّا  تَرَكْتُمْ  إِن  لَّمْ  يَكُن  لَّكُمْ  وَلَدٌ  فَإِن  كَانَ  لَكُمْ  وَلَدٌ  فَلَهُنَّ  الثُّمُنُ  مِمَّا  تَرَكْتُم  مِّن  بَعْدِ  وَصِيَّةٍ  تُوصُونَ  بِهَا  أَوْ  دَيْنٍ  وَإِن  كَانَ  رَجُلٌ  يُورَثُ  كَلَالَةً  أَوِ  امْرَأَةٌ  وَلَهُ  أَخٌ  أَوْ  أُخْتٌ  فَلِكُلِّ  وَاحِدٍ  مِّنْهُمَا  السُّدُسُ  فَإِن  كَانُوا  أَكْثَرَ  مِن  ذَٰلِكَ  فَهُمْ  شُرَكَاءُ  فِي  الثُّلُثِ  مِن  بَعْدِ  وَصِيَّةٍ  يُوصَىٰ  بِهَا  أَوْ  دَيْنٍ  غَيْرَ  مُضَارٍّ  وَصِيَّةً  مِّنَ  اللَّهِ  وَاللَّهُ  عَلِيمٌ  حَلِيمٌ
৪:১২ :: আর তোমাদের জন্য যা তোমাদের স্ত্রীগণ রেখে গিয়েছে তার দুই ভাগের এক ভাগ (১/২), যদি তাদের কোনো সন্তান না থাকে। তবে যদি তাদের কোনো সন্তান থাকে, তাহলে তোমাদের জন্য যা তারা ছেড়ে গিয়েছে তা থেকে চার ভাগের এক ভাগ (১/৪)। (এভাবে উত্তরাধিকার বণ্টন করতে হবে) তাদের কৃত ওয়াসিয়্যাতের দাবি পূরণ বা/এবং ঋণ পরিশোধের পরে।
আর তাদের জন্য (তথা তোমাদের স্ত্রীদের জন্য) যা তোমরা ছেড়ে গিয়েছো তা থেকে চার ভাগের এক ভাগ (১/৪), যদি তোমাদের কোনো সন্তান না থাকে। তবে যদি তোমাদের কোনো সন্তান থাকে, তাহলে তাদের জন্য যা তোমরা ছেড়ে গিয়েছো তা থেকে আট ভাগের এক ভাগ (১/৮)। (এভাবে উত্তরাধিকার বণ্টন করতে হবে) তোমাদের কৃত ওয়াসিয়্যাতের দাবি পূরণ বা/এবং ঋণ পরিশোধের পরে।
আর যদি কোনো পুরুষ বা নারী এরূপ হয় যে, তাকে পূর্বসূরী করা হয় (তথা তার উত্তরসূরী থাকে), (এবং) সে (তথা ঐ মৃত ব্যক্তি- পুরুষ বা নারী) কালালাহ হয়(১২)  এবং তার একজন ভাই বা/এবং একজন বোন থাকে, তাহলে তাদের দুইজনের মধ্য থেকে প্রত্যেকের জন্য (/তাদের দুইজনের মধ্যে যেই থাকুক তার জন্য) ছয় ভাগের এক ভাগ (১/৬)।  তবে যদি তারা (তথা ভাই/বোন) এর চেয়ে বেশি হয় (তথা একাধিক হয়), তাহলে তারা তিনভাগের এক ভাগে (১/৩) অংশীদার হবে। (এভাবে উত্তরাধিকার বণ্টন করতে হবে) কৃত ওয়াসিয়্যাতের দাবি পূরণ বা/এবং ঋণ পরিশোধের পরে।
(১২) তথা তার সাথে তার ভাইবোনের উত্তরাধিকার প্রাপ্যতার সম্পর্ক তৈরি হয়।
অক্ষতিকর উপায়ে।(১৩) এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ওয়াসিয়্যাত (তথা বিশেষ নির্দেশ)। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সহনশীল।
(১৩) তথা যেন কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এমনভাবে বণ্টন করতে হবে।
تِلْكَ  حُدُودُ  اللَّهِ  وَمَن  يُطِعِ  اللَّهَ  وَرَسُولَهُ  يُدْخِلْهُ  جَنَّاتٍ  تَجْرِي  مِن  تَحْتِهَا  الْأَنْهَارُ  خَالِدِينَ  فِيهَا  وَذَٰلِكَ  الْفَوْزُ  الْعَظِيمُ
৪:১৩ :: এগুলো আল্লাহপ্রদত্ত সীমাসমূহ। আর যে আল্লাহর এবং তাঁর রসূলের আনুগত্য করে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার নিচ অংশে নদীসমূহ প্রবাহিত হয়। তারা তাতে স্থায়ী হবে। এটাই মহাসফলতা।
وَمَن  يَعْصِ  اللَّهَ  وَرَسُولَهُ  وَيَتَعَدَّ  حُدُودَهُ  يُدْخِلْهُ  نَارًا  خَالِدًا  فِيهَا  وَلَهُ  عَذَابٌ  مُّهِينٌ
৪:১৪ :: আর যে আল্লাহকে ও তাঁর রসূলকে অমান্য করে এবং তাঁর প্রদত্ত সীমাসমূহ লংঘন করে, তিনি তাকে আগুনে (তথা জাহান্নামে) প্রবেশ করাবেন। সে তাতে স্থায়ী হবে। আর তার জন্য অপমানকর শাস্তি রয়েছে।
يَسْتَفْتُونَكَ  قُلِ  اللَّهُ  يُفْتِيكُمْ  فِي  الْكَلَالَةِ  إِنِ  امْرُؤٌ  هَلَكَ  لَيْسَ  لَهُ  وَلَدٌ  وَلَهُ  أُخْتٌ  فَلَهَا  نِصْفُ  مَا  تَرَكَ  وَهُوَ  يَرِثُهَا  إِن  لَّمْ  يَكُن  لَّهَا  وَلَدٌ  فَإِن  كَانَتَا  اثْنَتَيْنِ  فَلَهُمَا  الثُّلُثَانِ  مِمَّا  تَرَكَ  وَإِن  كَانُوا  إِخْوَةً  رِّجَالًا  وَنِسَاءً  فَلِلذَّكَرِ  مِثْلُ  حَظِّ  الْأُنثَيَيْنِ  يُبَيِّنُ  اللَّهُ  لَكُمْ  أَن  تَضِلُّوا  وَاللَّهُ  بِكُلِّ  شَيْءٍ  عَلِيمٌ
৪:১৭৬ :: তারা তোমার কাছে কালালাহর(১৪)  মধ্যকার (উত্তরাধিকার বণ্টন) বিষয়ে সমাধান জানতে চায়। বলো, আল্লাহ তোমাদেরকে (এ বিষয়ে) সমাধান দিচ্ছেন: যদি কোনো পুরুষ মৃত্যুবরণ করে, যার কোনো সন্তান নেই এবং তার একজন বোন থাকে, তাহলে তার জন্য যা সে ছেড়ে গিয়েছে তার দুই ভাগের একভাগ (১/২)। আর (অন্যদিকে বিপরীত অবস্থায়) সে (তথা ভাইটি) তাকে (তথা বোনটিকে) পূর্বসূরী করবে (তথা তার উত্তরসূরী হবে), যদি তার (তথা বোনটির) কোনো সন্তান না থাকে। তবে যদি তারা (বোনেরা) হয় দুইজন, তাহলে তাদের দুইজনের জন্য যা সে (তথা ভাইটি) ছেড়ে গিয়েছে তা থেকে তিন ভাগের দুই ভাগ (২/৩)। আর যদি তারা হয় ভাই-বোন, পুরুষরা ও নারীরা (তথা ভাইয়েরাও থাকে এবং বোনেরাও থাকে), তাহলে এক পুরুষের জন্য দুই নারীর অংশের অনুরূপ।
আল্লাহ তোমাদের জন্য স্পষ্টভাবে বিশদ বর্ণনা করছেন, পাছে তোমরা বিভ্রান্ত হবে। আর আল্লাহ সব বিষয়ে জ্ঞানী।
(১৪) কালালাহ এর অর্থ হলো: যার সাথে তার ভাইবোনের উত্তরাধিকার প্রাপ্যতার সম্পর্ক তৈরি হয়।
يَا  أَيُّهَا  النَّاسُ  اتَّقُوا  رَبَّكُمُ  الَّذِي  خَلَقَكُم  مِّن  نَّفْسٍ  وَاحِدَةٍ  وَخَلَقَ  مِنْهَا  زَوْجَهَا  وَبَثَّ  مِنْهُمَا  رِجَالًا  كَثِيرًا  وَنِسَاءً  وَاتَّقُوا  اللَّهَ  الَّذِي  تَسَاءَلُونَ  بِهِ  وَالْأَرْحَامَ  إِنَّ  اللَّهَ  كَانَ  عَلَيْكُمْ  رَقِيبًا
৪:১ :: হে মানুষ, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের বিষয়ে সচেতন থাকো যিনি তোমাদেরকে একক ব্যক্তিসত্তা থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে (অর্থাৎ তার সমজাতীয় উপাদান থেকে) তার জোড়া/সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন। আর তাদের দুজন থেকে অনেক পুরুষ ও অনেক নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন। তোমরা আল্লাহর বিষয়ে সচেতন থাকো, যাঁর (ব্যবস্থার) মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে (অধিকার) চেয়ে থাকো। আর রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়তার বিষয়েও (সচেতন থাকো)। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক।
وَآتُوا  الْيَتَامَىٰ  أَمْوَالَهُمْ  وَلَا  تَتَبَدَّلُوا  الْخَبِيثَ  بِالطَّيِّبِ  وَلَا  تَأْكُلُوا  أَمْوَالَهُمْ  إِلَىٰ  أَمْوَالِكُمْ  إِنَّهُ  كَانَ  حُوبًا  كَبِيرًا
৪:২ :: আর ইয়াতীম ছেলেমেয়েদেরকে তাদের সম্পদ বুঝিয়ে দাও।(১৫) আর মন্দ বস্তুকে ভালো বস্তু দ্বারা বদল করে নিও না।(১৬) আর তোমাদের সম্পদের সাথে মিলিয়ে তাদের সম্পদ ভক্ষণ করো না। নিশ্চয় তা মহাপাপ।
(১৫) ইয়াতীম ছেলেমেয়ের উদাহরণ হিসেবে সৎ ছেলে বা মেয়ের উল্লেখ করা যেতে পারে, যে তার মৃত পিতার সম্পদের উত্তরাধিকারী।
(১৬) অর্থাৎ তাদের ভালো সম্পদগুলো রেখে দিয়ে তার বদলে তাদেরকে তোমাদের মন্দ সম্পদগুলো দিও না। সম্পদ বণ্টনের সময় ভালো ও মন্দ সম্পদকে স্বতন্ত্রভাবে হিসেব না করে কারো ভাগে শুধু ভালো এবং কারো ভাগে শুধু মন্দ সম্পদ বণ্টন করাও মন্দ বস্তুকে ভালো বস্তু দ্বারা বদল করে নেয়ার একটি রূপ।
وَلَا  تُؤْتُوا  السُّفَهَاءَ  أَمْوَالَكُمُ  الَّتِي  جَعَلَ  اللَّهُ  لَكُمْ  قِيَامًا  وَارْزُقُوهُمْ  فِيهَا  وَاكْسُوهُمْ  وَقُولُوا  لَهُمْ  قَوْلًا  مَّعْرُوفًا
৪:৫ :: আর তোমরা নির্বোধদের হাতে তোমাদের সম্পদ প্রত্যর্পণ করো না, যেটাতে আল্লাহ তোমাদের জন্য প্রতিষ্ঠা (জীবনে প্রতিষ্ঠিত থাকার উপকরণ) বানিয়েছেন। আর তোমরা তাদেরকে তার মধ্যে (সম্পদের সুষম ব্যবস্থাপনার মধ্যে) জীবিকা সরবরাহ করো এবং পোশাকাদি প্রদান করো। এবং তোমরা তাদের সাথে ন্যায়সঙ্গত কথা বলো।
وَابْتَلُوا  الْيَتَامَىٰ  حَتَّىٰ  إِذَا  بَلَغُوا  النِّكَاحَ  فَإِنْ  آنَسْتُم  مِّنْهُمْ  رُشْدًا  فَادْفَعُوا  إِلَيْهِمْ  أَمْوَالَهُمْ  وَلَا  تَأْكُلُوهَا  إِسْرَافًا  وَبِدَارًا  أَن  يَكْبَرُوا  وَمَن  كَانَ  غَنِيًّا  فَلْيَسْتَعْفِفْ  وَمَن  كَانَ  فَقِيرًا  فَلْيَأْكُلْ  بِالْمَعْرُوفِ  فَإِذَا  دَفَعْتُمْ  إِلَيْهِمْ  أَمْوَالَهُمْ  فَأَشْهِدُوا  عَلَيْهِمْ  وَكَفَىٰ  بِاللَّهِ  حَسِيبًا
৪:৬ :: আর ইয়াতীম ছেলেমেয়েদেরকে পরীক্ষা করো যখন তারা বিয়ে করার বয়সে পৌঁছে যায়। তারপর যদি তোমরা তাদের মধ্যে সঠিক বোধবুদ্ধি (সম্পদের সঙ্গত ব্যবস্থাপনার যোগ্যতা) অনুভব করো তাহলে তাদের ধন-সম্পদ তাদেরকে দিয়ে দাও। আর তোমরা তাদের সম্পদ খেয়ো না অপচয় করে এবং তারা বড় হওয়ার আগে তাড়াহুড়া করে। আর যে ধনী সে যেন সংযত থাকে, আর যে দরিদ্র সে যেন ন্যায়সঙ্গতভাবে খায়। অতঃপর যখন তোমরা তাদের ধন-সম্পদ তাদের নিকট সোপর্দ করবে তখন তাদের উপর তোমরা সাক্ষী রাখবে। আর হিসাব গ্রহণকারী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।
وَلَا  تَقْرَبُوا  مَالَ  الْيَتِيمِ  إِلَّا  بِالَّتِي  هِيَ  أَحْسَنُ  حَتَّىٰ  يَبْلُغَ  أَشُدَّهُ  وَأَوْفُوا  بِالْعَهْدِ  إِنَّ  الْعَهْدَ  كَانَ  مَسْئُولًا
১৭:৩৪ :: উত্তম উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি ছাড়া ইয়াতীমের সম্পদের কাছে যেও না, (তার সম্পদের ব্যবস্থাপনা করবে) যতক্ষণ না সে যৌবনে (স্থিতিশীল শক্তিসামর্থ্যরে বয়সে) পৌঁছে। আর তোমরা প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করো। নিশ্চয় প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে।
فِي  الدُّنْيَا  وَالْآخِرَةِ  وَيَسْأَلُونَكَ  عَنِ  الْيَتَامَىٰ  قُلْ  إِصْلَاحٌ  لَّهُمْ  خَيْرٌ  وَإِن  تُخَالِطُوهُمْ  فَإِخْوَانُكُمْ  وَاللَّهُ  يَعْلَمُ  الْمُفْسِدَ  مِنَ  الْمُصْلِحِ  وَلَوْ  شَاءَ  اللَّهُ  لَأَعْنَتَكُمْ  إِنَّ  اللَّهَ  عَزِيزٌ  حَكِيمٌ
২:২২০ :: দুনিয়া ও আখিরাতে। এবং তারা তোমাকে ইয়াতীমের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলো, তাদের জন্য (অভিভাবকত্ব ও সম্পদ ব্যবস্থাপনার) সংস্কারমূলক কাজ করাই উত্তম ও কল্যাণকর। যদি তোমরা (অভিভাবকত্ব গ্রহণকারীগণ) তাদের সাথে একত্রে থাকো, তবে তারা তোমাদের ভাই। এবং আল্লাহ জানেন কে সংস্কারকারী হওয়ার পরিবর্তে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তোমাদেরকে (কঠিন বিধান দিয়ে) জটিলতায় ফেলতে পারতেন। নিশ্চয় আল্লাহ মহাশক্তিমান, মহাবিজ্ঞ।
وَآتِ  ذَا  الْقُرْبَىٰ  حَقَّهُ  وَالْمِسْكِينَ  وَابْنَ  السَّبِيلِ  وَلَا  تُبَذِّرْ  تَبْذِيرًا
১৭:২৬ :: এবং আত্মীয়-স্বজনকে তাদের হক্ব (অধিকার, প্রাপ্য) প্রদান করো এবং মিসকীন ও ছিন্নমূল/উদ্বাস্তু/বাস্তুহারাদেরকেও। এবং তোমরা অপব্যয় করো না।
إِنَّ  الْمُبَذِّرِينَ  كَانُوا  إِخْوَانَ  الشَّيَاطِينِ  وَكَانَ  الشَّيْطَانُ  لِرَبِّهِ  كَفُورًا
১৭:২৭ :: নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। এবং শয়তান তার প্রভুর প্রতি অকৃতজ্ঞ।
وَإِمَّا  تُعْرِضَنَّ  عَنْهُمُ  ابْتِغَاءَ  رَحْمَةٍ  مِّن  رَّبِّكَ  تَرْجُوهَا  فَقُل  لَّهُمْ  قَوْلًا  مَّيْسُورًا
১৭:২৮ :: আর যদি তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে ও প্রত্যাশায় থাকা অবস্থায় তাদের থেকে বিমুখ হও (তাদেরকে দান করা সম্ভব না হয়), তাহলে তাদের সাথে নম্রভাবে কথা বলো।
অধ্যায় ৫ : উত্তরাধিকার বণ্টন বিধির প্রাসঙ্গিক পূর্ব জ্ঞাতব্য
তুরাস শব্দটির অর্থ ও নির্ঘণ্ট (Concordance)
তুরাস শব্দটির শব্দমূল হচ্ছে ‘ওয়াও র ছা’। তুরাস শব্দটির অর্থ হলো ‘উত্তরাধিকার’। শব্দটি বিভিন্ন শব্দরূপে যেসব স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো।
(১) তুরাস (অর্থ: উত্তরাধিকার) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৮৯:১৯:২।
(২) মীরাস (অর্থ: স্বত্ব, উত্তরাধিকার) ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ৩:১৮০:২৪, ৫৭:১০:৯।
(৩) ওয়ারিস (কর্তৃবিশেষ্য, অর্থ: স্বত্বাধিকারী, উত্তরাধিকারী, বহুবচন: ওয়ারিসূন, ওয়ারাসাহ) ব্যবহৃত হয়েছে ৭ স্থানে: ২:২৩৩:৩১, ১৫:২৩:৬, ২১:৮৯:১১, ২৩:১০:৩, ২৬:৮৫:৩, ২৮:৫:১২, ২৮:৫৮:১৭।
(৪) ওয়ারিসা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ১, অর্থ: ওয়ারিস হওয়া, উত্তরসূরী হওয়া, পূর্বসূরী করা, স্বত্বাধিকারী হওয়া, উত্তরাধিকারী হওয়া) ব্যবহৃত হয়েছে ১৩ স্থানে: ৪:১১:৩৯, ৪:১২:৫৩, ৪:১৯:৮, ৪:১৭৬:২০, ৭:১০০:৪, ৭:১৬৯:৫, ১৯:৬:১, ১৯:৬:২, ১৯:৪০:৩, ১৯:৮০:১, ২১:১০৫:১০, ২৩:১১:২, ২৭:১৬:১।
(৫) আওরাসা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৪, অর্থ: কাউকে ওয়ারিস বানানো) ব্যবহৃত হয়েছে ১২ স্থানে: ৭:৪৩:৩৩, ৭:১২৮:১০, ৭:১৩৭:১, ১৯:৬৩:৪, ২৬:৫৯:২, ৩৩:২৭:১, ৩৫:৩২:২, ৩৯:৭৪:৭, ৪০:৫৩:৫, ৪২:১৪:২৩, ৪৩:৭২:৪, ৪৪:২৮।
আল কুরআনের আলোকে উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো।
উত্তরাধিকার বিধানের ভিত্তিমূলক প্রথম মূলনীতি
৮:৭৫ ও ৩৩:৬ আয়াতে উত্তরাধিকার বিধানের ভিত্তিমূলক মূলনীতি বিবৃত হয়েছে। তা হলো: আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়গণ একে অপরের প্রতি অগ্রাধিকারী।
৩৩:৬ আয়াতে প্রথমে বলা হয়েছে, নবী মু’মিনদের প্রতি তাদের নিজেদের চেয়ে ঘনিষ্ঠতর।
আয়াত দুটিতে ‘অগ্রাধিকারী, ঘনিষ্ঠতর’ অর্থে ব্যবহৃত আরবি শব্দ হচ্ছে ‘আওলা’। আওলা শব্দটি হচ্ছে ‘ওয়ালি’ শব্দের Comparative । এ শব্দটির শব্দমূল হচ্ছে ‘ওয়াও লাম ইয়া’। এ শব্দমূলের অর্থ হচ্ছে ‘বন্ধুত্ব, অভিভাবকত্ব, ঘনিষ্ঠতা, অগ্রাধিকার’। আওলা শব্দটি একবচনে ৬ স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে: ৩:৬৮:২, ৪:১৩৫:২১, ৮:৭৫:১৩, ১৯:৭০:৬, ৩৩:৬:২ এবং ৩৩:৬:১১। আওলা শব্দটির দ্বিবচন আওলাইয়ান ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে ৫:১০৭:১৪।(১৭) ‘ওয়াও লাম ইয়া’ থেকে গঠিত আওলা শব্দটির প্রয়োগ অনুসারে এর অর্থ হচ্ছে ‘অগ্রাধিকারী, ঘনিষ্ঠতর’।
(১৭) এছাড়া আওলা শব্দটি ভিন্ন শব্দমূল ‘ওয়াও ইয়া লাম’ থেকে ভিন্ন ব্যাকরণগত নিয়মে গঠিত হয়ে ভিন্ন অর্থে আরো ৫ স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে, তা এ আলোচ্য বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত নয়।
এই অগ্রাধিকার বা অধিক ঘনিষ্ঠতা উত্তরাধিকারের বণ্টনের ক্ষেত্রেও হতে পারে আবার অন্য ক্ষেত্রেও হতে পারে। সুতরাং ৮:৭৫ ও ৩৩:৬ আয়াতের বক্তব্য অনুযায়ী সাধারণভাবে মু’মিন ও মুহাজিরদের চেয়ে রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়গণ একে অন্যের প্রতি অগ্রাধিকারী তথ্যটির দুটি তাৎপর্য হচ্ছে:
১. আত্মীয় মু’মিনগণ অন্য মু’মিনদের চেয়ে অগ্রাধিকারী, কারণ তাতে আত্মীয়তার মাত্রা যোগ হয়েছে।
২. আত্মীয়গণ প্রাত্যহিক অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব ও উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী মু’মিনদের চেয়ে অগ্রাধিকারী। তবে এ অগ্রাধিকার আদর্শিক ক্ষেত্রে নয়, বরং আদর্শগত দিক থেকে মু’মিনরাই পরস্পরের বন্ধু ও অভিভাবক। এ বিষয়টি প্রমাণিত হয় ৪:৭, ৪:৩৩, ৪:১১-১২, ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি এবং ৯:২৩, ৯:৭১ আয়াতে বর্ণিত বন্ধুত্ব ও অভিভাবকত্বের নীতি অনুসারে।
সুতরাং উত্তরাধিকার বিধানের ভিত্তিমূলক প্রথম মূলনীতি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়দেরকে পরস্পরের উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।
উত্তরাধিকারের বিধান লঙ্ঘনের প্রবণতা ও অবৈধতা
৮৯:১৭-২০ আয়াতে মানুষের মধ্যে উত্তরাধিকারের বিধান অনুযায়ী সঠিকভাবে সম্পদ বণ্টন না করে অন্যের উত্তরাধিকারকে নির্বিচারে গ্রাস করার অভ্যাস ও মানসিকতা তুলে ধরা হয়েছে। এরূপ ব্যক্তিরা ইয়াতীম ছেলে-মেয়েদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করে না, মিসকীনের অন্ন সংস্থান বা কল্যাণ করার জন্য উৎসাহিত করে না। এর পেছনে যে মনস্তত্ব কাজ করে তা হলো সম্পদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষণ, যার ফলে সম্পদের প্রতি অনৈতিক লোভ তৈরি হয়। এ লোভের কারণেই মানুষ উত্তরাধিকারের সঠিক বণ্টন করে না এবং অন্য উত্তরাধিকারীদের প্রাপ্য সম্পদ আত্মসাৎ করে।
৪:১৯ আয়াতে বলপ্রয়োগপূর্বক নারীদের সম্পদের উত্তরাধিকারী বা ভোগদখলকারী হওয়াকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এটা একটা অত্যন্ত স্বত:সিদ্ধ যৌক্তিক বিষয় যে, নারীদেরকে তাদের সম্পদের অধিকার বা উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না এবং তাদের সম্পদকে তাদের স্বত:স্ফূর্ত অনুদান ও সম্মতি ছাড়া বলপ্রয়োগপূর্বক ব্যবহার করা যাবে না। তা সত্ত্বেও এখনো সমাজে এরূপ অনিয়ম অবিচার ব্যাপকভাবে বর্তমান রয়েছে। অনেক সময় এরূপ প্রচারণা চালানো হয় যে, ভালো মেয়েরা পিতা-মাতার সম্পত্তি থেকে নেয় না, তাদের ভাইকে ছেড়ে দেয়। এভাবে এক ধরনের মানসিক ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে নারীদেরকে তাদের প্রাপ্য উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। কোনো নারীর স্বামী যদি তার উত্তরাধিকারের বিষয়ে কথা বলে তখন স্বয়ং সেই নারীও তাকে অপমানসূচক কথা বলে যে, কেন তুমি শ^শুরবাড়ির বিষয়ে লোভ করছো? অথচ এটা একটা ন্যায়সঙ্গত অধিকারের প্রশ্ন। অথচ এটা নিশ্চিত নয় যে, যদি ঐ নারীকে তার প্রাপ্য সম্পদের মালিকানা প্রদান করা হতো তারপরেও সে তার ঐ সম্পদ তার ভাইকে দান করে দিতো। বরং অনেক সময় সে সামাজিক অপতৎপরতাকে নীরবে হজম করে বিধায় বাহ্যত এরূপ কথা বলে। আর এভাবে উত্তরাধিকার আত্মসাৎকারী হওয়া সত্ত্বেও অনেকের সামাজিক সম্মান, প্রতিপত্তি বজায় থাকে; যা প্রমাণ করে যে, সাধারণভাবে পুরো সমাজই ন্যায়বিচারের বিষয়ে উদাসীন। এটি সমাজের নৈতিক অধ:পতনের অন্যতম লক্ষণ।
উত্তরাধিকার যেন সঠিক নিয়মে বণ্টিত হতে পারে এবং কেউ যেন কাউকে তার ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করতে না পারে, ইয়াতীম ছেলে মেয়েরা যেন সম্মানের সাথে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, নারী যেন নিজ সম্পদে নিজের যথাযথ অধিকার পায় এবং উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় তথা যেন নারীর উত্তরাধিকার প্রাপ্তি নিশ্চিত করা যায় এসবের বাস্তবসম্মত উপায় হিসেবে আল্লাহ স্বয়ং উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি প্রদান করেছেন।
আল কুরআনে প্রদত্ত উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধি পরিপূর্ণ এবং বোধগম্য
একটি প্রচলিত ধারণাপ্রসূত কথা হচ্ছে: উত্তরাধিকার ও সুদ সম্পর্কিত আয়াতগুলো নবীর জীবনের শেষ দিকে নাজিল হয়েছে এবং তার ব্যাখ্যা দেয়ার আগেই নবীজী দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন - তাই এ দুটি বিষয়ে প্রকৃত ব্যাখ্যা জানা সম্ভব হয়নি এবং মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে।
অথচ উত্তরাধিকার বন্টন সম্পর্কে কুরআনের শেষ বক্তব্য হচ্ছে, আল্লাহ তোমাদের জন্য স্পষ্টভাবে বিশদ বর্ণনা করছেন, পাছে তোমরা বিভ্রান্ত হবে। আল্লাহ সর্ববিষয়ে জ্ঞানী (৪:১৭৬)। সুতরাং অবশ্যই উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহ (৪:১১, ৪:১২, ৪:১৭৬) থেকে স্পষ্টভাবে নির্ণয় করা সম্ভব। তবে, উলুল আলবাব/ চিন্তাশীলগণ ব্যতীত অন্যরা পুন:পুন: স্মরণীয় তথ্য গ্রহণ (সঠিক বুঝ লাভ) করে না। তাই আমরা আল্লাহর উপর ভরসা রেখে বিষয়টি নিয়ে চিন্তার প্রয়াস পাচ্ছি। কারণ আল্লাহ বলেছেন, যারা আমার (সাথে সম্পর্কিত) বিষয়ে প্রচেষ্টা করে আমি তাদেরকে আমার পথসমূহে(১৮) পথপ্রদর্শন করি।
(১৮) সর্বশক্তিমান ও পথপ্রদর্শকের পথের বিভিন্ন বিচরণক্ষেত্রে
কুরআনে উত্তরাধিকারের বন্টনবিধি যেভাবে দেয়া হয়েছে তা ভাষারীতির উৎকর্ষসম্পন্ন বিবৃতিমূলক পদ্ধতিতে উল্লেখিত হয়েছে। আর এতে অংশগুলোও উল্লেখ করা হয়েছে আনুপাতিক অংশ হিসাবে যা প্রদত্ত বন্টন বিধির বিশ্লেষণ থেকে বুঝা যায়। এরূপ উপস্থাপনা পদ্ধতির মাধ্যমে সামান্য পরিসরে সকল অবস্থার সাথে সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান নির্দেশ করা হয়েছে। কুরআনিক বণ্টন পদ্ধতির মাধ্যমে আল্লাহ যার বিপরীতে যাকে যেভাবে কম বা বেশি অনুপাতে দিয়েছেন তা বজায় রেখে নির্দিষ্ট উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সহজেই সমস্ত সম্পদের বণ্টন করা যায়। ভাষারীতি ও অনুপাতভিত্তিক বন্টন পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন থাকলে সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহ থেকে পরিপূর্ণ বন্টনবিধি বুঝে নেয়া মোটেই কঠিন নয়।
সূরা নিসা ৪:১১-১২ আয়াতের বক্তব্য কাঠামো ও ৪:১৭৬ আয়াতের বক্তব্য বিষয়
৪:১১-১২ আয়াতের বক্তব্য কাঠামোতে উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বন্টন বিধি দুটি মৌলিক ভাগে বিভক্ত:
প্রথম আয়াতে (৪:১১) মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা ও পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ বর্ণিত হয়েছে তথা এটি মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা ও পিতা-মাতার সাথে সম্পর্কিত। আয়াতটির শেষদিকে বলা হয়েছে, ‘তোমরা জান না, পিতা-মাতা ও পুত্র-কন্যার মধ্যে কে উপকার সাধনে অধিক নিকটবর্তী হবে’। আয়াতটিতে উল্লেখিত দুটি পক্ষের একটি পক্ষ হচ্ছে পুত্র-কন্যা যার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি সাপেক্ষে পিতা-মাতার জন্য ভিন্ন ভিন্ন আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে কিন্তু পিতা-মাতার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি সাপেক্ষে পুত্র-কন্যার জন্য ভিন্ন আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণ করা হয়নি।
আর দ্বিতীয় আয়াতে (৪:১২) মৃত ব্যক্তির স্ত্রী/ স্বামীর অংশ এবং মৃত ব্যক্তি কালালাহ হলে সে অবস্থায় তার ভাইবোনের অংশ বর্ণিত হয়েছে। আয়াতটিতে স্বামী/ স্ত্রীর জন্য পুত্র-কন্যার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি সাপেক্ষে ভিন্ন ভিন্ন আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু স্বামী/ স্ত্রীর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি সাপেক্ষে পুত্র-কন্যার জন্য ভিন্ন ভিন্ন আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণ করা হয়নি। আর পুত্র-কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ ৪:১১ আয়াতেই নির্ধারণ করা হয়েছে, ৪:১২ আয়াতে পুত্র-কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ নতুন করে বা ভিন্নভাবে নির্ধারণ করা হয়নি।
এ সম্পর্কিত শেষ আয়াতটি (৪:১৭৬) সূরাটির পরিশিষ্ট। প্রকৃতপক্ষে আয়াতটির বক্তব্য বিষয় হলো প্রথম আয়াতের (৪:১১) একটি অন্তর্নিহিত বন্টন বিধিকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা। আয়াতটিতে মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাইবোনের প্রাপ্য উত্তরাধিকার বর্ণনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ৪:১১ আয়াতে বর্ণিত পুত্র-কন্যা ও পিতা-মাতার অংশ বর্ণনায় পুত্র-কন্যার জন্য যে অংশ নির্ধারণ করা হয়েছে, পুত্র-কন্যার অনুপস্থিতিতে ভাইবোনের জন্য সেরূপ প্রাপ্য অংশই নির্ধারণ করা হয়েছে।
৪:১১ আয়াতে উল্লেখিত মৃত ব্যক্তি পুরুষ না নারী?
৪:১১ আয়াতে ব্যবহৃত সর্বনাম ও ক্রিয়া থেকে বুঝা যায়, যে মৃত ব্যক্তির সম্পদ বন্টনের কথা বলা হচ্ছে সে পুরুষ। কিন্তু যদি সে নারী হয় তাহলেও তার সম্পদ এই একই বন্টনবিধি আনুযায়ী বন্টন করতে হবে। কারণ, ৪:১২ আয়াত অনুযায়ী, মৃত ব্যক্তি পুরুষ না স্ত্রীলোক তা শুধমাত্রু তার স্বামী বা স্ত্রীর প্রাপ্য অংশ নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ স্বামীর সম্পদে স্ত্রীর বা স্ত্রীর সম্পদে স্বামীর অংশ কতটুকু তা ১২ নং আয়াতে বলে দেয়া হয়েছে। অন্য আত্মীয়দের ক্ষেত্রে মৃত পুরুষ লোকের সম্পদে যেরূপ বন্টন, মৃত মহিলার সম্পদেও সেরূপ বন্টন। কারণ সাধারণ নিয়মানুসারে যৌথ নির্দেশ পুরুষবাচক শব্দে দেয়া হয় আর ব্যতিক্রম উল্লেখ করে দেয়া হয়। এছাড়া এ বিষয়ে উদাহরণ হিসেবে ১২ নং আয়াতে মৃত পুরুষ কালালাহ ও মৃত মহিলা কালালাহর সম্পদ বন্টনের অভিন্ন নিয়ম প্রদান করা হয়েছে।
৪:১৭৬ আয়াতে অনুক্ত কিন্তু বোধগম্য বন্টন বিধি
৪:১৭৬ আয়াতে দুটি বিষয় অনুক্ত (Non expressed) কিন্তু বোধগম্য (Understood) অবস্থায় রয়েছে। বিষয় দুটি হলো:
(ক) মৃত ভাইয়ের এক বা একাধিক ভাই কিভাবে উত্তরাধিকার পাবে?
(খ) মৃত বোনের এক বা একাধিক বোন বা একাধিক ভাই বা ভাই-বোন কিভাবে উত্তরাধিকার পাবে?
৪:১৭৬ আয়াতে অবলম্বনকৃত ভাষারীতির মাধ্যমে বক্তব্য বিন্যাস সংক্ষেপীকরণ করা হয়েছে। কারণ ‘ক’ এর সাথে সম্পর্কিত কোনো অবস্থায় প্রদত্ত ব্যবস্থা যদি ‘খ’ এর সাথে সম্পর্কিত অনুরূপ অবস্থায় প্রযোজ্য ব্যবস্থা হয়, তবে তা বক্তব্যের প্রাসঙ্গিক অবস্থান ও বর্ণনাভঙ্গি থেকে সহজ বোধগম্য হলে সেক্ষেত্রে তা বক্তব্যের উৎকর্ষের প্রয়োজনে অনুল্লেখিত রাখা হয়।
উল্লেখিত ভাষাতাত্ত্বিক কারণে ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী বণ্টনের ক্ষেত্রে, মৃত ব্যক্তি ভাই হলে তার ভাই/ বোন/ ভাই-বোন যেভাবে পাবে, মৃত ব্যক্তি বোন হলেও তার ভাই/ বোন/ ভাই-বোন সেভাবে পাবে।
উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধিতে ‘বচন’ এর প্রভাব
উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধি বর্ণনায় যেক্ষেত্রে যে ‘বচন’ (এক বচন, দ্বিবচন, বহুবচন) ব্যবহার করা হয়েছে বক্তব্য প্রসঙ্গ অনুসারে যেক্ষেত্রে তা যে ধরনের প্রভাব রাখে নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো:
১. ৪:১২ আয়াতে স্বামী-স্ত্রীর আনুপাতিক অংশ বর্ণনায় বহুবচন ‘লাকুম’ (তোমাদের জন্য) এবং ‘লাহুন্না’ (তাদের জন্য তথা স্ত্রীদের জন্য) শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ এতে স্বামীদের ক্ষেত্রেও বহুবচন এবং স্ত্রীদের ক্ষেত্রেও বহুবচন ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ একজন স্বামীর একজন স্ত্রী হলেও বহু স্বামীর স্ত্রীসংখ্যা মিলে বহুবচন হয়। অনুরূপভাবে যদিও একজন স্ত্রীর স্বামী একজনই থাকে তবুও বহু স্ত্রীর স্বামীদেরকে তথা পুরুষদেরকে প্রধান সম্বোধিত ব্যক্তিবর্গ হিসেবে সাব্যস্ত করে ‘তোমাদের জন্য’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
তাই এতে বহুবচন ব্যবহৃত হলেও স্বামীর জন্য বর্ণিত অংশের প্রাপক হয় একজন স্বামী। অন্যদিকে স্ত্রীর জন্য বর্ণিত অংশের প্রাপক যেমন একজন স্ত্রী হতে পারে, তেমনি যদি একাধিক স্ত্রী থাকে সেক্ষেত্রে তারা যৌথভাবে ঐ অংশের প্রাপক হবে এবং তা তাদের মধ্যে সমান হারে ভাগ হবে।
২. ৪:১৭৬ আয়াতে বক্তব্যের ধারাবাহিকতা অনুসারে একজন ভাই তার বোনের উত্তরাধিকারী হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু যদি একজন ভাইয়ের পরিবর্তে একাধিক ভাই থাকে, তাহলে তারাও উত্তরাধিকারী হবে। অর্থাৎ আয়াতটিতে ভাইকে উত্তরাধিকারী হিসেবে উল্লেখ করার ক্ষেত্রে একবচন ব্যবহৃত হলেও বহু ভাইয়ের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য হবে।
৩. ৪:১১ আয়াতে পিতা-মাতার অংশ বর্ণনায় পিতা-মাতাকে দ্বিবচনে এবং মাতাকে একবচনে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই এতে বর্ণিত অংশটিতে প্রত্যক্ষভাবে পিতা-মাতাই অন্তর্ভুক্ত। দাদা-দাদী ও নানা-নানী পিতা-মাতা শ্রেণির হলেও তারা মৃতের সাথে পিতা-মাতার সম্পর্কসূত্রে পিতা-মাতা শ্রেণিভুক্ত হয়েছে। মৃত ব্যক্তির সাথে দাদা-দাদীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে পিতা-মাতা মাধ্যম (Media) শ্রেণি হওয়ায় পিতা-মাতা জীবিত থাকলে তারা মৃত ব্যক্তির আক্বরাব (নিকটতম) হয় না। কিন্তু পিতা-মাতা জীবিত না থাকলে, দাদা-দাদী ও নানা-নানী তাদের জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক ভগ্নাংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হবে। অর্থাৎ পিতার জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক ভগ্নাংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হবে দাদা-দাদী এবং মাতার জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক ভগ্নাংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হবে নানা-নানী; যদিও আয়াতটিতে পিতা-মাতার বিষয়টি দ্বিবচনে উল্লেখ করা হয়েছে।
৪. যেক্ষেত্রে তুলনামূলক অবস্থা বুঝাতে বা কোনো শর্ত হিসেবে বচন উল্লেখ করা হয়েছে সেক্ষেত্রে ব্যবহৃত বচন সরাসরি প্রযোজ্য হওয়া শর্তের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। যেমন, এক পুত্র পাবে দুই কন্যার সমান সূত্রটি অনুসারে একটি পুত্র ও তিনটি কন্যা একসাথে থাকলে একটি পুত্রকে দুই কন্যা হিসেবে বিবেচনা করে সম্পদকে মোট পাঁচ ভাগ করতে হবে। তা থেকে প্রত্যেক কন্যা এক ভাগ পাবে এবং পুত্রটি দুই ভাগ পাবে।
৪:১১ আয়াতে বর্ণিত ধারা হলো পুত্র না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র কন্যা থাকলে তার আনুপাতিক অংশ হলো ১/২। ধারাটি তাতে উল্লেখিত শর্তানুসারে কার্যকর হবে অর্থাৎ যখন পুত্র থাকে না এবং একাধিক কন্যা থাকে না শুধু তখন একটিমাত্র কন্যার আনুপাতিক অংশ হবে ১/২। নিম্নোক্ত দুটি ধারার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য:
(ক) ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত ধারা একটিমাত্র ভাই বা একটিমাত্র বোন থাকলে তার আনুপাতিক অংশ ১/৬।
(খ) ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত ধারা ভাই না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র বোন থাকলে তার আনুপাতিক অংশ ১/২।
পিতা-মাতা ও পুত্র-কন্যার মধ্যে উপকার সাধনে কে নিকটতম হবে?
পুত্র-কন্যা ও পিতা-মাতার নির্ধারিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ উল্লেখ করার পর বলা হয়েছে,  তোমরা জান না তোমাদের পিতা-মাতা ও পুত্র-কন্যার মধ্যে কে উপকার সাধনে নিকটতম হবে? এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি আবশ্যিক বিধান। নিশ্চয় আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাবিজ্ঞ।
এ কথার তাৎপর্য হলো আমরা যেভাবে জানি বাস্তবে কখনো তার উল্টোটা ঘটতে পারে। যেমন আমরা হয়তো ভাবলাম পুত্র-কন্যা উপকার সাধনে নিকটতম হবে কিন্তু বাস্তবে পিতা-মাতাই উপকার সাধনে নিকটতম হবে। আবার কখনো আমরা ভাবলাম পিতা-মাতা উপকার সাধনে নিকটতম হবে কিন্তু বাস্তবে পুত্র-কন্যাই উপকার সাধনে নিকটতম হবে। এটা একটা সাধারণ বিবৃতি। এর মাধ্যমে পিতা-মাতা বা পুত্র-কন্যার মধ্য থেকে একটি পক্ষই উপকার সাধনে সব সময় নিকটতম হবে তা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। বরং এর মাধ্যমে বুঝা যায় যে, উপকার সাধনে কখনো পিতা-মাতা নিকটতম হতে পারে, আবার কখনো পুত্র-কন্যা নিকটতম হতে পারে। কখন কে নিকটতম হবে তা আমরা জানি না কিন্তু আল্লাহ জানেন।
সুতরাং উত্তরাধিকারের প্রাপ্য অংশ নির্ধারণের ভিত্তি হিসেবে উপকার সাধনে কখন কে নিকটতম হবে সেটাই ভিত্তিমূলক বিবেচ্য বিষয় নয়। বরং সামগ্রিক সমাজ কল্যাণের ভারসাম্যপূর্ণ উপায় হিসেবে আল্লাহ তাঁর জ্ঞান ও বিজ্ঞতার মাধ্যমে যার জন্য যা আবশ্যিক নির্ধারিত অংশ করেছেন তাকে সেটা দেয়াই আমাদের কর্তব্য।
ওয়াসিয়্যাত ও দাইন (ঋণ): কোনটি আগে পরিশোধ করতে হবে?
আগে দাইন (ঋণ) পরিশোধ করতে হবে, পরে ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ করতে হবে। কারণ দাইন বা ঋণ অন্যের অধিকারের সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু আয়াতে আগে ওয়াসিয়্যাত এবং পরে দাইন (ঋণ) এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে। এর যে যৌিিক্তকতা বুঝা যায় তাহলো, ওয়াসিয়্যাত থাকার সম্ভাবনা ঋণ থাকার সম্ভাবনার চেয়ে বেশি। ওয়াসিয়্যাত করাকে ফরজ করা হয়েছে, কিন্তু ঋণ একটি অনুমোদিত বিষয় মাত্র। এছাড়া মানুষের ওয়াসিয়্যাত তার মৃত্যুর পর কার্যকর করা হয়, কিন্তু ঋণ ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় পরিশোধ করার চেষ্টা করতে হয়, যদি না পারে সেক্ষেত্রেই তার মৃত্যুর পর তার পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে তা পরিশোধ করতে হয়। ঋণের প্রসঙ্গ পরে বলার মাধ্যমে ঋণ রেখে যাওয়ার বিষয়ে পরোক্ষভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে বা জীবদ্দশায় ঋণ পরিশোধের চেষ্টাকে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। একইসাথে একজন বিবেকবান ব্যক্তি যখন সজ্ঞানে ওয়াসিয়্যাতের আবশ্যকতা পূরণ করবে, তখন তিনি প্রথমে নিজেই ঋণ পরিশোধকেও ওয়াসিয়্যাত বা উইলে ব্যবস্থা নিবে, এটাই অধিক সম্ভব ও বাস্তবসম্মত। অনুরূপভাবে ওয়াসিয়্যাতের প্রসঙ্গ আগে বলার মাধ্যমে ওয়াসিয়্যাত করে যাওয়ার বাধ্যবাধকতাকে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তবে পরিশোধের দিক থেকে দাইন বা দেনা পরিশোধ যে অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য তা সহজ বোধগম্য বিষয়।
অক্ষতিকর উপায়ে বণ্টনের তাৎপর্য কী?
৪:১২ আয়াতের একটি নির্দেশনা হচ্ছে গায়রা মুদাররিন অর্থাৎ (উত্তরাধিকার বণ্টন করতে হবে) অক্ষতিকর উপায়ে।
গায়রা শব্দটির অর্থ ‘ব্যতীত’। মুদাররিন শব্দটির অর্থ ‘ক্ষতিকর’। গায়রা শব্দটি কর্মকারক। তাই এর পূর্বে কোন ক্রিয়ার প্রয়োজন। কিন্তু এর পূর্ববর্তী ক্রিয়া উহ্য রয়েছে। এক্ষেত্রে এটিকে ‘ফারীদাতাম মিনাল্লাহ’ এবং ‘ওয়াসিয়াতাম মিনাল্লাহ’ এর মতো বিবেচনা করলে এর অর্থ হয় (অবলম্বন করো) অক্ষতিকর উপায়কে। অন্যদিকে গায়রা মুদাররিন বাক্যটিকে মিম বা’দি ওয়াসিয়্যাতিন .... এর মতো বিবেচনা করলে এর অর্থ হয় (উত্তরাধিকার বণ্টন করতে হবে) অক্ষতিকর উপায়ে। উভয় অবস্থায় এর তাৎপর্য একই থাকে, আর তা হলো শুধু ভাগ ঠিক হলে চলবে না, ভাগগুলোর মানও যেন প্রত্যেকের মধ্যে ন্যায্যভাবে বন্টিত হয় তা খেয়াল রাখতে হবে।
গায়রা মুদাররিন এর দ্বিতীয় তাৎপর্য হতে পারে, অধিক নফল ওয়াসিয়্যাতের মাধ্যমে এবং ওয়ারিসদের পাশাপাশি অন্য কাউকে কিছু দেয়ার জন্য মিথ্যাভাবে কারো কাছে ঋণী থাকার কথা বলে ওয়ারিসদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। এ বিষয়ে হাদীসে নির্দেশনা রয়েছে। নফল ওয়াসিয়্যাতের বিষয়ে হাদীসের নির্দেশনা হচ্ছে, তা যেন এক তৃতীয়াংশের বেশি না হয়, বরং এক তৃতীয়াংশও অনেক, তাই তা যেন এক চতুর্থাংশের বেশি না হয় সেভাবে ওয়াসিয়্যাত করা।
গায়রা মুদাররিন এর তৃতীয় তাৎপর্য হতে পারে, নফল ওয়াসিয়্যাত (ওয়ারিস ব্যতীত অন্যদের জন্য কৃত ওয়াসিয়্যাত) ও ঋণের পরিমাণ অধিক হলে অক্ষতিকর উপায়স্বরূপ সেক্ষেত্রে বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করা। যেমন:
১. নফল ওয়াসিয়াতের ক্ষেত্রে, যদি এক তৃতীয়াংশের বেশি নফল ওয়াসিয়্যাত থাকে তবে ঐ পরিমাণকে যাদের জন্য যা ওয়াসিয়্যাত করা হয়েছে তাদের পরস্পরের মধ্যে আনুপাতিক হারে হ্রাসসকরনের মাধ্যমে হাদীসের নির্দেশনার সাথে সঙ্গতি রেখে এক তৃতীয়াংশের মধ্যে বা এক চতুর্থাংশের মধ্যে সীমিত করে পরিপূরণ করা যেতে পারে। অথবা এক্ষেত্রে উলিল আমর যদি আরো কম পরিমাণের মধ্যে সীমিত করাকে যৌক্তিক মনে করেন তবে তাও করা যেতে পারে। এমনকি হাদীসেও ‘এক তৃতীয়াংশ বা এক চতুর্থাংশ’ শব্দের মাধ্যমে পরিস্থিতি অনুসারে বিভিন্নভাবে সীমিত করার বিকল্প সম্পর্কেই ধারণা দেয়া হয়েছে।
২. অধিক পরিমাণ ঋণের ক্ষেত্রে, যদি ঋণদাতা পাওনাদার কোনো অংশ মাফ না করে তবে তা কিস্তিতে পরিশোধের ব্যবস্থা করা বা উলিল আমরের (Central Authority) পক্ষ থেকে পরিশোধের ব্যবস্থা করার পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে।
গায়রা মুদাররিন এর চতুর্থ তাৎপর্য হতে পারে, ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে যাচাই বাছাই সাপেক্ষে প্রমাণিত ঋণ প্রাপককে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। কারণ প্রমাণিত ঋণ প্রাপককে ঋণ পরিশোধ না করলে ঐ ঋণ প্রাপককে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয় এবং তার অধিকার অনাদায়ী থেকে যায় বিধায় তা করা যাবে না। সুতরাং প্রমাণিত ঋণ প্রাপককে অবশ্যই ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
অধ্যায় ৬ : উত্তরাধিকারের আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি
৪:৭ আয়াত অনুযায়ী, পিতা-মাতা ও নিকটতম আত্মীয়গণ যা রেখে যায় তাতে পুরুষ ও নারীর প্রাপ্য অংশ নির্ধারিত।
৪:৩৩ আয়াত অনুযায়ী, পিতা-মাতা ও নিকটতম আত্মীয়গণ যা রেখে যায় তার প্রত্যেকটি সম্পদের জন্য উত্তরাধিকারী নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে।
সুতরাং ৪:৭ ও ৪:৩৩ আয়াতের সমন্বিত তথ্য অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার পরিত্যক্ত সম্পদের প্রত্যেকটির জন্য মহান আল্লাহ অব্যবহিত উত্তরাধিকারী (মাওয়ালিয়া) নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন এবং তাদের প্রত্যেকের প্রাপ্য অংশও নির্ধারিত করে দিয়েছেন।
৪:৭ ও ৪:৩৩ আয়াতের সমন্বিত তথ্য থেকে উত্তরাধিকার বণ্টন পদ্ধতির মূলনীতি পাওয়া যায়। আয়াতের বক্তব্য বিষয় থেকে নির্ণিত নিম্নলিখিত শর্তসমূহ থেকে বণ্টন পদ্ধতির মূলনীতি উৎসারিত হয়:
(১) উত্তরাধিকারের বিধানে মৃত ব্যক্তির নিকটতম আত্মীয়দেরকে যেভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে উত্তরাধিকার লাভের প্রশ্নে তারা সেভাবে নিকটতম হিসেবে সাব্যস্ত হবে। যেমন প্রদত্ত শর্ত অনুসারে ভাই-বোন কখনো পায় এবং কখনো পায় না। অর্থাৎ আত্মীয়তার দিক থেকে ভাই-বোন ‘আক্বরাবূন’ বা ‘নিকটতম আত্মীয়’ হলেও উত্তরাধিকারের প্রশ্নে তারা শর্ত সাপেক্ষে উত্তরাধিকার লাভ করতে পারে।
(২) উত্তরাধিকারের বিধানে যাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তাদের প্রত্যেকের প্রাপ্য অংশ নির্ধারিত। সুতরাং তাদের প্রত্যেকে নিজ নিজ নির্ধারিত প্রাপ্য অংশই পাবে, এর চেয়ে কম বা বেশি পাবে না।
(৩) উত্তরাধিকারের বিধানে যাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তারা মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদের প্রত্যেকটি অংশের প্রাপক। অন্য কথায়, তাদের কেউ জীবিত থাকা অবস্থায় তাদের বাহিরের কেউ উত্তরাধিকারী হতে পারবে না এবং আল্লাহ যাদেরকে নির্দিষ্ট করেছেন তাদের কেউ বাদ যাবে না।
(৪) উত্তরাধিকারের বিধানে যাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তারা পরিত্যক্ত সম্পদের প্রত্যেকটি অংশের প্রাপক। অন্য কথায় সমস্ত পরিত্যক্ত সম্পদ বণ্টিত হবে এবং তা থেকে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
(৫) মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদের প্রত্যেকটির জন্য মাওয়ালিয়া নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। সুতরাং প্রত্যেক স্বতন্ত্র মানসম্পন্ন জিনিস স্বতন্ত্রভাবে বণ্টিত হবে এবং প্রত্যেক স্বতন্ত্র মানসম্পন্ন জিনিসের উপর মাওয়ালিয়ার অন্তর্ভুক্ত সকলের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত কারণে যে একককে (Unit)  ভাঙ্গা যায় না সেরূপ এককটিকে না ভেঙ্গে এককের স্বত্ব আনুপাতিক হারে বণ্টিত হবে তথা এককটির উপযোগ (Unit/ উপকারিতা)  উত্তরাধিকারীরা আনুপাতিক হারে ভোগ করবে। যেমন: ধরা যাক, এক কক্ষবিশিষ্ট একটি কক্ষে উত্তরাধিকারী দুই ভাই পরিবারসহ থাকা সম্ভব নয় এবং দুই ভাই পূর্ব থেকেই আলাদা দুটি বাসায় নিজ নিজ পরিবারসহ আছে। এমতাবস্থায় তারা দুই ভাই যৌথভাবে এ কক্ষটিকে ভাড়া দিয়ে ভাড়া হিসেবে প্রাপ্ত টাকা সমান দুই ভাগ করে গ্রহণ করতে পারে। এছাড়া তারা চাইলে সেটাকে নিজেদের মধ্যে ক্রয়-বিক্রয় বা সমন্বয়ও করে নিতে পারে।
এই শর্তসমূহ পরিপূরণ করে উত্তরাধিকার বণ্টন করার একমাত্র গাণিতিক পদ্ধতি হচ্ছে আনুপাতিক ভাগ বণ্টন পদ্ধতি। কারণ যাদেরকে উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে তাদের প্রত্যেকের উপস্থিতি অথবা কারো কারো অনুপস্থিতির কারণে তাদের নির্ধারিত অংশগুলোকে সাধারণ ভগ্নাংশ পদ্ধতিতে বণ্টন করার অর্থ হচ্ছে কখনো যোগফল সম্পূর্ণ অংশের সমান, কখনো সম্পূর্ণ অংশের চেয়ে কম এবং কখনো সম্পূর্ণ অংশের চেয়ে বেশি হবে। অন্যদিকে আনুপাতিক ভাগ বণ্টন পদ্ধতিতে নরমালাইজেশন (normalization)  করা হয় এবং তাই শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশসমূহের যোগফল ১ এর চেয়ে কম বা বেশি যা-ই হোক, বাস্তবে সম্পূর্ণ সম্পদই বণ্টিত হয়, অবশিষ্টও থাকে না, ঘাটতিও পড়ে না।
৪:৭ ও ৪:৩৩ আয়াতের তথ্য অনুসারে জানা যায় যে, পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, স্বামী/স্ত্রী এবং ভাই, বোনের জন্য যে নির্ধারিত অংশগুলো উল্লেখ করা হয়েছে সেটা তাদের পারস্পরিক তুলনামূলক অংশ বা শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ। আনুপাতিক ভাগ বণ্টন পদ্ধতিতে বণ্টন করার পর উপস্থিত ওয়ারিসদের শ্রেণিসংখ্যা সাপেক্ষে নির্দিষ্ট শ্রেণির প্রকৃত প্রাপ্য অংশ এবং ঐ শ্রেণির জন্য উল্লেখিত শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ সমানও হতে পারে, অসমানও হতে পারে কিন্তু উভয় অবস্থায় অন্যদের সাথে শ্রেণিগত অনুপাত সমান থাকে।
যখন একজনমাত্র ওয়ারিস থাকে, তখন তার জন্য উল্লেখিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ যাই হোক আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে তার প্রাপ্য অংশের পরিমাণ হয় সম্পূর্ণ। কারণ আনুপাতিক ভগ্নাংশের অর্থই হচ্ছে এক ওয়ারিসের সাথে অন্য ওয়ারিসের অনুপাত বা তুলনামূলক অংশ। অন্য ওয়ারিস না থাকা অবস্থায় তার আনুপাতিক ভগ্নাংশ সম্পূর্ণ অংশে রূপান্তরিত হয় এবং এক্ষেত্রে আনুপাতিক ভাগ বণ্টন পদ্ধতির একই সূত্র প্রযোজ্য।

শ্রেণিগত আনুপাতিক সংখ্যাসমূহঃ
আয়াতসমূহে বিভিন্ন শ্রেণির জন্য যেসব আনুপাতিক ভগ্নাংশ উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হলো: ১/২  , ১/৩  , ২/৩  , ১/৪  , ১/৬  , ১/৮ ।
আনুপাতিক ভগ্নাংশগুলোর হর ২, ৩, ৪, ৬ ও ৮ এর ল.সা.গু হলো: ২৪।
সুতরাং আমরা সকল আনুপাতিক ভগ্নাংশকে সমহরে (হর হিসেবে ২৪ কে নিয়ে) প্রকাশ করলে অনুপাত বা তুলনা স্পষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে সহজ হবে। সেক্ষেত্রে উল্লেখিত আনুপাতিক ভগ্নাংশগুলোর সমহরে প্রকাশিত ভগ্নাংশ নিম্নরূপ হয়:
১/২  = ১২/২৪  , ১/৩  = ৮/২৪  , ২/৩  = ১৬/২৪  , ১/৪  = ৬/২৪  , ১/৬  = ৪/২৪  , ১/৮  = ৩/২৪  ।
ভগ্নাংশগুলোকে সমহরে প্রকাশ করায় সমহরবিশিষ্ট প্রতিটি ভগ্নাংশের লবই হবে নির্দিষ্ট শ্রেণির প্রাপ্য আনুপাতিক সংখ্যা।
সুতরাং ১/২  = ১২,  ১/৩  = ৮,  ২/৩  = ১৬,  ১/৪  = ৬,  ১/৬  = ৪,  ১/৮  = ৩।
(পূর্ণসংখ্যাগুলো হলো প্রতিটি ভগ্নাংশকে সমহর ২৪ দ্বারা গুণ করে প্রাপ্ত পূর্ণ সংখ্যা।)
আনুপাতিক অংশ বণ্টন পদ্ধতির সূত্র প্রয়োগের উদাহরণ
পরিস্থিতি: কোনো মৃত ব্যক্তির তিন কন্যা, পিতা-মাতা ও দুই স্ত্রীর মধ্যে ১০০০ টাকা ভাগ করে দিতে হবে।
সমাধান: সূরা নিসা ৪:১১-১২ আয়াত অনুযায়ী,
তিন কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ২/৩ বা তিনকন্যার শ্রেণিগত আনুপাতিক সংখ্যা = ১৬
পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১/৬ বা পিতার শ্রেণিগত আনুপাতিক সংখ্যা = ৪
মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১/৬  বা মাতার শ্রেণিগত আনুপাতিক সংখ্যা = ৪
স্ত্রীদের আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১/৮ বা স্ত্রীদের শ্রেণিগত আনুপাতিক সংখ্যা = ৩
আনুপাতিক ভগ্নাংশসমূহের সমষ্টি = ৯/৮  বা আনুপাতিক সংখ্যাসমূহের সমষ্টি = ২৭

সুতরাং উক্ত পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট শ্রেণির প্রাপ্য সম্পদ নির্ণয়ের সূত্র প্রয়োগ নিম্নে দেখানো হলো:
তিন কন্যা পরস্পর সমান হারে পাবে। সুতরাং প্রত্যেক কন্যা পাবে ৫৯২.৫৯/৩  = ১৯৭.৫৩
স্ত্রীরা পরস্পর সমান হারে পাবে। সুতরাং প্রত্যেক স্ত্রী পাবে ১১১.১১/২  = ৫৫.৫৫
অতএব,
প্রত্যেক কন্যা পাবে ১৯৭.৫৩ টাকা, পিতা পাবে ১৪৮.১১ টাকা, মাতা পাবে ১৪৮.১১ টাকা, প্রত্যেক স্ত্রী পাবে ৫৫.৫৫ টাকা।

দ্বিতীয় পদ্ধতিঃ

উল্লেখিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ থেকে নির্ণিত শ্রেণিগত আনুপাতিক প্রয়োগ করে দেখানো সূত্রানুসারে,
তিন কন্যা পরস্পর সমান হারে পাবে। সুতরাং প্রত্যেক কন্যা পাবে ৫৯২.৫৯/৩  = ১৯৭.৫৩
স্ত্রীরা পরস্পর সমান হারে পাবে। সুতরাং প্রত্যেক স্ত্রী পাবে ১১১.১১/২  = ৫৫.৫৫
অতএব,
প্রত্যেক কন্যা পাবে ১৯৭.৫৩ টাকা, পিতা পাবে ১৪৮.১১ টাকা, মাতা পাবে ১৪৮.১১ টাকা, প্রত্যেক স্ত্রী পাবে ৫৫.৫৫ টাকা।
আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি অবলম্বনের যৌক্তিকতা
কুরআনে যে ওয়ারিস বা যে শ্রেণির ওয়ারিসের জন্য (‘লাহু/ ...’ শব্দের পর) যে প্রাপ্য অংশসমূহ (২/৩ , ১/২ , ১/৬ , ১/৩ , ১/৪   , ১/৮   ) উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ। আয়াতসমূহের বক্তব্য বিশ্লেষণ এবং তাতে প্রদত্ত বণ্টন বিধির বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্টভাবে বুঝা যায়। আয়াতসমূহের বর্ণিত ভগ্নাংশগুলোকে শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ হিসেবে সাব্যস্ত করে আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি অবলম্বনের যৌক্তিকতা সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো।

পুত্র-কন্যা থাকা বা না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতা ও স্বামী/স্ত্রীর প্রাপ্য অংশ যেভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে তা নিম্নরূপ:
পুত্র-কন্যা থাকলে পিতা-মাতা পাবে ১/৬   ।
পুত্র-কন্যা না থাকলে মাতা পাবে ১/৩ ।
পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই বোন থাকলে মাতা পাবে ১/৬   ।
পুত্র-কন্যা থাকলে স্বামী পাবে ১/৪ ।
পুত্র-কন্যা না থাকলে স্বামী পাবে ১/২ ।
পুত্র-কন্যা থাকলে স্ত্রী পাবে ১/৪ ।
পুত্র-কন্যা না থাকলে স্ত্রী পাবে ১/৮ ।
কোনো ওয়ারিসের প্রাপ্য অংশের উপর পুত্র-কন্যা বা অন্য কোন ওয়ারিসের উপস্থিতি অনুপস্থিতির প্রভাব সম্পর্কিত কতিপয় বিশেষ তথ্য:
১. পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলেও স্বামী বা স্ত্রীর জন্য হ্রাসকৃত বা বর্ধিত অংশ উল্লেখিত হয়নি।
২. স্বামী বা স্ত্রী থাকা বা না থাকা সাপেক্ষে কারো জন্য হ্রাসকৃত বা বর্ধিত অংশ উল্লেখিত হয়নি।
৩. স্বামী বা স্ত্রীর জন্য পুত্র-কন্যার সাথে বা পুত্র-কন্যা ছাড়া পিতা-মাতা থাকা বা না থাকা, পুত্র-কন্যার সাথে বা পুত্র-কন্যা ছাড়া ভাই-বোন থাকা বা না থাকা ইত্যাদি বিবেচনা করে কোন হ্রাসকৃত বা বর্ধিত অংশ উল্লেখিত হয়নি।
৪. যখন পুত্র-কন্যা থাকে না এবং ভাই বোন ওয়ারিস হয় তখন পুত্র-কন্যা থাকলে তাদের মধ্যে (তথা পুত্র-কন্যার মধ্যে) যেমন এক পুরুষের জন্য দুই নারীর অংশের সমান বলা হয়েছে তেমনি ভাই বোনের মধ্যেও এক পুরুষের জন্য দুই নারীর অংশের সমান বলা হয়েছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে পুত্র-কন্যার মধ্যে প্রযোজ্য সূত্র ভাই বোনের মধ্যে প্রযোজ্য হবে।
৫. ৪:১২ আয়াতে ভাইবোনের জন্য প্রদত্ত অংশে তারা সমান অংশীদার হবে, সেখানে এক পুরুষের জন্য দুই নারীর অংশের সমান তা প্রযোজ্য হবে না। কারণ, ৪:১২ আয়াতে ভাই-বোন পায় সন্তান থাকা অবস্থায় ও পিতা/মাতা না থাকার কারণে এবং সন্তান থাকা অবস্থায় পিতা-মাতা যেমন পরস্পর কম বেশি পায় না, তেমনি সন্তান থাকা অবস্থায় ভাই-বোন পরস্পর কম বেশি পায় না।
উপরিউক্ত তথ্য থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, কুরআনে বিভিন্ন ওয়ারিসের মধ্য থেকে কারো কারো থাকা বা না থাকা সাপেক্ষে অন্য কারো কারো জন্য হ্রাসকৃত বা বর্ধিত ভগ্নাংশ উল্লেখিত হয়েছে, আবার কারো কারো থাকা বা না থাকা সাপেক্ষে অন্য কারো কারো জন্য হ্রাসকৃত বা বর্ধিত ভগ্নাংশ উল্লেখিত হয়নি। যাদের থাকা বা না থাকা সাপেক্ষে অন্য কারো কারো জন্য হ্রাসকৃত বা বর্ধিত ভগ্নাংশ উল্লেখিত হয়নি, বাস্তবে তাদের কারো কারো না থাকার কারণে উল্লেখিত ভগ্নাংশগুলোর যোগফল ১ এর চেয়ে কম হওয়া একান্তই স্বাভাবিক বিষয়। আর বাস্তবে দেখা যায় যে, তাদের সবার বর্তমান থাকার কারণে উল্লেখিত ভগ্নাংশগুলোর যোগফল বিপরীতক্রমে ১ এর চেয়ে বেশিও হয়ে থাকে।

যোগফল ১ এর চেয়ে বেশি হওয়া অনেকের কাছে আপত্তিকর মনে হয়। অথচ যোগফল ১ এর চেয়ে বেশি হওয়া আপত্তিকর হলে, ১ এর চেয়ে কম হওয়াও আপত্তিকর হওয়ার কথা। বস্তুত আনুপাতিক ভগ্নাংশগুলোর যোগফল ১ এর চেয়ে কম বা ১ এর চেয়ে বেশি হওয়া উভয় অবস্থার কোনোটি আপত্তিকর নয়। কারণ আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে আনুপাতিক ভগ্নাংশগুলোর যোগফল যাই হোক না কেন, সব অবস্থায় সম্পূর্ণ সম্পদ জীবিত থাকা নির্দিষ্ট ওয়ারিসদের মধ্যে পূর্ণভাবে বণ্টিত হয়ে যায়, কিছুই ঘাটতি পড়ে না এবং কিছুই অবশিষ্ট থাকে না এবং কেউ তার প্রাপ্য অংশ থেকে কমও পায় না, বেশিও পায় না।
আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে বণ্টন করার পর প্রত্যেকের আনুপাতিক ভগ্নাংশ একই থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন প্রকৃত প্রাপ্য অংশ হয়। এর কারণ, আনুপাতিক ভগ্নাংশ এবং ওয়ারিসদের বিভিন্ন শ্রেণির উপস্থিতি সাপেক্ষে সম্পূর্ণ সম্পদ থেকে প্রাপ্য অংশ হুবহু একই ভগ্নাংশ হয় না। কিন্তু এর মানে এ নয় যে, আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে কাউকে তার জন্য নির্দিষ্ট অংশের চেয়ে কম বা বেশি দেয়া হয়। বরং সম্পূর্ণ সম্পদ থেকে প্রকৃত প্রাপ্য অংশ যাই হোক না কেন সেটাই সম্পূর্ণ সম্পদ থেকে প্রাপ্য আনুপাতিক ভগ্নাংশ হিসেবে যথাস্থানে থাকে।

যেমন, একটিমাত্র কন্যার প্রাপ্য আনুপাতিক ভগ্নাংশ হলো ১/২   এবং যখন সে সন্তান হিসেবে একমাত্র সন্তান শুধু এতটুকু নয়, বরং তার সাথে অন্য কোনো শ্রেণির কোনো ওয়ারিস থাকে না, তখন আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে তার প্রাপ্য অংশ হলো ১ তথা সম্পূর্ণ। কারণ তার সাথে অন্য কোনো ওয়ারিস উপস্থিত না থাকলে তাকে নিম্নোক্ত গাণিতিক উপায়ে প্রকাশ করতে হয়।
একটিমাত্র কন্যা + শূন্য ওয়ারিস (অর্থাৎ অন্য কোনো ওয়ারিস জীবিত নেই)
= ১/২   + ০
= ১/২
এখন এরূপ পরিস্থিতিতে আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি অনুযায়ী,
কন্যাটির প্রাপ্য অংশ = ১/২    ১/২  = ১ (সম্পূর্ণ)
আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতির যৌক্তিকতা বোঝার জন্য উল্লেখ্য যে, যোগফল ১ এর চেয়ে কম বা বেশি হওয়া গাণিতিকভাবে একই ধরনের সমস্যা। কারণ একই পদ্ধতি তথা আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতির প্রয়োগের মাধ্যমেই উভয় গাণিতিক বণ্টন সমস্যার সমাধান করা হয়।
কেউ কেউ মনে করেন যে, যোগফল ১ এর চেয়ে কম হওয়া বড় সমস্যা নয়, তা কাউকে না কাউকে দেয়া যাবে। কিন্তু যোগফল ১ এর চেয়ে বেশি হওয়া বড় সমস্যা, কারণ সে অবস্থায় প্রত্যেককে তার প্রাপ্য অংশ দেয়া যায় না। নিম্নে এ প্রসঙ্গে পূর্বের উদাহরণটি আবার দেয়া হলো:
তিন কন্যা + পিতা + মাতা + স্ত্রী।
২/৩   + ১/৬  + ১/৬  + ১/৮
= ১৬/২৪  +  ৪/২৪  + ৪/২৪  + ৩/২৪
= ২৭/২৪

দেখা যাচ্ছে, উদাহরণটিতে যোগফল ১ এর চেয়ে বেশি হয়। এ থেকে স্পষ্ট যে, আয়াতগুলোতে বর্ণিত অংশকে শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ হিসেবেই নির্ধারণ করা হয়েছে তথা আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে বণ্টন করতে হবে। আর এটা স্বত:সিদ্ধ যে, ভগ্নাংশগুলোর যোগফল ১ এর বেশি হলে যদি আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, তাহলে যখন ভগ্নাংশগুলোর যোগফল ১ এর চেয়ে কম হবে তখনো আনুপাতিক পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে তথা আনুপাতিক হারে নির্দিষ্ট ওয়ারিসদেরকেই তা দিতে হবে, সম্পদের একটি অংশকে অবশিষ্ট অংশ হিসেবে দাবি করে তা অন্য কাউকে দেয়া যাবে না। কারণ অনুপাত পদ্ধতি অবলম্বন করলে উভয় ক্ষেত্রে করতে হবে।
কেউ কেউ প্রস্তাব করেন যে, প্রথমে স্ত্রীর জন্য উল্লেখিত ভগ্নাংশ দেয়া হবে, তারপর বাকি অংশ তিন কন্যা ও পিতা-মাতার মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে। কিন্তু এ প্রস্তাবনা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এভাবে বণ্টন করলে আয়াতের নির্দেশনা লংঘিত হবে, এর মাধ্যমে যেমন আয়াতে বর্ণিত অংশ বণ্টিত হবে না, তেমনি প্রত্যেকের আনুপাতিক ভগ্নাংশও ঠিক থাকবে না।
প্রথমে স্বামী/স্ত্রীর জন্য উল্লেখিত ভগ্নাংশ দেয়ার পরে পুত্র-কন্যা বা পিতা-মাতার মধ্যে তাদের জন্য উল্লেখিত ভগ্নাংশ অনুযায়ী বণ্টন করার প্রস্তাব প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, ৪:১২ আয়াত অনুযায়ী কালালাহর সম্পদ বন্টন প্রসঙ্গে প্রদত্ত ভাই বোনের জন্য উল্লেখিত ভগ্নাংশও কি স্বামী/স্ত্রীর জন্য উল্লেখিত ভগ্নাংশ বণ্টনের পরে দেয়া হবে, নাকি তাদের সাথে সমস্ত সম্পদে এ বণ্টন কার্যকর হবে? আয়াতের বর্ণনারীতিতে তাদের প্রাপ্য অংশকে স্বামী/স্ত্রীর অংশ দেয়ার পর অবশিষ্ট সম্পদে কার্যকর সাব্যস্ত করার অবকাশ নেই। সুতরাং প্রথমে স্বামী/স্ত্রীর অংশ দিয়ে দেয়ার প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রাপ্য ভগ্নাংশগুলোর যোগফল ১ এর চেয়ে বেশি না হয়ে বরং যে অবস্থায় যোগফল ১ এর চেয়ে কম হয়, আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে বণ্টন না করলে সে অবস্থায় একটা অংশ অবণ্টিত থেকে যাওয়ার অবকাশ তৈরি হয়। যেমন নিম্নের উদাহরণটি লক্ষ করা যেতে পারে।
তিন কন্যা + স্ত্রী।
= ২/৩  + ১/৮
= ১৬/২৪  + ৩/২৪
= ১৯/২৪ ।
আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে বণ্টন না করলে এ অবস্থায় অবণ্টিত থাকার মতো অংশ হলো ৫/২৪ ।
উত্তরাধিকারীদের জন্য উল্লেখিত ভগ্নাংশগুলোকে তাদের শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ সাব্যস্ত করার বিষয়ে ৪:১১ আয়াতের বর্ণনারীতিতে তুলনামূলক অবস্থা বা প্রাপ্য অংশ লক্ষণীয়। ৪:১১ আয়াতের শুরুতে পুত্র-কন্যার মধ্যে উত্তরাধিকার বণ্টন বিষয়ে ‘এক পুরুষের অংশ দুই নারীর অংশের সমান’ বলার মাধ্যমে পুত্র-কন্যার মধ্যে পারস্পরিক অনুপাত দেয়া হয়েছে (পুত্র:কন্যা = ২:১)। আবার ৪:১১ আয়াতের শেষাংশে মৃতের পিতা ও পুত্রের মধ্যকার প্রাপ্য নির্ধারণে তুলনামূলক অবস্থান সম্পর্কিত একটি প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়েছে। এ থেকেও বুঝা যায় যে, পুত্র কন্যা, পিতা মাতা, স্বামী বা স্ত্রী এবং ভাই, বোনের জন্য উল্লেখিত অংশগুলো হচ্ছে তাদের শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ। 
উত্তরাধিকার সম্পর্কিত আয়াতসমূহে উল্লেখিত ভগ্নাংশসমূহের তুলনামূলক পার্থক্য থেকেও আনুপাতিক বন্টন পদ্ধতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। যেমন সন্তান না থাকলে স্বামী পাবে ১/২ , স্ত্রী পাবে ১/৪  এবং সন্তান থাকলে স্বামী ও স্ত্রীর অংশ অর্ধেক হ্রাস পেয়ে স্বামী পাবে ১/৪ , স্ত্রী পাবে ১/৮ । উভয় অবস্থায় স্বামীর অংশ স্ত্রীর অংশের দ্বিগুণ। একটিমাত্র কন্যা সন্তান থাকলে সে পাবে ১/২ , পিতা-মাতা পাবে ১/৩ , স্ত্রী পাবে ১/৮ । অর্থাৎ স্ত্রীর তুলনায় কন্যা ৪ গুণ বেশি পাবে। অন্যদিকে তিনটি কন্যা সন্তান হলে তারা পাবে ২/৩ , পিতা-মাতা পাবে ১/৩ , স্ত্রী পাবে ১/৮ । অর্থাৎ কন্যা শ্রেণি পিতা-মাতা শ্রেণির দ্বিগুণ পাবে কিন্তু কন্যা শ্রেণির প্রাপ্য ২/৩  হওয়া সত্ত্বেও তৃতীয় শ্রেণিতে থাকা স্ত্রী তখনো ১/৮   পাবে তথা পিতা-মাতার অংশ এবং স্ত্রীর অংশের পারস্পরিক তুলনামূলক অবস্থান পূর্বের মতো একই থাকে। যারা এ উচ্চতর গাণিতিক হিসাব বুঝতে সক্ষম নয় বা ইচ্ছুক নয় বা বুঝলেও তা প্রকাশে অনিচ্ছুক, তারাই কুরআনের উত্তরাধিকার বিধানে গাণিতিক ভুল রয়েছে বলে মনে করে বা দাবি করে।
এ প্রসঙ্গে পরিশেষে বলা যায় যে, কুরআনে বর্ণিত উত্তরাধিকারের অংশগুলো হলো শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ এবং তা আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে বণ্টন করতে হবে। এ বিষয়টি বণ্টন পদ্ধতির শর্তসমূহ এবং আনুপাতিক বণ্টনের হিসাব সম্পর্কে গাণিতিক ধারণা থাকলে সহজেই অনুধাবন করা যেতে পারে।
কুরআন গবেষকদের কর্তৃক আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতির উপলব্ধি উপস্থাপন
এ গ্রন্থের সংকলক ছাড়াও অন্য যারা উত্তরাধিকার বণ্টনের ক্ষেত্রে আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি অবলম্বনের নীতিগত অবস্থানে পৌঁছেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন QURAN A Reformist Translation গ্রন্থের প্রণেতা এদিপ ইউকসেল এবং ‘কুরআনে বর্ণিত ফারায়েজ ব্যবস্থা’ গ্রন্থের প্রণেতা প্রফেসর ডক্টর মো: কামরুল আহসান।
১.
এদিপ ইউকসেল রচিত কুরআনের অনুবাদ গ্রন্থ থেকে আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতির আলোচনা সম্বলিত সূরা নিসার ১১ ও ১২ আয়াতের Endnotes থেকে নিম্নে উদ্ধৃতি দেয়া হলো:
Endnotes: Surah An Nisa
[[004:011 In this and following verses and from 2:180 we learn that priority is given to the will in the distribution of inheritance. According to these verses, first the debt is paid and the distribution according to the will is fulfilled. This Quranic rule allows the testator and the testatrix to adjust their will depending on specific conditions and needs of the inheritors or other personal issues. For instance, one may leave more inheritance to a daughter whom might be more in need than the others might. The testator or the testatrix might leave more to someone who is sick or handicapped. The Quran, by giving precedence to the will over the default distribution provides flexibility and thus accommodates special circumstances. Unfortunately, unable to comprehend the wisdom behind this divine arrangement, the followers of hadith and sunna have abrogated these verses via hadith fabrications and sectarian rules and thereby have deprived the so-called Muslims from God's mercy.
004:012. After paying the debt and distributing the shares according to the will, the inheritance will be distributed if the diseased had a mother, father, or wife, and the rest will be distributed to men and women according to the instructed ratio. It is important to remember that the ratio of shares instructed by the Quran to each other is as important as their ratio to the whole. In brief, the fractions are compared both to the whole and to each other. A deceased person might leave behind hundreds of combinations of relatives, father or no father, mother or no mother, son or no son, one son or more sons, daughter or no daughter, one daughter or more daughters, brother or no brother, one brother or more brothers, sister or no sister, one sister or more sisters, and numerous combinations among them. If the Quran suggested the fractions as merely their ratio compared to the whole inheritance, since for each combination of inheritors the ratios too would need to be changed, we would need hundreds of verses detailing the ratio for each combination. However, when we comprehend that the ratio in suggested distributions also reflect the amount of inheritance in proportion to each other, the verses about inheritance can easily be understood and implemented.
For instance, let us assume that after deducting the debt and other shares, a man left a 50 thousand dollar inheritance to his wife and father without specially allocating the shares. Their shares should be 1/4th and 1/6th, respectively. Thus, the formula would be (1/4)+(1/6)=50,000.
If we find the common denominator, then we see the ratio of inheritance as much clearer. When we take the common denominator, the numerator start to make sense in comparison to the share of each inheritor and to the inheritance: (3/12)+(2/12)=50,000. That means, the wife receives $30,000 and the father receives $20,000 of the inheritance.
In sum, to learn the default shares of inheritors the fractions indicating the shares are added up and equated to the inheritance. Let's assume that we are asked to distribute 19 gold pieces among two people; one will receive 1/5th and the other 1/3rd
(k1 + k2 + ... + kn) * x = t
pn = kn * x
k1 = 1/5
k2 = 1/3
(1/3 + 1/5) * x = 19  x = 19 * 15/ 8
p1 = (1/5) * 19 * 15/ 8  p1= 7 + 1/8
p2 = (1/3) * 19 * 15/ 8  p2= 11 + 7/8
The Old Testament does deprive daughters of inheritance from their parents and favors the first born against other children. Under the patriarchs, the property of a diseased father was divided among the sons of his legal wives and their concubines would not get a share (Genesis 21:10; 24:36; 25:5). The Mosaic law made specific regulations regarding the distribution of real property, giving the eldest son a larger portion than the rest. Deuteronomy 21:17; Numbers 27:8; 36:6; 27:9-11.]]
Reference: Edip Yuksel, Layth Saleh al-Shaiban & Martha Schulte-Nafeh. QURAN A Reformist Translation, US: brainbowpress, 2010, Page No. 102-103
২.
প্রফেসর ডক্টর মো: কামরুল আহসান (সাবেক ডীন, বুয়েট) রচিত ‘কুরআনে বর্ণিত ফারায়েজ ব্যবস্থা’ বই থেকে আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি সম্পর্কে উপস্থাপনার বিশেষ কিছু অংশ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওয়ারিশদের অংশের যোগফল ১ (এক) এর কম অথবা বেশি। তাই উপরিউক্ত আলোচনা ও বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে অনুপাতভিত্তিক বণ্টনের হিসাব পদ্ধতি হবে ফারায়েজের জন্য যথাযথ। (পৃষ্ঠা:৮৩)
কোন একজন অংশীদারের সম্পূর্ণ ত্যাজ্য সম্পত্তিতে অথবা কোন একটা বিশেষ সম্পত্তিতে অংশ বের করার জন্য প্রথমে সব ওয়ারিশদের অনুপাতের যোগফল বের করতে হবে। অতঃপর যোগফল দিয়ে যে সম্পত্তির অংশের পরিমাণ বের করা দরকার তাকে ভাগ করতে হবে। ভাগফলকে যে ওয়ারিশের জন্য সম্পত্তির অংশের পরিমাণ বের করতে হবে তার অনুপাত দিয়ে গুণ করতে হবে। তবেই সেই ওয়ারিশের অংশের পরিমাণ জানা যাবে। (পৃষ্ঠা:৮৫)
বণ্টনযোগ্য সম্পত্তিকে অনুপাতসমূহের যোগফল দিয়ে সরাসরি ভাগ করে অংশীদারের অনুপাত দ্বারা গুণ করলেই অংশীদারের পাওনা বের হবে। অনুপাতের যোগফল ১ (এক) এর কম বা বেশি দেখার প্রয়োজন নেই। (পৃষ্ঠা:৮২)
কুরআনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ওয়ারিশদের যে অংশ দেয়া আছে তা একজনের সাথে অন্যান্য ওয়ারিশদের তুলনার জন্য বণ্টনের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। তবে কেবলমাত্র একজন ওয়ারিশ হলে বণ্টনের জন্য তার তুলনামূলক অংশের প্রয়োজন নেই। কেননা, কেবলমাত্র একজন ওয়ারিশ হলে সে ১০০% বণ্টনযোগ্য ত্যাজ্য সম্পত্তির মালিক। তবে উদাহরণগুলোতে বর্ণিত অংশ উল্লেখ করার পর Normalize করে একমাত্র ওয়ারিশের অংশ দেখানো হয়েছে Confusion এড়ানোর জন্য। তবে ফলাফল একই। (পৃষ্ঠা:১১০)
অর্থাৎ কুরআনে উল্লেখিত যে আট জন ওয়ারিশ হিসেবে তালিকাভুক্ত (মাতা, পিতা, ছেলে, মেয়ে, স্বামী, স্ত্রী, ভাই ও বোন) তাদের মধ্যে যদি শুধুমাত্র একজন জীবিত থাকে তাহলে সে বণ্টনযোগ্য সমস্ত সম্পদের মালিক হবে। (পৃষ্ঠা:১১৪)
উদ্ধৃতি: মো: কামরুল আহসান, কুরআনে বর্ণিত ফারায়েজ ব্যবস্থা, প্রকাশনা: মাসুদা আহসান, জানুয়ারি ২০২০
অধ্যায় ৭ : পুত্র-কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ
৪:১১ আয়াতে প্রথমেই পুত্র-কন্যার আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করা হয়েছে। পুত্র-কন্যার আনুপাতিক অংশ অনুধাবনের জন্য প্রথমে সংশ্লিষ্ট আয়াতটিতে ব্যবহৃত কিছু শব্দের প্রয়োগগত তাৎপর্য জেনে নেয়া প্রয়োজন। তাই নিম্নে শব্দগুলো সম্পর্কে ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণাত্মক তথ্য উল্লেখপূর্বক পুত্র-কন্যার আনুপাতিক অংশ নির্ণয়ের নীতিমালা আলোচনা করা হলো:
আওলাদ ও ওয়ালাদ শব্দের অর্থ ও বিশ্লেষণাত্মক তথ্য
এ বিষয়ে প্রথমে পুত্র-কন্যাকে বুঝানোর জন্য আয়াতটিতে ব্যবহৃত ‘আওলাদ’ শব্দটির অর্থ সম্পর্কে আলোচনা করা প্রয়োজন। ‘আওলাদ’ শব্দটির শব্দমূল হলো: ‘ওয়াও লাম দাল’। শব্দটি ‘ওয়ালাদ’ শব্দের বহুবচন। ওয়ালাদ শব্দের অর্থ সন্তান। বাংলা ভাষায় ‘সন্তান’ শব্দটি দ্বারা যেমন পুত্রকেও বুঝায়, কন্যাকেও বুঝায়, আরবি ‘ওয়ালাদ’ শব্দটিও অনুরূপ।
উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি বুঝার জন্য আওলাদ, ওয়ালাদ এবং অনুরূপ কিছু শব্দের একবচন ও বহুবচন ব্যবহারের কারণ এবং কোন ক্ষেত্রে এর দ্বারা একজন, দুইজন বা বহুজনের অন্তর্ভুক্তি রয়েছে তা জানা প্রয়োজন। তাই নিম্নে আরবি ভাষারীতিতে বচনের ব্যবহার উল্লেখ করা হলো।
একবচনের ব্যবহার:
১. সুনির্দিষ্টভাবে একবচন বুঝানোর জন্য একবচন ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে যখন দ্বিবচন বা বহুবচনের সাথে তুলনামূলক অবস্থায় একবচন ব্যবহৃত হয় তখন এর দ্বারা সুনির্দিষ্টভাবে একবচন বুঝানো হয়।
২. সাধারণভাবে এক বা একাধিক বুঝানোর জন্য একবচন ব্যবহৃত হয়।
৩. একটি শ্রেণিভুক্ত ‘প্রত্যেক’ বা ‘কোনো’ বুঝানোর জন্য একবচন ব্যবহৃত হয়।
দ্বিবচনের ব্যবহার:
১. সুনির্দিষ্টভাবে দ্বিবচন বুঝানোর জন্য দ্বিবচন ব্যবহৃত হয়।
বহুবচনের ব্যবহার:
১. সুনির্দিষ্টভাবে বহুবচন বুঝানোর জন্য বহুবচন ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে যখন একবচন বা দ্বিবচনের সাথে তুলনামূলক অবস্থায় বহুবচন ব্যবহৃত হয় তখন এর দ্বারা সুনির্দিষ্টভাবে বহুবচন বুঝানো হয়।
২. যখন প্রসঙ্গ অনুসারে বহুবচনকে প্রাথমিক গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন হয়, যদিও বাস্তবসম্মত কারণে কখনো ঐ বহুবচনটির বদল (প্রতিনিধিত্বকারী) হিসেবে একবচন বা দ্বিবচনের অবকাশ থাকে, তখন বহুবচন ব্যবহৃত হয়।
আরবি ভাষারীতিতে বচনের ব্যবহার বিধি অনুসারে ৪:১১ আয়াতে প্রথমে ‘আওলাদ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ এর অব্যবহিত প্রসঙ্গ হচ্ছে, একটি পুত্র ও দুইটি কন্যার তুলনামূলক অবস্থা তথা বহুবচন। কিন্তু পরবর্তীতে ৪:১১, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে প্রতিবার ‘ওয়ালাদ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
৪:১১ আয়াতে পুত্র না থাকা অবস্থায় এক বা একাধিক কন্যাকে ‘আওলাদ’ শব্দের প্রতিনিধিত্বকারী অবস্থানে উপস্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বুঝা যায় যে, পুংলিঙ্গের বহুবচন ব্যবহৃত হলেও বাস্তবসম্মত কারণে কখনো কখনো এক বা একাধিক নারী সে শব্দের প্রতিনিধিত্বকারী হতে পারে।
দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যার অংশ বর্ণনার ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যার অংশ বর্ণনার জন্য যে আরবি বাক্যাংশ ব্যবহৃত হয়েছে তা হলো ফাওক্বাছনাতাইনি। ফাওক্বাছনাতাইনি বাক্যাংশে দুইটি শব্দ রয়েছে, ১. ফাওক্বা ২. ইছনাতাইনি। ফাওক্বা শব্দের প্রধান দুটি অর্থ হলো, ১. উপরে (above, over), ২. সমেত তদুর্ধ্ব, অন্তত বা অন্যুন (across, above from or at least)। ইছনাতাইনি শব্দের অর্থ হলো ‘দুইজন’। ৪:১১ আয়াতের পূর্বাপর প্রসঙ্গ অনুসারে প্রতীয়মান হয় যে, এতে ফাওক্বা শব্দটি দ্বিতীয় অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
৪:১১ আয়াতে কন্যাদের অংশ বর্ণনার ক্ষেত্রে প্রথমে দুইয়ের বেশি বা দুই (ফাওক্বাছনাতাইনি) কন্যার অংশ বর্ণনা করা হয়েছে, তারপর একটিমাত্র (ওয়াহিদাতান) কন্যার অংশ বর্ণনা করা হয়েছে। আয়াতটিতে কন্যাদের সংখ্যা বর্ণনার পদ্ধতি হলো ঊর্ধ্বক্রম থেকে নিম্নক্রমে। ভাষারীতির উৎকর্ষ ও সংক্ষেপায়নের জন্য ফাওক্বাছনাতাইনি শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, যার বিস্তৃত অর্থ হলো দুইয়ের বেশি কন্যা বা অন্তত দুই কন্যা। অর্থাৎ শব্দটিতে বহুবচনকে প্রাথমিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং দ্বিবচনের প্রসঙ্গকেও অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়েছে। এরূপ ক্ষেত্রে পূর্ণ বাক্যের মূল প্যাটার্ন হিসেবে বহুবচন ব্যবহৃত হয়েছে।
পুত্র-কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ সম্পর্কিত মূল ধারাসমূহ
৪:১১ আয়াতটিতে পুত্র-কন্যার অংশ বর্ণনায় তিনটি ধারা প্রদান করা হয়েছে। যথা:
১. এক পুত্রের জন্য দুই কন্যার অংশের অনুরূপ।
২. পুত্র নেই, শুধু কন্যারা আছে, যাদের সংখ্যা দুই বা দুইয়ের বেশি তাহলে তাদের সামষ্টিক আনুপাতিক ভগ্নাংশ হলো ২/৩ ।
৩. পুত্র নেই, শুধু একটি কন্যা আছে, তাহলে তার আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/২ ।
প্রথম ধারাটির তাৎপর্য হলো দুই কন্যা একসাথে যে আনুপাতিক ভগ্নাংশ পায় তাদের সেই সামষ্টিক আনুপাতিক ভগ্নাংশই হবে এক পুত্রের আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
দ্বিতীয় ধারাটির তাৎপর্য হলো পুত্র না থাকা অবস্থায় শুধু দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যা থাকলে তারা একসাথে পাবে তথা তাদের সামষ্টিক আনুপাতিক ভগ্নাংশ ২/৩ ।
তথ্য ও সূত্র বিশ্লেষণের ভিত্তিতে নির্ণেয় পুত্র-কন্যার আনুপাতিক অংশসমূহ
প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে যে, আয়াতটিতে নিম্নোক্ত অবস্থায় পুত্র-কন্যাদের জন্য কোনো নির্দিষ্ট আনুপাতিক ভগ্নাংশ উল্লেখ করা হয়নি:
১. যখন কন্যা নেই কিন্তু এক বা একাধিক পুত্র আছে, তাদের আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
২. যখন পুত্র ও কন্যা উভয়ে থাকে তখন তাদের সামষ্টিক আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
৩. একটিমাত্র পুত্র ও একটিমাত্র কন্যা থাকলে পুত্র কন্যার মধ্যকার আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
৪. একাধিক পুত্র ও একটি কন্যা থাকলে তাদের মধ্যকার আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে কারো আনুপাতিক ভগ্নাংশ অনির্ধারিত থাকতে পারে না এবং তাই আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন যে, প্রত্যেক পুরুষ ও নারী উত্তরাধিকারী নির্ধারিত হারে প্রাপ্য অংশ পাবে (৪:৭)।
সুতরাং উপরের চারটি সমস্যায় অবশ্যই আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারিত রয়েছে। তবে তা তথ্য ও সূত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে নির্ণয় করতে হবে।
এক পুত্রের জন্য দুই কন্যার অংশের অনুরূপ তথ্যটির তাৎপর্য হলো একটি কন্যাকে দুইটি কন্যার অনুরূপ হিসেবে ধরে নিয়ে সেভাবে আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ণয় করতে হবে। যখন পুত্র-কন্যা একসাথে রয়েছে এবং যখন শুধু পুত্র বা পুত্ররা রয়েছে উভয় অবস্থায় সূত্রটি প্রযোজ্য হবে।
পুত্র-কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ণয়ের সূত্রটি ব্যবহার করে নিম্নে সমস্যাগুলোর সমাধান করা হলো:
(এক) যখন কন্যা নেই, তখন এক বা একাধিক পুত্র থাকলে তাকে বা তাদেরকে দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যার মতো হিসেবে ধরতে হবে। যেহেতু দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ হলো ২/৩ । সুতরাং কন্যা না থাকা অবস্থায় এক বা একাধিক পুত্র থাকলে তাদের আনুপাতিক ভগ্নাংশ ২/৩ ।
(দুই) যখন পুত্র ও কন্যা উভয়ে আছে তখন পুত্রকে দুই কন্যার মতো হিসেবে ধরতে হবে। যেহেতু দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ হলো ২/৩ । সুতরাং যখন পুত্র ও কন্যা উভয়ে থাকে তখন তাদের সামষ্টিক আনুপাতিক ভগ্নাংশ ২/৩ । তারপর পুত্র কন্যার মধ্যে এই ২/৩  অংশকে এভাবে বণ্টন করতে হবে যে, এক পুত্রকে দুই কন্যার মতো হিসেবে ধরে কন্যাদের সংখ্যা যোগ করে প্রত্যেক কন্যা এক ভাগ এবং প্রত্যেক পুত্র দুই ভাগ পাবে। যেমন এক পুত্র ও দুই কন্যা থাকলে নিম্নোক্তভাবে হিসেব করতে হবে:
এক পুত্র = দুই কন্যা
দুই কন্যা = দুই কন্যা
সুতরাং মোট চার কন্যা হিসেবে ধরে তাদের প্রাপ্য অংশকে চারভাগ করতে হবে। তা থেকে প্রত্যেক কন্যা এক ভাগ পাবে এবং পুত্রটি দুই ভাগ পাবে।
(তিন) একটিমাত্র পুত্র ও একটিমাত্র কন্যা থাকলে পুত্রটিকে দুইটি কন্যার মতো বিবেচনা করতে হবে। যেহেতু দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ হলো ২/৩ । তাই একটিমাত্র পুত্র ও একটিমাত্র কন্যা থাকলে তাদের সামষ্টিক আনুপাতিক ভগ্নাংশ ২/৩ । তারপর পুত্র কন্যার মধ্যে এই ২/৩  অংশকে এভাবে বণ্টন করতে হবে যে, এক পুত্রকে দুই কন্যার মতো হিসেবে ধরতে হবে। সুতরাং তাদের প্রাপ্য অংশকে তিন ভাগ করতে হবে। তা থেকে কন্যাটি এক ভাগ এবং পুত্রটি দুই ভাগ পাবে।
(চার) একাধিক পুত্র ও একটি কন্যা থাকলে প্রত্যেক পুত্রকে দুইটি কন্যার মতো হিসেবে ধরতে হবে। যেহেতু দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ ২/৩ । তাই একাধিক পুত্র ও একটি কন্যা থাকলে তাদের সামষ্টিক আনুপাতিক ভগ্নাংশ ২/৩ । তারপর পুত্র কন্যার মধ্যে এই  ২/৩  অংশকে এভাবে বণ্টন করতে হবে যে, প্রত্যেক পুত্রকে দুই কন্যার মতো হিসেবে ধরতে হবে এবং সেই সাথে কন্যাটিকেও বিবেচনা করা হবে। এভাবে হিসেব করা কন্যা সংখ্যার যোগফল দিয়ে তাদের প্রাপ্য অংশকে ভাগ করা হবে। তা থেকে কন্যাটি এক ভাগ পাবে এবং প্রত্যেক পুত্র দুই ভাগ করে পাবে।
পুত্র না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র কন্যা থাকলে তার আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে  ১/২ । এটি একটিমাত্র পুত্র থাকলে তার আনুপাতিক ভগ্নাংশ (২/৩ ) এর অর্ধেকের চেয়ে বেশি। তাই মূল সুত্রটিকে একটি পুত্রের জন্য একটি কন্যার অংশের দ্বিগুণ বলে উল্লেখ না করে একটি পুত্রের জন্য দুইটি কন্যার অংশের অনুরূপ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ সর্বাবস্থায় একটি পুত্রের অংশ দুইটি কন্যার অনুরূপ, কিন্তু সর্বাবস্থায় একটি পুত্রের অংশ একটি কন্যার দ্বিগুণ নয়।
পুত্র-কন্যার আনুপাতিক অংশের সূত্রে নারী অধিকারের গুরুত্ব
পুত্র-কন্যার আনুপাতিক অংশের সূত্রটি হচ্ছে একটি পুত্রের জন্য দুইটি কন্যার অংশের অনুরূপ। সূত্রটি এভাবে উল্লেখ করার কারণ হলো কন্যাদের আনুপাতিক অংশ সরাসরি উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু পুত্রদের আনুপাতিক অংশ কন্যাদের আনুপাতিক অংশের সাথে তুলনামূলক পদ্ধতিতে নির্ণয় করতে হবে। এভাবে পুত্রদের প্রাপ্য অংশ নির্ধারণে নারীদের প্রাপ্য অংশকে ভিত্তি বানানো হয়েছে। এর মাধ্যমে মূলত সম্পত্তি বা উত্তরাধিকারের প্রশ্নে নারী অধিকারের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
একটি পুত্রের জন্য দুইটি কন্যার অংশের অনুরূপ এবং দুইটি কন্যার জন্য একটি পুত্রের অংশের অনুরূপ বাক্য দুটি সমার্থক। কিন্তু সূত্রটিতে প্রথম বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে, দ্বিতীয় বাক্যটি নয়। এভাবে ভিত্তিমূলক আনুপাতিক অংশ হিসেবে নারীর প্রাপ্য অংশকে নির্ধারণ করা হয়েছে। এই বক্তব্যভঙ্গির মাধ্যমে নারী অধিকারের উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে এবং নারীর প্রাপ্তিকে প্রথমে নিশ্চিত করা বা অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
একটি পুত্রের জন্য দুইটি কন্যার অংশের অনুরূপ হলেও সর্বাবস্থায় একটি কন্যার জন্য একটি পুত্রের অংশের অর্ধেক নয়। যেমন, পুত্র না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র কন্যা থাকলে তার আনুপাতিক ভগ্নাংশ  ১/২ । এটি একটিমাত্র পুত্র থাকলে তার আনুপাতিক ভগ্নাংশ (২/৩ ) এর অর্ধেকের চেয়ে বেশি।
একটিমাত্র কন্যার জন্য আলাদাভাবে অংশ নির্ধারণের যৌক্তিকতা
একটিমাত্র কন্যার জন্য আলাদাভাবে অংশ নির্ধারণের যৌক্তিকতা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে বুঝা যায় যে, এর মাধ্যমে যেমন সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকারকে নিশ্চিত করা হয়েছে, তেমনি অন্য কোনো পুত্র-কন্যা না থাকায় তার তুলনামূলক অসহায়ত্বের সাধারণ অবস্থাকে বিবেচনা করে তাকে উত্তরাধিকার বণ্টনের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।
অধ্যায় ৮ : পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ
পিতা-মাতার আনুপাতিক অংশ সম্পর্কিত মূল ধারাসমূহ
৪:১১ আয়াতে বর্ণিত পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ সম্পর্কিত মূল ধারাসমূহ হলো:
১) মৃত ব্যক্তির কোনো সন্তান থাকলে তার পিতা-মাতা দুজনের মধ্য থেকে প্রত্যেকে বা দুইজনের মধ্য থেকে যে-ই থাকুক সে পাবে ১/৬  । অন্য কথায়, পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৬ , মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৬ ।
২) মৃত ব্যক্তির কোনো সন্তান না থাকলে এবং এ অবস্থায় তার পিতা-মাতা তার উত্তরাধিকারী হলে তার মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৩ ।
৩) মৃত ব্যক্তির কোনো সন্তান না থাকলে কিন্তু ভাই-বোন থাকলে তার মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৬ ।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধারার সমন্বিত তথ্য অনুযায়ী, দ্বিতীয় ধারাটির তাৎপর্য হলো: মৃত ব্যক্তির সন্তানও নেই, ভাই-বোনও নেই, এ অবস্থায় মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৩ । কিন্তু মৃত ব্যক্তির সন্তান নেই তবে ভাই-বোন আছে, এ অবস্থায় মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৬ ।
লক্ষণীয় যে, সন্তান থাকলে মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ যেমন ১/৬ , সন্তান না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলে সেক্ষেত্রেও মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৬ । অর্থাৎ সন্তান না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভাই-বোন জীবিত থাকা, না থাকা প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। এক্ষেত্রে ভাই-বোনের প্রভাব সন্তানের প্রভাবের অনুরূপ।
তৃতীয় ধারাতে ভাই-বোন থাকা বলতে এক বা একাধিক ভাই বা বোন বা ভাই-বোন থাকাকে বুঝানো হয়েছে।
তথ্য ও সূত্র বিশ্লেষণের ভিত্তিতে নির্ণেয় পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশসমূহ
প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে যে, আয়াতটিতে  নিম্নোক্ত অবস্থায় পিতা-মাতার কোনো নির্দিষ্ট আনুপাতিক ভগ্নাংশ উল্লেখ করা হয়নি:
১) মৃত ব্যক্তির সন্তান নেই কিন্তু শুধুমাত্র পিতা-মাতাই উত্তরাধিকারী নয়, বরং স্বামী/স্ত্রীও আছে, এ অবস্থায় পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
২) মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকলে পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
৩) মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতা দুজনের মধ্যে মাত্র একজন জীবিত থাকলে তাঁর আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
৪) মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলে পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
৫) মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলে এবং পিতা-মাতা দুজনের মধ্যে মাত্র একজন জীবিত থাকলে তাঁর আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
৬) মৃত ব্যক্তির সন্তানও নেই, ভাই-বোনও নেই কিন্তু স্বামী/স্ত্রী আছে, এ অবস্থায় পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
৭) মৃত ব্যক্তির সন্তান নেই, ভাই-বোন জীবিত আছে এবং স্বামী/স্ত্রীও জীবিত আছে, এ অবস্থায় পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে কারো আনুপাতিক ভগ্নাংশ অনির্ধারিত থাকতে পারে না এবং তাই আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন যে, প্রত্যেক পুরুষ ও নারী উত্তরাধিকারী নির্ধারিত হারে প্রাপ্য অংশ পাবে (৪:৭)।
সুতরাং উপরের সাতটি পরিস্থিতির ক্ষেত্রেও অবশ্যই আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারিত রয়েছে। তবে তা তথ্য ও সূত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে নির্ণয় করতে হবে।
আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যসমূহ
এ প্রসঙ্গে আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতির নিম্নোক্ত তিনটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে লক্ষ রাখতে হবে:
ক) যখন কোনো পরিস্থিতিতে (তথা উপস্থিত ওয়ারিসদের শ্রেণিসংখ্যার প্রেক্ষিতে) শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশসমূহের সমষ্টি ১ হয় তখন শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ এবং প্রকৃত প্রাপ্য অংশ একইরূপ হয়। কিন্তু যখন কোনো পরিস্থিতিতে শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশসমূহের সমষ্টি ১ এর চেয়ে বেশি হয় বা কম হয় তখন নরমালাইজেশন (অর্থাৎ ভগ্নাংশগুলোর সমষ্টিকে ১ ধরে সকল অনুপাতকে তার সাপেক্ষে প্রকাশ) করতে হয়। নরমালাইজেশনের কারণে প্রত্যেকের আনুপাতিক ভগ্নাংশ একই থাকে কিন্তু আনুপাতিক ভগ্নাংশ বজায় রেখে প্রাপ্য প্রকৃত অংশকে বাহ্যত আনুপাতিক ভগ্নাংশের চেয়ে কম বা বেশি মনে হয়।
খ) যদি দুটি শ্রেণিকে প্রাপক হিসেবে নির্ধারণ করা হয় এবং তার একটি শ্রেণির আনুপাতিক ভগ্নাংশ উল্লেখ করা হয় কিন্তু অন্য শ্রেণির আনুপাতিক ভগ্নাংশ অনুক্ত থাকে, অথচ আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ সম্পদকে বণ্টন করার নির্দেশ থাকে; তাহলে উক্ত ও অনুক্ত আনুপাতিক ভগ্নাংশের সমষ্টি ১ ধরতে হবে। অর্থাৎ ১ থেকে উক্ত আনুপাতিক ভগ্নাংশকে বিয়োগ করে প্রাপ্ত বিয়োগফলই হবে অনুক্ত আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
গ) যে শর্তে কোনো আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারিত হয়, ঐ শর্তের পরিবর্তে অন্য শর্তের মাধ্যমে নির্ধারিত অন্য আনুপাতিক ভগ্নাংশ প্রযোজ্য না হলে; একই শর্তের মধ্যে থাকা অবস্থায় শ্রেণিসংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটলেও নির্ধারিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ স্থির থাকে।
অনুসিদ্ধান্ত প্রয়োগের মাধ্যমে সমাধান নির্ণয়
উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যগত তথ্য এবং আয়াতের বক্তব্য থেকে প্রাপ্ত অনুসিদ্ধান্ত প্রয়োগের মাধ্যমে নির্ণেয় পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশসমূহের সমাধান নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
১) পরিস্থিতি: মৃত ব্যক্তির সন্তান নেই কিন্তু শুধুমাত্র পিতা-মাতাই উত্তরাধিকারী নয়, বরং স্বামী/স্ত্রীও আছে, এ অবস্থায় পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
সমাধান:
মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকলে তার পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৬ , মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৬ । এ অবস্থায় মৃত ব্যক্তির স্বামী/স্ত্রী জীবিত থাকা বা না থাকার কারণে পিতা ও মাতার এই আনুপাতিক ভগ্নাংশের কোনো ব্যতিক্রম ঘটবে না। অনুরূপভাবে পিতা-মাতা জীবিত থাকা, না থাকার কারণে স্বামী/স্ত্রীর আনুপাতিক ভগ্নাংশেরও কোনো ব্যতিক্রম ঘটবে না।
সুতরাং যখন মৃত ব্যক্তির কোনো সন্তান নেই তখন স্বামী/স্ত্রী জীবিত থাকলেও পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশের ব্যতিক্রম ঘটবে না। তবে মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকা অবস্থায় তার ভাই-বোন থাকলে পিতা-মাতার জন্য ভিন্ন আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। সুতরাং প্রথম পর্যায়ে যদি তার (মৃত ব্যক্তির) কোনো সন্তান না থাকে আর তার পিতা-মাতা তার উত্তরাধিকারী হয় তথ্যটির তাৎপর্য হচ্ছে, যদি পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশের প্রভাবক কেউ (ভাই-বোন) না থাকে। স্বামী/স্ত্রীকে পিতা-মাতার জন্য ভিন্নরূপ আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণের প্রভাবক করা হয়নি। তাই মৃত ব্যক্তির স্বামী/স্ত্রী জীবিত থাকলেও পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ স্থির থাকবে।
২) পরিস্থিতি: মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকলে পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
সমাধান:
মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকলে (এবং কোনো ভাই-বোনও না থাকলে) মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ হলো ১/৩ । এক্ষেত্রে পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ণয়ের ভিত্তিমূলক তথ্য হলো: পিতা-মাতা তার (মৃত ব্যক্তির) উত্তরাধিকারী হয় বাক্যটিতে বুঝানো হয়েছে পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণে প্রভাবক কেউ (ভাই-বোন) না থাকা। সুতরাং এখানে মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ উক্ত (expressed) এবং পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ অনুক্ত (non expressed) রয়েছে, কিন্তু মাতা ও পিতা ছাড়া অন্য কারো আনুপাতিক ভগ্নাংশ বিবেচ্য নয়।
শর্তানুসারে, মাতার উক্ত আনুপাতিক ভগ্নাংশ + পিতার অনুক্ত আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১
সুতরাং, পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১ - মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ
বা, পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১ - ১/৩
বা, পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ২/৩
৩) পরিস্থিতি: মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতা দুজনের মধ্যে মাত্র একজন জীবিত থাকলে তাঁর আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
সমাধান:
মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকলে পিতা-মাতা উভয়ে জীবিত থাকলে তাঁদের প্রত্যেকের আনুপাতিক ভগ্নাংশ এবং পিতা-মাতা উভয়ের মধ্য থেকে মাত্র একজন জীবিত থাকলে তাঁর আনুপাতিক ভগ্নাংশের মধ্যে কোনো ব্যতিক্রম ঘটবে না।
অনুরূপভাবে, মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকলেও পিতা-মাতা উভয়ে জীবিত থাকলে তাঁদের প্রত্যেকের আনুপাতিক ভগ্নাংশ এবং পিতা-মাতা উভয়ের মধ্য থেকে মাত্র একজন জীবিত থাকলে তাঁর আনুপাতিক ভগ্নাংশের মধ্যে কোনো ব্যতিক্রম ঘটবে না।
সুতরাং, এ অবস্থায়, মাতা জীবিত থাকলে তাঁর আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৩
অথবা পিতা জীবিত থাকলে তাঁর আনুপাতিক ভগ্নাংশ ২/৩
৪) পরিস্থিতি: মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলে পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
সমাধান:
মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলে এবং (যদি) তার পিতা-মাতা তার উত্তরাধিকারী হয় তথ্যটির বিশেষ তাৎপর্য যদি তার পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণের প্রভাবক কেউ (ভাই-বোন) না থাকে প্রযোজ্য হয় না। তাই এ অবস্থায়, মাতার উক্ত আনুপাতিক ভগ্নাংশ এবং পিতার অনুক্ত আনুপাতিক ভগ্নাংশের সমষ্টি ১ হওয়ার নিয়ম প্রযোজ্য নয়।
সুতরাং এ অবস্থায় পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ণয় করার উপায় হিসেবে নিম্নের দুটি অনুসিদ্ধান্ত প্রয়োগ করতে হবে:
ক) সন্তান না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলে মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৬  ভাগে ফিরে যায়, যা সন্তান থাকা অবস্থায় মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশের সমান। সুতরাং সন্তান না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভাই-বোন সন্তানের সমান প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। সন্তান থাকা অবস্থায় পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৬ । সুতরাং সন্তান না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলে পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৬  ভাগে ফিরে যাবে। অর্থাৎ এ অবস্থায় পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৬ ।
খ) সন্তান না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলে এবং (যদি) তার (মৃত ব্যক্তির) পিতা-মাতা তার উত্তরাধিকারী হয় তথা যদি তার পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশের নির্ধারণে প্রভাবক কেউ (ভাই-বোন) না থাকে শর্তটি প্রযোজ্য নয়। তাই এ ক্ষেত্রে পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ না করার অর্থ হচ্ছে পিতার জন্য সন্তান থাকা অবস্থায় যে আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে সেটাই বহাল থাকবে। অর্থাৎ এ অবস্থায় পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৬ ।
৫) পরিস্থিতি: মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলে এবং পিতা-মাতা দুজনের মধ্যে মাত্র একজন জীবিত থাকলে তাঁর আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
সমাধান:
ইতোপূর্বের সমাধানগুলোর তথ্যানুসারে, মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলে এবং পিতা-মাতা দুজনের মধ্যে মাত্র একজন জীবিত থাকলে তাঁর আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৬ ।
৬) পরিস্থিতি: মৃত ব্যক্তির সন্তানও নেই, ভাই-বোনও নেই কিন্তু স্বামী/স্ত্রী আছে, এ অবস্থায় পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
সমাধান:
ইতোপূর্বের সমাধানগুলোর তথ্যানুসারে, মৃত ব্যক্তির সন্তানও নেই, ভাই-বোনও নেই, কিন্তু স্বামী/স্ত্রী আছে, এ অবস্থায় পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ ২/৩ ।
৭) পরিস্থিতি: মৃত ব্যক্তির সন্তান নেই, ভাই-বোন জীবিত আছে এবং স্বামী/স্ত্রীও জীবিত আছে, এ অবস্থায় পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
সমাধান:
ইতোপূর্বের সমাধানগুলোর তথ্যানুসারে, মৃত ব্যক্তির সন্তান নেই, ভাই-বোন জীবিত আছে এবং স্বামী/স্ত্রীও জীবিত আছে, এ অবস্থায় পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৬ ।
অধ্যায় ৯ : স্বামী-স্ত্রীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ
স্বামী-স্ত্রীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ সম্পর্কিত মূল ধারাসমূহ
১) মৃত নারীর কোনো সন্তান না থাকলে তার স্বামীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/২ ।
২) মৃত নারীর কোনো সন্তান থাকলে তার স্বামীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৪  ।
৩) মৃত পুরুষের কোনো সন্তান না থাকলে তার স্ত্রীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৪ ।
৪) মৃত পুরুষের কোনো সন্তান থাকলে তার স্ত্রীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৮ ।
তথ্য ও সূত্র বিশ্লেষণের ভিত্তিতে একাধিক স্ত্রীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ
কোনো পুরুষের একাধিক স্ত্রী থাকলে সেক্ষেত্রে নিম্নোক্ত দুটি প্রশ্নের অবতারণা ঘটতে পারে:
১) মৃত পুরুষের কোনো সন্তান না থাকলে তার একাধিক স্ত্রীর প্রত্যেকের আনুপাতিক অংশ ১/৪ , নাকি তাদের সম্মিলিত আনুপাতিক অংশ ১/৪ ?
২) মৃত পুরুষের কোনো সন্তান থাকলে তার একাধিক স্ত্রীর প্রত্যেকের আনুপাতিক অংশ ১/৮ , নাকি তাদের সম্মিলিত আনুপাতিক অংশ ১/৮ ?
উত্তরাধিকার বণ্টন বিধির আয়াতগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও সূত্র বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এ দুটি সমস্যার সমাধান নির্ণয় করা যায়। নিম্নোক্ত তিনটি তথ্যগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমস্যা দুটির সমাধান পাওয়া যায়।
এক) ৪:১৭৬ আয়াতে একটি পুরুষ সন্তানহীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে তার কোনো বোন থাকলে সে কতটুকু পাবে তা উল্লেখ করার পর বিপরীতক্রমে তার বোন সন্তানহীনা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে সে তার বোনের উত্তরাধিকারী হবে বলে জানানো হয়েছে। এক্ষেত্রে আরবি বাক্যাংশটি হলো ওয়া হুয়া ইয়ারিসুহা অর্থাৎ আর সে (ভাইটি) তার (বোনটির) উত্তরাধিকারী হবে। এতে বক্তব্যের প্রসঙ্গ কাঠামো (Subject of context) হিসেবে একটি ভাইকে নির্ধারণ করায় একবচন ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু যদি এর পরিবর্তে একাধিক ভাই থাকে তাহলে তাদের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। অর্থাৎ শুধু এক ভাই থাকলে সে যতটুকু অংশের ওয়ারিস হয়, একাধিক ভাই থাকলে তারা সম্মিলিতভাবে পরস্পর সমান হারে ততটুকু অংশের ওয়ারিস হয়(১৯)।
(১৯) বিষয়টি ভাইবোনের আনুপাতিক অংশ অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে।
এই একই সূত্র পিতার, মাতার ও স্ত্রীর আনুপাতিক ভগ্নাংশের বিষয়েও প্রযোজ্য। যদি পিতার স্থলে দাদা ও নানা থাকে তবে তারা উভয়ে সম্মিলিতভাবে পরস্পর সমান হারে পিতার জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ লাভ করবে। যদি মাতার স্থলে দাদী ও নানী থাকে তবে তারা উভয়ে সম্মিলিতভাবে পরস্পর সমান হারে মাতার জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ লাভ করবে। অনুরূপভাবে, যদি একটিমাত্র স্ত্রী থাকে সে একাই স্ত্রীদের জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক অংশ লাভ করবে। আর যদি একাধিক স্ত্রী থাকে তবে তারা সম্মিলিতভাবে ঐ আনুপাতিক অংশ লাভ করবে অর্থাৎ ঐ অংশটি তাদের মধ্যে পরস্পর সমান হারে বণ্টিত হবে।
দুই) একটিমাত্র কন্যা পাবে ১/২ । দুই বা দুইয়ের অধিক কন্যা (তাদের সংখ্যা যা-ই হোক) একত্রে পাবে ২/৩ । যেহেতু কন্যারা সবাই কন্যাই, তাই একটিমাত্র কন্যা যেরূপ ১/২  পাবে, একাধিক কন্যার প্রত্যেকে সেভাবে ১/২   পেতে পারতো। কিন্তু তা না হয়ে একাধিক কন্যা একত্রে ২/৩  পাবে। অর্থাৎ ২/৩  অংশে একাধিক কন্যা পরস্পর সমান হারে অংশীদার হবে। যদি নারীরা (কন্যারা) হয় দুই বা দুইয়ের বেশি তবে তাদের জন্য ২/৩ বাক্যটির মাধ্যমে এটা বুঝায় না যে, প্রত্যেক কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ ২/৩ । বরং এর দ্বারা বুঝায় যে, একাধিক কন্যার সম্মিলিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ ২/৩ । তবে যেহেতু পুত্র না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র কন্যা থাকলে তার জন্য আলাদাভাবে আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে তাই সেক্ষেত্রে সে তার জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ লাভ করবে। একাধিক কন্যার সম্মিলিত আনুপাতিক ভগ্নাংশের বণ্টনের অনুরূপ পদ্ধতিতে একাধিক স্ত্রীর সম্মিলিত আনুপাতিক ভগ্নাংশের বণ্টন হবে। অর্থাৎ স্ত্রী সংখ্যা একাধিক হলে তাদের প্রত্যেকের আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৪   বা ১/৮  নয়; বরং তাদের সম্মিলিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৪ বা ১/৮ । আর এই ১/৪  বা ১/৮  অংশে তারা প্রত্যেকে পরস্পরে সমান হারে অংশীদার হবে।
তিন) আর তোমাদের জন্য যা তোমাদের স্ত্রীগণ রেখে গিয়েছে তার দুই ভাগের এক ভাগ (১/২ ), যদি তাদের কোনো সন্তান না থাকে। তবে যদি তাদের কোনো সন্তান থাকে, তাহলে তোমাদের জন্য যা তারা ছেড়ে গিয়েছে তা থেকে চার ভাগের এক ভাগ (১/৪ )। ......... আর তাদের জন্য (তোমাদের স্ত্রীদের জন্য) যা তোমরা ছেড়ে গিয়েছো তা থেকে চার ভাগের এক ভাগ (১/৪ ), যদি তোমাদের কোনো সন্তান না থাকে। তবে যদি তোমাদের কোনো সন্তান থাকে, তাহলে তাদের জন্য যা তোমরা ছেড়ে গিয়েছো তা থেকে আট ভাগের এক ভাগ (১/৮ )।
আয়াতটিতে স্বামীদের ও স্ত্রীদের বিষয়ে বহুবচন ব্যবহৃত হয়েছে। পূর্বোক্ত বিশ্লেষণ অনুযায়ী, যদি কোনো স্ত্রীর একাধিক স্বামী থাকা সম্ভব হতো তবে এ আয়াতের ভিত্তিতে ঐ স্বামীরা সম্মিলিতভাবে ১/২  বা ১/৪  পেতো।  যেহেতু নারীদের জন্য একাধিক বিবাহ বৈধ নয়, তাই এখানে ‘তোমাদের জন্য’ শব্দটি সামষ্টিকভাবে বিবাহিত পুরুষদেরকে বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, কোনো স্ত্রীর একাধিক স্বামীর প্রসঙ্গ বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়নি।
অন্যদিকে যেহেতু পুরুষের জন্য শর্ত সাপেক্ষে একাধিক বিবাহ বৈধ, তাই স্ত্রীদের জন্য ১/৪  বা ১/৮  বলতে যেমন সামষ্টিকভাবে বিবাহিত নারীদেরকে বুঝানো হয়েছে, তেমনি কোনো পুরুষের একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদেরকে বুঝানোর ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। অর্থাৎ কোনো পুরুষের একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের সম্মিলিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৪  বা ১/৮ । তাদের প্রত্যেকের আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৪  বা ১/৮  নয়, বরং সম্মিলিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৪  বা ১/৮ ।
স্বামী-স্ত্রীর আনুপাতিক ভগ্নাংশের ক্ষেত্রে তাদের সন্তান থাকা অথবা না থাকার প্রসঙ্গ
একজন স্ত্রী মৃত্যুবরণ করলে তার স্বামীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৪  যদি ঐ স্ত্রীর কোনো সন্তান থাকে। মৃত স্ত্রীর সন্তান তার পুর্ব স্বামীর ঔরসজাত হলেও বর্তমান স্বামীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৪ ।
অনুরূপভাবে একজন স্বামী মৃত্যুবরণ করলে তার স্ত্রীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৮  যদি ঐ স্বামীর কোনো সন্তান থাকে। মৃত স্বামীর সন্তান তার পূর্ব স্ত্রীর গর্ভজাত হলেও বর্তমান স্ত্রীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৮ ।
সুতরাং যদি মৃত স্বামীর একাধিক স্ত্রী থাকে এবং স্বামীটির সন্তান তাদের কোনো একজনের গর্ভজাত হয়, তবুও তাদের সম্মিলিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৮ । স্বামীটির সন্তান যেই স্ত্রীর গর্ভজাত সেই স্ত্রী ও অন্য স্ত্রীর পারস্পরিক অংশে কোনো কম বেশি হবে না, বরং তারা সবাই সমান হারে এই ১/৮  আনুপাতিক ভগ্নাংশে শরিক হবে। বিষয় এ নয় যে, তাদের প্রত্যেকের আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৮ , বরং বিষয় এই যে, তাদের সবার সম্মিলিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৮ ।
শেষ কথা হলো, কোনো ব্যক্তির একাধিক স্ত্রী থাকলে তারা যৌথভাবে স্ত্রীর জন্য প্রদত্ত আনুপাতিক ভগ্নাংশ পাবে এবং তা তাদের নিজেদের মধ্যে পরস্পর সমানভাবে বন্টিত হবে।
অধ্যায় ১০ : কালালাহ বা ভাই-বোন উত্তরাধিকার পাওয়ার পূর্বশর্ত
কালালাহ শব্দটির শব্দমূল হচ্ছে ‘কাফ লাম লাম’। শব্দমূলের অর্থ হচ্ছে পরিবৃত করা (encircle), নির্ভরশীলতা। এ শব্দমূল থেকে কুরআনে পাঁচটি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে: কাল্লুন, কুল্লুন, কুল্লামা, কাল্লা এবং কালালাহ।
কাল্লুন (১৬:৭৬:১২) অর্থ হলো বোঝা, সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। কাল্লুন শব্দটি এই একটি স্থানেই ব্যবহৃত হয়েছে।
কুল্লুন (২:১১৬:১২) অর্থ হলো সব, প্রত্যেক। কুল্লুন শব্দটি ৩৫৯ স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে।
কুল্লামা (২:২০:৫) অর্থ হলো সবসময়, যখনই। কুল্লামা শব্দটি ১৫ স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে।
কাল্লা (১৯:৭৯:১) অর্থ হলো কখনো না। কাল্লা শব্দটি ৩৩ স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে।
কালালাহ (৪:১২:৫৪, ৪:১৭৬:৬)। কালালাহ শব্দটি এ দুইটি স্থানেই ব্যবহৃত হয়েছে।
কালালাহ শব্দের শব্দমূল অনুসারে এর মধ্যে বিশেষ নির্ভরশীলতা তৈরি হওয়ার অর্থ নিহিত রয়েছে।
কালালাহ এর সংজ্ঞা নির্ণয় করার উপায় হচ্ছে যে দুটি আয়াতে কালালাহ শব্দ ব্যবহৃত তাতে কালালাহ প্রসঙ্গে উল্লেখিত তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে কালালাহ এর সংজ্ঞা নির্ণয় করা।
৪:১২ আয়াতের বক্তব্যের বিষয়বস্তু হলো, মৃত ব্যক্তির ভাই-বোন দুটি শর্তে তার উত্তরাধিকার পাবে। প্রথম শর্তটি হলো, মৃত ব্যক্তির উত্তরসূরী রয়েছে এবং সেই সাথে তার ভাই-বোনও রয়েছে। দ্বিতীয় শর্তটি হলো, মৃত ব্যক্তি একজন কালালাহ হওয়া।
৪:১৭৬ আয়াতের বক্তব্যের বিষয়বস্তু হলো, মৃত ব্যক্তির কোনো সন্তান না থাকা অবস্থায় তার ভাই-বোন থাকলে তার ভাই-বোন তার উত্তরাধিকার পাবে। এ বিষয়টিকে কালালাহর বিষয়ে সমাধান জিজ্ঞাসার জবাবে আল্লাহ প্রদত্ত সমাধান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
৪:১৭৬ আয়াতে উল্লেখিত মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলে তারা তার উত্তরাধিকার পাবে তথ্যটির অর্থ হচ্ছে এ ক্ষেত্রে সন্তান না থাকাই ভাই-বোন উত্তরাধিকার পাওয়ার কারণ, পিতা-মাতা জীবিত আছে নাকি নেই তা বিবেচনা করা হবে না। অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকলে, সে অবস্থায় পিতা-মাতা জীবিত থাকুক বা না থাকুক, উভয় অবস্থায় ভাই-বোন তার উত্তরাধিকার পাবে।
এ বিষয়টিকে নিম্নোক্ত দুটি ধারায় উল্লেখ করা যেতে পারে:
(১) মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতা থাকলেও ভাই-বোন ৪:১৭৬ আয়াত অনুযায়ী উত্তরাধিকারের অংশ পাবে।
(২) মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকা অবস্থায় যদি পিতা-মাতাও না থাকে, সেক্ষেত্রেও ভাই-বোন ৪:১৭৬ আয়াত অনুযায়ী উত্তরাধিকারের অংশ পাবে।
কালালাহ বিষয়টির সাথে সম্পর্কিত দুটি আয়াতেরই মূল নির্দেশনা হচ্ছে, মৃত ব্যক্তি বা তার ভাই-বোন কালালাহ হওয়া হচ্ছে মৃত ব্যক্তির ভাই-বোনকে উত্তরাধিকার প্রদানের জন্য শর্ত। কালালাহ না হলে ভাই বোনের জন্য উত্তরাধিকারের কোনো অংশ নির্ধারণ করা হয়নি। অন্যভাবে বলা যায়, কালালাহ না হলে সে অবস্থায় ভাই বোন উত্তরাধিকার পাবে না।
৪:১১ আয়াত অনুসারে, পুত্র-কন্যা ও পিতা-মাতা উভয়ে থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকা না থাকার বিষয়টি বিবেচ্য নয়। অর্থাৎ পিতা-মাতা ও পুত্র-কন্যা উভয়ে থাকা অবস্থায় ভাই-বোন উত্তরাধিকার পাবে না। কিন্তু যদি সন্তান না থাকে, সে অবস্থায় ভাই বোন থাকা না থাকার সাপেক্ষে পিতা-মাতার প্রাপ্য অংশকে হ্রাসবৃদ্ধি করা হয়েছে।
সুতরাং ৪:১১, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতের সমন্বিত তথ্য অনুসারে প্রতীয়মান হয় যে, কালালাহ হচ্ছে ভাই-বোনের একটি অবস্থা, যা হচ্ছে জীবিত ও মৃত ভাই-বোনের মধ্যে এমন একটি বিশেষ সম্পর্ক যার প্রেক্ষিতে ভাই-বোন উত্তরাধিকার লাভ করবে।
কালালাহ সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার দুটি শর্ত রয়েছে। এর একটি হলো, মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকা। এ অবস্থায় তার পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক, তার ভাই-বোনের সাথে তার কালালাহ সম্পর্ক স্থাপিত হয়, অর্থাৎ তার ভাই-বোন তার উত্তরাধিকার পাবে।
আর দ্বিতীয়টি ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত অবস্থা, যা হচ্ছে মৃত ব্যক্তির উত্তরসূরী থাকা অবস্থায় তার ভাই-বোন তার উত্তরাধিকার পাওয়ার কারণে মৃত ব্যক্তিটিকে কালালাহ বলা হয়েছে। অর্থাৎ এমন একটি অবস্থা, যার ফলে শুধু তার ভাই-বোনই যে তার কালালাহ তা নয়, বরং সে নিজেও কালালাহ। অর্থাৎ যদি এমন হতো যে, সে জীবিত থাকতো এবং তার কোনো ভাই মৃত্যুবরণ করতো, তবে সে নিজেও তার ঐ ভাইয়ের উত্তরাধিকার পেতো।
এ বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার জন্য নিম্নের দুটি পয়েন্ট বিশেষভাবে লক্ষণীয়:
(এক) ২:১৭৬ আয়াতে একজন ভাইয়ের মৃত্যুর প্রেক্ষিতে তার এক বোন বা দুই বোন তার কতটুকু উত্তরাধিকার পাবে তা উল্লেখ করার মধ্যবর্তীতে বলা হয়েছে, ওয়া হুয়া ওয়ারিসুহা অর্থাৎ আর সে (ভাইটি) তার (বোনটির) উত্তরাধিকারী হবে, যদি তার (বোনটির) কোনো সন্তান না থাকে। অর্থাৎ এতে বক্তব্যের সাধারণ গতি (Subject and Object) পরিবর্তন করে এরূপ তথ্য দেয়া হয়েছে যে, অন্যদিকে যদি এমন হয় যে, ঐ ভাইটি জীবিত থাকে, আর তার বোনটি মৃত্যুবরণ করে, সে অবস্থায় সে ভাইটি তার বোনটির উত্তরাধিকারী হবে। এভাবে বিপরীত অবস্থার প্রসঙ্গ উল্লেখের বিষয়টি আরবি ভাষারীতির অলংকারের সাথে সম্পর্কিত।
অনুরূপভাবে, ৪:১২ আয়াতে মৃত ভাইটিকে কালালাহ হওয়ার শর্ত উল্লেখ করার তাৎপর্য হলো, যদি মৃত ভাইটি জীবিত থাকতো এবং জীবিত ভাই মৃত্যুবরণ করতো তবে সেও তার ভাইয়ের উত্তরাধিকার পেতো, এ বিষয়টি উল্লেখ করা।
(দুই) ৪:১১ আয়াতের বক্তব্য শুরু হয়েছে সন্তানদের মধ্যে উত্তরাধিকার বণ্টনের বিধি বর্ণনার মাধ্যমে। তারপর তার সাথে পিতা-মাতার প্রাপ্য অংশের বর্ণনা যোগ করা হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকা অবস্থায় তার পিতা-মাতা তার উত্তরাধিকারী হলে তাদের প্রাপ্য অংশ কত হবে তা উল্লেখ করতে গিয়ে বলা হয়েছে ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু তথা আর (যদি) তার উত্তরসূরী হয় তার পিতা-মাতা। এ অবস্থায় পিতা-মাতার জন্য যে আনুপাতিক ভগ্নাংশ বলা হয়েছে, পরবর্তী ধারায় যদি তার ভাই-বোন থাকে, তাহলে পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ তা থেকে হ্রাস করা হয়েছে। কিন্তু ভাই-বোন ছাড়া স্বামী/স্ত্রীকে পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশকে হ্রাস-বৃদ্ধির জন্য বিবেচনায় নেয়া হয়নি। সুতরাং রক্তসম্পর্কের আত্মীয়দের একের উপস্থিতি অন্যকে বিবেচনা থেকে রহিত করে, বৈবাহিক সম্পর্কের আত্মীয় (স্বামী/স্ত্রী) এরূপ প্রভাবক নয়। সুতরাং পিতা-মাতা প্রসঙ্গে ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু কথাটির প্রকৃত তাৎপর্য হচ্ছে, যদি পিতা-মাতা এমনভাবে ওয়ারিস হয় যে, তাদের আনুপাতিক ভগ্নাংশকে ভিন্নভাবে নির্ধারণের জন্য প্রভাবক কেউ (তথা ভাই-বোন) নেই।
অনুরূপভাবে, ৪:১৭৬ আয়াতে ভাইয়ের উত্তরাধিকার প্রসঙ্গে থাকা ওয়া হুয়া ইয়ারিসুহা’ তথা তার ভাই তার উত্তরসূরী হবে তথ্যটির প্রকৃত তাৎপর্য হচ্ছে, সন্তান না থাকার ফলে তার ভাই এমনভাবে ওয়ারিস হবে যে, তাদের আনুপাতিক ভগ্নাংশকে ভিন্নভাবে নির্ধারণের জন্য কাউকে (পিতা-মাতাকে/ স্বামী-স্ত্রীকে) বিবেচনায় নেয়া হবে না।
উপরিউক্ত দুটি বিষয় পর্যালোচনা করে বলা যায়, একজন ব্যক্তির সাধারণ উত্তরসূরী হচ্ছে তার সন্তান। তাই ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত যে দুটি শর্তের প্রেক্ষিতে ভাই-বোন উত্তরাধিকার পায়, তার ইউরাসূ তথা যার উত্তরসূরী থাকে কথাটির স্বত:সিদ্ধ অর্থ হচ্ছে, যে মৃত ব্যক্তির সন্তান রয়েছে। কারণ যদি সন্তান না থাকে, সে অবস্থায় ভাই-বোনের প্রাপ্য অংশ ৪:১৭৬ আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে। এমতাবস্থায়, ৪:১২ আয়াতে নির্দেশিত উত্তরসূরী বলতে মুখ্যত সন্তানের উপস্থিতিকেই বুঝানো হয়েছে।
কুরআনে উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধিতে যাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তাদের পরিপূর্ণ তালিকা হলো: পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, স্বামী/স্ত্রী, ভাই, বোন। ৪:১২ আয়াতে মৃত ব্যক্তির উত্তরসূরী থাকা বলতে সন্তান থাকা অবস্থার প্রসঙ্গ বুঝানো হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। কারণ এতে সন্তান ছাড়া বাকি তিন শ্রেণির (১. পিতা-মাতা, ২. স্বামী/স্ত্রী, ৩. ভাই-বোন) মধ্য থেকে একটি শ্রেণিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, একটি শ্রেণিকে প্রভাবক হিসেবে বিবেচনায় আনা হয়নি এবং অন্য একটি শ্রেণিকে অন্তর্ভুক্ত করার অবকাশ রাখা হয়নি। নিম্নে এ তিনটি শ্রেণির এ তিনটি অবস্থা বিশ্লেষণ করা হলো।
(১) উত্তরসুরীর পাশাপাশি ভাই-বোনের থাকার বিষয় বলা হয়েছে বিধায় এটা স্পষ্ট যে, উত্তরসূরী হিসেবে ভাই-বোনকে বুঝানো হয়নি।
(২) স্বামী/স্ত্রীর উপস্থিতি অনুপস্থিতির প্রেক্ষিতে কারো জন্য ভিন্নরূপ আনুপাতিক অংশ নির্ধারণ করা হয়নি বিধায় এটা স্পষ্ট যে, উত্তরসূরী বলতে স্বামী/স্ত্রীকেও বুঝানো হয়নি।
(৩) আর এটাও স্পষ্ট যে, এতে (৪:১২) উত্তরসূরী বলতে পিতা-মাতাকেও বুঝানো হয়নি। কারণ মৃত ব্যক্তির উত্তরসুরী থাকার পাশাপাশি দ্বিতীয় যে শর্তটি রয়েছে তা হলো: মৃত ব্যক্তি কালালাহ হবে। মৃত ব্যক্তির সাথে তার ভাই-বোনের কালালাহ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার একটি উপায় হচ্ছে, মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকা (সে অবস্থায় পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক), যা ৪:১৭৬ আয়াত থেকে স্পষ্ট। সুতরাং মৃত ব্যক্তি কালালাহ হওয়ার দ্বিতীয় অবস্থা একটিই হতে পারে, আর তা হলো, তার পিতা-মাতা না থাকা। কারণ পিতা-মাতা না থাকা অবস্থায় তার প্রতি তার ভাই-বোনদের এবং তার ভাই-বোনদের প্রতি তার নির্ভরশীলতা তৈরি হয়। আর এর ফলে তাদের একে অন্যের উত্তরাধিকার পাওয়ার মতো সম্পর্ক তৈরি হয়।
মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা ও সন্তান উভয় শ্রেণি জীবিত থাকলে সে অবস্থায় ভাই-বোনের জন্য কোনো অংশ নির্ধারণ করা হয়নি। অন্য কথায় যখন মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা ও সন্তান উভয় শ্রেণি জীবিত থাকে সে অবস্থায় মৃত ব্যক্তির ভাই-বোনের সাথে তার কালালাহ সম্পর্ক স্থাপিত হয় না বা তারা একে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয় না এবং একে অন্যের উত্তরাধিকার পায় না।
একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, ৪:১৭৬ আয়াতে সন্তান না থাকা অবস্থায় ভাই-বোনের জন্য সেই অংশই নির্ধারণ করা হয়েছে, ৪:১১ আয়াতে সন্তানের জন্য যে অংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। আবার, ৪:১১ আয়াতে সন্তান এবং ভাই-বোন না থাকা অবস্থায় মাতার জন্য ১/৩ অংশ নির্ধারণ করা হয়েছে, কিন্তু সন্তান না থাকলে কিন্তু ভাই-বোন থাকলে সেক্ষেত্রে আবার মাতার প্রাপ্য হিসেবে ১/৬ অংশ নির্ধারণ করা হয়েছে, যা হলো সন্তান থাকা অবস্থায় মাতার প্রাপ্য অংশের সমান। সুতরাং সন্তান না থাকা অবস্থায় ভাই-বোনকে সন্তানের অনুরূপ অংশের উত্তরাধিকার প্রদান করা হয়েছে।
একইভাবে ৪:১১ আয়াতে সন্তান থাকা অবস্থায় পিতা-মাতার জন্য যেভাবে অংশ নির্ধারণ করা হয়েছে, ৪:১২ আয়াতে কালালাহর ভাই-বোনের জন্য সেভাবেই অংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
সুতরাং বিভিন্নভাবে এটি স্পষ্ট যে, ৪:১২ আয়াতে কালালাহ বলতে তাকেই বুঝানো হচ্ছে যার পিতা-মাতা নেই, কিন্তু সন্তান আছে।
৪:১২ আয়াতে মৃত ব্যক্তি কালালাহ সাব্যস্ত হওয়ার অবস্থায় তার ভাই-বোন বলতে (সন্তান থাকলে) পিতা-মাতা উভয়ে না থাকা অবস্থায় তার পূর্ণ আপন, বৈপিত্রেয় ও বৈমাত্রেয় সকল ভাই-বোনকে বুঝানো হয়েছে। সন্তান ও পিতা-মাতা উভয় শ্রেণি থাকলে ভাই-বোন উত্তরাধিকার পায় না। কিন্তু সেক্ষেত্রে ভাই বোন পিতা-মাতার দ্বারা উপকৃত হতে পারে। তবে যেহেতু বিপিতা (সৎ পিতা) বা বিমাতা (সৎ মাতা) ওয়ারিস হয় না, তাই পিতা বা মাতা একজন জীবিত থাকলে এবং অন্যজন জীবিত না থাকলে ভাই-বোনদের মধ্য থেকে পূর্ণ আপন ভাই বোনের সাথে মৃত ব্যক্তির কালালাহ সম্পর্ক স্থাপিত হয় না, কিন্তু বৈপিত্রেয় বা বৈমাত্রেয় ভাইয়ের সাথে কালালাহ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। তাই ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত, কালালাহ এর কোনো ভাই বা বোন থাকার অর্থ হলো এমন ভাই বা বোন থাকা যার সাথে তার কালালাহ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। 
অন্যভাবে বলা যায়, সন্তানের পাশাপাশি পিতা-মাতা উভয়ে থাকলে পিতা-মাতা উত্তরাধিকার পায়, কিন্তু ভাই-বোন উত্তরাধিকার পায় না। কিন্তু শুধু পিতা থাকা অবস্থায় (তথা বিপিতার উপস্থিতির কারণে) বৈপিত্রেয় ভাই-বোন বঞ্চিত হবে না, কারণ বিপিতা ও স্ত্রীর পূর্ব স্বামীর ঔরসজাত সন্তান পরস্পরের ওয়ারিস হয় না। অনুরূপভাবে শুধু মাতা থাকা অবস্থায় (তথা বিমাতার উপস্থিতির কারণে) বৈমাত্রেয় ভাই-বোন বঞ্চিত হবে না। কারণ বিমাতা ও স্বামীর অন্য স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান পরস্পরের ওয়ারিস হয় না।
যদি এরূপ হয় যে, একজন মৃত ব্যক্তির পিতা নেই কিন্তু মা আছে এবং সন্তান আছে এবং একজন পূর্ণ আপন ও একজন বৈমাত্রেয় ভাই আছে, তবে মৃত ব্যক্তিটি তার পূর্ণ আপন ভাইয়ের কালালাহ নয়, কিন্তু তার বৈমাত্রেয় ভাইয়ের কালালাহ; তাই এ অবস্থায় তার পূর্ণ আপন ভাই উত্তরাধিকার পাবে না, কিন্তু বৈমাত্রেয় ভাই উত্তরাধিকার পাবে।
সুতরাং কালালাহ এর পরিপূর্ণ সংজ্ঞা নিম্নরূপ:
কালালাহ হলো ভাই-বোনের সাথে উত্তরাধিকারগত সম্পর্ক তথা নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে যখন কোনো ভাই বা বোন নির্ধারিত হারে উত্তরাধিকার পায় তখন তাকে কালালাহ বলে। কালালাহ সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার শর্ত নিম্নরূপ:
(ক) মৃত ব্যক্তির সন্তান নেই এবং এ অবস্থায় তার ভাই-বোন আছে, পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক।
অথবা,
(খ) মৃত ব্যক্তির সন্তান আছে কিন্তু পিতা-মাতা নেই এবং এ অবস্থায় তার পূর্ণ আপন ভাই-বোন (বা/ এবং বৈমাত্রেয় তথা পিতৃশরিক ভাই-বোন বা/ এবং বৈপিত্রেয় তথা মাতৃশরিক ভাই-বোন) আছে।
অথবা,
(গ) মৃত ব্যক্তির সন্তান আছে কিন্তু পিতা নেই এবং এ অবস্থায় তার বৈমাত্রেয় তথা পিতৃশরিক ভাই-বোন আছে।
অথবা,
(ঘ) মৃত ব্যক্তির সন্তান আছে কিন্তু মাতা নেই এবং এ অবস্থায় তার বৈপিত্রেয় তথা মাতৃশরিক ভাই-বোন আছে।
এর মধ্যে ক নং অবস্থায় থাকা ভাই-বোন পাবে ৪:১৭৬ আয়াত অনুযায়ী এবং খ, গ, ঘ নং অবস্থায় থাকা ভাই-বোন পাবে ৪:১৭৬ আয়াত অনুযায়ী।
যে অবস্থায় ভাই-বোন উত্তরাধিকার পাবে না
(১) পিতা-মাতা ও পুত্র-কন্যা (২) পিতা-মাতা ও পুত্র (৩) পিতা-মাতা ও কন্যা (৪) পিতা ও পুত্র-কন্যা (৫) পিতা ও পুত্র (৬) পিতা ও কন্যা (৭) মাতা ও পুত্র-কন্যা (৮) মাতা ও পুত্র (৯) মাতা ও কন্যা ইত্যাদি যে সংমিশ্রণেই পিতা-মাতা ও পুত্র-কন্যা উপস্থিত থাকুক, সে অবস্থায় ভাই-বোন (অর্থাৎ ভাই-বোন/ ভাই/ বোন) উত্তরাধিকার পাবে না। কারণ এ অবস্থায় মৃত ব্যক্তি বা ভাই-বোন কেউ কালালাহ হিসেবে সাব্যস্ত হয় না।
Image 109 and 110

অধ্যায় ১১ : ভাই-বোনের আনুপাতিক ভগ্নাংশঃ
ভাই বোনের আনুপাতিক ভগ্নাংশ দুটি প্রধান অবস্থায় বিভক্ত।
এক) যখন সন্তান জীবিত আছে কিন্তু পিতা-মাতা নেই সে অবস্থায় ভাই-বোনের আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
দুই) যখন সন্তান জীবিত নেই, পিতা-মাতা জীবিত থাকুক বা না থাকুক, সে অবস্থায় ভাই-বোনের আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
ভাই-বোনের আনুপাতিক ভগ্নাংশের প্রথম অবস্থা
৪:১২ আয়াতে ভাই-বোনের আনুপাতিক ভগ্নাংশের প্রথম অবস্থা উল্লেখ করা হয়েছে। এ অবস্থায় ভাই-বোনের আনুপাতিক ভগ্নাংশের প্রত্যক্ষ ধারাসমূহ নিম্নরূপ:
১) একমাত্র ভাইয়ের আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৬ । অনুরূপভাবে একমাত্র বোনের আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৬ ।
২) একাধিক ভাই বা বোন বা ভাই-বোন থাকলে তাদের সম্মিলিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৩ ।
প্রথম অবস্থায় ভাইবোনের প্রাপ্য অংশে পারস্পরিক অনুপাত
ভাইবোনের আনুপাতিক ভগ্নাংশের প্রথম অবস্থার ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত প্রশ্নের অবতারণা হয়:
যখন একাধিক ভাই-বোন একসাথে থাকে তখন ভাই-বোনের প্রাপ্য আনুপাতিক ভগ্নাংশে (১/৩ ) তাদের পারস্পরিক অনুপাত কত? অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে এক ভাই দুই বোনের সমান পাবে, নাকি এক ভাই ও এক বোন পরস্পর সমান পাবে?
এ প্রশ্নের সমাধান নিম্নোক্ত তিনটি তথ্য অনুযায়ী করা যায়:
১) সন্তান থাকা অবস্থায় পিতা-মাতার জন্য যেরূপ আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে, সন্তান থাকা অবস্থায় পিতা-মাতা না থাকলে ভাই-বোনের জন্য সেরূপ আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। সন্তান থাকা অবস্থায় পিতা-মাতা যেই থাকুক তার জন্য আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৬ , যার সমষ্টি হচ্ছে ১/৩ । অনুরূপভাবে সন্তান থাকা অবস্থায় পিতা-মাতা না থাকলে ভাই-বোন যেই থাকুক তার জন্য আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৬ । যদি একটি ভাই এবং একটি বোন থাকে তাহলে তাদেরকে এই একই নিয়মে ১/৬  আনুপাতিক ভগ্নাংশ দিলে ভগ্নাংশগুলোর সমষ্টি হয় ১/৩ । ৪:১২ আয়াত অনুসারে একাধিক ভাই-বোন ১/৩  আনুপাতিক ভগ্নাংশের অংশীদার হবে। এ থেকে বুঝা যায় যে, তারা এতে সমান হারে অংশীদার হবে।
২) একটিমাত্র ভাই থাকলে তার জন্য ১/৬ । একটি মাত্র বোন থাকলে তার জন্য ১/৬ । দেখা যাচ্ছে, ভাই বোনের আনুপাতিক ভগ্নাংশ সমান। সুতরাং ভাই বোন একসাথে থাকলে তাদের সম্মিলিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৩  এর ক্ষেত্রেও তারা পরস্পর সমান হারে অংশীদার হবে।
৩) যেহেতু একাধিক ভাই বোন ১/৩  আনুপাতিক ভগ্নাংশে অংশীদার হওয়ার বিধান দেয়া হয়েছে এবং এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে ভাইয়ের চেয়ে বোন বা বোনের চেয়ে ভাই বেশি পাওয়ার কোনো বিধান দেয়া হয়নি; তাই সম্মিলিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৩  ভাগে ভাই-বোন পরস্পর সমান হারে অংশীদার হবে। মোট ভাইবোনের সংখ্যা যত, তাদের সম্মিলিত আনুপাতিক ভগ্নাংশকে তত ভাগ করে প্রত্যেকে এক ভাগ পাবে।
পরিশেষে উল্লেখ্য, যদি একসাথে একাধিক ভাই এবং একাধিক বোন থাকে, তাদের মোট সংখ্যা যত বেশিই হোক, তাদের জন্য সম্মিলিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৩ । এই আনুপাতিক ভগ্নাংশ থেকে তাদের প্রত্যেকে পরস্পর সমান হারে পাবে।
ভাই-বোনের আনুপাতিক ভগ্নাংশের দ্বিতীয় অবস্থা
৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোনের আনুপাতিক ভগ্নাংশের দ্বিতীয় অবস্থা (মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকা অবস্থায় ভাই-বোনের প্রাপ্য) উল্লেখ করা হয়েছে। এ অবস্থায় ভাই-বোনের আনুপাতিক ভগ্নাংশের প্রত্যক্ষ ধারাসমূহ নিম্নরূপ:
১) ভাই না থাকা অবস্থায় একমাত্র বোন থাকলে তার আনুপাতিক ভগ্নাংশ  ১/২ । 
২) এবং (বিপরীতক্রমে) সে (ভাইটি) তার (বোনটির) উত্তরাধিকারী হবে।
৩) ভাই না থাকা অবস্থায় দুই বোন থাকলে তাদের সম্মিলিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ ২/৩ ।
৪) কয়েকজন ভাই-বোন থাকলে তাদের মধ্যে বণ্টনের ক্ষেত্রে এক ভাইয়ের জন্য দুই বোনের অংশের অনুরূপ সূত্রটি প্রযোজ্য হবে।
তথ্য ও সূত্র বিশ্লেষণের ভিত্তিতে নির্ণেয় ভাইবোনের আনুপাতিক ভগ্নাংশসমূহ
প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে যে, আয়াতটিতে নিম্নোক্ত অবস্থায় ভাই-বোনদের জন্য কোনো নির্দিষ্ট আনুপাতিক ভগ্নাংশ উল্লেখ করা হয়নি:
১) যখন বোন নেই, কিন্তু এক বা একাধিক ভাই আছে, তাদের আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
২) যখন ভাই ও বোন উভয়ে থাকে তাদের সামষ্টিক আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
৩) একটিমাত্র ভাই ও একটিমাত্র বোন থাকলে ভাই-বোনের মধ্যকার আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
৪) একাধিক ভাই ও একটি বোন থাকলে তাদের আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
লক্ষণীয় যে, পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোনের জন্য সেরূপ ভগ্নাংশই নির্ধারণ করা হয়েছে ৪:১১ আয়াতে পুত্র-কন্যার যেরূপ ভগ্নাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। সুতরাং এ সমস্যাগুলোর সমাধানও পুত্র-কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ণয়ের অনুরূপ।
নিচে সংক্ষেপে সমস্যাগুলোর সমাধান উল্লেখ করা হলো:
১) যখন বোন নেই, কিন্তু এক বা একাধিক ভাই আছে, তাদের আনুপাতিক ভগ্নাংশ ২/৩
২) যখন ভাই ও বোন উভয়ে থাকে তাদের সামষ্টিক আনুপাতিক ভগ্নাংশ ২/৩
৩) একটিমাত্র ভাই ও একটিমাত্র বোন থাকলে ভাই বোনের মধ্যকার অনুপাত হলো, ভাই : বোন = ২ : ১
(অর্থাৎ একটি ভাইকে দুই বোন হিসেবে ধরতে হবে এবং তাই সে দুই ভাগ পাবে এবং বোনটি এক ভাগ পাবে)।
৪) একাধিক ভাই ও একটি বোন থাকলে তাদের পারস্পরিক অনুপাত হলো, প্রত্যেক ভাই : বোন = ২ : ১
(অর্থাৎ প্রত্যেক ভাইকে দুই বোন হিসেবে ধরতে হবে এবং তাই সে দুই ভাগ পাবে এবং বোনটি এক ভাগ পাবে)।
পুত্র-কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ (৪:১১) ও ভাই-বোনের আনুপাতিক ভগ্নাংশ (৪:১৭৬) উপস্থাপনের বর্ণনাভঙ্গির তুলনা
১) পুত্র-কন্যার আনুপাতিক অংশ বর্ণনা করার ক্ষেত্রে প্রথমে দুইয়ের বেশি কন্যা ও দুই কন্যা এবং তারপর এক কন্যার আনুপাতিক অংশ বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ সংখ্যার উর্ধ্ব থেকে নিম্নক্রম অবলম্বন করা হয়েছে।
ভাই-বোনের আনুপাতিক অংশ বর্ণনা করার ক্ষেত্রে প্রথমে এক বোনের আনুপাতিক অংশ, মাঝে বিপরীত অবস্থায় ভাইয়ের প্রসঙ্গ এবং তারপর দুই বোনের আনুপাতিক অংশ বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ সংখ্যার নিম্ন থেকে ঊর্ধ্বক্রম অবলম্বন করা হয়েছে।
২) পুত্র-কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ বর্ণনার ক্ষেত্রে প্রথমে এক পুত্রের জন্য দুই কন্যার অংশের অনুরূপ সূত্রটি উল্লেখ করা হয়েছে।
ভাই-বোনের আনুপাতিক ভগ্নাংশ বর্ণনার ক্ষেত্রে শেষে এক ভাইয়ের জন্য দুই বোনের অংশের অনুরূপ সূত্রটি উল্লেখ করা হয়েছে।
৩) পুত্র-কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ বর্ণনায় দুই কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশকে পরোক্ষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কারণ তা দুইয়ের অধিক কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশের অনুরূপ এবং সংখ্যার নিম্নক্রম অনুসারে তার অবস্থান মধ্যবর্তীতে।
ভাই-বোনের আনুপাতিক ভগ্নাংশ বর্ণনায় দুইয়ের বেশি বোনের আনুপাতিক ভগ্নাংশ স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করা হয়নি। কারণ তা দুই বোনের আনুপাতিক ভগ্নাংশের অনুরূপ এবং সংখ্যার ঊর্ধ্বক্রম অনুসারে তার অবস্থান শেষে। তাই আয়াতের সর্বশেষ বর্ণিত ধারা (এক ভাইয়ের জন্য দুই বোনের অংশের অনুরূপ) থেকে দুইয়ের বেশি বোনের অংশ স্বত:সিদ্ধভাবে নির্ণিত হবে বিধায় ধারাটি উহ্য রেখে দেয়া হয়েছে।
অধ্যায় ১২ : দাদা-দাদী, নানা-নানী ও ইয়াতীম পৌত্র, পৌত্রী, দৌহিত্র, দৌহিত্রীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ
কুরআন অনুসারে পিতাকে বুঝাতে ‘আবুন’ এবং পিতা ও দাদাকে একসাথে বুঝাতে ‘আবাওয়ায়’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে (১২:৬)। অর্থাৎ পিতা ও দাদা উভয়ে পিতৃপুরুষ এবং পিতা প্রসঙ্গে দেয়া বিধানই দাদা ও নানার প্রসঙ্গে প্রযোজ্য। অনুরূপভাবে মাতার প্রসঙ্গে দেয়া বিধানই দাদী ও নানীর প্রসঙ্গে প্রযোজ্য।
কুরআনে পৌত্র-পৌত্রী, দৌহিত্র-দৌহিত্রীকে পুত্র-কন্যাদের প্রসঙ্গে প্রদত্ত বিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
কুরআনে বিবাহ ও পর্দা সম্পর্কিত বিধান (৪:২৩, ২৪:৩১) থেকে পিতা-মাতা প্রসঙ্গে দেয়া বিধানই যে দাদা-দাদী ও নানা-নানীর জন্য প্রযোজ্য এবং পুত্র-কন্যা প্রসঙ্গে দেয়া বিধানই যে পৌত্র-পৌত্রী ও দৌহিত্র-দৌহিত্রীর জন্য প্রযোজ্য তা সহজে অনুধাবন করা যায়।
সুতরাং উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশই দাদা-দাদী ও নানা-নানীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ হিসেবে প্রযোজ্য। অনুরূপভাবে পুত্র-কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশই পৌত্র-পৌত্রী ও দৌহিত্র-দৌহিত্রীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ হিসেবে প্রযোজ্য।
তবে দাদা-দাদী, নানা-নানী, পৌত্র-পৌত্রী ও দৌহিত্র-দৌহিত্রীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ কখন কার্যকর হবে তথা কখন তারা উত্তরাধিকার পাবে তা কিছু শর্তের উপর নির্ভর করে।
দাদা-দাদী, নানা-নানী ও ইয়াতীম পৌত্র-পৌত্রী, দৌহিত্র-দৌহিত্রী উত্তরাধিকার পাওয়ার শর্ত
৪:৭ ও ৪:৩৩ আয়াত অনুযায়ী, কুরআনে যাদের জন্য উত্তরাধিকার নির্ধারণ করা হয়েছে (পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, স্বামী/স্ত্রী এবং ভাই, বোন) তারা হলো ‘আক্বরাবূন’। ‘আক্বরাবূন’ শব্দটি কুরআনে দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে: (১) সবচেয়ে নিকটতম (২) সবচেয়ে নিকটতম আত্মীয়। যেহেতু দাদা-দাদী, নানা-নানী পিতা-মাতার শ্রেণিভুক্ত তাই তারাও আক্বরাবূন। অনুরূপভাবে যেহেতু পৌত্র-পৌত্রী, দৌহিত্র-দৌহিত্রী পুত্র-কন্যার শ্রেণিভুক্ত তাই তারাও আক্বরাবূন।
সম্পদের ওয়ারিস হওয়ার ক্ষেত্রে মুল শর্ত হলো আক্বরাবূন হতে হবে (৪:৭)। আর আক্বরাবূন হিসেবে কুরআন যাদেরকে চিহ্নিত করেছে তাদের মধ্যে বৈবাহিক কারণে আক্বরাবূন হওয়া একমাত্র শ্রেণি হচ্ছে স্বামী/স্ত্রী। আর রক্তসম্পর্কের দিক থেকে আক্বরাবূন হওয়া শ্রেণি হচ্ছে তিনটি, যথা- পুত্র-কন্যা, পিতা-মাতা এবং ভাই-বোন। এর মধ্য থেকে ভাই-বোনকে সব অবস্থায় ওয়ারিস করা হয়নি, শুধু কালালাহ(২০) সম্পর্কের প্রেক্ষিতে ওয়ারিস করা হয়েছে।
(২০) কালালাহর বিস্তারিত বিবরণ সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ে দেয়া হয়েছে
সুতরাং আক্বরাবূনদের মধ্য থেকে কে কোন শর্তে উত্তরাধিকার পাবে এবং কোন শর্তে পাবে না এর উপর ভিত্তি করে আক্বরাবূনদের (সবচেয়ে নিকটতম আত্মীয়) শ্রেণিবিভাগ রয়েছে। যারা সব অবস্থায় উত্তরাধিকার পাবে তারা শর্তহীন আক্বরাবূন এবং যারা কোনো বিশেষ শর্তে উত্তরাধিকার পাবে তারা শর্তাধীন আক্বরাবূন। নিম্নে আক্বরাবূনের শ্রেণিবিভাগ উল্লেখ করা হলো।
আক্বরাবূনের (সবচেয়ে নিকটতম আত্মীয়) শ্রেণিবিভাগ
আক্বরাবূন দুই শ্রেণিতে বিভক্ত, যথা:
১. শর্তহীন আক্বরাবূন: যারা সকল অবস্থায় উত্তরাধিকার পাবে তারা শর্তহীন আক্বরাবূন। শর্তহীন আক্বরাবূন হলো: পুত্র-কন্যা, পিতা-মাতা ও স্বামী/স্ত্রী।
২. শর্তাধীন আক্বরাবূন: যারা কোনো বিশেষ শর্তে উত্তরাধিকার পাবে তারা শর্তাধীন আক্বরাবূন।
শর্তাধীন আক্বরাবূনের শ্রেণিবিভাগ
শর্তাধীন আক্বরাবূন আবার দুটি উপশ্রেণিতে বিভক্ত। যথা:
২.১ যারা কালালাহ সম্পর্কের ভিত্তিতে আক্বরাবূন: কালালাহ সম্পর্ক হচ্ছে মৃত ব্যক্তির সন্তান ও পিতা-মাতা উভয় পক্ষ জীবিত না থাকলে অর্থাৎ উভয় পক্ষ বা কোনো একটি পক্ষ মৃত হলে তখন তার ভাইবোনের সাথে তার উত্তরাধিকারগত সম্পর্ক তৈরি হয়। কালালাহ সম্পর্কের ভিত্তিতে আক্বরাবূন হচ্ছে ভাই-বোন।
২.২ ঊর্ধ্বতন বা অধ:স্তন সম্পর্কের মাধ্যমিক স্তরের প্রাপ্য আনুপাতিক ভগ্নাংশের স্থলাভিষিক্ত ওয়ারিস ধরনের আক্বরাবূন: দাদা-দাদী ও নানা-নানী হচ্ছেন পিতা-মাতা শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। তবে পিতা-মাতা জীবিত থাকলে তাঁরা উত্তরাধিকার পাবেন না। আর পিতা-মাতা জীবিত না থাকলে পিতা-মাতার জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক ভগ্নাংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হবেন দাদা-দাদী ও নানা-নানী। অনুরূপভাবে পৌত্র-পৌত্রী ও দৌহিত্র-দৌহিত্রী হচ্ছে পুত্র-কন্যা শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। তবে পুত্র-কন্যা জীবিত থাকলে তাঁরা উত্তরাধিকার পাবেন না। আর পুত্র-কন্যা জীবিত না থাকলে পুত্র-কন্যার জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক ভগ্নাংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হবে পৌত্র-পৌত্রী, দৌহিত্র-দৌহিত্রী।
দাদা-দাদী, নানা-নানী, পৌত্র-পৌত্রী, দৌহিত্র-দৌহিত্রীকে শর্তাধীন আক্বরাবূন সাব্যস্ত করার যুক্তি
দাদা-দাদী ও নানা-নানীকে শর্তাধীন আক্বরাবূন সাব্যস্ত করার যুক্তিসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
প্রথম যুক্তি:
৪:১১ আয়াতে যেভাবে পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ বর্ণনা করা হয়েছে তা নিম্নরূপ:
আর তার [মৃত ব্যক্তির] পিতা-মাতা দুইজনের মধ্য থেকে প্রত্যেকের জন্য [তাদের দুইজনের মধ্য থেকে যেই থাকুক তার জন্য] যা সে ছেড়ে গিয়েছে তা থেকে ছয় ভাগের এক ভাগ (১/৬  ), যদি তার কোনো সন্তান থাকে। তবে যদি তার কোনো সন্তান না থাকে আর তার পিতা-মাতা তার উত্তরাধিকারী হয়, তাহলে তার মাতার জন্য তিন ভাগের এক ভাগ (১/৩  )। তবে যদি তার ভাই-বোন থাকে, তাহলে তার মাতার জন্য ছয় ভাগের এক ভাগ (১/৬  )।
এতে পিতা-মাতার প্রসঙ্গে দ্বিবচন এবং মাতার প্রসঙ্গে একবচন ব্যবহৃত হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় যে, এতে বর্ণিত আনুপাতিক ভগাংশে দাদা-দাদী ও নানা-নানীকে অংশীদার করা হয়নি। সুতরাং পিতা-মাতা জীবিত না থাকলে সেক্ষেত্রেই তাঁরা পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হবেন, অন্যথায় তাঁরা পাবেন না।
যদি পিতা জীবিত না থাকেন, তাহলে পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশটি দাদা-দাদী লাভ করবেন। এক্ষেত্রে আবার দাদা ও দাদীর পারস্পরিক আনুপাতিক ভগ্নাংশের বণ্টনে পিতা-মাতার  পারস্পরিক অনুপাতের নিয়ম প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ দাদাকে পিতা হিসেবে এবং দাদীকে মাতা হিসেবে সাব্যস্ত করে তাদের পারস্পরিক বণ্টন হবে। যেমন যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকে বা সন্তান না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকে তবে দাদা ও দাদীর প্রাপ্যতার পারস্পরিক অনুপাত হবে ১:১। আর যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকে এবং সন্তান না থাকা অবস্থায় ভাই-বোনও না থাকে তাহলে দাদা ও দাদীর প্রাপ্যতার পারস্পরিক অনুপাত হবে ২:১।
অনুরূপভাবে যদি মাতা জীবিত না থাকেন, তাহলে মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশটি নানা-নানী লাভ করবেন। এক্ষেত্রে আবার নানা ও নানীর পারস্পরিক আনুপাতিক ভগ্নাংশের বণ্টনে পিতা-মাতার পারস্পরিক অনুপাতের নিয়ম প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ নানাকে পিতা হিসেবে এবং নানীকে মাতা হিসেবে সাব্যস্ত করে তাদের পারস্পরিক বণ্টন হবে। যেমন যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকে বা সন্তান না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকে তবে নানা ও নানীর প্রাপ্যতার পারস্পরিক অনুপাত হবে ১:১। আর যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকে এবং সন্তান না থাকা অবস্থায় ভাই-বোনও না থাকে তাহলে নানা ও নানীর প্রাপ্যতার পারস্পরিক অনুপাত হবে ২:১।
আর যদি পিতা-মাতা উভয়ে জীবিত না থাকেন, তাহলে পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশটি দাদা-দাদী ও নানা-নানী লাভ করবেন। এক্ষেত্রেও পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হবেন দাদা-দাদী এবং মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হবেন নানা-নানী। কারণ দাদা-দাদী মৃত ব্যক্তির সাথে তার পিতার মাধ্যমে সম্পর্কিত এবং নানা-নানী মৃত ব্যক্তির সাথে তার মাতার মাধ্যমে সম্পর্কিত। এক্ষেত্রেও দাদা ও দাদীর পারস্পরিক অনুপাত হবে পিতা-মাতার পারস্পরিক অনুপাতের অনুরূপ এবং নানা ও নানীর পারস্পরিক অনুপাত হবে পিতা-মাতার পারস্পরিক অনুপাতের অনুরূপ।
যদি মৃত ব্যক্তির পিতা না থাকা অবস্থায় দাদী থাকে তবে পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশটি দাদীই লাভ করবেন। অনুরূপভাবে যদি মৃত ব্যক্তির মাতা না থাকা অবস্থায় নানা থাকেন তবে মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশটি নানাই লাভ করবেন। যদিও দাদী মাতৃতুল্য তবুও তিনি পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ পাবেন কারণ মৃতের সাথে তাঁর সম্পর্কসূত্র পিতার মাধ্যমে। অনুরূপভাবে যদিও নানা পিতৃতুল্য তবুও তিনি মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ পাবেন কারণ মৃতের সাথে তাঁর সম্পর্কসূত্র মাতার মাধ্যমে।

দ্বিতীয় যুক্তি:
পিতা জীবিত থাকলেও দাদা ও নানা পিতৃতুল্য এবং মাতা জীবিত থাকলেও দাদী ও নানী মাতৃতুল্য। সুতরাং সাধারণভাবে পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, নানা-নানী সকলেই আক্বরাবূন (নিকটতম আত্মীয়)। কিন্তু পিতা জীবিত থাকা অবস্থায় দাদা-দাদী উত্তরাধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আক্বরাবূন (নিকটতম) সাব্যস্ত হন না। কারণ পিতার মাধ্যমেই দাদা-দাদীর সাথে সম্পর্কসূত্র তৈরি হয়েছে। তাই পিতার উপস্থিতিতে তিনি (অর্থাৎ পিতা নিজেই) স্তরগত নৈকট্যের কারণে পিতা-মাতা শ্রেণির মধ্যকার আক্বরাবূন বা নিকটতম হিসেবে সাব্যস্ত হন।
অনুরূপভাবে, মাতা জীবিত থাকা অবস্থায নানা-নানী উত্তরাধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আক্বরাবূন (নিকটতম) সাব্যস্ত হন না।
আত্মীয়তার দিক থেকে সাধারণভাবে আক্বরাবূন বা নিকটতম আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও উত্তরাধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কখনো কখনো আক্বরাবূন বা নিকটতম সাব্যস্ত না হওয়ার অন্যতম উদাহরণ হলো ভাই-বোন। যেহেতু ভাই-বোন উত্তরাধিকার পায় তাই যারা কখনোই উত্তরাধিকার পায় না এমন আত্মীয় স্বজনের তুলনায় ভাই-বোন হলো আক্বরাবূন বা নিকটতম আত্মীয়। কিন্তু ভাই-বোন কোনো কোনো অবস্থায় উত্তরাধিকার পাবে এবং কোনো কোনো অবস্থায় উত্তরাধিকার পাবে না। সুতরাং সাধারণভাবে আক্বরাবূন হওয়া সত্ত্বেও উত্তরাধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কেউ কেউ কখনো কখনো আক্বরাবূন/নিকটতম হিসেবে সাব্যস্ত হতে পারে আবার কখনো কখনো আক্বরাবূন (নিকটতম) হিসেবে সাব্যস্ত নাও হতে পারে।
সুতরাং পিতা-মাতা শ্রেণির মধ্য থেকে দাদা-দাদী ও নানা-নানী স্তরগতভাবে পিতা-মাতার পরবর্তী ঊর্ধ্বতন স্তরের হওয়ার কারণে তাঁরা উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে শর্তাধীন আক্বরাবূন বা নিকটতম হিসেবে সাব্যস্ত হন। কেননা, পিতা-মাতা জীবিত থাকলে তাঁরা দাদা-দাদী ও নানা-নানীকে পিতা-মাতা শ্রেণির আওতায় মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে থাকেন।
দাদা-দাদী ও নানা-নানীকে শর্তাধীন আক্বরাবূন করার যুক্তি একইভাবে পৌত্র-পৌত্রী, দৌহিত্র-দৌহিত্রীকে শর্তাধীন আক্বরাবূন সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

"দাদা ও দাদী পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ লাভ করবেন এবং নানা ও নানী মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ লাভ করবেন কিন্তু দাদা ও নানাকে পিতা হিসেবে এবং দাদী ও নানীকে মাতা হিসেবে সাব্যস্ত করে দাদা-দাদীর এবং নানা-নানীর পারস্পরিক অনুপাত নির্ধারিত হবে।" এই ধারাটি প্রযোজ্য হওয়ার যুক্তি
১) শুধু পিতা জীবিত না থাকলে দাদা ও দাদী উত্তরাধিকার পাবেন এবং পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশটি পাবেন, কারণ পিতার অনুপস্থিতির কারণে পিতার মাধ্যমে মৃতের সাথে সম্পর্কিত ঊর্ধ্বতন পিতা-মাতা (দাদা-দাদী) মৃতের উত্তরাধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আক্বরাবূন (নিকটতম) হন। অনুরূপভাবে শুধু মাতা জীবিত না থাকলে নানা ও নানী উত্তরাধিকার পাবেন এবং মাতার আনুপাতিক অংশটি পাবেন, কারণ মাতার অনুপস্থিতির কারণে মাতার মাধ্যমে মৃতের সাথে সম্পর্কিত ঊর্ধ্বতন পিতা-মাতা (নানা-নানী) মৃতের উত্তরাধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আক্বরাবূন (নিকটতম) হন।

২) একাধিক কন্যা থাকলে কন্যা সংখ্যা যতই হোক তারা তাদের জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ ২/৩   ভাগ পরস্পর সমান হারে পাবে। ৪:১২ বর্ণিত অবস্থায় একাধিক ভাই-বোন থাকলে তাদের সংখ্যা যতই হোক তারা তাদের জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ ১/৩  ভাগ পরস্পর সমান হারে পাবে। ৪:১৭৬ বর্ণিত অবস্থায় একাধিক বোন থাকলে তাদের সংখ্যা যতই হোক তারা তাদের জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ ২/৩  ভাগ পরস্পর সমান হারে পাবে। ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত স্ত্রীদের আনুপাতিক ভগ্নাংশটি একটিমাত্র স্ত্রী থাকলে সে পাবে এবং একাধিক স্ত্রী থাকলে তারা সেই আনুপাতিক ভগ্নাংশটিই যৌথভাবে পরস্পর সমান হারে পাবে।
এই একই যুক্তি অনুসারে পিতা-মাতা জীবিত না থাকলে, দাদা-দাদী ও নানা-নানী পরবর্তী স্তরের পিতা-মাতা হিসেবে, পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশের স্থলাভিষিক্ত হবেন, যদিও মূল ধারা বর্ণিত হয়েছে পিতা-মাতার প্রাপ্য অংশ হিসেবে তথা দ্বিবচনে।
৩) কারো অনুপস্থিতিতে তার সমপরিমাণ আনুপাতিক ভগ্নাংশ অন্য কারো জন্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ হচ্ছে ভাই-বোনের আনুপাতিক ভগ্নাংশ। ভাই-বোন সরাসরি পিতা-মাতারও স্থলাভিষিক্ত নয়, পুত্র-কন্যারও স্থলাভিষিক্ত নয়। তবে পিতা-মাতা না থাকা অবস্থায় সন্তান থাকলে ভাই-বোনের জন্য পিতা-মাতার অনুরূপ আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। আর পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক ভাই-বোনের জন্য পুত্র-কন্যার অনুরূপ আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
অনুরূপভাবে পিতা-মাতার অনুপস্থিতিতে দ্বিতীয় স্তরের পিতা-মাতা হিসেবে দাদা-দাদী, নানা-নানীর জন্য পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ প্রযোজ্য হবে। এর কারণ হলো: (ক) তারা পিতা-মাতা শ্রেণিভুক্ত, (খ) কিন্তু পিতা-মাতার উপস্থিতি তাদেরকে বিবেচনা বহির্ভুত রাখে।
উপরিউক্ত তথ্যানুসারে একটি অনুসিদ্ধান্ত হলো: মৃত ব্যক্তির সন্তান বা পৌত্র-পৌত্রী, দৌহিত্র-দৌহিত্রী এবং পিতা-মাতা বা দাদা-দাদী ও নানা-নানী এই উভয় (ঊর্ধ্বতন ও অধ:স্তন) স্তরের মধ্য থেকে প্রত্যেক স্তরের কেউ না কেউ জীবিত থাকলে ভাই-বোন উত্তরাধিকার পাবে না।
৪) ৪:১৭৬ আয়াতে বক্তব্য কাঠামোর স্বাভাবিক ধারাবাহিকতায় বলা হয়েছে, ‘ওয়া হুয়া ইয়ারিসূহা’ অর্থাৎ ‘সে [ভাইটি] তার [বোনটির] ওয়ারিস হবে’। এখানে ‘হুয়া’ একবচন হওয়া সত্ত্বেও যখন ঐ মূল ধারাটি একটি ভাইয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হয়ে একাধিক ভাইয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে তথা একাধিক ভাইয়ের কোনো বোন মৃত্যুবরণ করবে, তখন তারা সম্মিলিতভাবে ঐ ভাইয়ের মতো করে বোনটির ওয়ারিস হবে। অর্থাৎ প্রসঙ্গ কাঠামো (subject of context) একটি ভাই ছিলো বিধায়, ওয়া হুয়া ইয়ারিসূহা বাক্য ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু একাধিক ভাই থাকলেও বিষয়টি প্রযোজ্য যদিও বহুবচনে ‘ওয়া হুম ওয়ারিসুহা’ কথাটি স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করা হয়নি। সুতরাং বচনের ব্যবহার হয়েছে প্রাথমিক বর্ণনাধারার সাথে মিল রেখে কিন্তু পূর্বাপর বক্তব্য বা কোনো ধারার মাধ্যমে বচনকে সুনির্দিষ্ট শর্ত হিসেবে নির্ধারিত করা না হলে, এটাকে প্রাসঙ্গিক স্বত:সিদ্ধ অবস্থাসমূহের সমন্বয়ের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে সাব্যস্ত করা যাবে না। এই যুক্তিতে পিতা-মাতার প্রসঙ্গে দ্বিবচনে দেয়া বক্তব্যকে পিতা-মাতা জীবিত না থাকায় দাদা-দাদী, নানা-নানীকে যৌথভাবে পিতা-মাতার আনুপাতিক অংশ প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা নয়।
পৌত্র-পৌত্রী ও দৌহিত্র-দৌহিত্রীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ
১) মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদ বণ্টনের সময় তার ইয়াতীম পৌত্র-পৌত্রীরা ততটুকু আনুপাতিক ভগ্নাংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হবে, যতটুকু ঐ ইয়াতীম পৌত্র-পৌত্রীর পিতা (তথা যার সম্পদ বণ্টন হচ্ছে তার মৃত পুত্র) জীবিত থাকলে পেতো। এটি আবার পৌত্র-পৌত্রীর মধ্যে এভাবে বণ্টিত হবে যে, প্রত্যেক পৌত্র : প্রত্যেক পৌত্রী = ২ : ১।

২) মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদ বণ্টনের সময় তার ইয়াতীম দৌহিত্র-দৌহিত্রীরা ততটুকু আনুপাতিক ভগ্নাংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হবে, যতটুকু ঐ ইয়াতীম দৌহিত্র-দৌহিত্রীর মাতা (তথা যার সম্পদ বণ্টন হচ্ছে তার মৃত কন্যা) জীবিত থাকলে পেতো। এটি আবার দৌহিত্র-দৌহিত্রীর মধ্যে এভাবে বণ্টিত হবে যে, প্রত্যেক দৌহিত্র: প্রত্যেক দৌহিত্রী = ২ : ১।

৩) যদি মৃত ব্যক্তির ওয়ারিস হয় তার এক পুত্রের সূত্রে দুই পৌত্র এবং অন্য পুত্রের সূত্রে এক পৌত্র তাহলে প্রথম পুত্রের সূত্রে দুই পৌত্র যা পাবে, দ্বিতীয় পুত্রের সূত্রে এক পৌত্র একাই তা পাবে। অর্থাৎ পৌত্ররা নিজ নিজ পিতা জীবিত থাকলে যে অংশ পেতো সেই অংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হবে।
৪) যদি মৃত ব্যক্তির কোনো পুত্রের সূত্রে একটি পৌত্রী এবং কোনো কন্যার সূত্রে একটি দৌহিত্র থাকে, তাহলে পৌত্রীটি তার পিতার (তথা মৃতের পুত্রের) আনুপাতিক ভগ্নাংশ এবং দৌহিত্রটি তার মাতার (তথা মৃতের কন্যার) আনুপাতিক ভগ্নাংশ পাবে। কারণ মৃত ব্যক্তির সাথে পৌত্রীর সম্পর্কসূত্র মৃত ব্যক্তির পুত্রের মাধ্যমে এবং দৌহিত্রের সম্পর্কসূত্র মৃত ব্যক্তির কন্যার মাধ্যমে। তাই মৃত ব্যক্তির পুত্রের প্রাপ্য অংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হবে পুত্রের কন্যা এবং মৃত ব্যক্তির কন্যার অংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হবে কন্যার পুত্র।

মৃত পিতা-মাতার জন্য আনুপাতিক ভগ্নাংশ বহাল রেখে তা দাদা-দাদী ও নানা-নানীকে দেয়া এবং মৃত পুত্র-কন্যার জন্য আনুপাতিক ভগ্নাংশ বহাল রেখে তা পৌত্র-পৌত্রী ও দৌহিত্র-দৌহিত্রীকে দেয়ার যুক্তি
মৃত পিতা-মাতার জন্য কিভাবে আনুপাতিক ভগ্নাংশ বিবেচনা করা যেতে পারে যা দাদা-দাদী ও নানা-নানীকে দেয়া হবে? অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির জন্য কোনো আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণের যৌক্তিকতা আছে কিনা? অনুরূপ প্রশ্ন পুত্র-কন্যার অংশ পৌত্র-পৌত্রী, দৌহিত্র-দৌহিত্রীকে দেয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
এ প্রশ্নটির উত্তর দাদা-দাদী ও নানা-নানী এবং ইয়াতীম পৌত্র-পৌত্রী, দৌহিত্র- দৌহিত্রীর উত্তরাধিকার নির্ণয়ের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এ প্রশ্নের উত্তরে প্রথম জ্ঞাতব্য বিষয় হচ্ছে, যদি পিতার পাশাপাশি দাদা-দাদীও মৃত হয় তাহলে ঐ পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ বিবেচনা করা হবে না। কারণ তাঁর সম্পর্কসূত্রে কোনো ঊর্ধ্বতন পিতা-মাতা উপস্থিত নেই। পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ তখনি বিবেচনা করা হবে যখন দাদা-দাদী জীবিত থাকে। কারণ দাদা-দাদী পিতা-মাতাতুল্য কিন্তু পিতা জীবিত থাকলে তাঁরা স্তরগত দূরত্বের কারণে নিকটতম হিসেবে সাব্যস্ত হন না। আর পিতা জীবিত না থাকলে তাঁরা নিকটতম সাব্যস্ত হওয়ার ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতা ছিল তা অপসারিত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে আবার তাঁরা পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশেরই স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হন, কারণ মৃত ব্যক্তির সাথে তাঁদের সম্পর্কসূত্র তৈরি হয়েছে পিতার মাধ্যমে। এমতাবস্থায় পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশকে বিবেচনা করতে হয় অর্থাৎ পিতা জীবিত থাকলে কত পেতো তা বিবেচনা করতে হয়।

কাউকে একবার জীবিত এবং একবার মৃত বিবেচনা করে উত্তরাধিকার নির্ধারণের প্রমাণ হচ্ছে ৪:১৭৬ আয়াতে একটি পুরুষ সন্তানহীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে তার একটি বোন থাকলে সে কত পাবে তা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু তার পরপরই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিপরীতক্রমে তথা যদি এমন হয় যে, ভাইটিই জীবিত আছে এবং বোনটিই সন্তানহীনা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে তাহলে ভাইটি বোনটির উত্তরাধিকারী হবে। এ থেকে বুঝা যায় যে, উত্তরাধিকার নির্ধারণের ক্ষেত্রে কেউ মৃত হওয়া সত্ত্বেও যদি সে জীবিত থাকতো তাহলে তার উত্তরাধিকার কত হতো তা বিবেচনা করার অবকাশ রয়েছে। আর মৃত পিতাকে সে জীবিত থাকলে কত পেতো তা বিবেচনা করতে হয় তার সম্পর্কসূত্রে সম্পর্কিত দাদা-দাদীর প্রাপ্য অংশ নির্ধারণের প্রয়োজনে, অন্যথায় এটি বিবেচনা করা প্রয়োজন হতো না।
নানা-নানী থাকা অবস্থায় মৃত মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশকে বিবেচনা করা, পৌত্র-পৌত্রী থাকা অবস্থায় মৃত পুত্রের আনুপাতিক অংশকে বিবেচনা করা এবং দৌহিত্র-দৌহিত্রী থাকা অবস্থায় মৃত কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশকে বিবেচনা করার ক্ষেত্রেও অনুরূপ কথা প্রযোজ্য।

অধ্যায় ১৩ : ইয়াতীম নাতিকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার যুক্তি খন্ডন
কুরআন অনুসারে পিতাকে বুঝাতে ‘আবুন’ এবং পিতা ও দাদাকে একসাথে বুঝাতে ‘আবাওয়ায়’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ পিতা ও দাদা উভয়ে পিতৃপুরুষ এবং পিতা প্রসঙ্গে দেয়া বিধানই দাদা ও নানার প্রসঙ্গে প্রযোজ্য। অনুরূপভাবে মাতার প্রসঙ্গে দেয়া বিধানই দাদী ও নানীর প্রসঙ্গে প্রযোজ্য।
ইয়াতীম নাতিকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য যেসব যুক্তি দেয়া হয়
ইয়াতীম নাতিকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য যেসব যুক্তি দেয়া হয় তা নিম্নরূপ:
১) মৃত ব্যক্তির কোনো পুত্র থাকলে তার ইয়াতীম নাতি উত্তরাধিকার পাবে না। কারণ কুরআন অনুসারে উত্তরাধিকার পাওয়ার জন্য মৃত ব্যক্তির আক্বরাবূন/নিকটতম হতে হবে। ইয়াতীম নাতির তুলনায় তার চাচা (তথা যার সম্পদ বণ্টন হচ্ছে তার পুত্র) আক্বরাবূন/নিকটতম। তাই ইয়াতীম নাতির চাচা জীবিত থাকার কারণে ইয়াতীম নাতি বঞ্চিত হবে।
২) যেহেতু অসহায়ত্বকে উত্তরাধিকারের ভিত্তি বানানো হয়নি বরং আক্বরাবূন/নিকটতম হওয়াকে উত্তরাধিকারের ভিত্তি বানানো হয়েছে। তাই ইয়াতীম নাতির চাচারা স্বচ্ছল হলেও তারা উত্তরাধিকার পাবে এবং ইয়াতীম নাতিরা অসহায় হলেও তারা উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
৩) ইয়াতীম নাতি সব সময় অসহায় নাও হতে পারে। এটাও সম্ভব যে, ইয়াতীম নাতির পিতা অনেক সম্পদ রেখে গিয়েছে। তাই ইয়াতীম নাতি দাদার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হওয়াকে অমানবিক বলে দেয়া উচিত নয়। এমনকি একাধিক পুত্র তাদের বয়স, যোগ্যতা, স্বচ্ছলতার পার্থক্য সত্ত্বেও যেমন পরস্পর সমান হারে সম্পত্তি পায়, অনুরূপভাবে ইয়াতীম নাতি নিয়ম বহির্ভুত হওয়ার কারণে বঞ্চিত হয়। এক্ষেত্রে মানবিকতার চেয়ে উত্তরাধিকার বণ্টনের নিয়মকে প্রাধান্য দিতে হবে।
৪) ইয়াতীম নাতিদেরকে উত্তরাধিকার দিলে যেসব নাতি ইয়াতীম নয় তাদেরকেও উত্তরাধিকার দিতে হতো। কারণ অন্যথায় নাতিদের মধ্যে বৈষম্য হতো। অন্য নাতিরা তাদের পিতার মাধ্যমে পাবে বিধায় তাদেরকে না দিয়ে শুধু ইয়াতীম নাতিকে দেয়া সঠিক হতো না। কারণ তাদের পিতা তাদের জন্য সম্পদ রেখে যাবে নাকি খরচ করে ফেলবে তা অনিশ্চিত। আবার তারা তাদের পিতা থেকে দাদার সম্পদই পাবে এমন নয়, বরং তাদের জন্য তাদের পিতা নিজ উপার্জিত সম্পদ রেখে যেতে পারে।
৫) ইয়াতীম নাতিদের জন্য ২:১৮০-১৮২ আয়াতে বর্ণিত ওয়াসিয়্যাতের বিধান অনুসারে ওয়াসিয়্যাত করা যেতে পারে। সুতরাং ইয়াতীম নাতিকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা অযৌক্তিক নয়।
৬) উত্তরাধিকার বণ্টনের সময় ইয়াতীমরা উপস্থিত হলে তাদেরকে কিছু দিতে হবে বলে ৪:৮ আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাই ইয়াতীম নাতিরা উপস্থিত হলে তাদেরকে কিছু দেয়া যেতে পারে, তাই তাদেরকে উত্তরাধিকারের কোনো নির্ধারিত অংশ পাওয়া থেকে বঞ্চিত করা অযৌক্তিক নয়।

ইয়াতীম নাতিকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার যুক্তি খন্ডন

ইয়াতীম নাতিকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য যেসব যুক্তি দেয়া হয় নিম্নে সেগুলো খন্ডন করা হলো:
১) কুরআনে যেমন ইয়াতীম নাতিকে সরাসরি উত্তরাধিকারী করা হয় হয়নি, তেমনি দাদাকেও সরাসরি উত্তরাধিকারী করা হয়নি। কিন্তু কুরআনে ‘আক্বরাবূন’ এবং সম্পদ বণ্টন প্রসঙ্গে যেসব তথ্য রয়েছে তার অনুসিদ্ধান্ত হিসেবে পিতার অবর্তমানে দাদা পিতার জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক ভগ্নাংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হয়। অনুরূপভাবে পুত্রের অবর্তমানে ইয়াতীম নাতি পুত্রের জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক ভগ্নাংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হয়।
দাদাকে পিতার জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক ভগ্নাংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে চাচা প্রতিবন্ধক নয়। কারণ দাদার সাথে নাতির সম্পর্ক চাচার মাধ্যমে স্থাপিত হয়নি বরং পিতার মাধ্যমে স্থাপিত হয়েছে। তাই যার মাধ্যমে সম্পর্ক সূত্র তৈরি হয়েছে তার উপস্থিতিতে তার পূর্বের স্তরের পিতা (অর্থাৎ দাদা) আক্বরাবূন হয় না, কিন্তু পিতার অনুপস্থিতিতে দাদা আক্বরাবূন হয়।
অনুরূপভাবে ইয়াতীম নাতির চাচা ঐ নাতিকে (তথা মৃত দাদার দ্বিতীয় স্তরের পুত্রকে) তার দাদার সম্পদে পুত্রের জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক ভগ্নাংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক নয়। কারণ ইয়াতীম নাতির চাচার মাধ্যমে নয়, বরং নিজ পিতার মাধ্যমেই তার দাদার সাথে তার সম্পর্কসূত্র তৈরি হয়েছে।
দাদা যেমন পিতা হিসেবে সাব্যস্ত তেমনি নানাও পিতা হিসেবে সাব্যস্ত। কিন্তু নানার সাথে সম্পর্ক হচ্ছে মাতার মাধ্যমে। তাই মাতার উপস্থিতিতে নানা উত্তরাধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আক্বরাবূন হতে পারেন না। অনুরূপভাবে কন্যার উপস্থিতিতে নাতি (কন্যার পুত্র) উত্তরাধিকার পাবে না, কিন্তু কন্যা জীবিত না থাকলে ঐ কন্যার পুত্র নিজ নানার সম্পদে উত্তরাধিকার পাবে।
এক্ষেত্রে দ্বিতীয় যুক্তি হচ্ছে, প্রচলিত নিয়মে ‘যাবিল আরমহামের’ (রক্তসম্পর্কিত আত্মীয়দের) মধ্যে বণ্টনের একটি ধারা হলো: মাতার পিতার পিতা পাবেন ২/৩  এবং মাতার পিতার মাতা পাবেন ১/৩ । কারণ তাঁরা উভয়ে মৃত ব্যক্তির সাথে তার মাতার মাধ্যমে সম্পর্কিত এবং একই স্তরে রয়েছেন।
উপরিউক্ত ধারাটিতে যে বণ্টননীতি অবলম্বন করা হয়েছে তা যথার্থ এবং একই নীতি ইয়াতীম নাতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ ইয়াতীম নাতি তার পিতা জীবিত থাকলে যে আনুপাতিক ভগ্নাংশ লাভ করতেন তার স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হিসেবে সাব্যস্ত হবে। অথচ প্রচলিত নিয়মে ইয়াতীম নাতিকে বঞ্চিত করা হয়। বস্তুত ইয়াতীম নাতিকে বঞ্চিত করা যুক্তিসিদ্ধ নয়।

২) অসহায়ত্বকে উত্তরাধিকারের বিধানের ভিত্তি বানানো হয়নি, কিন্তু উত্তরাধিকার বণ্টন বিধির ক্ষেত্রে অবশ্যই অসহায়ত্বের সাধারণ মাত্রাগত তারতম্যকে গড় হিসেবের নিয়মে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাই পুত্র ও কন্যা উভয়ে ওয়ালাদ বা সন্তান হওয়া সত্ত্বেও পুত্রের দায়-দায়িত্ব বিবেচনায় কন্যার চেয়ে পুত্রকে দ্বিগুণ দেয়া হয়েছে। গড় তারতম্যের সাথে বাস্তবে কখনো ব্যতিক্রম হতে পারে, কিন্তু গড় তারতম্য বিবেচনায় যেভাবে স্থায়ী বণ্টন বিধি দেয়া হয়েছে সেভাবেই বণ্টন করতে হবে। এটা নিশ্চিত যে, সকল ইয়াতীম অসহায় না হলেও সাধারণভাবে ইয়াতীম নাতিরা তুলনামূলক অসহায়ত্বের অবস্থায় থাকে। এ কারণে ইয়াতীম নাতিদেরকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা উত্তরাধিকারের সাধারণ মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

ইয়াতীমদের সাধারণ অসহায়ত্বকে কুরআনে বিশেষ গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সূরা নিসা ৪:৯-১০ আয়াতের বক্তব্য হচ্ছে:
৪:৯ :: আর তারা যেন ভয় করে যে, যদি তারা তাদের পেছনে দুর্বল-অসহায় সন্তানাদি রেখে যেতো তবে তারা তাদের বিষয়ে উদ্বিগ্ন হতো, সুতরাং তারা যেন আল্লাহ সচেতন হয় এবং সঙ্গত কথা বলে।
৪:১০ :: নিশ্চয় যারা ইয়াতীমের মালসম্পদ গ্রাস করার জুলুম করে, বস্তুত তারা তাদের পেটে আগুন খাচ্ছে, আর শীঘ্রই তারা জ্বলন্ত আগুনে জ্বলবে।
৩) ইয়াতীম নাতির পিতা অনেক সম্পদ রেখে গেলেও তাদেরকে তাদের প্রাপ্য নির্ধারিত অংশ দিতে হবে এবং সম্পদ না রেখে গেলেও ইয়াতীম নাতি তার দাদার থেকে নির্ধারিত প্রাপ্য অংশ পাবে। ইয়াতীম নাতিকে বঞ্চিত করাকে নিয়ম মনে করা একটি বহুল প্রচলিত ভুল।

৪) ইয়াতীম নাতি ছাড়া অন্য নাতির পিতা যা লাভ করবে তা খরচ করার ক্ষেত্রেও ঐ নাতিরা উপকৃত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। কারণ তাদের পিতা তাদের জন্য খরচ করতে পারে। আর তাদের পিতা ঐ সম্পদকে কাজে লাগিয়ে আরো উপার্জন করার ক্ষেত্রেও ঐ সম্পদের উপযোগিতা রয়েছে। সুতরাং সেক্ষেত্রেও তারা তাদের দাদার সম্পদ থেকে পরোক্ষভাবে উপকৃত হয়। এছাড়া পিতা-মাতা ও সন্তান থাকা অবস্থায় ভাই-বোন উত্তরাধিকার পায় না। এর একটি যৌক্তিকতা হচ্ছে পিতা-মাতা যা পাবে তা থেকে ভাই-বোন উপকৃত হতে পারবে। সুতরাং ইয়াতীম নাতি ছাড়া অন্য নাতি দাদার সম্পদ থেকে পরোক্ষভাবে উপকৃত হয় বিধায় তাদেরকে আলাদাভাবে ওয়ারিস সাব্যস্ত না করা কিন্তু ইয়াতীম নাতিকে তার পিতা জীবিত থাকলে যে অংশ লাভ করতো তার স্থলাভিষিক্ত করার মধ্যে কোনো বৈষম্য নেই। পিতার অবর্তমানে যেমন দাদা-দাদী উত্তরাধিকার পায় কিন্তু নানা-নানী উত্তরাধিকার পায় না, কারণ মৃত ব্যক্তির সাথে নানা-নানীর সম্পর্কসূত্র তার পিতার মাধ্যমে তৈরি হয়নি; তেমনি ইয়াতীম নাতি তার পিতার প্রাপ্য অংশের স্থলাভিষিক্ত হয়, কিন্তু অন্য নাতি উত্তরাধিকার পায় না কারণ তার সাথে তার দাদার সম্পর্কসূত্র তৈরি হয়েছে তার পিতার মাধ্যমে, আর তার পিতা জীবিত থাকায় সে কারো অংশের স্থলাভিষিক্ত নয়।

৫) ২:১৮০-১৮২ আয়াতে পিতা-মাতা ও আক্বরাবূনদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করাকে মৃত্যু নিকটবর্তী ব্যক্তির উপর বাধ্যতামূলক বিধান করা হয়েছে। আয়াত অনুসারে ইয়াতীম নাতির জন্য ওয়াসিয়্যাত করার সুযোগ রয়েছে বিধায় ইয়াতীম নাতি উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে বলে দাবি করা যৌক্তিক নয়। কারণ এ আয়াত অনুসারে পিতা-মাতার জন্য এবং সন্তানদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করা বাধ্যতামূলক। আবার উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধিতে পিতা-মাতার এবং সন্তানদের আনুপাতিক অংশ রয়েছে। অনুরূপভাবে এ আয়াত অনুসারে দাদা-দাদীও ওয়াসিয়্যাতের আওতাভুক্ত। অথচ পিতা-মাতা জীবিত না থাকলে দাদা-দাদী পিতা-মাতার প্রাপ্য অংশের স্থলাভিষিক্ত হয়। অনুরূপভাবে এ আয়াত অনুসারে ইয়াতীম নাতি ওয়াসিয়্যাতের আওতাভুক্ত। আবার ইয়াতীম নাতি মৃতের পুত্র-কন্যার প্রাপ্য অংশের স্থলাভিষিক্ত হবে।

যদিও গ্রহণযোগ্য মত নয়, তবু উল্লেখ্য যে, একটি মত অনুসারে, ২:১৮০-১৮২ আয়াত রহিত হয়ে গেছে তাই তা অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক নয়। একদিকে ২:১৮০-১৮২ আয়াতকে ইয়াতীম নাতিকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার প্রতিবিধান হিসেবে প্রস্তাব করা এবং অন্যদিকে ওয়াসিয়্যাতের আয়াতকে রহিত বলে দাবি করার মাধ্যমে সার্বিকভাবে ইয়াতীম নাতি সর্বপ্রকার অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকে যায়।

৬) ৪:৮ আয়াতে উত্তরাধিকার বণ্টনের সময় আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও মিসকীন উপস্থিত হলে তাদেরকে তা থেকে উপজীবিকা হিসেবে কিছু দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর ন্যুনতম পরিমাণ হিসেবে সমাজে যে প্রস্তাবটি চালু রয়েছে তা হলো, তাদেরকে এক বেলা খাইয়ে দেয়া। এ বিষয়ে একটি প্রচলিত (তবে অগ্রহণযোগ্য) দাবি হলো, ৪:৮ আয়াতটি রহিত হয়ে গেছে। আবার কারো কারো দাবি হলো, উত্তরাধিকার বণ্টনের পরে কিছু অবশিষ্ট থাকলে এ বিধান কার্যকর হবে। অথচ আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি অনুসারে কিছু অবশিষ্ট থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং এ দাবিটিও গ্রহণযোগ্য নয়। এসব প্রেক্ষিতে ইয়াতীম নাতিকে মিরাস থেকে বঞ্চিত করার প্রতিবিধান হিসেবে ৪:৮ আয়াতের নির্দেশনা পরিপালনের প্রস্তাব বাস্তবে অকার্যকর হয়ে রয়েছে।

বস্তুত ৪:৮ আয়াতের নির্দেশনা অনুসারে ওয়ারিসদের পারস্পরিক সম্মতিক্রমে ইয়াতীম নাতিকে সম্পদের একটি অংশ দেয়ার জন্য নির্ধারণ করলেও তা তাদেরকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার পক্ষে কোনো যৌক্তিক ভিত্তি হবে না।
সুতরাং ইয়াতীম নাতিকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য যেসব যুক্তি দেয়া হয় তা গ্রহণযোগ্য নয়। দাদা যেমন পিতার প্রাপ্য অংশের স্থলাভিষিক্ত হয়, ইয়াতীম নাতিও তেমনি পুত্রের প্রাপ্য অংশের স্থলাভিষিক্ত হবে।

স্থলাভিষিক্ত উত্তরাধিকারিত্বের প্রয়োগ সীমা
পিতা-মাতার অবর্তমানে দাদা-দাদী ও নানা-নানী পিতা-মাতার প্রাপ্য অংশের স্থলাভিষিক্ত হন। পুত্র-কন্যার অবর্তমানে পৌত্র-পৌত্রী ও দৌহিত্র-দৌহিত্রী পুত্র-কন্যার প্রাপ্য অংশের স্থলাভিষিক্ত হন। কারণ এ অবস্থায় ঊর্ধ্বতন বা অধ:স্তন সম্পর্কসূত্রের মাধ্যমিক স্তর অনুপস্থিত থাকায় তারা মৃত ব্যক্তির আক্বরারবূন বা নিকটতম হন।
কিন্তু এ স্থলাভিষিক্ততা শুধুমাত্র পিতা-মাতা ও পুত্র-কন্যা শ্রেণির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কারণ দাদা-দাদী ও নানা-নানী পিতা-মাতাতুল্য। কিন্তু পিতা-মাতা জীবিত থাকায় তাঁরা উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে আক্বরাবূন বা নিকটতম হন না বিধায় তখন উত্তরাধিকার পাবেন না। অন্যদিকে পিতা-মাতা জীবিত না থাকলে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে আক্বরাবূন বা নিকটতম হন বিধায় তখন উত্তরাধিকার পাবেন। অনুরূপভাবে পৌত্র-পৌত্রী ও দৌহিত্র-দৌহিত্রী পুত্র-কন্যাতুল্য। কিন্তু পুত্র-কন্যা জীবিত থাকায় তারা উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে আক্বরাবূন বা নিকটতম হয় না বিধায় তখন উত্তরাধিকার পাবে না। অন্যদিকে পুত্র-কন্যা জীবিত না থাকলে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে আক্বরাবূন বা নিকটতম হয় বিধায় তখন উত্তরাধিকার পাবে।
পিতা-মাতা ও পুত্র-কন্যা শ্রেণি ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারের স্থলাভিষিক্ততা প্রযোজ্য নয়। তাই পুত্র-কন্যা ছাড়া অন্য কোনো ওয়ারিস তার সন্তান রেখে গেলে তার সন্তান তার প্রাপ্য অংশের স্থলাভিষিক্ত হবে না। যেমন, কোনো ভাই তার সন্তান রেখে গেলে ঐ সন্তান (তথা যার উত্তরাধিকার বন্টন হবে তার ভাতিজা) মৃত ব্যক্তির ভাইয়ের প্রাপ্য অংশের স্থলাভিষিক্ত হবে না। অনুরূপভাবে, চাচা দাদার প্রাপ্য অংশের স্থলাভিষিক্ত হবে না।

একই যুক্তিতে, কোনো স্ত্রীর স্বামী না থাকলে স্বামীর জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ তার ভিন্ন স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান পাবে না এবং কোনো স্বামীর স্ত্রী না থাকলে স্ত্রীর জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ তার গর্ভধারণকৃত ভিন্ন স্বামীর সন্তান পাবে না।

অধ্যায় ১৪ : এক নজরে ওয়ারিসদের আনুপাতিক ভগ্নাংশসমূহ
আয়াতসমূহের সমন্বিত তথ্য অনুযায়ী আনুপাতিক ভগ্নাংশ সম্পর্কিত ধারাসমূহ
৪:১১, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ অনুযায়ী, ওয়ারিসদের মধ্যে উত্তরাধিকার বণ্টনের ভগ্নাংশসমূহের প্রত্যক্ষ ধারাসমূহ নিম্নরূপ:
১. সন্তানদের মধ্যে এক পুরুষ পাবে = দুই নারীর অংশের মতো। (অর্থাৎ এক পুত্রের অংশ = দুই কন্যার অংশের মতো)।
২. যদি সন্তানগণ হয় নারী, দুই বা দুইয়ের বেশি তবে তারা সমষ্টিগতভাবে পাবে = ২/৩ । (অর্থাৎ দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যা পাবে = ২/৩ )।
৩. যদি সন্তানটি হয় একজনই (কন্যা) তবে সে পাবে = ১/২ । (অর্থাৎ একটিমাত্র কন্যা থাকলে সে পাবে = ১/২ )।
৪. যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান (পুত্র/কন্যা) থাকে, তাহলে পিতা ও মাতা দুজনের প্রত্যেকে পাবে = ১/৬ । (অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকলে, পিতা পাবে = ১/৬ , মাতা পাবে = ১/৬ )।
৫. যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান (পুত্র/কন্যা) না থাকে, তাহলে তার পিতা-মাতা তার ওয়ারিস হলে, মাতা পাবে = ১/৩ ।
৬. যদি মৃত ব্যক্তির (সন্তান না থাকা অবস্থায় তার) ভাই-বোন থাকে, তাহলে মাতা পাবে =  ১/৬ । (অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির সন্তান নাই কিন্তু ভাই-বোন আছে, এ অবস্থায় মাতা পাবে = ১/৬ )।
৭. যদি মৃত স্ত্রীর সন্তান (পুত্র/কন্যা) না থাকে, তাহলে স্বামী পাবে = ১/২ ।
৮. যদি মৃত স্ত্রীর সন্তান (পুত্র/কন্যা) থাকে, তাহলে স্বামী পাবে = ১/৪ ।
৯. যদি মৃত স্বামীর সন্তান (পুত্র/কন্যা) থাকে, তাহলে স্ত্রী পাবে =  ১/৪ ।
১০. যদি মৃত স্বামীর সন্তান (পুত্র/কন্যা) থাকে, তাহলে স্ত্রী পাবে =  ১/৮ ।
১১. যদি কোনো পুরুষ বা নারী এরূপ হয় যে, তাকে পূর্বসূরী করা হয়েছে (অর্থাৎ তার উত্তরসূরী থাকে) এবং সে [মৃত পুরষটি বা নারীটি] কালালাহ হয়, তবে তার এক ভাই বা এক বোন থাকলে, তাদের দুজনের প্রত্যেকে/ দুজনের যে-ই থাকুক সে পাবে =  ১/৬ । (অর্থাৎ তার এক ভাই থাকলে ভাইটি পাবে ১/৬  অথবা এক বোন থাকলে বোনটি পাবে = ১/৬ )
১২. যদি ১১ নং ধারায় বর্ণিত অবস্থায় একাধিক ভাই/বোন থাকে, তবে ভাই-বোনেরা সম্মিলিতভাবে পাবে = ১/৩ ।
১৩. কালালাহর মধ্যে সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে, যদি কোনো মৃত পুরুষের সন্তান (পুত্র/কন্যা) না থাকে এবং তার একটি বোন থাকে, তবে বোনটি পাবে = ১/২ ।
১৪. যদি মৃত বোনের কোনো সন্তান (পুত্র/কন্যা) না থাকে, তবে তার ভাই তার ওয়ারিস হবে।
১৫. যদি মৃত ব্যক্তির বোন দুজন হয় তবে তারা সমষ্টিগতভাবে পাবে = ২/৩ ।
১৬. যদি মৃত ব্যক্তির কয়েকজন ভাই/বোন থাকে, তবে এক ভাই পাবে = দুই বোনের অংশের মতো।
৪:৭ ও ৪:৩৩ আয়াত অনুযায়ী, সম্পদ বণ্টন পদ্ধতির দুটি মৌলিক শর্ত
১. কুরআনে যাদেরকে মাওয়ালী বা আক্বরাবূন ওয়ারিস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তাদের কেউ না কেউ জীবিত থাকা অবস্থায় অন্য কেউ ওয়ারিস হবে না।
২. কুরআনে যাদেরকে মাওয়ালী বা আক্বরাবূন ওয়ারিস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তাদের মধ্যকার যে বা যারাই জীবিত থাকুক সে বা তারা সমস্ত সম্পদ পাবে, কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
এক নজরে ওয়ারিসদের আনুপাতিক ভগ্নাংশসমূহ
নিম্নে ৪:৭ ও ৪:৩৩ আয়াতের শর্ত অনুসারে ৪:১১, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতের বর্ণিত বণ্টন বিধির ভিত্তিতে এক নজরে ওয়ারিসদের আনুপাতিক ভগ্নাংশসমূহ উল্লেখ করা হলো:
পুত্র-কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ
১. একাধিক কন্যা, অথবা এক বা একাধিক পুত্র, অথবা পুত্র-কন্যা সম্মিলিতভাবে পাবে ২/৩ । যদি পুত্র-কন্যা যৌথভাবে থাকে, তবে এই ২/৩  অংশে পুত্র:কন্যা = ২:১ অনুপাতে বণ্টন হবে।
২. পুত্র না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র কন্যা থাকলে সে পাবে ১/২ ।
পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ
৩. পুত্র/কন্যা/পুত্র-কন্যা থাকলে মাতা পাবে ১/৬ ।
৪. পুত্র/কন্যা/পুত্র-কন্যা থাকলে পিতা পাবে ১/৬ ।
৫. কোনো সন্তান না থাকলে এবং কোনো ভাই বা বোনও না থাকলে মাতা পাবে ১/৩ ।
৬. কোনো সন্তান না থাকলে এবং কোনো ভাই বা বোনও না থাকলে পিতা পাবে ২/৩ ।
৭. কোনো সন্তান না থাকলে কিন্তু ভাই/বোন/ভাই-বোন থাকলে মাতা পাবে ১/৬ ।
৮. কোনো সন্তান না থাকলে কিন্তু ভাই/বোন/ভাই-বোন থাকলে পিতা পাবে ১/৬ ।
স্বামী/স্ত্রীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ
৯. স্ত্রীর কোনো সন্তান না থাকলে স্বামী পাবে ১/২ ।
১০. স্ত্রীর পুত্র/কন্যা/পুত্র-কন্যা থাকলে স্বামী পাবে ১/৪ ।
১১. স্বামীর কোনো সন্তান না থাকলে স্ত্রী পাবে ১/৪ ।
১২. স্বামীর পুত্র/কন্যা/পুত্র-কন্যা থাকলে স্ত্রী পাবে ১/৮ ।
ভাই-বোনের আনুপাতিক ভগ্নাংশ
১৩. মৃত ব্যক্তির কোনো সন্তান না থাকলে, একাধিক বোন, অথবা এক বা একাধিক ভাই, অথবা ভাই-বোন সম্মিলিতভাবে পাবে ২/৩ । যদি ভাই-বোন যৌথভাবে থাকে, তবে এই ২/৩  অংশে ভাই:বোন = ২:১ অনুপাতে বণ্টন হবে।
১৪. মৃত ব্যক্তির কোনো সন্তান না থাকলে, ভাই না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র বোন থাকলে সে পাবে ১/২ ।
১৫. মৃত ব্যক্তির পুত্র/কন্যা/পুত্র-কন্যা থাকলে কিন্তু পিতা-মাতা না থাকলে, একটিমাত্র ভাই থাকলে সে পাবে ১/৬ ।
১৬. মৃত ব্যক্তির পুত্র/কন্যা/পুত্র-কন্যা থাকলে কিন্তু পিতা-মাতা না থাকলে, একটিমাত্র বোন থাকলে সে পাবে ১/৬ ।
১৭. মৃত ব্যক্তির পুত্র/কন্যা/পুত্র-কন্যা থাকলে কিন্তু পিতা-মাতা না থাকলে, একাধিক ভাই, অথবা একাধিক বোন, অথবা ভাই-বোন সম্মিলিতভাবে পাবে ১/৩ । এই ১/৩  অংশ তাদের মধ্যে সমানুপাতে (পরস্পর সমান অনুপাতে) বণ্টন হবে।
দাদা-দাদীর ও নানা-নানীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ
১৮. দাদা-দাদী হচ্ছে পিতা-মাতাতুল্য, তবে পিতা জীবিত থাকা অবস্থায় দাদা-দাদী স্তরগত পার্থক্যের কারণে ‘আক্বরাবূন’ হিসেবে সাব্যস্ত হয় না। পিতা জীবিত না থাকলে, পিতার অংশ দাদা-দাদীর মধ্যে বণ্টিত হবে। এমতাবস্থায় ঐ অংশটি দাদা-দাদীর মধ্যে সেভাবে বণ্টিত হবে পিতার অংশটি মাতার সাথে যে আনুপাতিক হারে নির্ধারিত হয়েছে সে অনুসারে দাদার আনুপাতিক অংশ হবে পিতার অনুরূপ এবং দাদীর আনুপাতিক অংশ হবে মাতার অনুরূপ।
১৯. নানা-নানী হচ্ছে পিতা-মাতাতুল্য, তবে মাতা জীবিত থাকা অবস্থায় নানা-নানী স্তরগত পার্থক্যের কারণে ‘আক্বরাবূন’ হিসেবে সাব্যস্ত হয় না। মাতা জীবিত না থাকলে, মাতার অংশ নানা-নানীর মধ্যে বণ্টিত হবে। এমতাবস্থায় ঐ অংশটি নানা-নানীর মধ্যে সেভাবে বণ্টিত হবে মাতার অংশটি পিতার সাথে যে আনুপাতিক হারে নির্ধারিত হয়েছে সে অনুসারে নানীর আনুপাতিক অংশ হবে মাতার অনুরূপ এবং নানার আনুপাতিক অংশ হবে পিতার অনুরূপ।
২০. দাদা-দাদী ও নানা-নানী হচ্ছে পিতা-মাতাতুল্য, তবে পিতা-মাতা জীবিত থাকা অবস্থায় দাদা-দাদী ও নানা-নানী স্তরগত পার্থক্যের কারণে ‘আক্বরাবূন’ হিসেবে সাব্যস্ত হয় না। পিতা-মাতা জীবিত না থাকলে, পিতা-মাতার অংশ দাদা-দাদী ও নানা-নানীর মধ্যে বণ্টিত হবে। এমতাবস্থায় ঐ অংশটি দাদা-দাদী ও নানা-নানীর মধ্যে এভাবে বণ্টিত হবে যে, পিতার আনুপাতিক অংশ লাভ করবে দাদা-দাদী, কারণ তাঁরা পিতার সম্পর্কসূত্রে মৃতের সাথে সম্পর্কিত। আর মাতার আনুপাতিক অংশ লাভ করবেন নানা-নানী, কারণ তাঁরা মাতার মাধ্যমে মৃতের সাথে সম্পর্কিত। তারপর আবার দাদা-দাদীর পারস্পরিক অংশের অনুপাত হবে পিতা-মাতার পারস্পরিক অনুপাতের অনুরূপ। আর নানা-নানীর পারস্পরিক অংশের অনুপাত হবে পিতা-মাতার পারস্পরিক অনুপাতের অনুরূপ।
পৌত্র-পৌত্রী এবং দৌহিত্র-দৌহিত্রীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ
* পৌত্র = পুত্রের পুত্র, পৌত্রী = পুত্রের কন্যা, দৌহিত্র = কন্যার পুত্র, দৌহিত্রী = কন্যার কন্যা।
২১. পৌত্র-পৌত্রী হচ্ছে পুত্র-কন্যাতুল্য, তবে কোনো পুত্র জীবিত থাকা অবস্থায় ঐ পুত্রের সূত্রে থাকা পৌত্র-পৌত্রী স্তরগত পার্থক্যের কারণে ‘আক্বরাবূন’ হিসেবে সাব্যস্ত হয় না। কোনো পুত্র জীবিত না থাকলে, তার অংশ তার সূত্রে থাকা পৌত্র-পৌত্রীর মধ্যে বণ্টিত হবে। এমতাবস্থায় ঐ অংশটি ঐ পৌত্র-পৌত্রীর মধ্যে সেভাবে বণ্টিত হবে পুত্র-কন্যার মধ্যে যেভাবে বণ্টিত হয়ে থাকে। কিন্তু যদি পৌত্র না থাকা অবস্থায় শুধু পৌত্রী থাকে তবে সে একাই ঐ অংশটি লাভ করবে। অনুরূপভাবে যদি পৌত্রী না থাকা অবস্থায় শুধু পৌত্র থাকে, তবে সে একাই ঐ অংশটি লাভ করবে। যদি পৌত্র না থাকা অবস্থায় একাধিক পৌত্রী থাকে, তারা পরস্পর সমানুপাতে ঐ অংশটি লাভ করবে। অনুরূপভাবে যদি পৌত্রী না থাকা অবস্থায় একাধিক পৌত্র থাকে, তারা পরস্পর সমানুপাতে ঐ অংশটি লাভ করবে।
২২. দৌহিত্র-দৌহিত্রী হচ্ছে পুত্র-কন্যাতুল্য, তবে কোনো কন্যা জীবিত থাকা অবস্থায় ঐ কন্যার সূত্রে থাকা দৌহিত্র-দৌহিত্রী স্তরগত পার্থক্যের কারণে ‘আক্বরাবূন’ হিসেবে সাব্যস্ত হয় না। কোনো কন্যা জীবিত না থাকলে, তার অংশ তার সূত্রে থাকা দৌহিত্র-দৌহিত্রীর মধ্যে বণ্টিত হবে। এমতাবস্থায় ঐ অংশটি ঐ দৌহিত্র-দৌহিত্রীর মধ্যে সেভাবে বণ্টিত হবে পুত্র-কন্যার মধ্যে যেভাবে বণ্টিত হয়ে থাকে। কিন্তু যদি দৌহিত্র না থাকা অবস্থায় শুধু দৌহিত্রী থাকে তবে সে একাই ঐ অংশটি লাভ করবে। অনুরূপভাবে যদি দৌহিত্রী না থাকা অবস্থায় শুধু দৌহিত্র থাকে, তবে সে একাই ঐ অংশটি লাভ করবে। যদি দৌহিত্র না থাকা অবস্থায় একাধিক দৌহিত্রী থাকে, তারা পরস্পর সমানুপাতে ঐ অংশটি লাভ করবে। অনুরূপভাবে যদি দৌহিত্রী না থাকা অবস্থায় একাধিক দৌহিত্র থাকে, তারা পরস্পর সমানুপাতে ঐ অংশটি লাভ করবে।

২৩. পৌত্র-পৌত্রী ও দৌহিত্র-দৌহিত্রী হচ্ছে পুত্র-কন্যাতুল্য, তবে কোনো পুত্র-কন্যা জীবিত থাকা অবস্থায় ঐ পুত্র-কন্যার সূত্রে থাকা পৌত্র-পৌত্রী ও দৌহিত্র-দৌহিত্রী স্তরগত পার্থক্যের কারণে ‘আক্বরাবূন’ হিসেবে সাব্যস্ত হয় না। কোনো পুত্র-কন্যা জীবিত না থাকলে, তাদের অংশ তাদের সূত্রে থাকা পৌত্র-পৌত্রীর ও দৌহিত্র-দৌহিত্রীর মধ্যে বণ্টিত হবে। এমতাবস্থায় ঐ অংশটি ঐ পৌত্র-পৌত্রীর ও দৌহিত্র-দৌহিত্রীর মধ্যে এভাবে বণ্টিত হবে যে, পুত্রের আনুপাতিক অংশ পাবে পৌত্র-পৌত্রী এবং কন্যার আনুপাতিক অংশ পাবে দৌহিত্র-দৌহিত্রী। আবার এক পৌত্র পাবে দুই পৌত্রীর অনুরূপ এবং এক দৌহিত্র পাবে দুই দৌহিত্রীর অনুরূপ।
২৪. এক পুত্রের সূত্রে দুই পৌত্র এবং অন্য পুত্রের সূত্রে এক পৌত্র ওয়ারিস হলে, প্রথম পুত্রের সূত্রে দুই পৌত্র যা পাবে, দ্বিতীয় পুত্রের সূত্রে এক পৌত্র একাই তা পাবে। অর্থাৎ পৌত্ররা নিজ নিজ পিতার অংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হবে।

২৫. কোনো পুত্রের সূত্রে একটি পৌত্রী এবং কোনো কন্যার সূত্রে একটি দৌহিত্র ওয়ারিস হলে, পৌত্রীটি পুত্রের আনুপাতিক অংশ এবং দৌহিত্রটি কন্যার আনুপাতিক অংশ পাবে। কারণ মৃত ব্যক্তির সাথে পৌত্রীর সম্পর্কসূত্র মৃত ব্যক্তির পুত্রের মাধ্যমে এবং দৌহিত্রের সম্পর্কসূত্র মৃত ব্যক্তির কন্যার মাধ্যমে। তাই মৃত ব্যক্তির পুত্রের অংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হবে পুত্রের কন্যা এবং মৃত ব্যক্তির কন্যার অংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হবে কন্যার পুত্র।

বৈপিত্রেয় (মাতৃশরিক) ও বৈমাত্রেয় (পিতৃশরিক) ভাই-বোনের আনুপাতিক ভগ্নাংশ
২৬. মৃত ব্যক্তির কোনো সন্তান না থাকলে, বৈপিত্রেয় (মাতৃশরিক) ও বৈমাত্রেয় (পিতৃশরিক) ভাই/বোন/ভাই-বোন সেভাবেই উত্তরাধিকার লাভ করবে যেভাবে পূর্ণ আপন (পিতৃ-মাতৃ উভশরিক) ভাই/বোন/ভাই-বোন উত্তরাধিকার লাভ করে থাকে।

২৭. মৃত ব্যক্তির পুত্র/কন্যা/পুত্র-কন্যা থাকলে এবং পিতা থাকলে (কিন্তু মাতা না থাকলে) পূর্ণ আপন ভাই-বোন এবং বৈমাত্রেয় (পিতৃশরিক) ভাই-বোন উত্তরাধিকার পাবে না, কারণ এ অবস্থায় তারা মৃত ব্যক্তির ভাই-বোন হলেও মৃত ব্যক্তির কালালাহ অবস্থানের সাপেক্ষে ভাই-বোন নয়। এমতাবস্থায় বৈপিত্রেয় (মাতৃশরিক) ভাই/বোন/ভাই-বোন ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ অনুসারে উত্তরাধিকার পাবে।

২৮. মৃত ব্যক্তির পুত্র/কন্যা/পুত্র-কন্যা থাকলে এবং মাতা থাকলে (কিন্তু পিতা না থাকলে) পূর্ণ আপন ভাই-বোন এবং বৈপিত্রেয় (মাতৃশরিক) ভাই-বোন উত্তরাধিকার পাবে না, কারণ এ অবস্থায় তারা মৃত ব্যক্তির ভাই-বোন হলেও মৃত ব্যক্তির কালালাহ অবস্থানের সাপেক্ষে ভাই-বোন নয়। এমতাবস্থায় বৈমাত্রেয় (মাতৃশরিক) ভাই/বোন/ভাই-বোন ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ অনুসারে উত্তরাধিকার পাবে।

অধ্যায় ১৫ : ওয়ারিসদের আনুপাতিক ভগ্নাংশের চার্ট

অধ্যায় ১৬: ওয়ারিসদের আনুপাতিক ভগ্নাংশের সারণি (টেবিল)




অধ্যায় ১৭ : উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির উদাহরণ
১। মৃত ব্যক্তির ১ জন কন্যা, মাতা এবং ২ জন পূর্ণ আপন ভাই আছে। তাদের মধ্যে উত্তরাধিকার সম্পত্তির বণ্টন কীরূপ হবে?
উত্তর: ১ জন কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ =  ১ /২
মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১ /৬ 
২ জন পূর্ণ আপন ভাইয়ের আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ০
২। মৃত ব্যক্তির ২ জন পুত্র, ১ জন কন্যা, স্ত্রী এবং মাতা আছে। তাদের মধ্যে উত্তরাধিকার সম্পত্তির বণ্টন কীরূপ হবে?
উত্তর: পুত্র-কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ২ /৩  
(এতে ১ পুত্র : ১ কন্যা = ২ : ১)
স্ত্রীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১ /৮  
মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১ /৬  
৩। মৃত ব্যক্তির পিতা, মাতা, স্ত্রী এবং ১ জন ভাই আছে। তাদের মধ্যে উত্তরাধিকার সম্পত্তির বণ্টন কীরূপ হবে?
উত্তর: পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১ /৬  
মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১ /৬  
স্ত্রীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১ /৪  
১ জন ভাইয়ের আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ২ /৩  
৪। মৃত ব্যক্তির পিতা, স্ত্রী ও ৩ জন বোন আছে। তাদের মধ্যে উত্তরাধিকার সম্পত্তির বণ্টন কীরূপ হবে?
উত্তর: পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১ /৬  
স্ত্রীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১ /৪  
৩ জন বোনের আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ২ /৩  
৫। মৃত ব্যক্তির পিতা, মাতা ও ২ জন স্ত্রী আছে। তাদের মধ্যে উত্তরাধিকার সম্পত্তির বণ্টন কীরূপ হবে?
উত্তর: পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ২ /৩  
মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১ /৩  
২ জন স্ত্রীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১ /৪  
(এতে ১ স্ত্রী : ১ স্ত্রী = ১ : ১)
৬। মৃত ব্যক্তির দাদী, নানা, পৌত্রী (পুত্রের কন্যা) ও দৌহিত্র (কন্যার পুত্র) আছে। তাদের মধ্যে উত্তরাধিকার সম্পত্তির বণ্টন কীরূপ হবে?
উত্তর: (পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে)
দাদীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১ /৬  
(মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে)
নানার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১ /৬  
পৌত্রী ও দৌহিত্রের সম্মিলিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ২ /৩  
(এতে পৌত্রী : দৌহিত্র = ২ : ১,
কারণ- পৌত্রী হলো পুত্রের আনুপাতিক ভগ্নাংশের স্থলাভিষিক্ত
এবং দৌহিত্র হলো কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশের স্থলাভিষিক্ত)
৭। মৃত ব্যক্তির ১ জন পুত্র, মাতা, স্ত্রী, ১ জন পূর্ণ আপন ভাই, ১ জন বৈপিত্রেয় ভাই ও ১ জন বৈমাত্রেয় ভাই আছে। তাদের মধ্যে উত্তরাধিকার সম্পত্তির বণ্টন কীরূপ হবে?
উত্তর: পুত্রের আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ২ /৩  
স্ত্রীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১ /৮  
মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১ /৬  
১ জন পূর্ণ আপন ভাইয়ের আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ০
১ জন বৈপিত্রেয় ভাইয়ের আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ০
১ জন বৈমাত্রেয় ভাইয়ের আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১ /৬  
৮। মৃত ব্যক্তির ১ জন কন্যা, ১ জন পূর্ণ আপন বোন, ১ জন বৈপিত্রেয় বোন ও ১ জন বৈমাত্রেয় বোন আছে। তাদের মধ্যে উত্তরাধিকার সম্পত্তির বণ্টন কীরূপ হবে?
উত্তর: ১ জন কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১ /২  
বোনদের আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১ /৩  
(পূর্ণ আপন বোন : বৈপিত্রেয় বোন : বৈমাত্রেয় বোন = ১ : ১ : ১)

অধ্যায় ১৮ : উত্তরাধিকার থেকে আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও মিসকীনদেরকে অনুদান প্রদান
উত্তরাধিকার (তুরাস) বণ্টনকালে উপস্থিত আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও মিসকীনের জন্য করণীয়
উত্তরাধিকার বণ্টনকালে উপস্থিত (উত্তরাধিকারী নয় এমন) আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও মিসকীনের জন্য করণীয় সম্পর্কে ৪:৮ আয়াতে নিম্নরূপ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে:
৪:৮ :: আর যদি (উত্তরাধিকার) বন্টনের সময় আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও অভাবগ্রস্তরা উপস্থিত হয়, তবে তাদেরকে তা থেকে (বণ্টিত সম্পদ থেকে) কিছু দিবে এবং তাদের সাথে সদ্ভাবে কথা বলবে।
আয়াতটিতে আত্মীয়-স্বজন প্রসঙ্গে ব্যবহৃত শব্দটি হলো ‘উলুল ক্বুরবা’। উলুল ক্বুরবা শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো ‘নৈকট্যের অধিকারী’। কিন্তু এর প্রায়োগিক অর্থ হলো ‘যারা আক্বরাবূন (সবচেয়ে নিকটতম আত্মীয়) নয় বা যারা উত্তরাধিকারের নির্ধারিত অংশের প্রাপক নয় এমন আত্মীয়-স্বজন’।
এখানে যে আত্মীয়দের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে দুই ধরনের আত্মীয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:
(১) যারা কখনো উত্তরাধিকারের নির্ধারিত অংশের প্রাপক নয়, যেমন চাচা, মামা, ফুফু, খালা, ভাতিজা, ভাতিজি, ভাগিনা, ভাগিনি, চাচাতো ভাই-বোন, ফুফাতো ভাই-বোন, মামাতো ভাই-বোন, খালাতো ভাই-বোন, চাচী, মামী, খালু, ফুফা, শ^শুর, শ^াশুড়ি, শ্যালক, শ্যালিকা ইত্যাদি।
(২) উত্তরাধিকারীদের ক্ষেত্রে যেসব শর্তাধীন আক্বরাবূন শর্ত পূরণ না হওয়ায় উত্তরাধিকারের প্রাপক হয়নি, যেমন পিতা-মাতা ও পুত্র-কন্যা জীবিত থাকা অবস্থায় ভাই-বোন; পিতা-মাতা জীবিত থাকা অবস্থায় দাদা-দাদী, নানা-নানী; পুত্র-কন্যা জীবিত থাকা অবস্থায় পৌত্র-পৌত্রী, দৌহিত্র-দৌহিত্রী।
আয়াতটিতে দ্বিতীয় যে শ্রেণির উল্লেখ করা হয়েছে তারা হলো ইয়াতীম ছেলে-মেয়ে। যদি কোনো ইয়াতীম ছেলে-মেয়ে আত্মীয় হয়, তাহলে সে একইসাথে আত্মীয় হিসেবে একটি মানবিক অধিকার রাখে এবং ইয়াতীম হিসেবেও একটি মানবিক অধিকার রাখে।
আয়াতটিতে তৃতীয় যে শ্রেণির উল্লেখ করা হয়েছে তারা হলো অভাবগ্রস্তরা। উপস্থিত অভাবগ্রস্ত যদি আত্মীয় ও ইয়াতীম হয়, তাহলে সে তিনটি ক্যাটাগরির আওতায় মানবিক অধিকার রাখে।
আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও অভাবগ্রস্তদের মধ্য থেকে যারা কিছু পাওয়ার প্রত্যাশায় উপস্থিত হবে তাদের সাথে সদ্ভাবে কথা বলতে হবে। যেহেতু অনুপস্থিত আত্মীয়-স্বজনের বিষয়ে বাধ্য-বাধকতা আরোপ করা হয়নি, তাই সমস্যাগ্রস্ত আত্মীয়-স্বজনরা উপস্থিত হওয়ার ক্ষেত্রে ইতস্তত করা উচিত নয়। কারণ এতে তাদের সম্মান/ আত্মমর্যাদাবোধ ক্ষুন্ন হওয়ার কোনো ন্যায়সঙ্গত কারণ নেই।
উত্তরাধিকার বণ্টনের সময় আত্মীয়-স্বজন ও স্থানীয় জনসাধারণের পরিজ্ঞাত হতে হবে
উত্তরাধিকার বণ্টনের সময় যেসব আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও মিসকীন উপস্থিত হয় তাদেরকে তা থেকে কিছু দেয়ার নির্দেশ থেকে স্পষ্ট হয় যে, উত্তরাধিকার বণ্টনের সময় আত্মীয়-স্বজন ও স্থানীয় জনসাধারণের পরিজ্ঞাত হতে হবে। অর্থাৎ এটি গোপনীয়ভাবে হতে পারবে না।
এছাড়া উত্তরাধিকার বণ্টন করতে হবে ওয়াসিয়্যাতের দাবি পূরণ ও ঋণ পরিশোধের পরে (৪:১১-১২)। আর ওয়াসিয়্যাতের সাক্ষ্য গ্রহণ করতে হবে সালাতের পরে (৫:১০৬)। এ বিষয়টি থেকেও বুঝা যায় যে, উত্তরাধিকার বণ্টন করতে হবে পূর্বনির্ধারিত দিনে এবং সালাত পরবর্তী সময়ে।
আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও অভাবগ্রস্তদেরকে কখন ও কী থেকে কিছু দিতে হবে
ওয়াসিয়্যাত ও ঋণ পরিশোধের পরে উত্তরাধিকার বণ্টন করতে হবে। উত্তরাধিকারে প্রত্যেক ওয়ারিস নির্ধারিত হারে উত্তরাধিকার পাবে তথা নিজ নিজ আনুপাতিক ভগ্নাংশ লাভ করবে এবং তাদের মধ্যে সম্পূর্ণ উত্তরাধিকার বণ্টিত হবে। সুতরাং বণ্টনকালে উপস্থিত আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও অভাবগ্রস্তদেরকে বণ্টিত সম্পদ থেকে কিছু দিতে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা বাস্তবায়নের পদ্ধতি হলো: ওয়ারিসদের মধ্যে বণ্টিত হওয়ার অব্যবহিত পরে তাদের প্রাপ্ত সম্পদ থেকে তাদেরকে কিছু দিতে হবে। এক্ষেত্রে ওয়ারিসদের মধ্য থেকে কে কতটুকু অংশগ্রহণ করবে তা তাদের সামগ্রিক সামর্থ্যরে ভিত্তিতে বিবেচনা করতে পারবে। কারণ এটা কুরআনের বর্ণিত একটি সাধারণ মূলনীতি। অথবা যদি ওয়ারিসরা ঐকমত্যের ভিত্তিতে উত্তরাধিকারের সম্পত্তি থেকে কিছু দিতে সম্মত হয় সেক্ষেত্রে উত্তরাধিকার বণ্টনের অব্যবহিত পূর্বেও পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও অভাবগ্রস্তদেরকে দেয়া যেতে পারে।
এ বিধানের প্রয়োগ সম্পর্কে দুটি প্রচলিত দাবি হলো, উত্তরাধিকার বণ্টনের পরে কিছু অবশিষ্ট থাকলে এ বিধান কার্যকর হবে এবং আরেকটি প্রচলিত মত হলো, এ আয়াতের বিধান রহিত হয়ে গেছে। অথচ আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি অনুসারে কিছু অবশিষ্ট থাকার ধারণা গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়া ‘উত্তরাধিকার বন্টনের পর কিছু অবশিষ্ট থাকলে এ আয়াত কার্যকর হবে, অন্যথায় নয়’- কথাটির মাধ্যমে আয়াতের নির্দেশকে গুরুত্ব না দেয়ার মনোভাব প্রকাশ পায়। আর এ আয়াতের বিধান রহিত হওয়ার দাবিরও কোনো ভিত্তি নেই।
আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও অভাবগ্রস্তদেরকে ন্যুনতম কী দিতে হবে
আত্মীয় স্বজন, ইয়াতীম ও অভাবগ্রস্তদেরকে ন্যুনতম কী দিতে হবে এবং প্রত্যেক ধরনের সম্পদ থেকে দিতে হবে কিনা এর কোনো বাধ্যবাধকতা ও সুনির্দিষ্টতা নেই। তাদেরকে কিছু দেয়া বাধ্যতামূলক তবে কে কতটুকু দিবে তা উপস্থিত আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও অভাবগ্রস্তদের অবস্থা এবং কোনো উত্তরাধিকারী তার সামর্থ্য অনুসারে কী দিতে পারবে বা কী দেয়ার মাধ্যমে এই নৈতিক দায়িত্ব পালন করবে তার উপর নির্ভর করে।
সাধারণত মনে করা হয় যে, মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত অর্থসম্পদ থেকে উপস্থিত আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও অভাবগ্রস্তদেরকে এক বেলা খাইয়ে দিলে এ আয়াতের দাবি পূরণ হয়ে যাবে। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন যে, দায়সারা কাজে দায় সারে না। তাই বাস্তব পরিস্থিতি সাপেক্ষে তাদেরকে কিছু দেয়ার ক্ষেত্রে মনের সংকীর্ণতা পরিহার করে নৈতিক বিবেচনা-বোধ দ্বারা উজ্জীবিত হতে হবে। উপস্থিত ব্যক্তিদেরকে ওয়ারিসরা নিজেদের খরচে এক বেলা খাওয়ানোর আয়োজন করলে তা একটি সামাজিক শিষ্টাচারমূলক রীতি হিসেবে সাব্যস্ত হতে পারে। কিন্তু ৪:৮ আয়াতটির নির্দেশকে এক বেলা আহার করানোর অর্থে সীমিত মনে করা সঙ্গত নয়।

অধ্যায় ১৯ : ‘ফারায়েজ’ বা ‘মুসলিম উত্তরাধিকার বিধান’ নামে প্রচলিত বণ্টন বিধি

‘ফারায়েজ’ বা ‘মুসলিম উত্তরাধিকার বিধান’ নামে প্রচলিত বণ্টন বিধি এবং আল কুরআনে উপস্থাপিত বণ্টন বিধির মধ্যে মিল ও অমিলের তুলনামূলক পর্যালোচনার জন্য এ অধ্যায়ে ফারায়েজ বা মুসলিম উত্তরাধিকারের বিধান নামে প্রচলিত বণ্টন বিধি উপস্থাপন করা হলো।
প্রচলিত মতে ফারায়েজের মূল উৎসসমূহ 
প্রচলিত মতে, ফারায়েজের মূল উৎস ৪টি। যথা :
১. আল কুরআন
২. আল হাদীস
৩. ইজমা
৪. কিয়াস।
এছাড়া এর আরো কিছু আনুষঙ্গিক উৎস আছে, যেমন আরবীয় প্রথা এবং কল্যাণ নীতি ইত্যাদি।
ফারায়েজ বিষয়ক মতভেদ ও ভিন্ন ভিন্ন আইন এবং তার কারণ
‘ফারায়েজ’ বা ‘উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি’ নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে সুন্নী আইন ও শিয়া আইনে মতভেদ রয়েছে। এছাড়া সুন্নীদের মধ্যেও হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী, হাম্বলী ইত্যাদি মতে বিভিন্নতা রয়েছে। এ বিষয়ে তাফসীর ও ফারায়েজের গ্রন্থগুলোতে বিস্তর মতপার্থক্যের উল্লেখ রয়েছে। এর কারণ হিসেবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে, সুদ এবং উত্তরাধিকার সম্পর্কিত আয়াত নবীজীবনের শেষবর্ষে নাজিল হয় এবং এরপর তিনি কিছুদিন মাত্র জীবিত ছিলেন বিধায় এ দুটি বিষয়ের ব্যাখ্যা দিয়ে যেতে পারেননি এবং এজন্য সুদ ও উত্তরাধিকারের বিষয়ে বিস্তর মতভেদের সুযোগ রয়েছে। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে এ সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে ‘ইয়াতীম নাতির উত্তরাধিকার লাভ’ এবং ‘কালালাহ’ সমস্যার প্রশ্নে।
সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতানুসারে প্রচলিত উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি
উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি নিয়ে মুসলিম মনীষীদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য থাকায় বিভিন্ন ধারার ক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতের সমন্বয়ে প্রচলিত উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি উপস্থাপনই এক নজরে দেখার ক্ষেত্রে যথোপযোগী হবে। তাই নিম্নে বিভিন্ন ধারার ক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতানুসারে প্রচলিত উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি উপস্থাপন করা হলো।
প্রচলিত উত্তরাধিকার বণ্টন বিধির ভাষ্য অনুযায়ী, আল কুরআনে উল্লেখিত ফারায়েজের মূল ধারাসমূহ 
(১) পুত্র কন্যা এভাবে পাবে যে, এক পুত্র পাবে দুই কন্যার অংশের সমান তথা এক কন্যার দ্বিগুণ। তাদের সাথে অন্য ওয়ারিস না থাকলে তারা সম্পূর্ণ সম্পত্তি পাবে, অন্যথায় তারা অবশিষ্টভোগী হবে।
(২) পুত্র না থাকা অবস্থায় দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যা থাকলে তারা পাবে ২/৩ ।
(৩) পুত্র না থাকা অবস্থায় এক কন্যা থাকলে সে পাবে ১/২ ।
(৪) কন্যা না থাকা অবস্থায় এক বা একাধিক পুত্র থাকলে সে বা তারা সমস্ত সম্পত্তি পাবে যদি অন্য ওয়ারিস না থাকে কিন্তু অন্য ওয়ারিস থাকলে তারা অবশিষ্টভোগী হবে।
(৫) কোনো পুত্র/কন্যা থাকলে মাতা পাবে ১/৬ ।
(৬) কোনো পুত্র/কন্যা থাকলে পিতা পাবে ১/৬ ।
(৭) কোনো পুত্র/কন্যা না থাকলে মাতা পাবে ১/৩ । 
(৮) কোনো পুত্র/ কন্যা না থাকলে কিন্তু একাধিক ভাই বা ভাই-বোন থাকলে মাতা পাবে ১/৬ ।
(৯) কোনো পুত্র/কন্যা না থাকলে, ভাই-বোন থাকুক বা না থাকুক উভয় অবস্থায় পিতা অবশিষ্টভোগী হবে।
(১০) মৃত স্ত্রীর কোনো পুত্র/ কন্যা না থাকলে স্বামী পাবে ১/২ ।
(১১) মৃত স্ত্রীর কোনো পুত্র/কন্যা থাকলে স্বামী পাবে ১/৪ ।
(১২) মৃত স্বামীর কোনো পুত্র/কন্যা না থাকলে স্ত্রী পাবে ১/৪ ।
(১৩) মৃত স্বামীর কোনো পুত্র/কন্যা থাকলে স্ত্রী পাবে ১/৮ ।
(১৪) যদি মৃত ব্যক্তির পিতা এবং পুত্র না থাকে তাহলে মৃত ব্যক্তির একটি বৈপিত্রেয় ভাই বা একটি বৈপিত্রেয় বোন থাকলে সে পাবে ১/৬ ।
(১৫) যদি মৃত ব্যক্তির পিতা এবং পুত্র না থাকে তাহলে মৃত ব্যক্তির একাধিক বৈপিত্রেয় ভাই বা বোন বা ভাই-বোন থাকলে তারা একত্রে পাবে ১/৩  যেখানে ভাই ও বোন পরস্পরের সমান পাবে।
(১৬) যদি মৃত ব্যক্তির পিতা এবং পুত্র না থাকে তাহলে মৃত ব্যক্তির ভাই না থাকা অবস্থায় একটি বৈমাত্রেয় বা পূর্ণ আপন বোন থাকলে সে পাবে ১/২ ।
(১৭) যদি মৃত ব্যক্তির পিতা এবং পুত্র না থাকে তাহলে মৃত ব্যক্তির ভাই না থাকা অবস্থায় দুই বা দুইয়ের বেশি বৈমাত্রেয় বা পূর্ণ আপন বোন থাকলে তারা পাবে ২/৩ ।
(১৮) যদি মৃত ব্যক্তির পিতা এবং পুত্র না থাকে তাহলে মৃত ব্যক্তির বোন না থাকা অবস্থায় এক বা একাধিক বৈমাত্রেয় বা পূর্ণ আপন ভাই থাকলে সে বা তারা সম্পূর্ণ সম্পত্তি পাবে যদি অন্য ওয়ারিস না থাকে, অন্যথায় তারা অবশিষ্টভোগী হবে।
(১৯) যদি মৃত ব্যক্তির পিতা এবং পুত্র না থাকে তাহলে মৃত ব্যক্তির বৈমাত্রেয় বা পূর্ণ আপন ভাই-বোন এভাবে পাবে যে, এক ভাই পাবে দুই বোনের অংশের সমান তথা এক বোনের দ্বিগুণ। তাদের সাথে অন্য ওয়ারিস না থাকলে তারা সম্পূর্ণ সম্পত্তি পাবে, অন্যথায় তারা অবশিষ্টভোগী হবে।
ফারায়েজ বন্টনের জন্য ওয়ারিস নির্ধারণের শর্ত
ফারায়েজ বণ্টনের জন্য ওয়ারিস নির্ধারণের শর্ত হচ্ছে মৃত ব্যক্তিকে ওয়ারিসের বা অন্য কথায় ওয়ারিসকে মৃত ব্যক্তির আক্বরাবূন বা নিকটতম আত্মীয় হতে হবে।

ওয়ারিসদের শ্রেণিবিভাগ
কুরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াস অনুসারে ওয়ারিসদেরকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে।
(১) যাবিল ফুরুজ (২) আসাবা (৩) যাবিল আরহাম।
যাবিল ফুরুজ/যা-উইল ফুরুজ (অত্যাবশ্যকীয় অধিকারী)
কুরআনে যাদেরকে ‘নির্ধারিত অংশ’ প্রদান করা হয়েছে তাদেরকে ‘যাবিল ফুরুজ’ বলা হয়। তাঁদের সংখ্যা ১২ জন। নিম্নে ছক আকারে যাবিল ফুরুজের তালিকা উপস্থাপন করা হলো:

আসাবা (অবশিষ্টভোগী)
‘আসাবা’ শব্দের শাব্দিক অর্থ ‘মাংসপেশী’। ফারায়েজের পরিভাষায় ‘আসাবা’ শব্দের অর্থ হলো ‘অবশিষ্টভোগী’। যাবিল ফুরুজের নির্দিষ্ট অংশ নেয়ার পর যারা অবশিষ্ট অংশ পায় তাদেরকে ‘আসাবা’ বলা হয়। যদি কোনো ‘যাবিল ফুরুজ’ না থাকে তাহলে আসাবাদের মধ্যে সম্পূর্ণ সম্পদ বণ্টিত হয়।
আসাবার শ্রেণিবিভাগ
আসাবা দুই শ্রেণিতে বিভক্ত। যথা:
(১) যাবিল ফুরুজের মধ্য থেকে কেউ কেউ কোনো অবস্থায় আসাবা হিসেবে সাব্যস্ত হয়। এদের সংখ্যা ছয়জন। তাদের তালিকা হলো: ১. পিতা, ২. দাদা এবং তাদের ঊর্ধ্বক্রম, ৩. কন্যা, ৪. পুত্রের কন্যা এবং তাদের নিম্নক্রম, ৫. পূর্ণ আপন বোন, ৬. বৈমাত্রেয় বোন।
(২) যারা যাবিল ফুরুজ নয় কিন্তু মৃত ব্যক্তির সাথে কোনো পুরুষ আত্মীয়ের মাধ্যমে তাদের রক্তসম্পর্ক আছে। যেমন, চাচা ও ফুফু।
যেহেতু মৃত ব্যক্তির সাথে তার বৈপিত্রেয় ভাই-বোন একজন মহিলার মাধ্যমে অর্থাৎ মাতার মাধ্যমে সম্পর্কিত, তাই তারা আসাবার তালিকাভুক্ত নয়।
যাবিল ফুরুজ ও আসাবাদের মধ্যে বণ্টনের নীতিমালা
(১) যাবিল ফুরুজ (স্বামী/স্ত্রী ছাড়া) ও যাবিল ফুরুজের মধ্যকার আসাবা জীবিত থাকলে অন্য আসাবারা বঞ্চিত হবে।
(২) পিতা জীবিত থাকলে ভাই-বোন বঞ্চিত হবে। তবে মাতা জীবিত থাকলেও বৈপিত্রেয় ভাই-বোন বঞ্চিত হবে না। কারণ মাতা সমস্ত সম্পত্তি পাবেন না, বরং তিনি আংশিকভাবে যাবিল ফুরুজ হিসাবে এবং আংশিকভাবে রদ্দ নীতির মাধ্যমে পাবেন।
(৩) রক্তের নিকটতম আত্মীয়ের কারণে দূরবর্তী আত্মীয় বঞ্চিত হবেন। তাই পিতা জীবিত থাকলে দাদা বঞ্চিত হবেন, মাতা জীবিত থাকলে দাদী বঞ্চিত হবেন এবং পুত্র জীবিত থাকলে পৌত্র-পৌত্রী বঞ্চিত হবে। তবে কোনো পুত্র না থাকলে শুধু কন্যাদের কারণে পৌত্র-পৌত্রী বঞ্চিত হবে না। মৃত ব্যক্তির কোনো পুত্র থাকা অবস্থায় তার ইয়াতীম নাতি দাদার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। অর্থাৎ ইয়াতীম নাতির চাচা তার বঞ্চিত হওয়ার কারণ হবে।
(৪) যাবিল ফুরুজের মধ্যে বণ্টনের সময় অবশিষ্ট থাকলে বা ঘাটতি পড়লে রদ্দ বা আউল নীতির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
(৫) স্বামী/স্ত্রী আউলের অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ তাদের অংশ হ্রাস করা যেতে পারে। কিন্তু স্বামী/স্ত্রী রদ্দের অন্তর্ভুক্ত নয় অর্থাৎ তাদের অংশ বৃদ্ধি করা যেতে পারে না।
প্রথম শ্রেণির আসাবাদের তালিকা
১. পুত্র
২. কন্যা: ১ অবস্থায় আসাবা
(ক) যদি পুত্রের সাথে থাকে
৩. পিতা: ২ অবস্থায় আসাবা
(ক) যদি শুধু অধস্তন নারী (কন্যা, পৌত্রী ইত্যাদি) থাকে
(খ) যদি কোনো অধস্তন না থাকে।
৪. দাদা: ২ অবস্থায় আসাবা
(ক) যদি অধস্তন নারী (কন্যা, পৌত্রী ইত্যাদি) থাকে
(খ) যদি কোনো অধস্তন না থাকে
৫. পৌত্রী: ১ অবস্থায় আসাবা
(ক) যদি মৃতের শুধু কন্যা থাকে
৬. পূর্ণ আপন বোন: ২ অবস্থায় আসাবা
(ক) পূর্ণ আপন বা বৈমাত্রেয় ভাইয়ের সাথে
(খ) যদি শুধু অধস্তন নারী (কন্যা, পৌত্রী) থাকে
৭. বৈমাত্রেয় (পিতৃশরিক) বোন: ২ অবস্থায় আসাবা
(ক) পূর্ণ আপন বা বৈমাত্রেয় ভাইয়ের সাথে
(খ) যদি শুধু অধস্তন নারী (কন্যা, পৌত্রী) থাকে
৮. দাদী: ১ অবস্থায় আসাবা
(ক) যদি পিতা না থাকে কিন্তু মাতা থাকে
যেসব যাবিল ফুরুজের অংশ কখনো কখনো শূন্য:
১. দাদা: পিতা থাকলে দাদা বঞ্চিত হবে
২. বৈপিত্রেয় (মাতৃশরিক) ভাই: ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন থাকলে বৈপিত্রেয় ভাই বঞ্চিত হবে
৩. পৌত্রী: পুত্র থাকলে পৌত্রী বঞ্চিত হবে
৪. পূর্ণ আপন বোন: ঊর্ধ্বতন বা অধস্তন পুরুষ থাকলে পূর্ণ আপন বোন বঞ্চিত হবে
৫. বৈমাত্রেয় (পিতৃশরিক) বোন: ঊর্ধ্বতন বা অধস্তন পুরুষ থাকলে বৈমাত্রেয় বোন বঞ্চিত হবে
৬. বৈপিত্রেয় (মাতৃশরিক) বোন: ঊর্ধ্বতন বা অধস্তন থাকলে বৈপিত্রেয় বোন বঞ্চিত হবে
৭. দাদী: পিতা ও মাতা উভয়ে থাকলে দাদী বঞ্চিত হবে
আসাবার ক্রমিক বিন্যাস
১. পুত্র -- পৌত্র -- প্রপৌত্র -- পিতা -- দাদা -- পরদাদা -- ভাই -- ভাতিজা -- ভাতিজা পুত্র -- চাচা -- চাচাতো ভাই -- চাচাতো ভাইয়ের পুত্র। (ক্রম অনুসারে আসাবা হবে, যেমন, পুত্র থাকলে পৌত্র আসাবা হবে না)
২. কন্যা (পুত্রের সাথে থাকলে) -- পৌত্রী -- পূর্ণ আপন বোন ও বৈমাত্রেয় (পিতৃশরিক) বোন।
যাবিল আরহাম (মেয়েলোকের সূত্রে রক্তসম্পর্কের আত্মীয়)
‘যাবিল আরহাম’ শব্দের অর্থ হলো ‘রক্তসম্পর্কের আত্মীয়’। কুরআন অনুসারে সকল রক্তসম্পর্কের আত্মীয়কে উলুল আরহাম বলা হলেও ফারায়েজর পরিভাষায় শুধুমাত্র মেয়েলোকের সূত্রে রক্তসম্পর্কের আত্মীয়রাই যাবিল আরহাম (উলুল আরহাম) হিসেবে সাব্যস্ত হয়। ‘আরহাম’ শব্দটি হচ্ছে রহিম বা রেহেম শব্দের বহুবচন। রেহেম অর্থ স্ত্রীলোকের গর্ভাশয়, রক্তসম্পর্কের আত্মীয়তা। ফারায়েজের পরিভাষা অনুসারে যারা ‘যাবিল ফুরুজ’ বা ‘আসাবা’ নয় এমন রক্তসম্পর্কের আত্মীয়গণকে ‘যাবিল আরহাম’ বলা হয়।
যাবিল আরহামের মধ্যে বন্টনের নীতিমালা
(১) যখন কোনো নসব যাবিল ফুরুজ (অর্থাৎ স্বামী/স্ত্রী ছাড়া অন্য যাবিল ফুরুজ) অথবা আসাবা জীবিত নেই শুধু সে অবস্থায় যাবিল আরহাম পায়।
(২) কিন্তু যদি স্বামী বা স্ত্রী জীবিত থাকে এবং কোনো আসাবা না থাকে, তাহলে স্বামী বা স্ত্রী নির্ধারিত পূর্ণ অংশ পায় এবং অবশিষ্ট অংশ যাবিল আরহাম পায়।
(৩) নিকটবর্তী যাবিল আরহাম দূরবর্তী যাবিল আরহামকে বঞ্চিত করে।
(৪) একই স্তরের দাবিদারদের মধ্যে যারা মৃত ব্যক্তির সাথে যাবিল ফুরুজের বা আসাবার মাধ্যমে সম্পর্কিত তারা অগ্রাধিকার পাবে।
(৫) পিতৃকুল এবং মাতৃকুলের দাবিদার থাকলে পিতৃকুলের দিকে ২/৩  এবং মাতৃকুলের দিকে ১/৩  দিতে হবে। যেমন পিতার মাতার পিতা পাবেন ২/৩  এবং মাতার মাতার পিতা পাবেন ১/৩ ।
(৬) মাতার পিতার পিতা পাবে ২/৩  এবং মাতার পিতার মাতা পাবে ১/৩  কারণ তাঁরা উভয়ে মাতৃকুলের দাবিদার এবং মৃত ব্যক্তির মধ্যবর্তী ঊর্ধ্বতন হচ্ছেন একই জন তথা মা (একই লিঙ্গের), তাই নানা পুরুষ বিধায় ২/৩  ও নানী নারী বিধায় ১/৩  পাবে।
যাবিল আরহামের শ্রেণিবিভাগ
যাবিল আরহাম চার শ্রেণিতে বিভক্ত। যথা:
(১) মৃত ব্যক্তির বংশধরগণ (যারা যাবিল ফুরুজ বা আসাবা নয়)
(২) মৃত ব্যক্তির পূর্ব পুরুষগণ (যারা যাবিল ফুরুজ বা আসাবা নয়)
(৩) মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতার বংশধরগণ (যারা যাবিল ফুরুজ বা আসাবা নয়)
(৪) মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতার ঊর্ধ্বক্রমের পূর্ব পুরুষগণ (যারা যাবিল ফুরুজ বা আসাবা নয়)
যাবিল আরহাম চার শ্রেণির বিস্তারিত তালিকা 
প্রথম শ্রেণি: (১) কন্যার সন্তান এবং তাদের বংশধরগণ। (২) পুত্রের কন্যার সন্তান এবং তাদের বংশধরগণ। যতই নিম্নক্রম হোক।
দ্বিতীয় শ্রেণি: (১) নানা নানীগণ যতই ঊর্ধ্বক্রম হোক (২) তাঁদের পূর্ব পুরুষগণ যতই ঊর্ধ্বক্রম হোক।
তৃতীয় শ্রেণি: (১) পূর্ণ আপন ভাইয়ের কন্যা এবং তার বংশধরগণ (২) বৈমাত্রেয় ভাইয়ের কন্যা এবং তার বংশধরগণ (৩) পূর্ণ আপন ভাইয়ের পুত্রের কন্যা যতই নিম্নœক্রম হোক, তারা এবং তাদের বংশধরগণ (৪) বৈমাত্রেয় ভাইয়ের পুত্রের কন্যা, যতই নিম্নক্রম হোক তারা এবং তাদের বংশধরগণ (৫) পূর্ণ আপন, বৈমাত্রেয়, বৈপিত্রেয় বোনদের সন্তান এবং তাদের বংশধরগণ।
চতুর্থ শ্রেণি: (১) পিতার পূর্ণ আপন ভাইয়ের কন্যা এবং তার বংশধরগণ (২) পিতার বৈমাত্রেয় ভাইয়ের কন্যা এবং তার বংশধরগণ (৩) পিতার বৈপিত্রেয় ভাইয়েরা, তাদের সন্তান এবং তাদের বংশধরগণ (৪) পিতার পূর্ণ আপন ভাইয়ের পুত্রগণের কন্যাগণ, যতই নিম্নক্রম হোক, তারা এবং তাদের বংশধরগণ (৫) পিতার বৈমাত্রেয় ভাইয়ের পুত্রের কন্যাগণ যতই নিম্নক্রম হোক, তারা এবং তাদের বংশধরগণ (৬) পিতার পূর্ণ আপন, বৈমাত্রেয়, বৈপিত্রে বোন, তাদের সন্তান এবং তাদের বংশধরগণ (৭) মাতার মাতা, বোনেরা, তাদের সন্তান, তাদের বংশধরগণ এবং পূর্ব পুরুষগণ, যতই ঊর্ধ্বক্রম হোক তাদের বংশধরগণ।
আউল ও রদ্দ নীতি
‘আউল’ মানে ‘বৃদ্ধি’। যখন অংশগুলোর যোগফল একটি ভগ্নাংশ হয় যার লব বড়, হর ছোট, তখন হরকে লবের সমান করে নিতে হয় তথা হরের মধ্যে বৃদ্ধি করতে হয় এটাকে ‘আউল’ বলে। যেমন, মৃত ব্যক্তি রেখে গেছেন স্বামী ও তিন বোন। তাহলে স্বামীর অংশ + তিন বোনের অংশ = ১/২  + ২/৩  = ৭/৬ । এ অবস্থায় স্বামীকে দিতে হবে ৩/৭  এবং তিন বোনকে দিতে হবে ৪/৭ ।
‘রদ্দ’ অর্থ ‘ফেরত দেয়া বা ফিরিয়ে দেয়া’। ‘রদ্দ’ হলো আউলের বিপরীত। যখন অংশগুলোর যোগফল একটি ভগ্নাংশ হয় যার লব ছোট, হর বড়, তখন হরকে হ্রাস করে লবের সমান করতে হয়। এটাকে ‘রদ্দ’ বলে।
যাবিল ফুরুজের মধ্যকার আসাবা না থাকা অবস্থায় বণ্টন বিধি অনুযায়ী যোগফল ১ এর চেয়ে কম বা বেশি হলে যাবিল ফুরুজের মধ্যে আউল বা রদ্দ হয়।
স্বামী/স্ত্রী আউলের অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ তাদের অংশ হ্রাস করা যেতে পারে। কিন্তু তারা রদ্দের অন্তর্ভুক্ত নয় অর্থাৎ তাদের অংশ বৃদ্ধি করা যেতে পারে না। অর্থাৎ স্বামী/ স্ত্রী কেউই অন্য কোনো উত্তরাধিকারীর বর্তমানে (সে যাবিল ফুরুজ বা আসাবা বা যাবিল আরহাম যে-ই হোক) ফেরতের অংশ লাভের অধিকারী নয়। তবে যদি অন্য কোনো উত্তরাধিকারী না থাকে, শুধুমাত্র সে ক্ষেত্রে স্বামী/স্ত্রী ফেরতের অংশ লাভের অধিকারী হয়।
কালালাহ সমস্যা এবং হিমারিয়া বা গাধা সমাচার নীতি
কালালাহ কাকে বলে সে সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা না থাকায় এ বিষয়ে ব্যাপক মতবিরোধ রয়েছে। কালালাহ কি মৃত ব্যক্তি, নাকি তার ভাই বোন, চাচা মামা, ফুফু খালা প্রমুখ তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। মৃত ব্যক্তিকে কোন অবস্থায় কালালাহ হিসেবে সাব্যস্ত করা হবে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ মনে করেন যার পিতা নেই সে কালালাহ। অন্য কেউ মনে করেন যার পুত্র নেই সে কালালাহ। তবে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ সংজ্ঞা হচ্ছে যার পিতা ও পুত্র নেই সে কালালাহ।
আবার কালালাহর ভাই-বোনদের মধ্যে পূর্ণ আপন, বৈমাত্রেয় এবং বৈপিত্রেয় ভাই-বোনদের কে কোন আয়াত (৪:১২ অথবা ৪:১৭৬) অনুযায়ী পাবে, তা নিয়েও মতভেদ রয়েছে। অনেক মনীষী মনে করেন যে, ৪:১৭৬ আয়াতের মাধ্যমে ৪:১২ আয়াতের দ্বিতীয়ার্ধ তথা কালালাহ সম্পর্কিত অংশ মানছুখ বা রহিত হয়ে গেছে।
তবে শেষ পর্যন্ত ইজমা কিয়াসের মাধ্যমে কালালাহ বিষয়ে যে মতটি সবচেয়ে বেশি গৃহীত হয়েছে তা হলো: (১) মৃত ব্যক্তির পিতা ও পুত্র না থাকলে তাকে কালালাহ বলে। (২) কালালাহর বৈপিত্রেয় ভাই-বোনেরা ৪:১২ আয়াত অনুসারে প্রাপক হবে। (৩) কালালাহর পূর্ণ আপন ও বৈমাত্রেয় ভাই-বোনেরা ৪:১৭৬ আয়াত অনুসারে প্রাপক হবে।
কালালাহ সমস্যার একটি মামলায় হযরত উমার ফারুকের রায়ের মাধ্যমে হিমারিয়া বা গাধা সমাচার নীতির প্রবর্তন ঘটে।
হিমারিয়া বা গাধা সমাচার নীতি সম্পর্কিত মামলার বিবরণ নিম্নরূপ:
দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমার (রা.) এর শাসনামলে তাঁর কাছে উত্তরাধিকার নিয়ে একটি মোকদ্দমা হয়। মোকদ্দমাটি নিম্নরূপ:
মাতা, স্বামী, ২ জন বৈপিত্রেয় ভাই, ২ জন পূর্ণ আপন ভাই ভাই।
খলিফা রায় দেন যে, কুরআন অনুসারে মাতা, স্বামী ও বৈপিত্রেয় ভাই যাবিল ফুরুজ এবং সহোদর ভাই আসাবা।
সুতরাং,
মাতা পাবে = ১/৬
স্বামী পাবে = ১/২  
২ জন বৈপিত্রেয় ভাই পাবে = ১/৩
তাদের অংশের যোগফল = ১/৬  + ১/২  + ১/৩  = ১/৬  + ৩/৬  + ২/৬  = ৬/৬  = ১
কোনো অংশ অবশিষ্ট নেই।
সুতরাং ২ জন পূর্ণ আপন ভাই পাবে = ০। অর্থাৎ পূর্ণ আপন দুই ভাই কিছুই পাবে না।
তখন সহোদর বা পূর্ণ আপন ভাইয়েরা পুনর্বিবেচনা বা ন্যায়বিচারের প্রার্থনা করে। জবাবে খলিফা জানান যে, কুরআন অনুযায়ী বণ্টন হয়েছে, তাই তাঁর কিছুই করার নেই।
তখন পূর্ণ আপন ভাইয়েরা আরজ করে যে, হে আমিরুল মু’মিনীন, মৃত ব্যক্তির আপন ভাই হওয়ার জন্য যখন আমরা উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হচ্ছি, তখন না হয় ধরে নিন, আমাদের পিতা কোনো হিমার বা গাধা (অর্থাৎ কোনো মানুষ আমাদের পিতা নয়), তাহলে কি আমরা বৈপিত্রেয় ভাইদের সাথে উত্তরাধিকার পেতে পারি না? আর এটা কেন হবে যে, যাদের পিতা এক তারা তো পাবে, কিন্তু যাদের পিতা ও মাতা উভয়ে এক তারা কিছুই পাবে না?
এ কথায় খলিফা বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে ন্যায়বিচার বা কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে বৈপিত্রেয় ভাইদের প্রাপ্য ১/৩  অংশ থেকে অর্ধেক সহোদর ভাইদেরকে দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন।
উল্লেখিত অবস্থায় খলিফা উমরের রায় অনুসারে সমাধান করার পদ্ধতি শরীয়তে ‘হিমারিয়া বা গাধা নীতি’ নামে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে।
প্রচলিত মতে উত্তরাধিকারের বিধান (৪:১১-১২) দ্বারা যেসব আয়াত মানছুখ (রহিত) হয়েছে
প্রচলিত মতে, উত্তরাধিকারের বিধান (৪:১১-১২) দ্বারা ২:১৮০-১৮২, ২:২৪০ এবং ৪:৮ আয়াত রহিত হয়েছে। এর মধ্যে ২:১৮০-১৮২ আয়াত হচ্ছে ওয়াসিয়াতের বিধান সম্বলিত এবং ৪:৮ আয়াত হচ্ছে উত্তরাধিকার বণ্টনকালে উলুল কুরবা/ (ওয়ারিস নয় এমন) আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও মিসকীন উপস্থিত হলে তাদেরকে তা থেকে উপজীবিকা হিসেবে কিছু দেয়ার নির্দেশ।
প্রচলিত মতে, ৪:১১-১২ আয়াত দ্বারা ২:১৮০-১৮২ আয়াতে থাকা ওয়ারিসদের জন্য ওয়াসিয়্যাতের বিধান মানছুখ বা রহিত হয়ে গেছে। এখন শুধুমাত্র যারা ওয়ারিস নয় তাদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করা মুস্তাহাব এবং হাদীস মতে তা এক তৃতীয়াংশ বা এক চতুর্থাংশে সীমিত হতে হবে।
প্রচলিত মতে, ২:২৪০ আয়াতে প্রদত্ত বিধবাদের জন্য এক বছরের ভরণপোষণের ওয়াসিয়্যাত ২:২৩৪ আয়াতে বর্ণিত বিধবাদের চারমাস দশদিনের ইদ্দাতের বিধান দ্বারা এবং ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত স্ত্রীর জন্য প্রদত্ত উত্তরাধিকারের অংশের দ্বারা রহিত হয়ে গেছে।
প্রচলিত মতে উত্তরাধিকারের কিছু বিশেষ ধারা
(১) কোনো মুসলিম কোনো অমুসলিমের ওয়ারিস হবে না এবং কোনো অমুসলিম কোনো মুসলিমের ওয়ারিস হবে না।
(২) হত্যাকারী নিহত ব্যক্তির ওয়ারিস হবে না। (এ বিধির উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়, কেউ তাড়াতাড়ি উত্তরাধিকার পাওয়ার জন্য যেন কাউকে হত্যা করতে উদ্যত না হয় সেজন্যই এ বিধি প্রণীত হয়েছে।)
(৩) জারজ সন্তান ওয়ারিস হবে না। ইত্যাদি।
অধ্যায় ২০ : প্রচলিত ফারায়েজ: আপত্তি, জবাব ও পর্যালোচনা
এ অধ্যায়ে প্রচলিত ফারায়েজের উপর ভিত্তি করে যেসব আপত্তি রয়েছে তার জবাব এবং কুরআনের আলোকে প্রচলিত ফারায়েজের পর্যালোচনা উপস্থাপন করা হলো:
মুসলিম উত্তরাধিকার বিধান সম্পর্কিত মৌলিক আপত্তিসমূহ
প্রচলিত ফারায়েজ বা মুসলিম উত্তরাধিকার বিধান ও আয়াতের সরল অনুবাদের পার্থক্য সাপেক্ষে ইসলামী উত্তরাধিকার বন্টন বিধির বিষয়ে উত্থাপিত মৌলিক আপত্তিসমূহ নিম্নরূপ:
(১) কুরআনে প্রদত্ত উত্তরাধিকার বন্টন বিধিতে বর্ণিত অংশগুলোর যোগফল কোনো অবস্থায় সমস্ত হয়, কিন্তু কোনো অবস্থায় সমস্তের চেয়ে বেশি হয় এবং কোনো অবস্থায় সমস্তের চেয়ে কম হয়, যার সমাধানের জন্য আউল ও রদ্দ নীতি চালু করা হয়েছে, যা কুরআনে প্রদত্ত বন্টন বিধির একটি কৃত্রিম সংশোধন। তাহলে মানুষ কি আল্লাহর বিধান মানবে, না তাঁর বিধানে থাকা ত্রুটি সংশোধন করে যে মানবীয় বিধান তা মানবে? (নাউযুবিল্লাহ)।
(২) প্রচলিত মতে, ৪:১১-১২ ও ৪:১৭৬ দ্বারা ২:১৮০-১৮২, ২:২৪০, ৪:৮ রহিত হয়েছে এবং ৪:১৭৬ দ্বারা ৪:১২ এর দ্বিতীয়াংশ (কালালাহ এর সাথে সম্পর্কিত অংশ) রহিত হয়েছে। এটি কি প্রমাণ করে না যে, কুরআনে স্ববিরোধ রয়েছে?
(৩) মুসলিম উত্তরাধিকার বন্টন বিধি অনুসারে, মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা থাকা অবস্থায় তার ইয়াতীম নাতি নাতিনদেরকে বঞ্চিত করা হয়। এটি মানবতাবোধকে আহত করে। কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছেন যে, একটি পাইপের মাঝখানে কাটা পড়লে উপরের অংশ থেকে নিচের অংশে কিছু পৌঁছবে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে দাদা যদি ইয়াতীম নাতির উত্তরাধিকারী হতে পারে, ইয়াতীম নাতি কেন দাদার উত্তরাধিকারী হতে পারে না? যদি পাইপের মাঝখানে কাটা পড়ে তাহলে নিচের অংশ থেকে উপরের অংশেও কিছু পৌঁছবে না। কেউ কেউ সুপারিশ করেন যে, যদি সম্পত্তি বন্টনের পর কিছু বাকি থাকে তাহলে ইয়াতীমদেরকে দেয়া যেতে পারে। যেহেতু প্রচলিত মতে ২:১৮০-১৮২ এবং ৪:৮ এখন ওয়াজিব নয় বরং মানসুখ বা রহিত; তাই আয়াত দুটির বিধানকে বাধ্যতামূলক হিসেবে নয় বরং মুস্তাহাব/ঐচ্ছিক হিসেবে ইয়াতীম নাতির জন্য কার্যকর করা যেতে পারে। কেউ কেউ বলেন যে, ইয়াতীম নাতি উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হলেও তারা ইয়াতীমদের বিষয়ে কুরআনের সাধারণ নির্দেশনা অনুসারে সদাচার প্রাপ্ত হবে। এসব জবাবী সুপারিশকে ইয়াতীমদের বাস্তব অসহায়ত্বের মোকাবেলায় নামমাত্র সান্ত¡নার চেয়ে বেশি কিছু বলা যায় কি?
(৪) প্রচলিত দাবি হচ্ছে, কুরআনের আইন অনুযায়ী যে অবস্থায় পূর্ণ আপন/ পিতৃমাতৃশরিক ভাই-বোন উত্তরাধিকার পায় না কিন্তু বৈপিত্রেয় তথা মাতৃশরিক ভাই-বোন উত্তরাধিকার পায়, এরূপ একটি মোকদ্দমায় ন্যায়বিচার ও কল্যাণ সাধনের জন্য খলিফা হযরত উমার (রা) হিমারিয়া বা গাধা সমাচার নীতি প্রবর্তন করে পূর্ণ আপন ভাই-বোনকে বৈপিত্রেয় ভাই-বোনের সম-অংশীদার করে দিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, যদি কুরআনের আইনে ন্যায়বিচার না হয় না হবে, খলিফা উমর কুরআনের আইনের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু প্রবর্তন করার অধিকার রাখেন কি? আর প্রকৃতই ন্যায়বিচারের পরিপন্থী আইন কুরআনে রয়েছে নাকি আইনটিকে বুঝতে বা বুঝাতে গিয়ে ভুল করা হয়েছে? এ প্রসঙ্গের সাথে সম্পূরক আরেকটি প্রশ্ন হলো, যদি কুরআনের আইনে না থাকা সত্ত্বেও ন্যায়বিচারের স্বার্থে পূর্ণ আপন ভাই-বোনকে উত্তরাধিকার দেয়া যায়, তাহলে একইভাবে কুরআনের আইনে না থাকা সত্ত্বেও ন্যায়বিচারের স্বার্থে ইয়াতীম নাতিকে উত্তরাধিকার দেয়া যাবে না কেন?
(৫) প্রচলিত মতে, আসাবা বা অবশিষ্টভোগী হবে কোনো পুুরুষের মাধ্যমে সম্পর্কিত আত্মীয়-স্বজন এবং তাদের বর্তমানে যাবিল আরহাম তথা কোনো নারীর মাধ্যমে সম্পর্কিত আত্মীয়-স্বজন বঞ্চিত হবে। এ ধরনের বণ্টন কি যথার্থ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত?
মৌলিক আপত্তিসমূহের জবাব
প্রথম আপত্তির জবাব
আউল বা রদ্দ নীতি কুরআনের আয়াতে প্রদত্ত বিধির সংশোধন নয়। বরং কুরআনে প্রদত্ত বন্টন বিধির সঠিক উপলব্ধিই হচ্ছে এই যে, কুরআনে থাকা অংশগুলো প্রত্যেকের শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ, যা সমস্ত সম্পদ নির্দিষ্টকৃত ওয়ারিসদের মধ্যে বন্টনের ক্ষেত্রে কার্যকর হবে। কারণ আয়াতের তথ্যভিত্তিক দুটি শর্ত হলো: কোনো সম্পদ অবন্টিত থাকবে না এবং নির্দিষ্টকৃত ওয়ারিসদের বাহিরেও বন্টিত হবে না। এ দুটি শর্ত পূরণের একমাত্র গাণিতিক বণ্টন পদ্ধতি হলো আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি।
আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতির একটি গাণিতিক মডেল হচ্ছে হচ্ছে আউল ও রদ্দ নীতি, তবে শর্ত হচ্ছে তা সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হবে, যাতে কোনো ক্ষেত্রে অবশিষ্টাংশ বলে কিছু না থাকে। বর্তমানে প্রচলিত আউল বা রদ্দ নীতি এ শর্ত মেনে প্রয়োগ করা হয় না। বর্তমানে যে ধরনের মূলনীতি অনুসরণ করে আউল ও রদ্দ নীতি প্রয়োগ করা হয় তার পরিপ্রেক্ষিতে যৌক্তিকভাবে উপরিউক্ত আপত্তিটি তৈরি হয়েছে।
আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি অধ্যায়ে এ পদ্ধতির প্রয়োগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। বস্তুত কুরআনের বন্টন পদ্ধতির বিষয়ে অভিযোগের পিছনে দুটি কারণ দায়ী। একটি কারণ হলো- কুরআনের বন্টন পদ্ধতি বুঝতে না পারা। অন্য কারণটি হলো- যারা কুরআনের ধারক বাহক তারা এর সঠিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন ও অনুসরণ না করা বরং এমন বিধি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যা কুরআনের বিধি ব্যবস্থা থেকে বিচ্যুত হওয়া সত্ত্বেও সেটাকে কুরআনের বিধি ব্যবস্থা মনে করা।
দ্বিতীয় আপত্তির জবাব
কুরআন স্বয়ং তার মধ্যে স্ববিরোধ না থাকার বিষয়ে চ্যালেঞ্জ দিয়েছে যে, যদি এটি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো রচিত হতো তবে এতে স্ববিরোধ থাকতো, অর্থাৎ এতে স্ববিরোধ পাওয়া যাবে না (৪:৮২)। যদি আপাত স্ববিরোধ মনে হয় তা ধর্তব্য নয়, কারণ চূড়ান্ত বিশ্লেষণে আপাত স্ববিরোধের সমাধান হয়ে সুসমঞ্জস তথ্য উদ্ঘাটিত হয়।
যেহেতু কুরআনে স্ববিরোধ নেই তাই কুরআনের কোনো আয়াত অন্য আয়াত দ্বারা রহিত হতে পারে না। কুরআনে কোনো রহিত আয়াত না থাকার বিষয়টি বিভিন্নভাবে প্রমাণ করা যায়, তার মধ্যে কুরআনের স্ববিরোধমুক্ততার যুক্তিটি অন্যতম।
উত্তরাধিকারের আয়াত দ্বারা যেসব আয়াত রহিত হয়েছে বলে প্রচলিত মতে দাবি করা হয় প্রকৃতপক্ষে এসব আয়াতে কোনো স্ববিরোধ নেই এবং তাই কোনো আয়াত রহিত হওয়ার দাবিটি সঠিক নয়।
যেমন  ৪:১১-১২ আয়াতে চারবার বলা হয়েছে যে, উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধি কার্যকর করতে হবে ওয়াসিয়্যাতের দাবি পুরণ ও ঋণ পরিশোধের পরে। সুতরাং ৪:১১-১২ আয়াত দ্বারা ২:১৮০-১৮২ আয়াতে বিধিবদ্ধ ওয়াসিয়্যাতের বিধান রহিত হয়নি বরং বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।
অনুরূপভাবে ৪:৮ আয়াতে উত্তরাধিকার বণ্টনকালে (বণ্টনের অব্যবহিত পরে) সাধারণ আত্মীয়-স্বজন (উলুল ক্বুরবা), ইয়াতীম ও অভাবগ্রস্তদেরকে তা থেকে উপজীবিকা হিসেবে কিছু দেয়ার যে আদেশ রয়েছে তাও উত্তরাধিকার বণ্টন বিধির সম্পূরক নির্দেশ, সুতরাং অবশ্যই তা পরিপালন করতে হবে।
তৃতীয় আপত্তির জবাব
পিতা না থাকা অবস্থায় দাদাকে নাতির সম্পদের ওয়ারিস করা অথচ ইয়াতীম নাতিকে (তার চাচার উপস্থিতিতে) দাদার সম্পদের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা একটি অযৌক্তিক ও স্ববিরোধী ব্যবস্থা।
প্রকৃতপক্ষে পিতা জীবিত না থাকা অবস্থায় যেমন দাদা নাতির সম্পদের উত্তরাধিকার পায়, তেমনি ইয়াতিম নাতিও দাদার সম্পদের উত্তরাধিকার পাবে, এক্ষেত্রে ঐ নাতির কোনো চাচা তাকে বঞ্চিত করতে পারবে না।
‘আক্বরাবূন’ (নিকটতম আত্মীয়) শব্দের ব্যাপকতার মাত্রা এবং স্তরগত মাত্রা বিবেচনায় ওয়াসিয়্যাত এবং উত্তরাধিকার উভয়ক্ষেত্রে দাদা ও নাতি পরস্পরের আক্বরাবূন হিসেবে সাব্যস্ত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইয়াতীম নাতিকে ওয়ারিস সাব্যস্ত করার বিষয়টি তার অসহায়ত্ব বিবেচনায় নয়, বরং সে তার নিজ পিতার অনুপস্থিতিতে পিতার আনুপাতিক অংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হওয়ার বিবেচনায় প্রযোজ্য। অর্থাৎ দাদা যেমন তার নাতির ওয়ারিস হয় যদি নাতির পিতা জীবিত না থাকে, অনুরূপভাবে নাতি তেমনি তার দাদার ওয়ারিস হয় যদি নাতির পিতা জীবিত না থাকে। ইয়াতীম নাতির উত্তরাধিকার অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
আর ইতোপূর্বেই স্পষ্ট করা হয়েছে যে, কুরআনের কোনো আয়াত রহিত হওয়ার দাবি সঠিক নয়। সুতরাং ২:১৮০-১৮২ এবং ৪:৮ আয়াতের বিধান অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে।
চতুর্থ আপত্তির জবাব
প্রকৃতপক্ষে হিমারিয়া বা গাধা সমাচার নীতির প্রবর্তনের যে যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে তা সঠিক নয়। কারণ কুরআনের বক্তব্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে কালালাহর সংজ্ঞা এবং ভাই-বোনের প্রাপ্য নির্ণয় করলে দেখা যায় যে, হিমারিয়া বা গাধা সমাচার মোকদ্দমার প্রাথমিক ও চূড়ান্ত রায়ের একটিও সঠিক ছিল না। বরং ঐ মোকদ্দমায় মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকায় তার পূর্ণ আপন ও বৈপিত্রেয় ভাইয়েরা ৪:১৭৬ আয়াত অনুসারে পরস্পর সমান হারে ওয়ারিস হতো। অথচ কথিত মোকদ্দমায় প্রাথমিক রায়ে পূর্ণ আপন ভাই-বোনকে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং চূড়ান্ত  রায়ে তাদেরকে ৪:১২ আয়াত অনুসারে বৈপিত্রেয় ভাই-বোনদের সাথে সমান অংশীদার করে বণ্টন করা হয়েছে। কালালাহ বা ভাই-বোন উত্তরাধিকার পাওয়ার পূর্বশর্ত অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
এছাড়া কুরআনের বিধানে ন্যায়বিচারের পরিপন্থী বিধান থাকা এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে কুরআনের বিধানের পরিবর্তে অন্য বিধান জারি করা প্রয়োজন হয়েছিল বলে দাবি করা বিশ^প্রভুর প্রতি একটি মিথ্যা দোষারোপ, যা অমার্জনীয় অপরাধ। কারণ আল্লাহর বাণী সত্য বিধান ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ (৬:১১৫)।
পঞ্চম আপত্তির জবাব
প্রকৃতপক্ষে এই আসাবা এবং যাবিল ফুরুজ সম্পর্কিত বণ্টন যথার্থ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নয় তথা কুরআনের আয়াতে প্রদত্ত নির্দেশনার সঠিক উপলব্ধির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়।
কুরআনে ৮:৭৫ ও ৩৩:৬ আয়াতে ‘উলুল আরহাম’ তথা রক্তসম্পর্কের আত্মীয়দেরকে (উত্তরাধিকারের প্রশ্নে) পরস্পরের প্রতি অগ্রাধিকারী (আওলা) বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। অন্য কথায়, পুত্র-কন্যা, পিতা-মাতা ও ভাই-বোনকে ‘উলুল আরহাম’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অথচ প্রচলিত বণ্টন বিধিতে ‘যাবিল আরহাম’ বা ‘উলুল আরহাম’ বলতে চিহ্নিত করা হয় কথিত ‘আসাবা’দের কেউ না থাকলে কোনো নারীর মাধ্যমে সম্পর্কিত অন্য আত্মীয়দেরকে। সুতরাং এটি গ্রহণযোগ্য নয়।
৪:৭ আয়াত অনুসারে কুরআনে বর্ণিত প্রত্যেক নারী-পুরুষ ওয়ারিস নির্ধারিত হারে উত্তরাধিকারের প্রাপ্য অংশ (নাসীবাম মাফরূদা) লাভ করবে। সুতরাং কুরআনে বর্ণিত প্রত্যেক ওয়ারিসই ‘যাবিল ফুরুজ’ বা ‘নির্ধারিত অংশের প্রাপক’। আর এই যাবিল ফুরুজদের মধ্যে পুত্র-কন্যা, পিতা-মাতা ও ভাই-বোন হচ্ছে ‘উলুল আরহাম’ (ফারায়েজের পরিভাষায়, যাবিল আরহাম) এবং স্বামী/স্ত্রী হচ্ছেন ছিহর বা বৈবাহিক আত্মীয়তা সূত্রে আক্বরাবূনের (নিকটতম আত্মীয়) বা ওয়ারিসের অন্তর্ভুক্ত। উত্তরাধিকারের বিধানে আসাবা বা অবশিষ্টভোগী বলে কেউ নেই এবং যাবিল আরহাম সম্পর্কিত প্রচলিত নিয়ম গ্রহণযোগ্য নয়।
উত্তরাধিকার বন্টন সমস্যা ও তার দুটি প্রস্তাবিত সমাধান, সমাধানের সমালোচনা ও সমালোচনার জবাব এবং জবাবের পর্যালোচনা
‘সামহয়্যার ইন ব্লগে’ উত্তরাধিকার বণ্টন সমস্যা ও তার দুটি প্রস্তাবিত সমাধান, সমাধানের সমালোচনা ও সমালোচনার জবাব নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা(২১) উপস্থাপিত হয়েছে।
(২১) https://www.somewhereinblog.net/blog/mashudul_haque/28898205
এ আলোচনাটি এ বিষয়ে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক হওয়ায় এখানে তা পর্যালোচনাসহ উপস্থাপন করা হলো।
উত্তরাধিকার বন্টন সমস্যার একটি উদাহরণ
যদি মৃত ব্যক্তির ৩ কন্যা, স্ত্রী এবং পিতা ও মাতা থাকেন তাহলে কিভাবে বন্টন করা হবে?
প্রথম সমাধান
৩ কন্যা = ২/৩  ,
স্ত্রী = ১/৮  ,
পিতা = ১/৬  ,
মাতা = ১/৬  ।
মোট = ২/৩  + ১/৮   + ১/৬  + ১/৬  = ২৭/২৪  ।
তথা
৩ কন্যা = ১৬/২৪  ,
স্ত্রী = ৩/২৪ ,
পিতা = ৪/২৪ ,
মাতা = ৪/২৪ ।
কিন্তু আউল প্রয়োগ করে,
৩ কন্যা = ১৬/২৭ ,
স্ত্রী = ৩/২৭ ,
পিতা = ৪/২৭ ,
মাতা = ৪/২৭ ।
প্রথম সমাধানের সমালোচনা
আউলের পক্ষে বলা হয়, কুরআনের আয়াতের বক্তব্যকে আক্ষরিকভাবে নেয়া যাবে না। আউলের আগের পারস্পরিক ভাগসমূহের অনুপাত আউলের পরেও একই থাকে। তাই শরিকদের মোট ভাগ যদি ১ এর অধিক হয় তাহলে আউল প্রযোজ্য হবে তথা পরস্পরের প্রাপ্য ভাগের সমানুপাতে প্রত্যেক শরিকের প্রাপ্য কমে যাবে।
এক্ষেত্রে নিচের প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হয়।
(১) আউল কার প্রবর্তিত? আল্লাহর না মানুষের?
আল্লাহ ও মুহাম্মাদ (সা) কেন এ বিষয়ে কিছু বলেননি?
ওমর/ আলীকে কেন নতুন করে এ পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হলো?
অর্থাৎ ওমর/ আলী এর সময়কার ফারায়েজী আইন আর মুহাম্মাদ (সা:) এর সময়কার ফারায়েজী আইন কি একই ছিল?
(২) কুরআনের নির্দেশনাগুলোকে আক্ষরিকভাবে নেয়া যাবে না কেন? ৪:১১ আয়াতে যেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যদি দুইয়ের বেশি কন্যা থাকে তারা পাবে ২/৩ । এখন প্রদত্ত সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আউল প্রয়োগ করে কন্যাদের দেয়া হচ্ছে ১৬/২৭ । ২/৩  = ১৮/২৭ । অন্যকথায়, ২/৩ – -  ১৬/২৭  = ২/২৭ । অর্থাৎ কুরআনের আয়াত অনুসারে কন্যারা তাদের ২/৩  না পেয়ে ২/২৭  ভাগ কম পাচ্ছে। এটাকে কি বলা যাবে না যে, কুরআনের ৪:১১ আয়াতের নির্দেশটি অমান্য করা হচ্ছে?
(৩) বলা হচ্ছে, কুরআনে থাকা ভাগসমূহের অনুপাত ঠিকই মেইনটেইন করা হয়েছে। কিন্তু  কুরআনে কি বলা হয়েছে যে, প্রত্যেকের ভাগের পরস্পরের অনুপাতের ভিত্তিতে সম্পত্তি বন্টন করতে হবে? নাকি মোট সম্পত্তি থেকে কে কত ভাগ পাবে তা জানানো হয়েছে?
উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট করা যাক।
এখানে আউলের আগে ৩ কন্যা ও স্ত্রীর অনুপাত = ২/৩  : ১/৮   = ১৬ : ৩।
আউলের পরে ৩ কন্যা ও স্ত্রীর অনুপাত = ১৬/২৭  : ৩/২৭  = ১৬ : ৩।
অর্থাৎ উভয় অবস্থায় ৩ কন্যার সাথে স্ত্রীর অনুপাত ঠিক থাকছে।
কিন্তু যদি কেউ নিম্নোক্তভাবে বন্টন করে তাহলেও কিন্তু পরস্পরের অনুপাত একই থাকে।
৩ কন্যা = ১৬/২৯  ,
স্ত্রী = ৮/২৯  ,
পিতা = ৪/২৯  ,
মাতা = ৪/২৯ ।
এভাবে বন্টন করলে ২/২৯  অবশিষ্ট রাখা যায় এবং তা অবশিষ্টাংশভোগীদেরকে বা বাইতুল মালে দেয়া যেতে পারে।
কিন্তু তখন প্রশ্ন উঠবে যে, কুরআন অনুযায়ী কন্যাদেরকে ২/৩  দেয়ার কথা কিন্তু ১৬/২৯   কোনোভাবেই ২/৩  এর সমান নয়?
তাহলে এর মাধ্যমে কি প্রমাণিত হয় না যে, আউল করার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করলেও প্রশ্ন থেকেই যায়?
(৪) এক লোক তার সঞ্চিত ৯০,০০০ টাকা তার তিন বন্ধুকে (ক, খ, গ) দেয়ার জন্য একটা উইল করে বিদেশে চলে গেল। উইলটি করলো এরকম:
ক পাবে = ২০,০০০ টাকা।
খ পাবে = ৩০,০০০ টাকা।
গ পাবে = ৫০,০০০ টাকা।
পরে ভাগ করতে গিয়ে দেখা গেল যে, ১০,০০০ টাকা কম পড়েছে।
এক্ষেত্রে কি বলা যাবে না যে, লোকটি ভুল হিসাব করেছে?
এটা ঠিক যে, এক্ষেত্রে টাকা বন্টনের যৌক্তিক উপায় হচ্ছে মোট টাকা ক : খ : গ অনুপাত = ২ : ৩ : ৫ অনুপাতে ভাগ করে দেয়া। সে অনুযায়ী,
ক পাবে = ১৮,০০০ টাকা।
খ পাবে = ২৭,০০০ টাকা।
গ পাবে = ৪৫,০০০ টাকা।
কিন্তু এ সমাধানে আসার পরেও কি বলা যাবে না যে, উইল অনুযায়ী ক ২০,০০০ টাকা, খ ৩০,০০০ টাকা, গ ৫০,০০০ টাকা পায়নি এবং এর কারণ উইলকারী ভুল করেছেন?
মানুষের এমনকি বিখ্যাত মানুষেরও এমন ভুল হতে পারে এবং এমনকি হয়েছেও। কিন্তু আল্লাহর কিতাবে কি এরকম ভুল থাকতে পারে?
দ্বিতীয় সমাধান
৩ কন্যা = ২/৩  ।
বাকি থাকে = ১/৩  ।
এই ১/৩  অংশ ১/৮   : ১/৬   : ১/৬   অনুপাতে তথা ৩ : ৪ : ৪ অনুপাতে স্ত্রী, পিতা ও মাতার মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে। ফলে,
স্ত্রী =  ৩/৩৩  ,
পিতা = ৪/৩৩  ,
মাতা = ৪/৩৩  ।
সমাধানের ভিত্তি: ওয়ালাদ শব্দটি একবচন, এর বহুবচন হচ্ছে আওলাদ। যেহেতু তিন কন্যার অংশ ২/৩  । তাই প্রথমে তাদেরকে তাদের এই প্রাপ্য অংশ দিতে হবে। তারপর স্ত্রী, পিতা ও মাতার জন্য যে প্রাপ্য অংশ উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো যখন মৃত ব্যক্তির ওয়ালাদ (একবচন, পুংলিঙ্গ) থাকে। কিন্তু একাধিক ওয়ালাদ থাকলে অথবা কন্যা/কন্যারা থাকলে স্ত্রী, মাতা ও পিতা কত পাবে তা উল্লেখ করা হয়নি। যেহেতু এ উদাহরণে ওয়ালাদ বা একজনমাত্র পুত্র উপস্থিত নয়, তাই তিন কন্যাকে তাদের অংশ দেয়ার পর অবশিষ্ট অংশ স্ত্রী, পিতা ও মাতাকে তাদের জন্য উল্লেখিত প্রাপ্য অংশের অনুপাতে ভাগ করে দিয়ে সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।
দ্বিতীয় সমাধানের সমালোচনা
দ্বিতীয় সমাধানের ক্ষেত্রেও নিচের প্রশ্নগুলো এসে যায়:
(১) কেন অবশিষ্টাংশ পিতা, মাতা ও স্ত্রীর মধ্যে সমান তিনভাগে ভাগ করে দেয়া হবে না? কেন এক পুত্র থাকলে তারা যেভাবে পাবে, একাধিক সন্তান থাকলে অবশিষ্টাংশে তারা সেই একইভাবে পাবে?
(২) কেন অবশিষ্টাংশ তাদের মধ্যে আনুপাতিকভাগে বন্টিত হবে? এভাবে তো সেই প্রথম সমাধানের মত আউল বা রদ্দ করা হলো।
সমালোচনার জবাব [মাসুদুল হকের প্রদত্ত জবাব]: (সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত)
(১) শরীয়তের আইনে ইজমা ও কিয়াসের মাধ্যমে বিধান তৈরি হতে পারে।
(২) ওমর রা. এর সময় যখন তিনি খুৎবা দিচ্ছিলেন তখন একজন প্রথম আউল জনিত সমস্যা জানতে চায়।  সে সময় সমাবেশে উপস্থিত আলী রা. দাড়িয়ে এই সমাধান দেন, প্রথমে তার সমাধান পুরো সঠিক ছিল না, পরে সবাই আলোচনা করে আউল আইন ঠিক করা হয়। এই ঘটনাকে মিম্বরিয়া বলে। (মুসলিম আইন, প্রথম খন্ড, এম হাবিবুর রহমান, সহযোগী অধ্যাপক ও সভাপতি, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়) তারপর সেসময়ই এ সমাধান পর্যালোচনা করে একে আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যা ইজমার অন্তর্ভুক্ত। 
(৩) আউল নীতি ও রদ্দ নীতি
আউল নীতি: আউল শব্দের আভিধানিক অর্থ বৃদ্ধি হওয়া। শরীয়তের নিয়মানুযায়ী যাবিল ফুরুজ বা অংশীদারদের অংশ প্রদানের পর তাদের অংশাবলীর যোগফল যদি মূল সম্পদ হতে বেড়ে যায় বা ১ এর চেয়ে বেশি হয় তাহলে যে নিয়মে তা সমাধান করা হয় সেটাই আউল। কুরআনে অংশীদারদের যে তালিকা রয়েছে তাদের বিভিন্ন বিন্যাস ও সমাবেশে কখনো কখনো তা ১ এর চেয়ে বেশি হওয়াটা গাণিতিকভাবে ও অনুপাতভিত্তিক বন্টনে যদিও সেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার কিন্তু এ বিন্যাস খুব সহজলভ্য নয়, তাই হাদীসে এ পরিস্থিতির উদাহরণ নেই, তবে চার খলিফার আমলে এটি আলোচিত হয় এবং পরবর্তীতে শরীয়তের ৩য় উৎস ইজমার মাধ্যমে ইসলামী আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
রদ্দ নীতি: রদ্দ এর আভিধানিক অর্থ ‘প্রত্যাবর্তন করা’ । এটি আউলের বিপরীত নিয়ম। শরীয়তের নিয়মানুযায়ী যাবিল ফুরুজ বা অংশীদারদের অংশ প্রদানের পর তাদের অংশাবলীর যোগফল যদি ১ এর চেয়ে কম হয় এবং মৃত ব্যক্তির কোনো আসাবা না থাকে তাহলে অবশিষ্ট সম্পত্তি স্বামী/স্ত্রী ব্যতিত অন্যান্য অংশীদারদের কাছে পুনরায় প্রত্যাবর্তন করা হয়।
আউল নীতি ও রদ্দ নীতি প্রয়োগের তিনটি উদাহরণ
উদাহরণ-১
জলিল সাহেব মৃত্যুকালে পিতা ও এক কন্যা রেখে গেলেন।
প্রথমত, কন্যা পাবে ১/২  
পিতা পাবে ১/৬   
এখানে, ১/২  + ১/৬  = ৪/৬  ,
সুতারাং আসাবা বা অবশিষ্টাংশ = ১ -  ৪/৬ =  ২/৬   
দ্বিতীয়ত, পিতা আসাবা হিসেবে এই অংশও পাবে।
তাহলে পিতার মোট প্রাপ্য হবে = ১/৬  + ২/৬   = ৩/৬   =  ১/২ 
কন্যার অংশ = ১/২  
উদাহরণ-২
কামাল সাহেব মৃত্যুকালে মাতা ও ১ কন্যা রেখে গেলেন।
প্রথমত, কন্যা পাবে  ১/২   
মাতা পাবে  ১/৬  
মোট =  ১/২  + ১/৬   =  ৩/৬  + ১/৬   =  ৪/৬ 
দ্বিতীয়ত, রদ্দনীতি প্রয়োগ করে পাই, ৩/৪   +  ১/৪   =  ৪/৪   = ১
তাহলে, কন্যা ৩/৪   ও মাতা  ১/৪   অংশ পাবে।
উদাহরণ-৩
আনিস সাহেব মৃত্যুকালে স্ত্রী, ২ পূর্ণ আপন বোন ও ২ জন বৈপিত্রেয় (মাতৃশরিক) বোন রেখে গেলেন।
প্রথমত, এখানে স্ত্রী পাবে  ১/৪ 
পূর্ণ আপন দুই বোন পাবে  ২/৩  
বৈপিত্রেয় (মাতৃশরিক) দুই বোন পাবে  ১/৩ 
মোট = ১/৪   + ২/৩   + ১/৩   = ৩/১২   + ৮/১২   + ৪/১২   =  ১৫/১২  
দ্বিতীয়ত, ১ এর বেশি হওয়ায় আউল অবলম্বন করে হরকে ১৫ করে পাই,
৩/১৫   + ৮/১৫   +  ৪/১৫   =  ১৫/১৫   = ১
তাহলে স্ত্রী পাবে ৩/১৫  ,
পূর্ণ আপন দুই বোন পাবে ৮/১৫ 
বৈপিত্রেয় (মাতৃশরিক) দুই বোন পাবে ৪/১৫   অংশ পাবে।
উদাহরণ তিনটিতে দেখা যায় প্রথম ২টি উদাহরনে অংশ বৃদ্ধি পায়, দ্বিতীয়টিতে অংশ কিছুটা হ্রাস পায়। এখন ১ম নিয়মটি সাধারণভাবে আসাবা বা অবশিষ্টাংশভোগী নিয়মে করা হয়েছে, ২য় টি রদ্দ নীতি ও ৩য় টিতে আউল নীতি প্রয়োগ করা হয়েছে।  
দেখা যাচ্ছে কুরআনে বর্ণিত অংশ প্রাপ্ত হবার পর সে অংশ দ্বিতীয় ধাপে বাড়তে বা কমতে পারে, আর সেটা মোটেও কুরআনের পরিপন্থী নয় ।
কুরআনে এ সংক্রান্ত আয়াতগুলোতে দেখা যায় কয়েকজনের অনুপাত উল্লেখ করা হয়নি, যেমন পুত্র,ভাই, চাচা ইত্যাদি। এখন কেউ যদি বলে এদের উল্লেখ নেই, তাহলে এদের ভাগ দেয়া হলে কুরআনের বিরুদ্ধে যাবে, তাহলে তা অবান্তর মন্তব্য হবে। আসলে কুরআনে উল্লেখিত অংশ দেবার পর যা বাকি থাকবে সেখান থেকে তাদের অংশ নির্ধারিত হয়। আবার কখনো নিদির্ষ্ট অংশভোগীরাও তা পেতে পারে (যেমন- উদা ১), রদ্দ নীতিতেও বেশি পেয়ে থাকে। তাই নির্ধারিত অংশের বেশি পাওয়া ইসলামী আইনের পরিপন্থী নয়।
অধিকাংশ প্রশ্নে আমি দেখেছি আউল নীতি নিয়ে যত প্রশ্ন অথচ বেশি পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রশ্ন নেই । কিন্তু গণিতের দৃষ্টিতে বলা যায়, বৃদ্ধি ধনাত্মক বা ঋণাত্মক দুইই হতে পারে। ইসলামে উত্তরাধিকার আইনে আউল ও রদ্দ নীতিতে পরস্পরের সম্পদের অনুপাত ঠিক রাখা হয়, তাই এভাবে বণ্টন গাণিতিকভাবে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য ও বৈজ্ঞানিক।
যেমন ২ নং উদাহরণে প্রথমত অনুপাত থাকে, কন্যা : মা =  ৩/৬   : ১/৬   =  ৩ : ১
রদ্দ নীতি প্রয়োগের পর এ অনুপাত, কন্যা : মা =  ৩/৪   :  ১/৪   =   ৩ : ১ 
৩নং উদাহরণের আউল নীতিতেও ৩ : ৮ : ৪ অনুপাত ঠিক থাকে।
(৩ খ)  অভিযোগকারীর বক্তব্য হচ্ছে, সেরকম তো যেকেউই দাবি করতে পারে যে, তিন কন্যা ও স্ত্রীর অনুপাত,  ১৬/২৭   :  ৩/২৭   এবং  ১৬/২৯  :  ৩/২৯   এ অনুপাত কিন্তু একই থাকে।
এর জবাব হচ্ছে, আউল ও রদ্দ আইন তো কন্ডিশনাল নিয়ম, আইনে যেমন অধ্যাদেশ থাকে। সবক্ষেত্রে তা হবে কেন?
আর এই সমাধান যে কতটা যৌক্তিক তা ফ্রি মাইন্ড নিয়ে একটু দেখলেই বুঝবেন। ধরুন আমার কোনো সম্পত্তির ১/৩   ভাগ পাওয়ার কথা, ২য় জনের পাওয়ার কথা ২/৩  এবং তৃতীয় জনের পাওয়ার কথা ১/৩ । এখন দেখা যাবে মোট সম্পত্তির চেয়ে তা বেশি হয়ে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে সহজেই আউলের মত নিয়ম দিয়ে তা সমাধান করে দেয়া যায়। সেক্ষেত্রে যে দুজনের ১/৩   করে পাওয়ার কথা তারা সমান অংশই পাচ্ছে, তাই আপত্তির জায়গা থাকছে না, যার ২/৩   পাওয়ার কথা সেও নির্দিষ্ট অনুপাতে বেশি পাওয়ায় তারও আপত্তি থাকছে না।
প্রশ্ন করতে পারেন, এরকম অনুপাত হবে কেন যা কখনো একের চেয়ে বেশি হয়। আসলে ক্লাস এইটের ভাগ বাটোয়ারা টাইপ হিসাব চিন্তা করলে তা মনে হতেই পারে। আসলে প্রাপক যখন নিদির্ষ্ট সংখ্যক থাকে তখন তা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু ইসলামী আইনে প্রাপক নির্দিষ্ট সংখ্যক থাকে না, পারমুটেশন, কম্বিনেশন করে তা অনেক বাড়তে পারে, তখন খুব সাধারণ ভাবেই ১ এর চেয়ে তা বেড়ে যায়।
(৪) সমালোচনাকারী উদাহরণ দিয়েছেন যে-
এক লোক তার সঞ্চিত ৯০,০০০ টাকা তার তিন বন্ধুকে (ক, খ, গ) দেয়ার জন্য একটা উইল করে বিদেশে চলে গেল। উইলটি করলো এরকম:
ক পাবে= ২০,০০০টাকা
খ পাবে=৩০,০০০ টাকা
গ পাবে= ৫০,০০০ টাকা
পরে টাকা ভাগ বাটোয়ারা করতে দেখা গেলো ১০,০০০ টাকা কম পড়েছে।
এক্ষেত্রে কি বলা যাবে না যে, লোকটি ভুল হিসাব করেছেন?
আপনার উদাহরনের সাথে ইসলামী আইনের সর্ম্পক নেই। প্রথমত, আপনি বলেছেন ক পাবে একটা নিদির্ষ্ট অ্যামাউন্ট, এরকম নির্দিষ্ট অ্যামাউন্টের উদাহরণ দেয়া হলে তা শুধু অন্যদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা। কারণ ইসলামী আইনে শুধুই অনুপাত নিয়ে আলোচনা করে।
দ্বিতীয়ত, এখানে নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রাপক আছে, ইসলামী আইনে নিদির্ষ্ট সংখ্যক প্রাপকের বিবেচনায় প্রণীত হয়নি। এটা সার্বজনীন।
মাসুদুল হকের প্রদত্ত জবাবের পর্যালোচনা [শওকত জাওহারের উপস্থাপিত পর্যালোচনা]
(১) ইজমা কিয়াসের প্রবক্তাদের একটি স্বীকার্য হচ্ছে, ইজমা কিয়াসের মাধ্যমে যে বিধান তৈরি হতে পারে তা হচ্ছে যে বিষয়ে কুরআন হাদীসে বিধান দেয়া হয়নি সে বিষয়ে কুরআন হাদীসের সীমারেখার ভিতরে ও অন্যান্য নির্দেশনার আলোকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য, যাতে কুরআন হাদীসের নির্দেশনার সাথে সাংঘর্ষিক কোনো কাজ থেকে বিরত থাকা যায়। কিন্তু যে বিষয়ে কুরআন হাদীসে বিধান দেয়া হয়েছে তাতে ইজমা কিয়াস অচল। তবে সার্বিক ক্ষেত্রে আউল বা রদ্দ নীতির প্রয়োগ তথা প্রতিটি অংশকে আনুপাতিক অংশ হিসাবে ধরা হলে তা (প্রচলিত আউল বা রদ্দ নীতি নয়) কুরআনের আয়াতের বক্তব্যের সঠিক উপলব্ধি, সেক্ষেত্রে এ প্রশ্ন আসতে পারে না। পরবর্তী পয়েন্টে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
(২) আউল নীতি হচ্ছে ইজমা বা কিয়াস, এটি যথার্থ জবাব নয়। কারণ আয়াতে নির্ধারিত অংশের যোগফল ১ এর বেশি হওয়ায় জটিলতা তৈরি হয়েছে, ইজমা-কিয়াসের মাধ্যমে তা দূর করা হয়েছে, এমনটি হলে অভিযোগ যথাস্থানে থেকে যায় যে, তবে কি আয়াতের বক্তব্য অনুসরণ করা অসম্ভব হওয়ায় সেক্ষেত্রে কিয়াসের আওতায় বাড়তি বিধান যোগ করা হয়েছে? আসলে সঠিক উত্তর হচ্ছে এই যে, আয়াতে দেয়া অংশগুলো হচ্ছে আনুপাতিক অংশ। তাই আউল বা রদ্দ নীতি বাড়তি বিধান নয় বরং সর্বক্ষেত্রেই এই একই নীতি (আনুপাতিক অংশের নীতি) প্রযোজ্য হবে।
(৩) আউল, রদ্দ কন্ডিশনাল নিয়ম, অধ্যাদেশের মত, কথাটি গ্রহণযোগ্য নয়। বরং যদি এ নিয়ম থাকে তবে সার্বিকভাবেই তা প্রযোজ্য হতে হবে। অধ্যাদেশ হলে, এ অধ্যাদেশ কার? অর্থাৎ এ নীতির প্রবর্তক কে? আসলে, এটা অধ্যাদেশ নয়, বরং আয়াতে বর্ণিত অংশগুলো আনুপাতিক অংশ এটাই প্রকৃত কথা। সুতরাং একজনমাত্র ওয়ারিস হলে তার অংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পূর্ণ অংশে পরিণত হবে।
১৬/২৭   এর পরিবর্তে ১৬/২৯   দিয়ে অনুপাত একই রেখে  ২/২৯   অন্য কাউকে দিয়ে দেয়া যায় বলে অভিযোগকারী যে অভিযোগ করেছে তার সঠিক জবাব হলো, পারস্পরিক আনুপাতিক অংশের ক্ষেত্রে মূল কথা হলো সমস্ত সম্পদ তাদের মধ্যে ভাগ করতে হবে যাদের অংশ উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে যেমন তাদের পারস্পরিক অনুপাত ঠিক থাকতে হবে তেমনি সমস্ত সম্পদই বন্টিত হতে হবে এবং তাদের মধ্যেই বন্টিত হতে হবে। সুতরাং এ দুটি শর্ত একসাথে মেইনটেইন করতে হবে। তাই ২/২৯ অংশ বের করে নিয়ে অন্য কাউকে দেয়ার সুযোগ নেই। একইভাবে, উপরোক্ত শর্ত সাপেক্ষে একজনমাত্র ওয়ারিস হলে তার আনুপাতিক অংশ যাই হোক না কেন সে একাই সমস্ত সম্পত্তি পাবে।
(৪) এ ক্ষেত্রে সমালোচনার জবাবটি সঠিক হয়েছে। তবে এ কথা যোগ করা যেতে পারে যে, যেহেতু আয়াতে বর্ণিত অংশগুলো আনুপাতিক অংশ, তাই এক্ষেত্রে যোগফল ১ হওয়ার চিন্তাটাই একটা ভুল চিন্তা। কারণ, আনুপাতিক অংশের বন্টনের নিয়ম অনুসারে যোগফল ১ হওয়া এবং ১ এর কম বা বেশি হওয়া উভয়টিই সমান। কুরআনে বর্ণিত অংশগুলো আনুপাতিক অংশ হওয়ায়, একজনমাত্র ওয়ারিস থাকলে সে একাই সমস্ত সম্পত্তি পাবে, তার আনুপাতিক অংশ যাহাই বর্ণিত থাকুক না কেন।
অধ্যায় ২১ : প্রচলিত ফারায়েজ ও ব্যাখ্যা থেকে উদ্ভুত সমস্যা বা প্রশ্নসমূহ
উত্তরাধিকার বণ্টন বিধির বিষয়ে বিশ্লেষণাত্মক সমস্যাসমূহ
প্রচলিত মুসলিম ফারায়েজ এবং ৪:১১, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতের সরল অনুবাদের পার্থক্য সাপেক্ষে উত্তরাধিকার বন্টন বিধির বিভিন্ন ধারা সম্পর্কে বিভিন্ন চিন্তক পাঠক যেসব সমস্যা চিহ্নিত করেন তা নিম্নরূপ :
(১) শুধু এক পুত্র বা শুধু একাধিক পুত্র বা পুত্র-কন্যা থাকলে তারা কতটুকু পাবে তা কোনো আয়াতে সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। প্রচলিত ফারায়েজে ধরে নেয়া হয় যে, তারা অবশিষ্ট অংশ পাবে।
(২) ৪:১১ আয়াতে উল্লেখিত ‘ফাওক্বাছনাতাইনি’ এর প্রচলিত অনুবাদ হলো, ‘দুইয়ের বেশি (কন্যা হলে)’। এই অনুবাদ যথাযথ হলে, শুধু দুই কন্যা থাকলে তারা কতটুকু পাবে কোনো আয়াতে তা সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি।
(৩) শুধু দুইয়ের বেশি কন্যা থাকলে তথা পুত্র না থাকা অবস্থায় দুইয়ের বেশি কন্যা থাকলে তারা পাবে ২/৩  এবং শুধু এক কন্যা থাকলে তথা পুত্র না থাকা অবস্থায় এক কন্যা থাকলে সে পাবে ১/২ । কিন্তু ‘শুধু’ বা ‘পুত্র না থাকা অবস্থায়’ শব্দগুলো আরবিতে নেই, অনুবাদকেরা যোগ করে। সুতরাং বর্ণিত অংশগুলো কি পুত্র থাকা বা না থাকা উভয় অবস্থায় প্রযোজ্য নয়? দুইয়ের বেশি কন্যা পায় ২/৩  , তাহলে এক বা একাধিক পুত্র কি বাকি ১/৩  পায়? তাহলে অন্যদের জন্য কিছু বাকি থাকে কি? যদি দুইয়ের বেশি কন্যার সাথে দুই পুত্র থাকে তারা কি ১/৩   পাবে না ৪/৩   পাবে? যদি এক কন্যার সাথে এক পুত্র থাকে তাহলে কি কন্যা ১/২  এবং পুত্র তার দ্বিগুণ তথা ১ পাবে, মোট ৩/২   বন্টিত হবে?
(৪) এক পুত্র পাবে দুই কন্যার অংশের সমান কথাটির অর্থ কি এই যে, প্রত্যেক পুত্রের বিপরীতে দুইজন করে কন্যা থাকলে এটি কার্যকর হবে, পুত্র-কন্যার অনুপাত এর চেয়ে কম বা বেশি হলে এ কথা কার্যকর হবে না বরং তখন পুত্র ও কন্যা পরস্পর সমান পাবে? যেমন, এক কন্যার সাথে এক পুত্র থাকলে কন্যা পাবে অর্ধেক আর পুত্রটি পাবে অর্ধেক? কেন ‘এক পুত্র এক কন্যার দ্বিগুণ পাবে’ না বলে ‘এক পুত্র পাবে দুই কন্যার সমান’ বলা হলো?
(৫) কেউ কেউ মনে করেন যে, দুইয়ের বেশি কন্যা (বা দুই কন্যা) পাবে ২/৩  এবং একটিমাত্র কন্যা পাবে ১/২ , এটি শুধু তখন প্রযোজ্য যখন তাদের সাথে আর কোনো ওয়ারিস যেমন পিতা-মাতা না থাকে। কিন্তু যদি অন্য ওয়ারিস থাকে তাহলে শুধু এক কন্যা বা শুধু একাধিক কন্যা থাকলেও তারা অবশিষ্টাংশ পাবে। প্রশ্ন হচ্ছে এ কথা কিভাবে জানা গেল? যদি বলা হয় যে, কারণ অন্য কারো থাকার কথা উল্লেখ করা হয়নি তাই এভাবে বুঝা যায়। তাহলে তো বলতে হবে, পিতা-মাতার অংশ নির্ধারণে পুত্র-কন্যা থাকা না থাকাকে বিবেচনা করা হয়েছে কিন্তু স্বামী/ স্ত্রীর থাকা না বিবেচনা করা হয়নি, সুতরাং তা কার্যকর হবে যদি স্বামী/ স্ত্রী না থাকে শুধু সে অবস্থায়। অনুরূপভাবে, স্বামী/ স্ত্রীর অংশ নির্ধারণে পুত্র-কন্যা থাকা না থাকাকে বিবেচনা করা হয়েছে কিন্তু পিতা-মাতা থাকা না থাকাকে বিবেচনা করা হয়নি, সুতরাং তা কার্যকর হবে যদি পিতা-মাতা না থাকে শুধু সে অবস্থায়। তাহলে উল্লেখিত অবস্থার ভিন্নরূপ অবস্থায় কে কিভাবে পাবে তা কিভাবে নির্ধারিত হবে?
(৬) কেউ কেউ মনে করেন যে, শুধু দুইয়ের বেশি কন্যা পাবে ২/৩   বলতে বুঝানো হয়েছে অবশিষ্টাংশের ২/৩ , এবং শুধু এক কন্যা পাবে ১/২  বলতে বুঝানো হয়েছে অবশিষ্টাংশের ১/২ । সুতরাং পিতা-মাতা ও স্বামী/ স্ত্রীর অংশ দেয়ার পর অবশিষ্টাংশের ২/৩  পাবে একাধিক কন্যা বা অবশিষ্টাংশের ১/২  পাবে এক কন্যা। আর পুত্র/পুত্ররা/পুত্র-কন্যা পাবে অবশিষ্টের সমস্ত। কিন্তু ‘অবশিষ্টাংশের’ শব্দটি যোগ করার ভিত্তি কী? যদি বলা হয় যে, আউল মুক্ত বন্টনের উদ্দেশ্যে এরূপ ব্যাখ্যা গ্রহণ করা হয়েছে, তবে রদ্দের ক্ষেত্রেও তথা যখন সবাইকে তার অংশ দেয়ার পর কিছু বাকি থেকে যায় সেক্ষেত্রেও আপত্তি থাকে যে, সেটার ক্ষেত্রে কী করা হবে? কারণ কুরআন অনুযায়ী যারা ওয়ারিস তাদের ভিতরেই বন্টন করতে হলে এবং সেজন্য রদ্দ করতে হলে তা আউলের বিপরীত অথচ একইরূপ আপত্তিকর বিষয় সাব্যস্ত হয়। কারণ যোগফল সমস্তের বেশি হওয়া যেমন একটি ত্রুটি, সমস্তের কম হওয়াও অনুরূপ একটি ত্রুটি। এছাড়া পিতা-মাতা ও স্বামী স্ত্রীর জন্য অংশ বর্ণনার ক্ষেত্রে যেভাবে ‘মা তারাকা’ বা ‘মিম্মা তারাকা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে বা ‘আল’ যুক্ত অবস্থায় অংশ বর্ণনা করা হয়েছে পুত্র-কন্যার জন্যও অনুরূপ করা হয়েছে। সুতরাং উভয় ক্ষেত্রে একই ধরনের অবস্থা প্রযোজ্য হবে। কোনোটি সমস্ত সম্পদে কার্যকর হবে এবং কোনোটি অবশিষ্ট সম্পদে কার্যকর হবে এ কথা গ্রহণযোগ্য নয়।
(৭) পুত্র থাকা অবস্থায় পিতা মাতা উভয়ের প্রত্যেকের অংশ ১/৬ । একটি মত অনুযায়ী, যদি পিতা ও মাতার মধ্য থেকে মাতা না থাকে তাহলে মাতার অংশ পিতা পাবে (আসাবা হিসাবে)। প্রশ্ন হলো, যদি পিতা না থাকে তাহলে কি পিতার অংশ মাতা পাবে? নাকি মাতার অংশও পিতা পাবে না এবং পিতার অংশও মাতা পাবে না বরং পিতা/মাতা ছাড়া অন্য যে ওয়ারিস থাকবে সে পাবে, যেমন পুত্র-কন্যা? যদি তিন কন্যা এবং শুধু পিতা বা শুধু মাতা থাকে তাহলে পিতার বা মাতার অংশ কত হবে? এক্ষেত্রে কিছু অংশ অবন্টিত থেকে যায় বিধায় এখানে কি রদ্দের বিষয়টি কার্যকর হবে? নাকি মাতা থাকলে তো রদ্দ হবে কিন্তু পিতা থাকলে রদ্দ না হয়ে অবশিষ্টাংশ পিতা পাবে (আসাবা হিসাবে)? নাকি পিতা আসাবা হয় শুধুমাত্র যেক্ষেত্রে পিতার অংশ উল্লেখ থাকে না সেক্ষেত্রে?
(৮) যদি কারো একটিমাত্র কন্যা থাকে এবং পিতা-মাতা থাকে তাহলে কে কতটুকু পাবে? এক্ষেত্রে কয়েকটি বিকল্প প্রস্তাবনা রয়েছে। এ প্রস্তাবনাগুলোর সাথে আসাবার ধারণা সম্পর্কিত। আসাবা (অবশিষ্টাংশভোগী) হওয়ার ভিত্তি  দুটি। প্রথম ভিত্তি: কুরআনে যাকে ওয়ারিস করা হয়েছে অথচ তার অংশ নির্ধারণ করা হয়নি বা কোনো বিশেষ অবস্থায় যার অংশ নির্ধারণ করা হয়নি সে হচ্ছে আসাবা; যেমন পুত্র-কন্যা। দ্বিতীয় ভিত্তি: হাদীস অনুযায়ী, নিকটতম পুরুষ আত্মীয়ের মাধ্যমে সম্পর্কিত আত্মীয় হলো আসাবা। অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোনো ক্ষেত্রে যাবিল ফুরুজ হলেও অন্য কোনো ক্ষেত্রে তার অংশ অনির্ধারিতসে প্রথম স্তরের আসাবা এবং যে ব্যক্তি যাভিল ফুরুজ ধরনের আসাবার অবর্তমানে আসাবা হয় সে দ্বিতীয় স্তরের আসাবা। কন্যা আসাবা নয়। কিন্তু পুত্রের সাথে থাকলে সে আসাবা হয়ে যায়। তাই পুত্র-কন্যা একসাথে থাকলে পিতা-মাতার পর অবশিষ্টাংশ পুত্র-কন্যা পায়। কিন্তু যদি কোনো ব্যক্তির একটিমাত্র কন্যা থাকে (যখন পুত্র নেই) তাহলে কন্যা পাবে ১/২ , মাতা পাবে ১/৬  , পিতা পাবে ২/৬  (যাভিল ফুরুজ হিসাবে ১/৬  + আসাবা হিসাবে অবশিষ্ট ১/৬ )। অন্য একটি মতে, এক্ষেত্রে রদ্দের নিয়মে কন্যা, মাতা ও পিতা সবাই আনুপাতিক হারে বেশি পাবে। আবার তৃতীয় একটি মতে, কন্যা কন্যা হওয়ায় (তথা পুত্র না হওয়ায়) সে অর্ধেক পাবে, বাকি অর্ধেক পিতা-মাতা সমানভাবে পাবে, যেহেতু সন্তান থাকলে পিতা-মাতার অংশ পরস্পরের সমান হয়।
(৯) দুইয়ের বেশি কন্যার চেয়ে দুই কন্যা কি বেশি পেতে পারে? যদি শুধু পিতা বা মাতা থাকে এবং দুই কন্যা পায় অবশিষ্ট অংশ। প্রশ্নটির কারণ হলো, যেহেতু প্রচলিত মতে যার অংশ উল্লেখ করা হয়নি সে পায় অবশিষ্ট অংশ, আর প্রচলিত অনুবাদ অনুসারে দুইয়ের বেশি কন্যার অংশ সরাসরি উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু দুই কন্যার অংশ সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। অবশ্য সাধারণ মত হলো, দুই কন্যার জন্যও  দুইয়ের বেশি কন্যার সমান অংশ নির্ধারিত হবে। কিন্তু এই সাধারণ মতের ভিত্তি হচ্ছে ‘ফাওক্বাছনাতাইনি’ শব্দটি দুইয়ের ক্ষেত্রেও কার্যকর হয় বলে কৃত ব্যাখ্যা অথবা হাদীসের মাধ্যমে এই অতিরিক্ত ধারাটি যোগ করা হয়। যেমন ৪:১৭৬ আয়াতের ক্ষেত্রে দুইয়ের বেশি বোনের অংশ সরাসরি উল্লেখ না করা সত্ত্বেও হাদীস অনুযায়ী ২/৩   অংশ নির্ধারণ করা হয়, যদিও সেখানে ‘ফাওক্বা’ বা অনুরূপ কোনো শব্দ নেই যা থেকে ঐ ব্যাখ্যা করা যায়। কেউ কেউ বলেন, ৪:১১ তে দুই কন্যা কত পাবে তা নির্ধারিত হয় ৪:১৭৬ আয়াতে দুই বোনকে যা দেয়া হয়েছে তা দ্বারা এবং ৪:১৭৬ আয়াতে দুইয়ের বেশি বোন কত পাবে তা নির্ধারিত হবে ৪:১১ আয়াতে দুই কন্যাকে যা দেয়া হয়েছে তা দ্বারা। কিন্তু কেন এমনটি হবে? এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা উচিত। 
(১০) তিন কন্যা ও পিতা-মাতার সাথে স্বামী থাকলে বন্টন কিভাবে হবে? প্রচলিত মতে এক্ষেত্রে অংশগুলোর যোগফল সমস্ত সম্পদের বেশি হয়ে যায় ফলে আউলের প্রয়োজন হয়। 
(১১) কেউ কেউ বলেন যে, ‘ওয়ালাদ’ অর্থ ‘একটি পুত্র’। সুতরাং ‘ওয়ালাদ’ থাকা অবস্থায় পিতা-মাতার ও স্বামী/ স্ত্রীর যে অংশ নির্ধারণ করা হয়েছে তা কার্যকর হবে শুধু এক পুত্র থাকা অবস্থায়। কিন্তু একাধিক পুত্র থাকলে অথবা এক বা একাধিক কন্যা থাকলে অথবা পুত্র-কন্যা থাকলে তা কার্যকর হবে না। প্রশ্ন হলো তাহলে সে ক্ষেত্রে পিতা-মাতার অংশ ও স্বামী/ স্ত্রীর অংশ কিভাবে নির্ধারিত হবে?
(১২) ওয়ালাদ না থাকলে এবং পিতা-মাতা একমাত্র ওয়ারিস হলে মাতা পাবে ১/৩ । প্রশ্ন হলো এখানে আরবিতে ওয়ারিস হওয়ার কথা বলা হয়েছে, তাহলে একমাত্র ওয়ারিস হলে অর্থ করা হলো কেন? পিতা-মাতা ওয়ারিস হলেও স্বামী/ স্ত্রী ওয়ারিস হতে পারে, কারণ ওয়ালাদ না থাকা অবস্থায় স্বামী/ স্ত্রীর অংশ উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া, ওয়ালাদ থাকলে পিতা-মাতা ও স্বামী/ স্ত্রী সবাই ওয়ারিস হবে, কিন্তু ওয়ালাদ না থাকলে শুধু পিতা-মাতা ওয়ারিস হবে তা যৌক্তিকও নয় এবং বলাও হয়নি। বরং ওয়ালাদ না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতা ওয়ারিস হলে (একমাত্র ওয়ারিস হোক বা তার সাথে অন্য ওয়ারিস থাকুক উভয় অবস্থায়) মাতার অংশ কত তা উল্লেখ করা হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, অন্য ওয়ারিস না থাকলে মাতা পাবে ১/৩ , অন্য ওয়ারিস থাকলে তার অংশ দেয়ার পর মাতা পাবে অবশিষ্ট থেকে ১/৩ । কিন্তু অবশিষ্টাংশের ১/৩  বলার ভিত্তি কী? পিতা-মাতার অংশ কার্যকর হবে পুত্র-কন্যার সাথে আর স্বামী/ স্ত্রীর অংশ সমস্ত সম্পদে এ ধারণার উপর ভিত্তি করে এ মত দেয়া হয়। কিন্তু আয়াতের বক্তব্য বা ভাষা থেকে এ কথা প্রমাণ করা যায় না। যেহেতু পুত্র-কন্যার পর পিতা-মাতার অংশ বলার আগে সেটাকে যেমন ‘ওয়া’ (এবং) দ্বারা যুক্ত করা হয়েছে, স্বামী/স্ত্রীর অংশ বলার আগেও তেমনি সেটাকে ‘ওয়া’ (এবং) দ্বারা যুক্ত করা হয়েছে। তাই এতে পাথক্য করার কোনো প্রকৃত ভিত্তি নেই।
(১৩) ওয়ালাদ না থাকলে এবং পিতা-মাতা ওয়ারিস হলে মাতা পাবে ১/৩ । প্রশ্ন হলো তখন পিতা কতটুকু পাবে?
(১৪) ওয়ালাদ না থাকলে এবং পিতা-মাতা ওয়ারিস হলে, এবং ইখওয়াত থাকলে মাতা পাবে ১/৬  । প্রশ্ন হলো তখন পিতা কতটুকু পাবে? আর ইখওয়াত কিছু পাবে কিনা? যদি পায় তবে কতটুকু পাবে? প্রচলিত মতে, পিতা পাবে অবশিষ্টাংশ এবং ইখওয়াত কিছু পাবে না। কেউ কেউ মনে করেন, পিতা পাবে মাতার দ্বিগুণ এবং ইখওয়াত পাবে ৪:১২ আয়াতে প্রদত্ত ইখওয়াতের অংশ। আবার কেউ কেউ মনে করেন, ওয়ালাদ না থাকলেও পিতার অংশ ওয়ালাদ থাকার সমান, ইখওয়াত থাকুক বা না থাকুক। এসব মতের মধ্যে কোনটি সঠিক এবং কেন?
(১৫) ওয়ালাদ না থাকলে এবং পিতা-মাতা ওয়ারিস হলে, এবং ইখওয়াত থাকলে মাতা পাবে ১/৬ । প্রশ্ন হলো, ইখওয়াত বলতে একাধিক ভাই এবং ভাই-বোন বুঝায়, নাকি শুধু একাধিক বোন থাকলেও মাতা ১/৬  পাবে? এছাড়া যদি শুধু এক ভাই বা এক বোন থাকে তাহলে মাতা কতটুকু পাবে?
(১৬) কালালাহ বলতে কাকে বুঝানো হয়েছে? মৃত ব্যক্তিকে না মৃত ব্যক্তির কোনো বিশেষ ধরনের ওয়ারিসকে? যদি মৃত ব্যক্তির কোনো বিশেষ ধরনের ওয়ারিসকে বুঝানো হয়, তাহলে কালালাহর এক ভাই বা এক বোন থাকার ব্যাখ্যা কি এই যে, কালালাহসহ মোট দুজন? আর যখন তারা এর চেয়ে বেশি হয় কথটির অর্থ কি এই যে, যখন কালালাহসহ ভাইসংখ্যা দুইয়ের বেশি হয়? এক্ষেত্রে কেউ কেউ মনে করেন, কালালাহর ভাই বা বোন পাবে কালালাহ যে অংশ থেকে পায় সেটার (অর্থাৎ অবশিষ্টাংশের) অংশবিশেষ আর কালালাহ পাবে (অবশিষ্টাংশ থেকে) সেই অংশবিশেষের পরবর্তী সমস্ত অংশ।
(১৭) ৪:১২ আয়াতে, যখন তারা (ভাই/বোন) এর চেয়ে বেশি হয় বলতে একাধিক বুঝানো হয়েছে নাকি দুইয়ের অধিক বুঝানো হয়েছে?
(১৮) ৪:১২ আয়াতে উল্লেখিত তারা (ভাই-বোন) শরিক হবে ১/৩  অংশে বলতে ভাই-বোনকে সমান অংশীদার বুঝানো হয়েছে নাকি এক্ষেত্রেও ভাই পাবে বোনের দ্বিগুণ? এটি কিভাবে নির্ণয় করা হবে?
(১৯) কেউ কেউ মনে করেন যে, মৃত ব্যক্তির ওয়ারিসদের মধ্যে যখন কেউ কেউ থাকে না অথবা তাদের অংশ পাওয়ার পর কিছু অবশিষ্ট থেকে যায় তখন ঐ অবশিষ্ট অংশের ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তি কোনো কালালাহ আত্মীয়কে মনোনীত করে যেতে পারেন। ঐ কালালাহ আত্মীয় তার (কালালাহর) ভাই বা বোনসহ প্রত্যেকে অবশিষ্টাংশের ১/৬  পাবে। প্রশ্ন হলো, ‘অবশিষ্টাংশের’ শব্দটি কিভাবে পাওয়া গেল? আবার কেউ কেউ মনে করেন, মনোনীত ব্যক্তির ভাই/বোন পাবে মনোনয়নসম্পৃক্ত পরিমাণের (অবশিষ্টাংশের) ১/৬  এবং মনোনীত ব্যক্তি পাবে অবশিষ্টাংশ (তথা মনোনয়নসম্পৃক্ত পরিমাণের বা অবশিষ্টাংশের অবশিষ্টাংশ)।
(২০) যদি মৃত ব্যক্তি তার কোনো কালালাহ আত্মীয়কে মনোনীত না করেন তাহলে কি তাঁর কালালাহ আত্মীয় কিছু পাবে না? এ অবস্থায় কি কিছু সম্পত্তি অবন্টিতই থেকে যাবে? কেউ কেউ মনে করেন যে, ২:১৮০-১৮২ আয়াত এবং ৪:৮ আয়াত এরূপ অবস্থার জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো এরূপ অবশিষ্ট থাকা ছাড়া কি ২:১৮০-১৮২ এবং ৪:৭ আয়াতের আদেশ মান্য করা হবে না?
(২১) ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত কালালাহ কি একই না ভিন্ন ভিন্ন? যদি একই হয় তাহলে দুই আয়াতের বন্টন বিধিতে স্ববিরোধ রয়েছে। আর যদি ভিন্ন হয় তবে কোন আয়াতে বর্ণিত কালালাহর অর্থ কী? এবং তা কিভাবে নির্ণিত হবে?
(২২) ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত ভাই-বোন কি একই না ভিন্ন ভিন্ন? যদি একই হয় তাহলে দুই আয়াতের বন্টন বিধিতে স্ববিরোধ রয়েছে। আর যদি ভিন্ন হয় তবে কোন আয়াতে বর্ণিত ভাই-বোনের অর্থ কী? এবং তা কিভাবে নির্ণিত হবে?
(২৩) ৪:১৭৬ আয়াতে ভাই যে বোনের ওয়ারিস হবে তা দ্বারা কি সে বোনের একমাত্র ওয়ারিস হওয়ার কথা বলা হয়েছে তথা সে বোনের সমস্ত সম্পত্তি পাওয়ার কথা বলা হয়েছে? তাহলে কি এরূপ অবস্থায় পিতা-মাতা ও স্বামী/ স্ত্রী কিছুই পাবে না? পিতা-মাতা ওয়ারিস হলেও যেমন তার সাথে অন্য ওয়ারিস যেমন স্বামী/ স্ত্রী থাকতে পারে, তেমনি ভাই ওয়ারিস হবে এবং তার সাথে অন্য ওয়ারিসও থাকতে পারে যেমন পিতা-মাতা ও স্বামী/ স্ত্রী, এটিই যৌক্তিক কথা। অন্য ওয়ারিস থাকুক বা না থাকুক মাতার অংশ  ১/৩ । কিন্তু ভাইয়ের কোনো নির্দিষ্ট অংশ বলা হয়নি। তবে কি অন্য ওয়ারিস না থাকলে সে সমস্ত সম্পত্তি পাবে, অন্যথায় অবশিষ্টাংশ পাবে? একাধিক ভাইয়ের ক্ষেত্রেও কি একই কথা প্রযোজ্য?
(২৪) কেউ কেউ মনে করে যে, ভাই-বোন হলো অবশিষ্টাংশের ওয়ারিস। অর্থাৎ ৪:১৭৬ আয়াতের প্রয়োগ এভাবে হবে যে, এক বোন পাবে অবশিষ্টাংশের অর্ধেক, দুই বোন পাবে অবশিষ্টাংশের ২/৩ , শুধু ভাই থাকলে সে পাবে অবশিষ্টাংশ সম্পূর্ণ। কিন্তু অবশিষ্টাংশ শব্দ যোগ করার ভিত্তি কী?
(২৫) শুধু দুইয়ের বেশি বোন থাকলে তারা কতটুকু পাবে তা সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। কেউ কেউ মনে করেন, তারা পাবে অবশিষ্টাংশ, যেহেতু তাদের অংশ উল্লেখ করা হয়নি। আবার কারো কারো মতে, তারা পাবে শুধু দুই বোনের সমান অংশ তথা ২/৩ ।
আয়াত নম্বর ভিত্তিক বিশেষ সমস্যাসমূহ
৪:১১ আয়াতের প্রসঙ্গে সমস্যাসমূহ
(ক) প্রচলিত একটি অনুবাদ অনুসারে শুধু দুই কন্যা থাকলে তারা কতটুকু পাবে তা সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি।
(খ) শুধু এক বা একাধিক পুত্র থাকলে তারা কতটুকু পাবে তা সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি।
(গ) পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন না থাকলে মাতা পাবে ১/৩  এবং ভাই-বোন থাকলে মাতা পাবে ১/৬ । কিন্তু এ দুই অবস্থায় পিতা কতটুকু পাবে তা উল্লেখ করা হয়নি।
(ঘ) পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় যদি পিতা-মাতার মধ্য থেকে শুধু পিতা বা শুধু মাতা ওয়ারিস হয় সেক্ষেত্রে পিতা বা মাতা কতটুকু পাবে তা উল্লেখ করা হয়নি।
(ঙ) ইখওয়াত বলতে ভাই-বোনের সংখ্যা (একবচন, দ্বিবচন, বহুবচন) ও লিঙ্গ (পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ) নির্দিষ্ট করা হয়েছে কিনা তাও বিবেচ্য বিষয়।
(চ) ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ বলতে পিতা-মাতা ওয়ারিস হলে বুঝানো হয়েছে নাকি শুধুমাত্র পিতা-মাতাই ওয়ারিস হলে বুঝানো হয়েছে? যদি শুধুমাত্র পিতা-মাতাই ওয়ারিস হলে বুঝানো হয়, তাহলে মাতার অংশ ১/৩  এবং ভাই-বোন থাকা অবস্থায় ১/৬  উভয়টির সাথেও কি শুধুমাত্র পিতা-মাতাই ওয়ারিস হলে শর্তটি বহাল থাকবে? অর্থাৎ ভাই-বোন থাকলেও কি পিতা-মাতা একমাত্র ওয়ারিস হবে? অন্যকথায়, পিতা-মাতার সাথে ভাই-বোন ওয়ারিস হতে পারে কিনা?
(ছ) ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ বাক্যের আওতায় দেয়া পিতা-মাতার অংশ, বিশেষ করে মাতার অংশসমূহ কি তাদের সাথে ওয়ারিস হিসেবে স্বামী/ স্ত্রী থাকলে সেক্ষেত্রেও একই থাকবে?
৪:১২ আয়াতের প্রসঙ্গে সমস্যাসমূহ
(ক) ভাই-বোনের প্রসঙ্গে ‘ফাইন কানা আকছারা মিন যালিকা’ বলতে একাধিক বুঝানো হয়েছে না দুইয়ের অধিক বুঝানো হয়েছে? একাধিক বোন বা একাধিক ভাই বা ভাই-বোন যেভাবেই থাকুক তারা কি এই ১/৩  সম্মিলিতভাবে পাবে?
(খ) ভাই-বোনের প্রসঙ্গে ‘ফাহুম শুরাকাউ’ বলতে তারা সমানুপাতিকভাবে অংশীদার হবে বুঝানো হয়েছে নাকি এখানেও এক ভাই পাবে দুই বোনের সমান?
৪:১৭৬ আয়াতের প্রসঙ্গে সমস্যাসমূহ
(ক) শুধু রবান দুইয়ের বেশি হলে তারা তথা দুইয়ের বেশি বোন কতটুকু পাবে তা উল্লেখ করা হয়নি।
(খ) ‘ওয়া হুয়া ইয়ারিছুহা’ বাক্য দ্বারা কি ভাইকে সম্পূর্ণ সম্পত্তির একমাত্র ওয়ারিস করা হয়েছে? নাকি স্বামী/ স্ত্রী থাকলে তার অংশ দেয়ার পর সে অবশিষ্ট সম্পূর্ণ সম্পত্তির ওয়ারিস করা হয়েছে?
(গ) ‘ওয়া হুয়া ইয়ারিছুহা’ বাক্যের মাধ্যমে একটি ভাই যতটুকু পাওয়ার হকদার হয়, শুধু ভাই একাধিক থাকলে তারাও কি ঠিক ততটুকু পাওয়ার হকদার হবে?
(ঘ) ‘ওয়া ইন কানূ ইখওয়াতান রিজালান ওয়া নিসাআন’ বাক্যের ‘নিসাআন’ যে বহুবচন এবং তা দুইয়ের বেশি নারীকে বুঝায় ৪:১১ আয়াতে ব্যবহৃত ‘ফাইন কুন্না নিছাআন ফাওক্বাছনাতাইনি’ এবং দ্বিবচনের ক্ষেত্রে ৪:১৭৬ আয়াতে ব্যবহৃত ‘ফাইন কানাতাছনাতাইনি’ থেকে তা স্পষ্ট হয়। এছাড়া, ৪:১১ ও ৪:১৭৬ আয়াতে দুই নারী বুঝানোর জন্য ‘উনছায়ায়নি’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এখন রিজালান বহুবচন, নিছাআনও বহুবচন। তাহলে, এখানে কি অন্তত তিন বা দুই ভাই এবং সেই সাথে অন্তত তিন বা দুই বোন থাকার কথা বুঝাচ্ছে? নাকি দুই ভাই চার বোন, তিন ভাই ছয় বোন এভাবে ১:২ অনুপাতে ভাই-বোন থাকা অবস্থার কথা বুঝাচ্ছে? (পরের প্রশ্ন থেকে এ প্রশ্নটি আরো স্পষ্ট হবে)।
(ঙ) পুত্র-কন্যা ও ভাই-বোনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ‘লিয যাকারি হাযযিল উনছায়ায়নি’ বাক্যটি কি শুধুমাত্র পুত্র ও কন্যার অনুপাত ১:২ হলে এবং অনুরূপভাবে ভাই ও বোনের অনুপাত ১:২ হলে প্রযোজ্য? যেমন যখন ১ পুত্র ২ কন্যা, ২ পুত্র ৪ কন্যা, ৩ পুত্র ৬ কন্যা এভাবে থাকবে তখন প্রযোজ্য? নাকি পুত্র কন্যা মিলিতভাবে থাকলেই তা প্রযোজ্য হবে পুত্র সংখ্যা যা-ই হোক এবং কন্যা সংখ্যা যা-ই হোক? যেমন, ১ পুত্র ১ কন্যা, ২ পুত্র ১ কন্যা, ১ পুত্র ৩ কন্যা ইত্যাদি যেভাবেই থাকুক না কেন?
সামগ্রিক বন্টন বিধির প্রসঙ্গে বিশেষ সমস্যাসমূহ
(ক) কেউ যাবিল ফুরুজ, কেউ আসাবা বা অবশিষ্টভোগী এবং কেউ যাবিল আরহাম এ বিভাজন কি সঠিক?
(খ) যাবিল ফুরুজদের মধ্যে বন্টন করতে গিয়ে যদি অংশসমূহের যোগফল ১ এর বেশি বা কম হয় তখন আউল বা রদ্দ করতে হবে; কিন্তু শুধু একজন যাবিল ফুরুজ থাকলে এবং কোনো আসাবাও না থাকলে তা থেকে যাবিল আরহামকে দিতে হবে বা তা থেকে ৪:৮ আয়াতে বর্ণিত ইয়াতীম মিসকীনকে দিতে হবে বা তা বাইতুল মালে দিতে হবে এই বন্টন নীতি কি যথার্থ? কেন এক্ষেত্রে আউল বা রদ্দের নিয়মে তথা আনুপাতিক অংশের স্বাভাবিক নিয়মে সেই একমাত্র যাবিল ফুরুজ সম্পূর্ণ সম্পত্তি পাবে না?
(গ) ৪:১১ আয়াতের ক্ষেত্রে, মৃত পুরুষের পিতা-মাতা ও পুত্র-কন্যা যেভাবে পায়, মৃত নারীর পিতা-মাতা ও পুত্র-কন্যা কি সেভাবে পাবে?
(ঘ) ৪:১৭৬ আয়াতের ক্ষেত্রে, মৃত ভাইয়ের শুধু এক বা একাধিক ভাই থাকলে তারা কিভাবে পাবে? মৃত নারীর একাধিক ভাই, এক বা একাধিক বোন এবং ভাই-বোন কিভাবে পাবে?
কালালাহ ও ভাই-বোনের অংশ প্রসঙ্গে বিশেষ সমস্যাসমূহ
(ক) ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত কালালাহ কি একই অর্থবোধক? নাকি এ দুই স্থানের কালালাহর মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে? আসলে কালালাহ এর প্রকৃত অর্থ কী? এ শব্দটির অর্থ সম্পর্কে বিভিন্ন মত চালু আছে। কোন মতটি সঠিক তা কিভাবে নির্ণয় করা যাবে?
(খ) ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে কালালাহর ভাই-বোনদের প্রাপ্য অংশ ভিন্ন দেখা যায়। এর কারণ কী? প্রচলিত উত্তর হচ্ছে, এ দুই স্থানের মধ্যে ৪:১২ আয়াতে বৈপিত্রেয় ভাই-বোনদেরকে বুঝানো হয়েছে এবং ৪:১৭৬ আয়াতে পূর্ণ আপন ভাই-বোন এবং বৈমাত্রেয় ভাই-বোনদেরকে বুঝানো হয়েছে। দাবি করা হয় যে, এ কথার ভিত্তি হচ্ছে ইজমা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ ইজমার ভিত্তি কী? অর্থাৎ আয়াতে উভয় স্থানে ‘আখুন, উখতুন’ শব্দ ব্যবহৃত হওয়া সত্ত্বেও এ পৃথকীকরণ কিভাবে করা যেতে পারে? যদি এ পৃথকীকরণ সঠিক না হয় তবে কি ভাই-বোনদের অংশ দুই স্থানে দুই রকম দেয়া হয়েছে? কেউ কেউ এ কথা স্বীকার করেন এবং বলেন যে, ৪:১৭৬ আয়াত ৪:১২ আয়াতের কালালাহ সম্পর্কিত অংশকে মানছুখ (রহিত) করেছে। এ বিষয়ে প্রকৃত সমাধান কী? আর যারা মানছুখ হিসাবে মানেননি বরং ৪:১২ আয়াতে বৈপিত্রেয় ভাই-বোন এবং ৪:১৭৬ আয়াতে পূর্ণ আপন ও বৈমাত্রেয় ভাইবোনের কথা বুঝানো হয়েছে বলে দাবি করেন, তাঁরা হিমারিয়া নীতি/ গাধা সমাচার অনুযায়ী, যে অবস্থায় পূর্ণ আপন ভাইয়ের জন্য কিছু অবশিষ্ট থাকে না তখন তাকে বৈপিত্রেয় ভাই-বোনের সাথে সমান অংশীদার সাব্যস্ত করেন। প্রশ্ন হলো, আল্লাহর বিধান অনুযায়ী যদি পূর্ণ আপন (পিতা-মাতা উভশরিক) ভাই-বোন বঞ্চিত হয়, তাদেরকে বঞ্চিত করতে হবে, সেক্ষেত্রে হযরত উমরের সিদ্ধান্ত অনুসারে বণ্টন করলে তা কি আল্লাহর বিধানের অনুসরণ হয়, নাকি এর মাধ্যমে তার লঙ্ঘন হয় বা ত্রুটি সংশোধন করা হয়?
(গ) কালালাহ সম্পর্কিত ফতোয়া জানতে চাওয়ার প্রেক্ষিতে ৪:১৭৬ আয়াতে কালালাহ সম্পর্কিত বন্টনের একটি বাড়তি ধারা উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলে যদি ফতোয়া জানতে চাওয়া না হতো তবে কি ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত বন্টন বিধি ছাড়াই উত্তরাধিকার বন্টিত হতো বা তাহলে কি উত্তরাধিকারের বিধান পূর্ণাঙ্গ হতো? অন্য কথায়, কেন ৪:১১, ৪:১২ আয়াতে উত্তরাধিকারের পূর্ণাঙ্গ বিধান দেয়া হয়নি? কেন ৪:১৭৬ আয়াতটি ৪:১৩ আয়াত না হয়ে ৪:১৭৬ আয়াত হলো বা সূরা নিসার শেষ আয়াত হলো যা উত্তরাধিকারের বন্টন বিধি সম্বলিত ৪:১১, ৪:১২ আয়াত থেকে বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থিত?
উল্লেখ্য: উপরিউক্ত সমস্যাগুলোর ধারণা বিভিন্ন বই ও আর্টিকেল ছাড়াও অনলাইন ফোরাম ও ব্লগ ইত্যাদি থেকে সংকলিত হয়েছে। একত্রীকরন, বিন্যাস ও সরলিকরনের ক্ষেত্রে সংকলক কর্তৃক যথেষ্ট পরিমার্জন করা হয়েছে। সমস্যাগুলোর বিষয়ে আলোকপাত করার উদ্দেশ্য হলো এ বিষয়ে পাঠককে ধারণা দেয়া এবং বিভিন্ন চিন্তা-উপলব্ধির তুলনামূলক পর্যালোচনার মাধ্যমে তথ্যগত সিদ্ধান্ত বা অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সহযোগিতা করা।
সমস্যার গোড়ার কথা ও সমাধান
প্রচলিত মতে অংশগুলোকে আনুপাতিক অংশ না ধরায় সর্বক্ষেত্রে অবশিষ্ট অংশের ধারণা নেয়া হয়েছে। অথচ শুধুমাত্র পুত্র কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলে পিতার অংশ কত হবে সেক্ষেত্রে অবশিষ্ট অংশের ধারণা স্বত:সিদ্ধভাবে আসে এবং তা একটি ব্যক্তিগত আনুপাতিক অংশ সৃষ্টি করে। এই অবশিষ্টাংশের বিষয়টি পিতার আনুপাতিক অংশের নির্ধারক, তা আনুপাতিক অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, পিতা-মাতার আনুপাতিক অংশ শিরোনামে বিষয়টি বিস্তারিত যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে অবশিষ্ট অংশের ধারণা গ্রহণ করলে তা আয়াতসমূহের বিভিন্ন তথ্যের সাথে অসঙ্গতিশীল বলে প্রতীয়মান হয়।
৪:১২ এবং ৪:১৭৬ আয়াতের বক্তব্যে দুইয়ের বেশি কন্যার অংশ ও দুই কন্যার অংশ সমান, অনুরূপভাবে দুই বোনের অংশ ও দুইয়ের বেশি বোনের অংশ সমান এ বিষয়টি সাধারণত সব বিশ্লেষকই মেনে নেন। কিন্তু এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমান এই সূত্রটিকে শুধুমাত্র পুত্র-কন্যা মিলিতভাবে থাকার অবস্থায় প্রযোজ্য ধরে নিয়ে, শুধু পুত্র থাকা অবস্থায় তাদেরকে অবশিষ্ট অংশের অধিকারী সাব্যস্ত করা হয়ে থাকে।
এমতাবস্থায় শুধু এক কন্যা থাকলে সে পায় অর্ধেক অথচ শুধু চার পুত্র থাকলে তাদের প্রত্যেকে পিতা-মাতার সাথে যা পায় তা হয় শুধু এক কন্যা থাকলে সে যা পেত তার তিন ভাগের এক ভাগ। একইভাবে শুধু চার কন্যা থাকলে তাদের প্রত্যেকে পিতা-মাতার সাথে যা পায় তা শুধু চার পুত্র থাকলে প্রত্যেক পুত্র যা পেতো তার সমান হয়। কিন্তু যখন পিতা বা মাতা শুধু একজন থাকে সে অবস্থায় পুত্রের অংশ বেড়ে যায় যেহেতু সে অবশিষ্ট অংশের অধিকারী অথচ সে অবস্থায় দুই বা ততোধিক কন্যার অংশ বাড়ে না যেহেতু তাদের অংশ নির্ধারিত ধরে নেয়া হয়েছে।
এছাড়া পিতা-মাতা ও স্বামী থাকলে শুধু এক কন্যাকে অর্ধেক দেয়ার পর তাদের মধ্যে বন্টনের ক্ষেত্রে অংশগুলোর যোগফল সমগ্র সম্পদের চেয়ে বেশি হয়ে যায়।  এমতাবস্থায় স্বামীকে প্রথমে তার অংশ দিয়ে বাকি অংশকে পিতা-মাতা ও এক কন্যার মধ্যে আনুপাতিক হারে ভাগ করতে হয়। অথচ আয়াতে এরূপ কোনো নির্দেশ বা নির্দেশনা নেই।
সন্তান না থাকা অবস্থায় মাতার উল্লেখিত আনুপাতিক অংশের সাপেক্ষে অবশিষ্ট অংশ হলো পিতার আনুপাতিক অংশ। কিন্তু এ বিষয়টির অন্যরূপ প্রয়োগ তথা পিতাকে সাধারণভাবেই অবশিষ্টভোগী হিসেবে সাব্যস্ত করার ফলে কখনো কখনো পিতা তার আনুপাতিক অংশ থেকে বঞ্চিত হয় এমনকি কোনো উত্তরাধিকার লাভ করা থেকে বঞ্চিত হয়। যেমন, যদি ওয়ারিস হয় পিতা, মাতা, স্বামী ও তিনজন বৈপিত্রেয় ভাই। তাহলে মাতা, স্বামী ও তিনজন বৈপিত্রেয় ভাই যাবিল ফুরুজ হিসেবে নির্দিষ্ট অংশ লাভ করে। পিতা পূর্ণ আপন ও বৈমাত্রেয় ভাইকে বঞ্চিত করতে পারলেও বৈপিত্রেয় ভাইকে বঞ্চিত করতে পারে না। এক্ষেত্রে পিতা আসাবা বা অবশিষ্টভোগী হওয়ার কারণে কিছুই পাবে না। কারণ এক্ষেত্রে কোনো অবশিষ্ট থাকে না। অথচ এটি স্বাভাবিক বিচার বুদ্ধির সাথেও সাংঘর্ষিক হয়।
সুতরাং সমস্যাটি তৈরির পেছনে চারটি মৌলিক কারণ পাওয়া যায়। প্রথমত ,উল্লেখিত অংশগুলোকে ব্যক্তিগত আনুপাতিক অংশ হিসাবে না বুঝা এবং তাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে যৌক্তিক বিশ্লেষণ ছাড়া অবশিষ্টাংশ ধরে নেয়া। দ্বিতীয়ত, এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমান কথাটিকে শুধুমাত্র পুত্র কন্যা মিলিতভাবে থাকা অবস্থার জন্য নির্দিষ্ট করে নেয়া। তৃতীয়ত, আয়াতে উল্লেখ না থাকা ও অবকাশ না রাখা সত্ত্বেও অন্য কিছু উৎস (হাদীস, ইজমা, কিয়াস) এর দ্বারা ‘যাবিল ফুরুজ, আসাবা, যাবিল আরহাম’ ইত্যাদি বিভিন্ন ধারা সংযোজন করা। চতুর্থত, আউল ও রদ্দের নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অভিনব শর্ত তৈরি করা।
যদি ‘অংশ’ বলতে ‘ব্যক্তিগত বা শ্রেণিগত আনুপাতিক অংশ’ ধরা হয়, তাহলে এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমান কথাটি শুধু এক পুত্রের আনুপাতিক অংশ নির্ধারণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়। কারণ অন্যথায় শুধু পুত্রের কোনো ব্যক্তিগত আনুপাতিক অংশ পাওয়া যায় না।
এক পুত্র পাবে দুই কন্যার অংশের সমান সূত্রটির ফলে যখন পুত্র কন্যা মিলিতভাবে থাকবে তখন তারা এক বা একাধিক পুত্র তথা দুই বা ততোধিক কন্যার সমতুল্য গণ্য হবে এবং এক্ষেত্রে তাদের আনুপাতিক অংশ হবে ২/৩  । আর এই ২/৩   অংশ বন্টনের ক্ষেত্রে পুত্র: কন্যা = ২:১ হিসাবে বন্টিত হবে।
উত্তরাধিকার বণ্টন বিধিতে যাদের ‘অংশ’ নির্ধারণ করা হয়েছে তাতে ‘অংশ’ বলতে ‘শ্রেণিগত আনুপাতিক অংশ’ বুঝানো হয়েছে। এর পক্ষে একটি সরল যুক্তি হলো: অন্যথায় কখনো সমস্ত সম্পদ বন্টিত হয় না এবং কখনো বন্টনীয় অংশগুলোর যোগফল সমস্ত সম্পদের চেয়ে বেশি হয়ে যায়।
বর্তমানে অবন্টিত অংশ বন্টনের জন্য দুটি পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। হয় এটাকে রদ্দ করা হয় তথা পুন:বন্টন করা হয় যাতে প্রত্যেকের প্রাপ্য অংশের পরিবর্তন ঘটে কিন্তু পারস্পরিক অনুপাত ঠিক থাকে। অথবা কিছু পুরুষ আত্মীয়কে আসাবা সাব্যস্ত করে তাদেরকে তথাকথিত অবশিষ্টাংশ দেয়া হয়, নারীদের সাথে সম্পর্কিত সাধারণ আত্মীয়দেরকে দেয়া হয় না। অন্যদিকে যখন যোগফল সমস্তের চেয়ে বেশি হয়ে যায় তখন আউলের মাধ্যমে প্রত্যেকের প্রাপ্য অংশে পরিবর্তন আনা হয় কিন্তু পারস্পরিক অনুপাত ঠিক থাকে। এভাবে রদ্দ ও আউল করাকে একটি উদ্ভূত সমস্যার সমাধান হিসাবে গ্রহণ করা হয় যাকে ধরে নেয়া হয় মূল সূত্রের ব্যতিক্রম অবস্থা বা ঠেকায় পড়ে এক ধরনের সমাধান। অথচ ‘অংশ’ বলতে যদি ‘শ্রেণিগত আনুপাতিক অংশ’ বুঝানো হয় তাহলে এটিই হয়ে যায় একমাত্র সূত্র যা সর্বাবস্থায় প্রযোজ্য। সেক্ষেত্রে আউল বা রদ্দকে ব্যতিক্রম বা ঠেকায় পড়ে করা সমাধান হিসেবে সাব্যস্ত করার অবকাশ থাকে না।
উত্তরাধিকার বণ্টন বিধিতে যার জন্য যে প্রাপ্য অংশ নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা তার শ্রেণিগত আনুপাতিক অংশ সাব্যস্ত করার অর্থ হলো আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে ভাগ করা। আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে একজনমাত্র ওয়ারিস যেই হোক না কেন সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমস্ত সম্পদের ওয়ারিস হয়ে যায়।
সুতরাং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত অবশিষ্ট অংশের প্রাপ্যতার ধারণা গ্রহণযোগ্য নয়। বরং ধরে নেয়া অবশিষ্ট অংশের পরিবর্তে সূত্র মোতাবেক সুনির্দিষ্ট শ্রেণিগত আনুপাতিক অংশ নির্ধারিত হয়ে যায়। যেমন শুধু এক বা একাধিক পুত্রের অংশ, (শুধু দুই কন্যার অংশ) এবং ৪:১৭৬ আয়াতের ক্ষেত্রে, এক বা একাধিক ভাইয়ের অংশ, (শুধু দুইয়ের অধিক বোনের অংশ) ইত্যাদি সবই আয়াতের বক্তব্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়।
এ বইতে আল কুরআনের উত্তরাধিকারের বিধান বা নির্ধারিত বণ্টন বিধি সম্পর্কিত আয়াতসমূহের বক্তব্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে কিভাবে এবং কার জন্য কী সুনির্দিষ্ট হয়, তা বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। এ অধ্যায়ে যে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হলো এ বইয়ে উপস্থাপিত তথ্যগত বিশ্লেষণ অনুসারে তার প্রতিটির সুসামঞ্জস্যপূর্ণ সমাধান নির্ণয় করা সম্ভব হবে, ইনশাআল্লাহ।
অধ্যায় ২২ : প্রচলিত ফারায়েজ ও কুরআনিক উত্তরাধিকার বণ্টন বিধির তুলনামূলক চিত্র
এ বইয়ে উপস্থাপিত কুরআনিক উত্তরাধিকার বণ্টন বিধির সাথে প্রচলিত ফারায়েজের তুলনামূলক চিত্র তথা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য সম্পর্কে নিম্নে আলোকপাত করা হলো।
মিলসমূহ
১. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে পুত্র-কন্যার পারস্পরিক অনুপাত পুত্র:কন্যা = ২:১।
২. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে পুত্র-কন্যা ও পিতা-মাতা না থাকা অবস্থায় ভাইবোনের পারস্পরিক অনুপাত ভাই:বোন = ২:১।
৩. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে অন্য ওয়ারিশের উপস্থিতিতে পুত্র জীবিত না থাকলে দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যার অংশ ২/৩  ।
৪. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে অন্য ওয়ারিশের উপস্থিতিতে পুত্র-কন্যা ও পিতা-মাতা না থাকা অবস্থায় ভাই জীবিত না থাকলে দুই বা দুইয়ের বেশি বোনের অংশ ২/৩ ।
৪. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে অন্য ওয়ারিশের উপস্থিতিতে পুত্র জীবিত না থাকলে একটিমাত্র কন্যার অংশ ১/২  ।
৫. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে অন্য ওয়ারিশের উপস্থিতিতে পুত্র-কন্যা ও পিতা-মাতা না থাকা অবস্থায় ভাই জীবিত না থাকলে একটিমাত্র বোনের অংশ ১/২ ।
৬. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে সন্তান জীবিত থাকলে পিতার অংশ ১/৬ ।
৭. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে সন্তান জীবিত থাকলে মাতার অংশ ১/৬ ।
৮. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে সন্তান ও ভাই-বোন জীবিত না থাকলে মাতার অংশ ১/৩ ।
৯. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে স্ত্রীর সন্তান জীবিত না থাকলে স্বামীর অংশ  ১/২  ।
১০. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে স্ত্রীর সন্তান জীবিত থাকলে স্বামীর অংশ ১/৪  ।
১১. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে স্বামীর সন্তান জীবিত না থাকলে স্ত্রীর বা স্ত্রীদের অংশ ১/৪ ।
১২. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে স্বামীর সন্তান জীবিত থাকলে স্ত্রীর বা স্ত্রীদের অংশ ১/৮ ।
অমিলসমূহ
১. প্রচলিত ফারায়েজে ওয়ারিশদের জন্য কৃত ওয়াসিয়্যাতকে রহিত করে দেয়া হয়। কুরআনিক বণ্টন বিধি অনুযায়ী প্রথমে ওয়াসিয়্যাত ও ঋণ পূরণ করতে হবে তারপর বাকি সম্পদই হবে বণ্টনযোগ্য সম্পত্তি।
২. প্রচলিত ফারায়েজে কুরআনে বর্ণিত উত্তরাধিকারীদের কাউকে যাবিল ফুরুজ (আবশ্যিক অংশের প্রাপক), কাউকে আসাবা (অবশিষ্টভোগী) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কুরআনিক বণ্টন বিধি অনুসারে এরূপ বিভাজনের সুযোগ নেই।
৩. প্রচলিত ফারায়েজে কুরআনে উল্লেখিত নয় কিন্তু পুরুষ নিকটতম আত্মীয়ের সূত্রে সাধারণ আত্মীয় (উলুল ক্বুরবা) আসাবা হিসেবে গণ্য হয়। কিন্তু কুরআনিক বণ্টন বিধি অনুযায়ী এর মাধ্যমে ‘হুদুদুল্লাহ’ বা আল্লাহ প্রদত্ত সীমা লংঘন হয়।
৪. প্রচলিত ফারায়েজে যাবিল ফুরুজ বা আসাবা থাকলে উলুল আরহাম (নারী নিকটতম আত্মীয়ের সূত্রে সাধারণ আত্মীয়, যেমন মামা, খালা) বঞ্চিত হয়। কিন্তু কুরআন অনুযায়ী, সকল রক্তসম্পর্কের আত্মীয়ই ‘উলুল আরহাম’, তারা কোনো পুরুষের মাধ্যমে সম্পর্কিত হোক বা নারীর মাধ্যমে সম্পর্কিত হোক। কুরআনে যাদেরকে ওয়ারিহ করা হয়েছে তারাই প্রথম শ্রেণির উলুল আরহাম তথা আক্বরাবূন। অন্যরা দ্বিতীয় শ্রেণির উলুল আরহাম তথা উলুল ক্বুরবা। আক্বরাবূনের কেউ জীবিত থাকা অবস্থায় উলুল ক্বুরবা ওয়ারিশ হবে না।
৫. প্রচলিত ফারায়েজে পিতা জীবিত না থাকলে দাদা-দাদীকে ওয়ারিস করা হয়, মৃত নাতির চাচা জীবিত কিনা তা বিবেচ্য নয়, যেহেতু দাদার সাথে সম্পর্ক পিতার মাধ্যমে, চাচার সাথেও সম্পর্ক পিতার মাধ্যমে, দাদা ও নাতির মধ্যে সম্পর্কসূত্রের ক্ষেত্রে চাচা মাধ্যম নন। কিন্তু বিপরীতক্রমে দাদার সম্পদে ইয়াতীম নাতিকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়, যদি তার চাচা জীবিত থাকে। কুরআনিক বণ্টন বিধি অনুযায়ী ইয়াতীম নাতিকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার সুযোগ নেই। বিশেষ করে সাধারণভাবে আত্মীয়-অনাত্মীয় সকল ইয়াতীমের বিষয়েও আল্লাহ সচেতনতার সাথে আচরণ করার জন্য উত্তরাধিকার বণ্টন বিধির অন্তর্ভুক্ত ৪:৯-১০ আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
৬. প্রচলিত ফারায়েজে ওয়ারিসদের অংশের যোগফল যখন ১ এর চেয়ে কম বা বেশি হয় তখন ক্ষেত্রবিশেষে আউল বা রদ্দের নিয়মে এর সমাধান করা হয়। কিন্তু আউল ও রদ্দের নীতির ক্ষেত্রে এমন কিছু ধারা রয়েছে যাতে সবাইকে আউল বা রদ্দের অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। কুরআনিক উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি অনুযায়ী উত্তরাধিকারের বণ্টন পদ্ধতি হতে হবে আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি। আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি এবং আউল ও রদ্দ নীতি মূলগতভাবে একই বণ্টন পদ্ধতির দুটি ভিন্ন ধরনের গাণিতিক প্রকাশ। কিন্তু আউল ও রদ্দ নীতিতে কিছু বিশেষ ধারা উপধারা যোগ করার মাধ্যমে তা সর্বক্ষেত্রে একই নিয়মে প্রয়োগ করা হয় না। এর ফলে তা কুরআনিক বণ্টন পদ্ধতির সাথে অসামঞ্জস্যশীল হয়ে পড়ে।
৭. প্রচলিত ফারায়েজে একজনমাত্র যাবিল ফুরুজ ওয়ারিস থাকলে সে তার জন্য বর্ণিত অংশ পাবে এবং বাকি অংশ আসাবা বা যাবিল আরহামের মধ্যে বণ্টিত হবে। কুরআনিক বণ্টন বিধি অনুযায়ী আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে বন্টন করতে হবে বিধায় একজনমাত্র ওয়ারিস থাকলে তার জন্য উল্লেখিত অংশ যা-ই হোক না কেন তা সমস্ত অংশে রূপান্তরিত হয় অর্থাৎ সে একাই সমস্ত উত্তরাধিকার লাভ করবে।
৮. প্রচলিত ফারায়েজে কালালাহ এর সংজ্ঞা নিয়ে বিভিন্ন মতের উদ্ভব ঘটেছিল তবে শেষ পর্যন্ত ইজমা হয়েছে যে, যে মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা ও পুত্র-কন্যা নেই তাকে কালালাহ বলে। অবশ্য এক্ষেত্রে দ্বিতীয় প্রসিদ্ধ মত হিসেবে এটিও চালু আছে যে, পিতা ও পুত্র না থাকলে সে কালালাহ, মাতা ও কন্যা জীবিত থাকলেও সমস্যা নেই। কুরআনিক বণ্টন বিধির তথ্যগত বিশ্লেষণ থেকে বুঝা যায় যে, কালালাহ হচ্ছে যে ভাই/বোন তার মৃত ভাই-বোনের উত্তরাধিকার লাভের জন্য দুটি শর্তের কোনো একটি উপস্থিত থাকে, শর্ত দুটি হলো- তাদের পিতা-মাতা নেই কিন্তু মৃত ব্যক্তির সন্তান আছে, অথবা মৃত ব্যক্তির সন্তান নেই, পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক।
৯. প্রচলিত ফারায়েজে কারো কারো মতে সূরা নিসার ১২ নং আয়াতের শেষার্ধ তথা কালালাহ সম্পর্কিত অংশ সূরা নিসার ১৭৬ নং আয়াত অনুযায়ী মানছুখ (রহিত) হয়ে গেছে। কুরআনিক বণ্টন বিধি অনুযায়ী এরূপ রহিতকরণের ধারণা গ্রহণযোগ্য নয়।
১০. প্রচলিত ফারায়েজ অনুযায়ী সূরা নিসার ১২ নং আয়াতে ভাই-বোন বলতে বৈপিত্রেয় ভাই-বোনকে বুঝে নিতে হবে এবং সূরা নিসার ১৭৬ নং আয়াতে ভাই-বোন বলতে পূর্ণ আপন ও বৈমাত্রেয় ভাই-বোনকে বুঝে নিতে হবে। কুরআনিক বণ্টন বিধি অনুযায়ী সূরা নিসার ১২ নং ও ১৭৬ নং আয়াতে ভাই-বোনকে বুঝাতে একইভাবে ‘আখু’ ও ‘উখতু’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। তাই এ দুই আয়াতের দুইটিতে দুই ধরনের ভাই-বোনকে বুঝে নেয়ার অবকাশ নেই।
১১. প্রচলিত ফারায়েজ অনুযায়ী সন্তান না থাকলে ভাই-বোন থাকলেও পিতা জীবিত থাকলে ভাই-বোন কিছু পাবে না, বরং মাতার অংশের পর পিতা একাই অবশিষ্টভোগী হবে। কুরআনিক বণ্টন বিধি অনুযায়ী সন্তান না থাকলে ভাই-বোন সন্তানের সমানুপাতিক অংশের উত্তরাধিকারী হবে।
১২. প্রচলিত ফারায়েজ অনুযায়ী যখন পূর্ণ আপন ভাই-বোন সম্পূর্ণ বঞ্চিত হওয়ার অবস্থা তৈরি হয় তখন তাদেরকে বৈপিত্রেয় ভাইদের সাথে সমান অংশীদার করে দিতে হবে। এটাকে হিমারিয়া নীতি বা গাধা সমাচার নীতি বলা হয়। কুরআনিক বণ্টন বিধি অনুযায়ী আল্লাহর বিধান স্বয়ং সত্য ও ন্যায়ে পরিপূর্ণ বিধায় এর কোন লংঘন করলে তা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। তাই কোনো অবস্থায় যদি পূর্ণ আপন ভাইবোনের কোনো অংশ না থাকে সে অবস্থায় তারা পাবে না, কিন্তু তাদেরকে অন্য কারো সাথে অংশীদার করা যাবে না। বরং সে অবস্থায় তাদেরকে উলুল ক্বুরবা হিসেবে অনুদান দেয়া যেতে পারে।
অধ্যায় ২৩ : উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সামাজিক সংকট নিরসনে কুরআন কাউন্সেলিং ও শেষ কথা
উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সামাজিক সংকট নিরসনে কুরআন কাউন্সেলিং
কুরআনে প্রদত্ত ওয়াসিয়্যাত ও উত্তরাধিকার সম্পর্কিত বিধি-বিধানের যথাযথ জ্ঞান ও তার সঠিক প্রয়োগের অভাবে সমাজে সম্পদ বণ্টনের সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। অথচ কুরআনের বিধি-বিধান সঠিকভাবে জানলে ও পরিপালনের জন্য যথাযথ উদ্যোগ চালু থাকলে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব যেমন হ্রাস পেতো তেমনি সম্পদের কল্যাণমূলক সুষম বণ্টনও নিশ্চিত হতো। এর মাধ্যমে সমাজে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পেতো। কুরআনে একদিকে যেমন মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদের উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নির্ধারিত আনুপাতিক অংশসহ নির্দিষ্ট ওয়ারিস চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে তেমনি উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধি কার্যকর করার ক্ষেত্রে প্রথমে মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পূরণ ও ঋণ পরিশোধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া উত্তরাধিকার বণ্টনকালে উত্তরাধিকারী নয় এমন যেসব আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ছেলেমেয়ে এবং অভাবগ্রস্তরা উপস্থিত হন তাদেরকেও তা থেকে কিছু অনুদান দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে উত্তরাধিকার বণ্টনের ক্ষেত্রেও ব্যাপকভাবে সমাজ কল্যাণ নিশ্চিত করা হয়েছে। উত্তরাধিকারীদের বাস্তব অবস্থা ও প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার জন্য মৃত্য নিকটবর্তী ব্যক্তির উপর ওয়াসিয়্যাতকে বাধ্যতামূলক করা হলেও বর্তমান সমাজে এ বিষয়ে অজ্ঞতা, অনীহা এবং বিভ্রান্তি বজায় থাকার কারণে এ বিধানটি অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে। এর ফলে সমস্ত উত্তরাধিকার সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখকৃত অংশ বণ্টন পদ্ধতিতে বণ্টিত হচ্ছে। অথচ আল্লাহর বিধানে ওয়াসিয়্যাত ও উত্তরাধিকারের বণ্টন-বিধির যে পূর্বাপর প্রক্রিয়াগত সম্পর্ক সেটাই সর্বোচ্চ সমাজ কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য সর্বাধিক কার্যকর পন্থা বিধায় কুরআনে ওয়াসিয়্যাত ও উত্তরাধিকার উভয়টির বিধান দেয়া হয়েছে। উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি কার্যকর করার ক্ষেত্রেও প্রচলিত ধারা উপধারার অনেক কিছু কুরআনে প্রদত্ত বণ্টন নীতির সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে সমাজে যেভাবে প্রচলিত ফারায়েজ চালু আছে তাও যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না। বরং বিভিন্ন ওয়ারিসকে বঞ্চিত করার মন্দ রেওয়াজ এখনো ব্যাপকভাবে চালু রয়েছে যার ফলে দীর্ঘসূত্রিতায় আটকে পড়া মামলা-মোকদ্দমার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। এসব কিছুর পেছনে কুরআনে উত্তরাধিকারের বিধানকে কিরূপ মুখ্য গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং এর লংঘনের যে অশুভ পরিণতি উল্লেখ করা হয়েছে তা সম্পর্কে সচেতনতার অভাবই প্রধান কারণ। তাই উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সামাজিক সংকট নিরসনে সরকারের আইন বিভাগে যারা রয়েছেন তারা কুরআনের ভিত্তিতে প্রচলিত ফারায়েজকে সংশোধন করে আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। সেই সাথে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে যেসব রাজনৈতিক অরাজনৈতিক জনপ্রতিনিধি রয়েছেন, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় সমাজসেবামূলক যেসব অধিদপ্তর এবং সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাঁরা এক্ষেত্রে গঠনমূলক ভূমিকা পালনার্থে কুরআনের জ্ঞানে সমৃদ্ধ স্কলারদের নিয়ে কুরআন কাউন্সেলিং সেল গঠন করতে পারেন। এক্ষেত্রে তারা যেমন নিজেদের মধ্যকার সংশ্লিষ্ট কুরআন গবেষকদেরকে কাজে লাগাতে পারেন, তেমনি যারা কুরআনের যথাযথ জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত এমন স্কলারদের সহযোগিতাও গ্রহণ করতে পারেন। যদি এভাবে কুরআন কাউন্সেলিং করা যায় তবে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সামাজিক সংকট নিরসনে নি:সন্দেহে তা কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
শেষকথা
পরিশেষে বলতে হয়, হাজার বছর ধরে আল কুরআনে প্রদত্ত পিতা-মাতা ও নিকটতম আত্মীয়দের জন্য ওয়াসিয়্যাত করার বাধ্যতামূলক বিধানকে সমাজে মানছুখ (রহিত) বা নফল (ঐচ্ছিক) কাজ হিসেবে সাব্যস্ত করা হচ্ছে। সেই সাথে ফারায়েজ বা মুসলিম উত্তরাধিকার বিধানের নামে লিখিত গ্রন্থসমূহে প্রথমে কুরআনের আয়াত উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে কুরআনে বর্ণিত বণ্টন বিধিকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে যার যা প্রাপ্য তাকে তা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে কাউকে প্রাপ্যের চেয়ে বেশি দেয়া হয়েছে। এর ফলে আল্লাহ প্রদত্ত কল্যাণকর বিধানের কল্যাণ থেকে মানব সভ্যতা বঞ্চিত হয়েছে এবং ন্যায়বিচার লংঘিত হয়েছে। আল্লাহ প্রদত্ত বিধান পরিপালনের মাধ্যমে মানব সভ্যতাকে সত্যিকার কল্যাণমুখী ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য ওয়াসিয়্যাত ও উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধিসহ যাবতীয় আইন-কানুনকে আল কুরআনের ভিত্তিতে যাচাই করে নিয়ে সঠিকভাবে পুন:বিন্যস্ত করার কোনো বিকল্প নেই। 
একটি প্রশ্ন হতে পারে যে, যদি এই ব্যাখ্যা সঠিক হয়, তাহলে প্রকৃত ব্যাখ্যা পুন:উপস্থাপিত হওয়ার পূর্বে মধ্যবর্তীকালে যারা প্রচলিত ব্যাখ্যা অনুসরণ করে অতীত হয়ে গেছেন তাদের কী হবে বা তাদের কর্মের মূল্যায়ন কিভাবে হবে বা আখিরাতে তারা কিরূপ দায়ী হবেন? এর জবাব হচ্ছে, প্রত্যেকে তার সাধ্যসীমায় উত্তম কর্মের জন্য দায়িত্বশীল। তাই জ্ঞানার্জন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় থাকার শর্তসহ কে তার সাধ্য অনুযায়ী (যেমন যতটুকু জ্ঞান আয়ত্ত করেছে সে অনুযায়ী) উত্তম কর্ম সম্পাদন করেছে সেটার সাপেক্ষেই তার আমলের মূল্যায়ন হবে। এ কারণে মধ্যবর্তীকালীন যারা জ্ঞানার্জন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় থেকে যতটুকু যা জেনেছে তা অনুসারে উত্তম কর্ম সম্পাদন করেছে তারা দায়মুক্ত হয়ে যাবে। যারা সঠিক কর্মনীতির উপরে থেকে (সত্য জানার ও মানার স্বাভাবিক রীতি বজায় রেখে) প্রচলিত ব্যাখ্যাকে কুরআনের সঠিক ব্যাখ্যা মনে করার কারণে অনুসরণ করেছেন তারা আখিরাতে দায়মুক্ত হতে পারেন। অতীত জনগোষ্ঠী সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে, তারা ছিল এক উম্মাত যারা অতীত হয়ে গেছে। তারা যা করেছে তা তাদের জন্য। আর তোমরা যা করছ তা তোমাদের জন্য। তারা যা করত সে বিষয়ে তোমাদের জিজ্ঞেস করা হবে না। (সূরা বাকারা ২:১৪১)। 
সুতরাং আমাদেরকে আমাদের সাধ্যমতো সঠিক তথ্যজ্ঞান অর্জন ও তদনুযায়ী উপলব্ধ বিধান পরিপালন করতে হবে। আমাদেরকে সাবধান থাকতে হবে যেন অন্ধ অনুসরণের মাধ্যমে শিরকের গুনাহে গুনাহগার না হই এবং যেন সঠিক কার্যনির্বাহের মাধ্যমে যথাযথ কল্যাণ লাভ করতে পারি।
যেহেতু প্রকৃত ব্যাখ্যার অনুসরণ ব্যতীত সার্বিকভাবে প্রকৃত কল্যাণ লাভ করা সম্ভব নয়, তাই প্রকৃত ব্যাখ্যা জানার পর তা মানবজাতির সামনে উপস্থাপন না করা সবচেয়ে বড় জুলুম। সুতরাং আমাদের কাজ হবে যারা বর্তমান আছে তাদের সামনে গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত তথ্য উপস্থাপন করা এবং তা অনুসরণ করা।  
যে কোনো মানবীয় উপলব্ধি প্রয়াসের মতো এ বইয়েও ভুল-ত্রুটি থেকে যাওয়া নিতান্ত স্বাভাবিক। তাই এ বইয়ে কুরআনের আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমে যে তথ্যগত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়েছে, কুরআনের আলোকেই তার পর্যালোচনা বা যাচাই করে কোনো ত্রুটি চিহ্নিত হলে যথাযথভাবে তথা আয়াতের ভিত্তিতে অকাট্য যুক্তি উপস্থাপনসহ তুলে ধরা হলে অবশ্যই তদনুযায়ী পরবর্তী সংস্করণ করা হবে ইনশাআল্লাহ।
ওয়া মা তাওফীকী ইল্লা বিল্লাহ। আলাইহি তাওয়াক্কালতু ওয়া ইলাইহি উনিব। (সূরা হূদ ১১:৮৮)
পরিশিষ্ট ১ : উত্তরাধিকারের বিধান সম্পর্কিত মৌলিক শব্দ, বাক্য ও শর্তের তথ্যগত বিশ্লেষণ
আল কুরআনের আলোকে উত্তরাধিকারের বিধান গবেষণামূলক অধ্যয়ন ও অনুধাবনের ক্ষেত্রে যেসব প্রাসঙ্গিক মৌলিক শব্দ, বাক্য ও শর্ত তথা আলোচ্য বিষয় বা ধারণা সহায়ক হতে পারে সেগুলোর তথ্যগত বিশ্লেষণকে পরিশিষ্ট হিসেবে উপস্থাপন করা হলো।
১. ওয়ারিস ও মাওয়ালিয়া (উত্তরাধিকারী ও অব্যবহিত/ নির্দিষ্ট উত্তরাধিকারী)
ওয়ারিস শব্দটি একটি বহুল প্রচলিত শব্দ। ওয়ারিস শব্দটির অর্থ হচ্ছে উত্তরাধিকারী। যেমন ২:২৩৩ আয়াতে বলা হয়েছে যে, তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী যখন তালাকদাতা স্বামীর সন্তানকে তথা নিজ সন্তানকে দুধ পান করায় তখন ঐ সময়কালে তাকে ভরণপোষণ ও পোশাকাদি দেয়া স্বামীর কর্তব্য এবং (ইতোমধ্যে স্বামীর মৃত্যু হলে) তা একইভাবে তার ওয়ারিসদেরও দায়িত্ব।
৪:৩৩ আয়াতে পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়গণ যে সম্পদ রেখে যায় তাতে আল্লাহ যাদেরকে ওয়ারিস হিসেবে নির্ধারিত করে দিয়েছেন তাদেরকে ‘মাওয়ালিয়া’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সাধারণত ‘মাওয়ালিয়া’ শব্দটিকে ‘ওয়ারিস’ শব্দের সমার্থক হিসেবে অনুবাদ করা হয়। 
২৮:৫ আয়াতে বলা হয়েছে, আমি ইচ্ছা করলাম যাদেরকে পৃথিবীতে দুর্বল করে রাখা হয়েছে তাদেরকেই অগ্রনায়ক করতে এবং তাদেরকে উত্তরাধিকারী [ওয়ারিস] করতে। অর্থাৎ ফেরাউন ও তার দলবলের ধ্বংসের পর বানী ইসরাইলকে তাদের স্থান ও সম্পদের ওয়ারিস করা হয়েছে। 
সুতরাং ‘ওয়ারিস’ শব্দটি ‘মাওয়ালিয়া’ শব্দটির তুলনায় সাধারণ পর্যায়ের। ‘মাওয়ালিয়া’ হচ্ছে উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী ‘অব্যবহিত/ নির্দিষ্ট ওয়ারিস’। আর ‘মাওয়ালিয়া’ এর অন্তর্ভুক্ত কেউ না থাকলে যারা ঐ সম্পদের উত্তরাধিকার লাভ করবে তারাও সম্পদের ‘ওয়ারিস’ হয়েছে বলা যায়।
‘মাওয়ালিয়া’ শব্দটি হচ্ছে ‘মাওলা’ শব্দের বহুবচন। ‘মাওলা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘রক্ষাকর্তা, উত্তরাধিকারী’। ‘মাওয়ালিয়া’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৩ স্থানে: ৪:৩৩:৩, ১৯:৫:৩ এবং ৩৩:৫:১৪।
৪:৩৩ আয়াতে মৃত ব্যক্তির নিকটতম আত্মীয় [আক্বরাবূন] হিসেবে সাব্যস্ত করে যাদের মধ্যে সম্পূর্ণ উত্তরাধিকার বণ্টনের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে সেই অব্যবহিত/ নির্দিষ্ট ওয়ারিসদেরকে ‘মাওয়ালিয়া’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। 
১৯:৫ আয়াতে নবী যাকারিয়ার প্রার্থনায় প্রকাশিত উদ্বেগ তুলে ধরা হয়েছে, যাতে তিনি তাঁর ‘মাওয়ালিয়ার’ প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিলেন। তিনি তাঁর প্রার্থনায় বলেছিলেন: আমি আমার উত্তরাধিকারীদের [মাওয়ালিয়া] (কর্মকা-ের বিষয়ে) আশংকা রাখি, আর আমার স্ত্রী বন্ধ্যা, সুতরাং আপনার পক্ষ থেকে আমাকে একজন উত্তরাধিকারী [সন্তান] দান করুন। 
৩৩:৫ আয়াতে যে পালিত পুত্রদের পিতৃপরিচয় জানা যায় না তাদেরকে দ্বীনের ভিত্তিতে ভাই এবং ‘মাওয়ালিয়া’ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। 
৪:৭, ৪:৩৩ ও ৩৩:৫ আয়াতের সমন্বিত তথ্য থেকে বুঝা যায়, ‘মাওয়ালিয়া’ এর একটি অর্থ হচ্ছে নির্দিষ্ট ওয়ারিস, যাদের মধ্যে উত্তরাধিকার বণ্টিত হবে এবং তাদের প্রাপ্য অংশও নির্ধারিত। আর ‘মাওয়ালিয়া’ এর অন্য একটি অর্থ হচ্ছে যাদেরকে দ্বীনের খাতিরে অব্যবহিত উত্তরাধিকারীদের আওতাভুক্ত করা হয়েছে কিন্তু তারা ‘আক্বরাবূন’ না হওয়ায় তাদের জন্য কোনো নির্ধারিত অংশ নেই এবং তারা নির্দিষ্ট উত্তরাধিকারী নয়। এ প্রসঙ্গে ৩৩:৫ আয়াতটি একটি নৈতিক ব্যবস্থাপনার নির্দেশক, যা থেকে বুঝা যায় যে, পালিত পুত্রদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বহন করতে হবে। যেসব উত্তরাধিকারীর জন্য নির্ধারিত বণ্টন বিধি দেয়া হয়েছে পালিত পুত্র তাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে নির্দিষ্ট উত্তরাধিকারীদের মধ্য থেকে যাদের সাধ্য রয়েছে তাদের উচিত উত্তরাধিকার থেকে তাকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা। 
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ‘ওয়ারিস’ অর্থ হচ্ছে উত্তরাধিকারী, আর ‘মাওয়ালিয়া’ অর্থ হচ্ছে ‘অব্যবহিত (রসসবফরধঃব) ওয়ারিস/ নির্দিষ্ট ওয়ারিস’। উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধিতে আল্লাহ যাদেরকে ‘ওয়ারিস’ হিসেবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন তারাই হচ্ছেন মূল ‘মাওয়ালিয়া’। তাদের মধ্য থেকে কেউ জীবিত থাকা অবস্থায় অন্য কেউ ওয়ারিস হওয়ার অবকাশ নেই। কিন্তু মাওয়ালিয়া এর অন্তর্ভুক্ত কেউই না থাকলে শুধু সেই অবস্থায় নির্বাহী ব্যবস্থাপনায় অন্য ওয়ারিস হতে পারে। অন্য ওয়ারিস নির্ধারণের ও তাদের মধ্যে বণ্টনের ক্ষেত্রে মাওয়ালিয়ার মধ্যে নির্ধারিত বণ্টন বিধি থেকে শিক্ষা নেয়া যেতে পারে।
২. আত্মীয়তার প্রকারভেদ
আল কুরআনে কোনো ব্যক্তি নিজে বিবাহ করার মাধ্যমে যাদের সাথে সম্পর্কিত হয়, যার সাথে তার স্বীয় ঔরসগত সম্পর্ক নেই, সেই বৈবাহিক সম্পর্ক বুঝাতে ‘ছিহর’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আর বংশীয় সম্পর্ক বুঝাতে ‘নাসাব’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। সুনির্দিষ্টভাবে বৈবাহিক সম্পর্কের বিপরীতে (তথা বিপরীত সম্পর্ক হিসাবে) ‘নাসাব’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
নাসাব শব্দের শব্দমূল হচ্ছে ‘নূন ছীন বা’। শব্দমূলের অর্থ ‘বংশগত আত্মীয়তা’।
নাসাব/ নসব (বংশগত আত্মীয়তার সম্পর্ক) ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ২৫:৫৪:৮, ৩৭:১৫৮। 
আনসাব (নাসাব এর বহুবচন) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ২৩:১০১:৬। 
ছিহর শব্দের শব্দমূল হচ্ছে ‘সদ হ র’। শব্দমূলের অর্থ ‘গলানো, ক্ষারণ, বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তা’।
ছিহর (বিবাহগত আত্মীয়তার সম্পর্ক) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ২৫:৫৪:৯।
সাধারণভাবে রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় বুঝাতে ‘উলুল আরহাম’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছে। আবার কখনো কখনো ‘উলুল আরহাম’ বুঝাতে শুধু ‘আরহাম’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। 
আরহাম শব্দের শব্দমূল হচ্ছে ‘র হা মীম’। শব্দমূলের অর্থ হচ্ছে ‘দয়া, গর্ভ, জরায়ু, গর্ভসূত্রের আত্মীয়তা, রক্তসম্পর্কের আত্মীয়তা’।
উলুল আরহাম (গর্ভসূত্রের আত্মীয়/ রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়) শব্দগুচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ৮:৭৫:১০-১১, ৩৩:৬:৮-৯। 
উলুল আরহাম বুঝাতে আরহাম শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে ৩ স্থানে: ৪:১:২৩, ৪৭:২২:১০, ৬০:৩:৩।
রক্ত সম্পর্কের আত্মীয় এবং বৈবাহিক সম্পর্কের আত্মীয় উভয় প্রকার আত্মীয়দেরকে একসাথে ‘ক্বুরবা’ (একবচনে ‘যুল ক্বুরবা’ এবং বহুবচনে ‘উলুল ক্বুরবা’) এবং ‘যা মাক্বরাবাহ’ বলা হয়। 
ক্বুরবা শব্দটির শব্দমূল হচ্ছে ‘ক্বফ র বা’। শব্দমূলের অর্থ হচ্ছে ‘নৈকট্য, উৎসর্গ, নৈকট্যের মাধ্যম, নিকটবর্তী আত্মীয়তা’।
যুল ক্বুরবা (একবচন) ও উলুল ক্বুরবা (বহুবচন) এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ‘নিকটবর্তী আত্মীয়তার অধিকারী’।
ক্বুরবা (আত্মীয়-স্বজন) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১৬ স্থানে: ২:৮৩:১৩, ২:১৭৭:২৪, ৪:৮:৫, ৪:৩৬:১০, ৪:৩৬:১৫, ৫:১০৬:৪৩, ৬:১৫২:২৭, ৮:৪১:১১, ৯:১১৩:১২, ১৬:৯০:৮, ১৭:২৬:৩, ২৪:২২:১০, ৩০:৩৮:৩, ৩৫:১৮:১৮, ৪২:২৩:১৮, ৫৯:৭:১২। 
‘যা মাক্বরাবাহ’ (ক্বুরবা এর প্রতিশব্দ) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে। ৯০:১৫:৩। 
‘ক্বফ র বা’ শব্দমূল থেকে গঠিত একটি শব্দ ‘ক্বারীব’ এর কম্পারেটিভ ও সুপারলেটিভ শব্দরূপ হচ্ছে ‘আক্বরাব’। ‘ক্বারীব’ অর্থ ‘নিকটবর্তী, নিকটবর্তী আত্মীয়’। আর ‘আক্বরাব’ অর্থ ‘অধিক/সর্বাধিক নিকটবর্তী, সর্বাধিক নিকটবর্তী আত্মীয়’। 
অধিক/ সর্বাধিক নিকটবর্তী অর্থে ‘আক্বরাব’ বা ‘আক্বরাবূন’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে ১৩ স্থানে: ২:২৩৭:২৫, ৩:১৬৭:২১, ৪:১১:৬১, ৫:৮:১৮, ৫:৮২:১১, ১৬:৭৭:১৩, ১৭:৫৭:৯, ১৮:২৪:১৪, ১৮:৮১:৮, ২২:১৩:৪, ২৬:১৪৩:৩, ৫০:১৬:১০, ৫৬:৮৫:২। 
সর্বাধিক নিকটবর্তী আত্মীয় অর্থে ‘আক্বরাবূন’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে ৬ স্থানে: ২:১৮০:১২, ২:২১৫:১০, ৪:৭:৬, ৪:৭:১২, ৪:৩৩:৭, ৪:১৩৫:১৪। 
যেসব আয়াতে ‘আক্বরাবূন’ শব্দটি সবচেয়ে নিকটবর্তী আত্মীয়’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলোতে ব্যবহৃত শব্দগুচ্ছ হলো ‘আল ওয়ালিদানি ওয়াল আক্বরাবূন’ অর্থাৎ ‘পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়গণ’। 
৪:৭ ও ৪:৩৩ আয়াত অনুযায়ী, পিতা-মাতা ও নিকটতম আত্মীয়গণ [আক্বরাবূন] যা রেখে যায় তাতে যেমন পুরুষদেরকে ‘মাওয়ালিয়া’ [প্রধান ওয়ারিস] বানিয়ে অংশ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে তেমনি নারীদেরকেও মাওয়ালিয়া [প্রধান ওয়ারিস] বানিয়ে অংশ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এ কথার স্বত:সিদ্ধ হচ্ছে মৃত ব্যক্তি হলেন মাওয়ালিয়ার (প্রধান ওয়ারিসদের) আক্বরাবূন এবং মাওয়ালিয়া (প্রধান ওয়ারিসগণ) হলেন মৃত ব্যক্তির আক্বরাবূন। মৃত ব্যক্তি যেমন মাওয়ালিয়ার পিতা বা মাতা হতে পারে, তেমনি পিতা এবং মাতাকেও মৃত ব্যক্তির মাওয়ালিয়া বানানো হয়েছে। সুতরাং পিতা-মাতা অবশ্যই আক্বরাবূনের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং ‘আল ওয়ালিদানি ওয়াল আক্বরাবূন’ অর্থ ‘পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়গণ’। অর্থাৎ পিতা-মাতা অবশ্যই ‘আক্বরাবূনের’ অন্তর্ভুক্ত কিন্তু তাদেরকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার জন্য প্রথমে তাদের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবে ‘ওয়া’ [এবং] শব্দের পরে অর্থের মধ্যে ‘অন্য’ শব্দটির প্রায়োগিকতা স্বত:সিদ্ধভাবে এসে যায় এবং এভাবে মধ্যবর্তীতে ‘অন্য’ শব্দ উহ্য করে দিয়ে বক্তব্য প্রদান করা আরবি ভাষারীতির একটি রীতি।
৩. আক্বরাবূন ও উলুল ক্বুরবা (নিকটতম আত্মীয় এবং আত্মীয়-স্বজন)
৪:৭ ও ৪:৩৩ আয়াত অনুযায়ী যাদেরকে মৃত ব্যক্তির মাওয়ালিয়া [প্রধান ওয়ারিস] বানিয়ে উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি দেয়া হয়েছে তারা হলেন তার আক্বরাবূন [সবচেয়ে নিকটবর্তী আত্মীয়]। ৪:১১, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াত অনুযায়ী যাদের জন্য উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি দেয়া হয়েছে তারা হলো: পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, স্বামী/স্ত্রী, ভাই, বোন। সুতরাং এরাই আক্বরাবূন। এর মধ্য থেকে স্বামী/স্ত্রী ছাড়া বাকি সবাই রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়।
৪:৮ আয়াতে (আক্বরাবূনের মধ্যে) উত্তরাধিকার বণ্টনের সময় (ইয়াতীম ছেলে-মেয়ে ও মিসকীনদের পাশাপাশি) যেসব আত্মীয় স্বজন উপস্থিত হয় তাদেরকে ‘উলুল ক্বুরবা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং (বণ্টনের অব্যবহিত পরে) তাদেরকে জীবিকাস্বরূপ কিছু দিতে এবং তাদের সাথে ন্যায়সঙ্গত কথা বলতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং ‘আক্বরাবূন’ ছাড়া অন্য আত্মীয়গণ হচ্ছেন ‘উলুল ক্বুরবা’। 
৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াত অনুযায়ী, আক্বরাবূনের মধ্য থেকে ভাই, বোন শুধুমাত্র তখন পায় যখন মৃত ব্যক্তির সাথে তাদের কালালাহ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। (কালালাহ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য কালালাহ সম্পর্কিত অধ্যায়টি দ্রষ্টব্য)। সুতরাং যে অবস্থায় ভাই, বোন উত্তরাধিকারের কোনো নির্ধারিত অংশ পায় না, ঐ অবস্থায় ভাই-বোন ‘উলুল ক্বুরবার’ অন্তর্ভুক্ত হিসেবে সাব্যস্ত হবে। অনুরূপভাবে পিতা-মাতা জীবিত থাকলে দাদা, দাদী, নানা, নানী ‘উলুল ক্বুরবা’ হিসেবে সাব্যস্ত হবে এবং কোনো পুত্র-কন্যা জীবিত থাকলে ঐ পুত্র-কন্যার সম্পর্ক সূত্রে থাকা পৌত্র, পৌত্রী, দৌহিত্র, দৌহিত্রী ‘উলুল ক্বুরবা’ হিসেবে সাব্যস্ত হবে।
বিবাহগত সম্পর্কের দিক থেকে একমাত্র স্বামী/স্ত্রী আক্বরাবূনের অন্তর্ভুক্ত। বিবাহসূত্রের অন্য সকল আত্মীয়-স্বজন ‘উলুল ক্বুরবার’ অন্তর্ভুক্ত।
৪. আক্বরাবূন, ওয়াস্যিয়াত ও ইয়াতীম নাতির উত্তরাধিকার 
আক্বরাব শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘নিকটতম আত্মীয়’। প্রায়োগিকভাবে ‘আক্বরাব’ শব্দটির দুটি অর্থ রয়েছে। (১) সাধারণভাবে আত্মীয় হিসেবে অন্য আত্মীয়দের তুলনায় নিকটতম [আক্বরাব] হওয়া। (২) উত্তরাধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নিকটতম আত্মীয় [আক্বরাব] হিসেবে অধিভুক্ত হওয়া।  
সাধারণভাবে সকল নাতিই সমান স্তরের প্রপুত্র। তবে উত্তরাধিকার প্রাপ্তির প্রশ্নে ইয়াতীম নাতি ‘আক্বরাব’ হয়, কিন্তু অন্য নাতিরা ‘আক্বরাব’ হয় না। কারণ প্রথমত সকল নাতিই পুত্রতুল্য হলেও পুত্রদের তুলনায় প্রপুত্ররা দ্বিতীয় স্তরের পুত্র হওয়ায় উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে স্তরগত দূরত্বের বিবেচনায় পুত্র ‘আক্বরাব’ হয় কিন্তু নাতি ‘আক্বরাব’ হয় না। তবে ইয়াতীম নাতির পিতা না থাকার কারণে দাদার উত্তরাধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে সে তার নিজ পিতার প্রাপ্য আনুপাতিক অংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হয়, যে ক্ষেত্রে অন্য নাতিরা তাদের নিজ পিতা জীবিত থাকায় দাদার উত্তরাধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তিনি (তাদের নিজ পিতা) প্রতিবন্ধক হয়ে থাকেন অর্থাৎ তারা উত্তরাধিকার পায় না। এমতাবস্থায় উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে ইয়াতীম নাতি তার দাদার ‘আক্বরাবে’ পরিণত হয় কিন্তু অন্য নাতিরা ‘আক্বরাব’ হয় না। এক্ষেত্রে পার্থক্য তৈরি হওয়ার কারণ প্রত্যেক নাতির নিজ নিজ পিতা জীবিত থাকা বা না থাকা। সংক্ষেপে বলা যায়, যেহেতু নাতির পিতার মাধ্যমেই দাদার সাথে নাতির বংশধারার সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে থাকে তাই উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নাতি দাদার ‘আক্বরাব’ সাব্যস্ত হওয়ার ক্ষেত্রে নাতির পিতা প্রতিবন্ধক হয়ে থাকে। 
যারা ইয়াতীম নাতি উত্তরাধিকারী হতে পারে না বলে মতপ্রকাশ করেন তাঁরা সাধারণত উত্তরাধিকারের পরিবর্তে ২:১৮০ আয়াতে বর্ণিত ‘আক্বরাবূনা’ শব্দের আওতায় ইয়াতীম নাতি নাতিনর জন্য ওয়াসিয়্যাত করার সুপারিশ উপস্থাপন করেন। আয়াতটিতে বলা হয়েছে:
কুতিবা আলাইকুম ইযা হাদারা আহাদাকুমুল মাওতু ইন তারাকা খায়রানিল ওয়াসিয়্যাতু লিল ওয়ালিদায়নি ওয়াল আক্বরাবীনা বিল মা’রূফি হাক্বক্বান আলাল মুত্তাক্বীনা 
২:১৮০ :: তোমাদের উপর বিধিবদ্ধ করা হলো যে, তোমাদের মধ্য থেকে কারো মৃত্যু সন্নিকটে এসে গেলে যদি সে সম্পদ রেখে যায় তবে সে তার পিতা-মাতার জন্য এবং অন্য নিকটতম আত্মীয়দের জন্য ন্যায়সঙ্গত ওয়াসিয়্যাত করতে হবে। এটা আল্লাহ সচেতনদের উপর দায়িত্ব।
আয়াতটিতে প্রদত্ত বিধান বাস্তবায়নের জন্য প্রথমে জানা প্রয়োজন যে, ৪:৭-৮ এবং ৪:৩৩ আয়াত অনুসারে, পিতা-মাতা ছাড়া অন্য আক্বরাবূনের মধ্যে রয়েছে অন্য সকল ওয়ারিস এবং দ্বিতীয় স্তরের (স্থলাভিষিক্ত) আক্বরাবূনও এর অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয় স্তরের আক্বরাবূন হলো দাদা-দাদী, নানা-নানী, পৌত্র-পৌত্রী ও দৌহিত্র-দৌহিত্রী। কিন্তু চাচা মামা প্রথম বা দ্বিতীয় কোনো স্তরের আক্বরাবূন নন, তাঁরা হলেন উলুল ক্বুরবা। আর বৈবাহিক সম্পর্কের আওতায় আক্বরাবূন হিসাবে শুধুমাত্র স্বামী বা স্ত্রী অন্তর্ভুক্ত। তাই শশুর, শাশুড়ি প্রমুখ হলেন উলুল ক্বুরবা।
২:১৮০ আয়াত অনুসারে যেমন ইয়াতীম নাতি আক্বরাবূন হওয়ায় তাদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করা কর্তব্য, তেমনি দাদা আক্বরাবূন হওয়ায় তাঁর জন্য ওয়াসিয়্যাত করা কর্তব্য। সুতরাং ইয়াতীম নাতির জন্য ওয়াসিয়্যাত করা যেতে পারে বিধায় যদি ইয়াতীম নাতি উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে দাদার জন্য ওয়াসিয়্যাত করা যেতে পারে বিধায় দাদাও উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার কথা। কিন্তু ইয়াতীম নাতিকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করলেও পিতা না থাকা অবস্থায় পিতার প্রাপ্য অংশের স্থলাভিষিক্ত ওয়ারিস হিসেবে দাদাকে উত্তরাধিকার দেয়া হয় অর্থাৎ দাদাকে বঞ্চিত করা হয় না। অনুরূপভাবে ইয়াতীম নাতিকেও বঞ্চিত করা যেতে পারে না।
এছাড়া, আয়াতটিতে আক্বরাবূনের জন্য ওয়াসিয়্যাত করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে উত্তরাধিকারের বিধানের ক্ষেত্রেও তা আক্বরাবূনের মধ্যে বণ্টনের বিধিব্যবস্থা দেয়া হয়েছে। উত্তরাধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোনো কোনো ওয়ারিস কোনো কোনো অবস্থায় প্রাপক হয় এবং কোনো অবস্থায় প্রাপক হয় না, যেমন ভাই-বোন। অনুরূপভাবে দাদা-দাদী এবং নাতি-নাতিনও কোনো কোনো অবস্থায় প্রাপক হয় এবং কোনো অবস্থায় প্রাপক হয় না। যেমন পিতা থাকলে দাদা-দাদী প্রাপক হবে না। অনুরূপভাবে নাতি-নাতিনের পিতা থাকলে নাতি-নাতিন প্রাপক হবে না। নাতি নাতিন যেমন আক্বরাবূন হিসেবে ওয়াসিয়্যাতের প্রাপক, তেমনি তারা আক্বরাবূন হিসেবে প্রযোজ্য অবস্থায় (অর্থাৎ পিতৃহীন বা ইয়াতীম অবস্থায়) উত্তরাধিকারের প্রাপক। 
সুতরাং প্রথম স্তরের সর্বাবস্থায় প্রাপক আক্বরাবূন হলেন পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, স্বামী/স্ত্রী। প্রথম স্তরের শর্তযুক্ত অবস্থায় প্রাপক আক্বরাবূন হলেন ভাই-বোন। আর দ্বিতীয় স্তরের আক্বরাবূন হলেন দাদা নানা, দাদী নানী, পৌত্র, দৌহিত্র, পৌত্রী, দৌহিত্রী। প্রথম স্তরের আক্বরাবের মধ্য থেকে যার মাধ্যমে দ্বিতীয় স্তরের আক্বরাবূনের সাথে মৃত ব্যক্তির সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তার বর্তমানে দ্বিতীয় স্তরের আক্বরাবূন উত্তরাধিকার বণ্টনের বিবেচনা থেকে বাদ যায়। যেমন পিতা দাদা দাদীকে বিবেচনা থেকে বাদ রাখে, মাতা নানা নানীকে বিবেচনা থেকে বাদ রাখে, পুত্র তার নিজ পুত্র-কন্যাকে (মৃতের ঐ পুত্রের মাধ্যমে সম্পর্কিত মৃতের পৌত্র-পৌত্রীকে) বিবেচনা থেকে বাদ রাখে, কন্যা তার নিজ পুত্র-কন্যাকে (মৃতের ঐ কন্যার মাধ্যমে সম্পর্কিত মৃতের দৌহিত্র- দৌহিত্রীকে) বিবেচনা থেকে বাদ রাখে। 
৫. আওলাদ, আবনা ও আক্বরাব প্রসঙ্গ
আওলাদ শব্দের আওতায় শুধু পুত্র নয় বরং প্রপুত্রও শামিল। এর একটি প্রমাণ হলো, আয়াতের (৪:১১) পরবর্তী অংশে আক্বরাবূনের তুলনামূলক অবস্থানের বিষয়ে যে প্রশ্ন করা হয়েছে তাতে আওলাদ শব্দের পরিবর্তে আবনা শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আর আবনা শব্দে পুত্রের মত প্রপুত্রও শামিল। সুতরাং আওলাদ শব্দ (যার বিকল্প শব্দ হিসাবে আবনা শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে) দ্বারা প্রপুত্রকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্য কথায়, ওয়ালাদ (আওলাদ শব্দের একবচন) অর্থ পুত্র, প্রপুত্র প্রমুখ।
আরবি ভাষারীতি অনুসারে পিতা ও পুত্র বুঝাতে যেখানে জন্মগত সম্পর্কের দিককে গুরুত্ব দেয়া হয় সেখানে ওয়ালিদ ও ওয়ালাদ ব্যবহৃত হয় এবং যেখানে জন্মগত সম্পর্কের মধ্যে অন্তর্নিহিত আবেগিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়া হয় সেখানে আবু ও ইবনু শব্দ ব্যবহৃত হয়।
কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের উদাহরণ থেকে স্পষ্ট যে, আবু ও ইবনু এর বহুবচনের (আবাউ ও আবনা) আওতায় দাদা ও নাতি অন্তর্ভুক্ত। আবার কুরআনে ৪:৭ ও ৪:৩৩ আয়াত অনুযায়ী স্পষ্ট যে, ওয়ারিস ও মৃত ব্যক্তি পরস্পর আক্বরাবূন। তবে পুত্র থাকা অবস্থায় প্রপুত্র ওয়ালাদ হওয়া সত্ত্বেও ওয়ারিস হবে না, বরং সে হবে এমন ওয়ালাদ যে ওয়ারিস হিসাবে বিবেচ্য ওয়ালাদ নয়। কারণ ওয়ারিস হিসাবে বিবেচ্য হওয়ার জন্য আক্বরাবূন (নিকটতম) হওয়া শর্ত। আর সাধারণভাবে আক্বরাবূন হলেও পুত্র থাকা অবস্থায় তার সূত্রে প্রপুত্র স্তরগত দূরত্বের কারণে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে আক্বরাবূন হিসেবে বিবেচনা থেকে বাদ যায়। 
আক্বরাবূন শব্দের কারণে এ কথা স্বত:সিদ্ধ যে, একই শব্দের আওতায় থাকা ব্যক্তিবর্গের মধ্যে যদি ঊর্ধ্বতন বা অধ:স্তনের একাধিক স্তর থাকে, তবে সেক্ষেত্রে প্রথম স্তর দ্বিতীয় স্তরের তুলনায় আক্বরাবূন তথা প্রথম স্তরের ব্যক্তি জীবিত থাকা অবস্থায় সে-ই উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে আক্বরাবূন হিসেবে সাব্যস্ত হয়। অন্যভাবে বলা যায়, প্রথম স্তরের উপস্থিতিতে দ্বিতীয় স্তরের আক্বরাবূনকে স্তরগত বিবেচনায় উত্তরাধিকার প্রাপ্তির বিবেচনা থেকে বাদ রাখা হয়। কিন্তু প্রথম স্তরের অনুপস্থিতিতে দ্বিতীয় স্তরের আক্বরাবূন উত্তরাধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিবেচনায় আসে। এক্ষেত্রে তারা বিবেচনায় আসে প্রথম স্তরের যে আক্বরাবূনের মাধ্যমে মৃত ব্যক্তির সাথে তাদের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তার আনুপাতিক অংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হিসেবে। তাদেরকে আক্বরাবূন সাব্যস্ত করার কারণ হলো যারা কখনোই আক্বরাবূন হয় না তাদের তুলনায় তারা কখনো কখনো আক্বরাবূন হিসেবে সাব্যস্ত হয়, কারণ তারা মৃত ব্যক্তির ঊর্ধ্বতন বা অধ:স্তন সম্পর্কের প্রতিনিধিত্ব করে। 
লম্বরূপ সরলরৈখিক ঊর্ধ্বক্রমের মধ্যবর্তী ব্যক্তি ঊর্ধ্বক্রমের উপরের ব্যক্তিকে ও নিম্নক্রমের মধ্যবর্তী ব্যক্তি নিম্নক্রমের নিচের ব্যক্তিকে বঞ্চিত করে। যেমন পিতা দাদাকে বিবেচনা থেকে বাদ রাখে এবং পুত্র নাতিকে বিবেচনা থেকে বাদ রাখে। কিন্তু এক পুত্র অন্য পুত্রের পুত্রকে বঞ্চিত করতে পারে না। অর্থাৎ কোনো ইয়াতীম নাতি এজন্য বঞ্চিত হবে না যে, তার চাচা আছে। পিতা দাদাকে ও দাদীকে বিবেচনা থেকে বাদ রাখে,কারণ দাদী মাতৃতুল্য হলেও তার সাথে সম্পর্ক পিতার মাধ্যমে বা এক্ষেত্রে পিতা সম্পর্কের মধ্যবর্তী ব্যক্তি। মাতা নানাকে ও নানীকে বিবেচনা থেকে বাদ রাখে, কারণ নানা পিতৃতুল্য হলেও তার সাথে মৃতের সম্পর্ক মাতার মাধ্যমে বা এক্ষেত্রে মাতা সম্পর্কের মধ্যবর্তী ব্যক্তি। পুত্র পৌত্র-পৌত্রী উভয়কে বিবেচনা থেকে বাদ রাখে, কারণ পৌত্রী কন্যাতুল্য হলেও তার সাথে সম্পর্ক পুত্রের মাধ্যমে। কন্যা দৌহিত্র-দৌহিত্রী উভয়কে বিবেচনা থেকে বাদ রাখে, কারণ  দৌহিত্র পুত্রতুল্য হলেও তার সাথে সম্পর্ক কন্যার মাধ্যমে। 
৬. লিকুল্লি ও লিকুল্লিন (প্রত্যেক ... জন্য, প্রত্যেকের জন্য/ প্রত্যেকটির জন্য) 
উত্তরাধিকার বণ্টন প্রসঙ্গে প্রদত্ত অংশসমূহ যে আনুপাতিক পদ্ধতির সাথে সম্পর্কিত তা স্পষ্ট হওয়ার জন্য ৪:৩৩ আয়াতটিতে ব্যবহৃত ‘লিকুল্লিন’ শব্দটির তাৎপর্য জানা জরুরি। এ প্রসঙ্গে ‘লিকুল্লি’ ও ‘লিকুল্লিন’ শব্দ দুটির প্রায়োগিক পার্থক্য নির্ণয় করতে হবে। 
নিম্নে ‘লিকুল্লি’ ও ‘লিকুল্লিন’ শব্দ দুটির কোনটি কোন কোন আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে তার তালিকা দেয়া হলো-
লিকুল্লি শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৩০ স্থানে: ৪:১১:২৪, ৪:১২:৬১,  ৬:৬৭:১, ৬:১০৮:১৫, ৬:১১২:৩, ৬:১৫৪:১০, ৭:৩৪:১, ৭:১৪৫:১০, ১০:৪৭:১, ১০:৪৯:১২, ১০:৫৪:৩, ১৩:৭:১৩, ১৩:৩৮:২০, ১৪:৫:১৯, ১৫:৪৪:৪, ১৬:৮৯:১৯, ২২:৩৪:১, ২২:৬৭:১, ২৪:১১:১৫, ২৫:৩১:৩, ৩১:৩১:১৭, ৩৪:৯:২৭, ৩৪:১৯:১৭, ৪২:৩৩:১৩, ৪৫:৭:২, ৫০:৮:৩, ৫০:৩২:৪, ৬৫:৩:১৯, ৮০:৩৭:১, ১০৪:১। 
লিকুল্লিন শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে ৬ স্থানে: ২:১৪৮:১, ৪:৩৩:১, ৫:৪৮:২৫, ৬:১৩২:১, ৭:৩৮:৩৬, ৪৬:১৯:১।  
‘লিকুল্লি’ এবং ‘লিকুল্লিন’ শব্দ দুটির মধ্যে অর্থগত পার্থক্য রয়েছে। শুধু ‘লিকুল্লি’ শব্দটি পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করে না। পূর্ণ অর্থ প্রকাশের জন্য ‘লিকুল্লি’ শব্দের পরে কোনো বিশেষ্য বসে এবং ঐ বিশেষ্যের মাধ্যমেই নির্দিষ্ট হয় ‘লিকুল্লি’ শব্দটি দ্বারা কোন ব্যক্তি, বস্তু বা বিষয়কে নির্দেশ করা হয়েছে। ‘লিকুল্লি’ অর্থ ‘প্রত্যেক ... জন্য’। এখানে শূন্যস্থানে ‘লিকুল্লি’ এর পর ব্যবহৃত বিশেষ্য এর অর্থ বসবে। যেমন, ‘লিকুল্লি উম্মাতিন’ (৭:৩৪, ১০:৪৭, ২২:৩৪) অর্থ হচ্ছে ‘প্রত্যেক উম্মাতের জন্য’। 
অন্যদিকে ‘লিকুল্লিন’ একটি পূর্ণ অর্থ প্রকাশক শব্দ। ‘লিকুল্লিন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘প্রত্যেকের জন্য, প্রত্যেকটির জন্য’। কোনো বাক্যে ‘লিকুল্লিন’ শব্দ দ্বারা প্রত্যেকটি ব্যক্তির জন্য, বস্তুর জন্য না প্রসঙ্গগত বিষয়ের জন্য বুঝাচ্ছে তা বক্তব্য বিষয়ের মাধ্যমে অথবা পরবর্তী ব্যাখ্যামূলক শব্দ বা বাক্যাংশের মাধ্যমে বুঝা যায়। যেমন ‘লিকুল্লিন’ শব্দটি ২:১৪৮, ৬:১৩২ ও ৪৬:১৯ আয়াতে ব্যক্তির জন্য বুঝাতে এবং ৪:৩৩ আয়াতে বস্তুর জন্য বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে।
৪:৩৩ আয়াতে ‘লিকুল্লিন’ শব্দটির সাথে সম্পর্কিত বাক্য হলো: ওয়া লিকুল্লিন জায়ালনা মাওয়ালিয়া মিম্মা তারাকাল ওয়ালিদানি ওয়াল আক্বরাবূনা। অর্থাৎ পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়গণ যা রেখে যায় আমি তার প্রত্যেকটির জন্য উত্তরাধিকারী নির্দিষ্ট করে দিয়েছি। এখানে ‘লিকুল্লিন’ বলতে বুঝানো হয়েছে ‘মিম্মা তারাকাল ওয়ালিদানি ওয়াল আক্বরাবূনা’ এর ‘লিকুল্লিন’। অর্থাৎ ‘পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়রা’ যা রেখে যায় তা থেকে প্রত্যেকটি অংশের জন্য। ‘পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়রা যা রেখে যায় তার প্রত্যেকটি অংশের জন্য ....... নির্দিষ্ট করা হয়েছে।’ কী বা কাকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে? এর উত্তর হচ্ছে ‘মাওয়ালিয়া’ তথা ‘অব্যবহিত উত্তরাধিকারী’ নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
৭. আনুপাতিক ভগ্নাংশের প্রকৃতি
কিছু ক্ষেত্রে শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ ও প্রকৃত প্রাপ্য অংশ অভিন্ন হয়ে থাকে, আর কিছু ক্ষেত্রে শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ ও প্রকৃত প্রাপ্য অংশ ভিন্ন হয়ে থাকে; এটি একটি স্বাভাবিক বিষয়। একই ব্যক্তির একই আনুপাতিক ভগ্নাংশ অন্য ওয়ারসিদের মধ্য থেকে কে কে উপস্থিত আছে তার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন প্রকৃত অংশে রূপায়িত হয়, এটি আনুপাতিক ভগ্নাংশের স্বাভাবিক প্রকৃতি। আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণের তাৎপর্য হলো, উত্তরাধিকারের প্রাপকদের বিভিন্ন শ্রেণির উপস্থিতি সাপেক্ষে তাদের প্রাপ্য অংশ নির্ধারণে তাদের মধ্যকার পারস্পরিক তুলনামূলক তারতম্য (অনুপাত) স্থির করা।  
আয়াতসমূহে বর্ণিত ও অন্তর্নিহিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ণয়ের উপায় 
আয়াতসমূহে বর্ণিত ও অন্তর্নিহিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ণয়ের জন্য নিম্নোক্ত দুটি উপায় রয়েছে:
(১) প্রত্যক্ষভাবে উল্লেখিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ। 
(২) তুলনামূলক পদ্ধতিতে প্রাপ্তব্য (প্রত্যক্ষভাবে অনুল্লেখিত) আনুপাতিক ভগ্নাংশ। 
৪:১১ আয়াতে সন্তান না থাকা অবস্থায় ও ভাই-বোন থাকা অবস্থায়, এ দু অবস্থায় মাতার অংশ প্রত্যক্ষভাবে উল্লেখিত কিন্তু পিতার অংশ তুলনামূলক পদ্ধতিতে প্রাপ্তব্য। 
সন্তান না থাকা অবস্থায় মা পাবে ১/৩  ভাগ। সুতরাং পিতা পাবে ১ - ১/৩   =  ২/৩  ভাগ। এক্ষেত্রে, মায়ের  ১/৩  ভাগের বিপরীতে পিতার ২/৩  ভাগ ধরার কারণ হচ্ছে, আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে পিতা-মাতা ওয়ারিস। সুতরাং মাতার অংশ ও পিতার অংশের সমষ্টি ১ হিসাবে ধরা হবে। আবার যদি তাদের সাথে অন্য ওয়ারিসও থাকে তবে ১/৩  + ২/৩  + অন্য আনুপাতিক অংশ কার্যকর হবে সমস্ত সম্পদে, যদিও ১/৩  + ২/৩  + অন্য আনুপাতিক অংশ = ১ এর বেশি হয়। অর্থাৎ এখানে অন্য ওয়ারিস থাকলেও এই  ১/৩  + ২/৩   = ১ হবে পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ অন্য ওয়ারিসের আনুপাতিক ভগ্নাংশের তুলনায়। যেমন, তিন কন্যা ও পিতা-মাতা থাকলে, তিন কন্যা পাবে ২/৩ , পিতা ও মাতা পাবে (১/৬   + ১/৬  =) ১/৩ । সাথে স্বামী/ স্ত্রী থাকলেও তাদের আনুপাতিক অংশ এটিই থাকবে। কারণ, সর্বাবস্থায় পারস্পরিক আনুপাতিক ভগ্নাংশগুলোর যোগফল ১ হওয়া শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো শর্ত নয়। শুধুমাত্র সন্তান না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতা যখন ওয়ারিস তখন তাদের উভয়ের আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণের সুনির্দিষ্টি ক্ষেত্রে যোগফল ১ হওয়ার বিষয়টি প্রযোজ্য। কারণ এতে বক্তব্যভঙ্গি (ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু ...) থেকে তাদের উভয়ের মধ্যকার অনুপাতের যোগফল ১ হওয়ার বিষয়টি স্থিরিকৃত হয়ে যায়। 
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভাই-বোন থাকা অবস্থায় মাতা পাবে ১/৬  , যা সন্তানের উপস্থিতিতে মাতার অংশের অনুরূপ। সুতরাং এ অবস্থায় পিতাও পাবে ১/৬  । অর্থাৎ এক্ষেত্রে ভাই-বোনের উপস্থিতির প্রভাব সন্তানের উপস্থিতির প্রভাবের সমান।
৮. আনুপাতিক অংশের পরিবর্তে অবশিষ্টাংশের ধারণা গ্রহণ করলে যেসব ক্ষেত্রে অবশিষ্টাংশ বন্টিত হবে তার তালিকা
আনুপাতিক অংশের পরিবর্তে অবশিষ্টাংশের ধারণা গ্রহণ করলে যেসব ক্ষেত্রে অবশিষ্টাংশ অনুসারে বণ্টিত হবে তার তালিকা নিম্নরূপ:
(ক) এক বা একাধিক পুত্র পাবে অবশিষ্টাংশ। 
(খ) পুত্র-কন্যা মিলিতভাবে থাকলে তারা পাবে অবশিষ্টাংশ। 
(গ) পুত্র-কন্যা না থাকলে সে অবস্থায় পিতা-মাতা উভয়ে ওয়ারিস হলে পিতা পাবে অবশিষ্টাংশ। 
(ঘ) পুত্র-কন্যা না থাকলে কিন্তু ভাই-বোন থাকলে সে অবস্থায় পিতা-মাতা উভয়ে ওয়ারিস হলে পিতা পাবে অবশিষ্টাংশ। 
(ঙ) পুত্র-কন্যা না থাকলে পিতা-মাতা উভয়ে ওয়ারিস না হয়ে পিতা বা মাতা ওয়ারিস হলে তখন পিতা বা মাতা পাবে অবশিষ্টাংশ। 
(চ) পুত্র-কন্যা না থাকলে কিন্তু ভাই-বোন থাকলে সে অবস্থায় পিতা-মাতা উভয়ে ওয়ারিস না হয়ে পিতা বা মাতা ওয়ারিস হলে তখন পিতা বা মাতা পাবে অবশিষ্টাংশ। (এরূপ হলে, ভাই-বোনকে পুত্র-কন্যার সমান গুরুত্ব দেয়া হয় না, কারণ পুত্র-কন্যা থাকা অবস্থায় শুধু পিতা বা শুধু মাতা যেই থাকুক সে পায় ১/৬  )। 
(ছ) পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় এক বা একাধিক ভাই পাবে অবশিষ্টাংশ। 
(জ) পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন মিলিতভাবে থাকলে তারা পাবে অবশিষ্টাংশ। 
(ঝ) একটি উপলব্ধি অনুযায়ী, শুধু দুই কন্যা থাকলে তারা পাবে অবশিষ্টাংশ। 
(ঞ) একটি উপলব্ধি অনুযায়ী, পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় শুধু দুইয়ের বেশি বোন থাকলে তারা পাবে অবশিষ্টাংশ। 
কিন্তু আনুপাতিক অংশ বণ্টন পদ্ধতি অনুসারে উপরিউক্ত অবশিষ্টাংশের ধারণা ও ধারাগুলো সঠিক নয়।
৯. আউল ও রদ্দ নীতির সাথে আনুপাতিক বন্টন পদ্ধতির তুলনা 
প্রকৃতপক্ষে আউল বা রদ্দ নীতি এবং আনুপাতিক বন্টন পদ্ধতি একই বিষয়। কিন্তু আউল বা রদ্দ নীতির প্রচলিত প্রয়োগ রীতি এবং আনুপাতিক অংশ বন্টন পদ্ধতি একই বিষয় নয়। অর্থাৎ বর্তমানে আউল বা রদ্দ নীতি সবসময় প্রয়োগ করা হয় না বরং অনেক সময় আসাবার মধ্যে অবশিষ্ট অংশ বন্টন করা হয় বা যাবিল আরহামের মধ্যে বন্টন করা হয়, শুধুমাত্র কিছু বিশেষ অবস্থায় আউল বা রদ্দ নীতি প্রয়োগ করা হয় যা একটি সমস্যায় পড়া অবস্থায় বাধ্য হয়ে করা সমাধান হিসাবে প্রবর্তিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। 
এছাড়া আউল ও রদ্দ নীতির মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে দ্বৈতনীতি দেখা যায়। আউলের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী অন্তর্ভুক্ত অথচ রদ্দের ক্ষেত্রে তারা অন্তর্ভুক্ত নয়। এরূপ স্ববিরোধ আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। যেমন প্রচলিত ফারায়েজ অনুসারে পিতা ভাই-বোনকে বঞ্চিত করে, অথচ মা বঞ্চিত করে না। দাদা ওয়ারিস হয় অথচ ইয়াতীম নাতি ওয়ারিস হয় না। ইত্যাদি। 
আনুপাতিক বন্টন পদ্ধতি হচ্ছে সর্বাবস্থায় আউল বা রদ্দ নীতি বাস্তবায়নের নামান্তর। তখন এটাই হয় মূল সূত্র। এ ক্ষেত্রে তথাকথিত যাবিল ফুরুজ, আসাবা ও যাবিল আরহামের প্রশ্ন নেই। বরং প্রত্যেকেই যাবিল ফুরুজ, যারা কুরআনের আলোকে ওয়ারিস। এতে প্রচলিত ফারায়েজের এ নীতি স্বীকৃত নয় যে, পুরুষের মাধ্যমে সম্পর্কিতরা আসাবা, নারীর মাধ্যমে সম্পর্কিতরা যাবিল আরহাম।  বরং এখানে পুরুষ ও নারীর মাধ্যমে সম্পর্কিত সমস্তরের রক্তসম্পর্কের আত্মীয়রা (উলুল আরহাম) একই রূপ শর্তানুসারে ওয়ারিস হয়। যেমন দাদা, নানা, দাদী, নানী প্রমুখ। 
পিতার অংশ পাবে দাদা-দাদী, যেখানে দাদা-দাদীর পারস্পরিক অনুপাত হবে পিতা-মাতার পারস্পরিক অনুপাতের অনুরূপ, কিন্তু মাতা তার নিজের অংশ পাবে। অনুরূপ মাতার অংশ পাবে নানা-নানী, যেখানে নানা নানীর পারস্পরিক অনুপাত হবে পিতা-মাতার পারস্পরিক অনুপাতের অনুরূপ, কিন্তু পিতা তার নিজের অংশ পাবে। ইয়াতীম পৌত্র, পৌত্রী, দৌহিত্র, দৌহিত্রীর মধ্যে সম্পদ অনুরূপ পদ্ধতিতে সম্পদ বণ্টিত হবে। 
প্রচলিত ফারায়েজেও স্বীকার করে নেয়া হয়েছে যে, পিতা দাদীকে বঞ্চিত করে। কিন্তু দাদা দাদীর মাতাকে বঞ্চিত করে না। কারণ দাদা নিকটবর্তী হলেও দাদীর মাতার সাথে মৃতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে দাদা মাঝখানের কেউ নন। 
একই যুক্তি অনুসারে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, পিতা মাতার মাতাকে বা নানীকে বঞ্চিত করে না। কারণ, নানীর সাথে মৃতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে পিতা মাঝখানের কেউ নয় (লম্বরূপ সরলরৈখিক ঊর্ধ্বক্রমের বিবেচনায়)।  
আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি হলো আউল ও রদ্দ নীতিকে বিভিন্ন শর্তে বিভিন্নভাবে প্রয়োগ না করে একইরূপে প্রয়োগের জন্য গৃহীত বণ্টন পদ্ধতি। নিম্নে আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি এবং বিভিন্নভাবে প্রয়োগের শর্তকে পরিহার করে আউল ও রদ্দ নীতিতে বণ্টনের পদ্ধতি পরপর উপস্থাপনের মাধ্যমে উভয়টি যে একই পদ্ধতির দুই ধরনের গাণিতিক উপস্থাপনা তা দেখানো হলো।
আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতির সূত্র
নির্দিষ্ট শ্রেণির নির্ণেয় প্রাপ্য সম্পদ = (শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ/ আনুপাতিক ভগ্নাংশসমূহের সমষ্টি) * মোট সম্পদ (একক)
যেমন:  কোনো ব্যক্তির তিন কন্যা, পিতা-মাতা ও স্ত্রীর মধ্যে ১০০০ টাকা ভাগ করে দিতে হবে। 
আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি অনুসারে,
তিন কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ২/৩  , 
পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১/৬  , 
মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১/৬  , 
স্ত্রীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১/৮  । 
আনুপাতিক ভগ্নাংশসমূহের সমষ্টি = ৯/৮  । 
সুতরাং,
Image 232

তিন কন্যা পরস্পর সমান হারে পাবে। সুতরাং প্রত্যেক কন্যা পাবে ৫৯২.৫৯/৩  = ১৯৭.৫৩
স্ত্রীরা পরস্পর সমান হারে পাবে। সুতরাং প্রত্যেক স্ত্রী পাবে ১১১.১১/২  = ৫৫.৫৫
অতএব,
প্রত্যেক কন্যা পাবে ১৯৭.৫৩ টাকা, পিতা পাবে ১৪৮.১১ টাকা, মাতা পাবে ১৪৮.১১ টাকা, প্রত্যেক স্ত্রী পাবে ৫৫.৫৫ টাকা।
প্রচলিত শর্তসমূহ বিবেচনা ছাড়া সাধারণভাবে আউল বা রদ্দ নীতিতে বণ্টনের সূত্র
উল্লেখিত অংশসমূহের যোগফল থেকে হরকে হ্রাস/বৃদ্ধি করে লবের সমান করতে হবে এবং তদনুসারে প্রত্যেককে তার প্রাপ্য অংশ দিতে হবে।
যেমন, উপরের উদাহরণের বণ্টনটি আউল/রদ্দ পদ্ধতি প্রয়োগ করে নিম্নরূপ হয়:
তিন কন্যা + পিতা + মাতা + স্ত্রী = ২/৩  + ১/৬  + ১/৬  + ১/৮ 
    = ১৬/২৪  + ৪/২৪  + ৪/২৪  + ৩/২৪ 
= ২৭/২৪ 
= ২৭/২৭ 
সুতরাং 
তিন কন্যা পাবে (১৬/২৭ ) ১০০০  =   ১৬০০০/২৭  = ৫৯২.৫৯
পিতা পাবে (৪/২৭ ) ১০০০  =   ৪০০০/২৭  = ১৪৮.১৪ 
মাতা পাবে (৪/২৭ ) ১০০০  =   ৪০০০/২৭  = ১৪৮.১৪ 
স্ত্রী পাবে (৩/২৭ ) ১০০০  =   ৩০০০/২৭  = ১১১.১১  
উল্লেখ্য: যেহেতু প্রদত্ত উদাহরণে উল্লেখিত অংশসমূহের যোগফল ১ এর বেশি তাই প্রচলিত ফারায়েজেও উপরের পদ্ধতিতে আউল প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু যদি যোগফল ১ এর কম হতো তাহলে প্রচলিত ফারায়েজ অনুসারে রদ্দ নীতি হলো স্ত্রীকে রদ্দের ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। যেমন, 
ধরি উপরের উদাহরণটির ক্ষেত্রে পিতা জীবিত নেই। এরূপ ক্ষেত্রে প্রচলিত ফারায়েজের নিয়মে বণ্টন কিরূপ হবে তা নিম্নে দেয়া হলো।
তিন কন্যা, মাতা ও স্ত্রীর মধ্যে ১০০০ টাকা ভাগ করে দিতে হবে।
প্রচলিত ফারায়েজের নিয়মে,
তিন কন্যা পাবে = ২/৩ 
মাতা পাবে = ১/৬ 
স্ত্রী পাবে = ১/৮ 
অংশসমূহের যোগফল = ২/৩  + ১/৬  + ১/৮ 
= ১৬/২৪   +  ৪/২৪   + ৩/২৪ 
= ২৩/২৪  
অবশিষ্ট অংশ = ১/২৪ 
সুতরাং স্ত্রী পাবে = ৩/২৪  * ১০০০
= ১২৫ টাকা।
কিন্তু তিন কন্যা ও মাতার মধ্যে রদ্দ হবে। 
তাই তাদের মধ্যে নিম্নোক্তভাবে বণ্টন হবে।
প্রথম পর্যায়ে, তিন কন্যা পাবে = ১৬/২৪  * ১০০০ = ৬৬৬.৬৬
মাতা পাবে = ৪/২৪  * ১০০০ = ১৬৬.৬৬
মোট বণ্টিত হলো ১২৫ + ৬৬৬.৬৬ + ১৬৬.৬৬ = ৯৫৮.৩২
অবশিষ্ট রয়েছে ১০০০ - ৯৫৮.৩২ = ৪১.৬৮
অর্থাৎ পুনরায় ৪১.৬৮ টাকা তিন কন্যা ও মাতার মধ্যে বণ্টন করতে হবে।
তিন কন্যার অংশ + মাতার অংশ
= ২/৩  + ১/৬ 
= ৪/৬  + ১/৬ 
= ৫/৬  
রদ্দের নিয়মানুসারে হরকে ৫ ধরতে হবে। 
সুতরাং তিন কন্যা পাবে = ৪/৫   * ৪১.৬৮ = ৩৩.৩৪
মাতা পাবে = ১/৫  * ৪১.৬৮ = ৮.৩৪
অর্থাৎ, তিন কন্যা মোট পাবে = ৬৬৬.৬৬ + ৩৩.৩৪ = ৭০০ টাকা।
মাতা মোট পাবে = ১৬৬.৬৬ + ৮.৩৪ = ১৭৫
প্রচলিত ফারায়েজের রদ্দ নীতিতে বণ্টনের মাধ্যমে, তিন কন্যা পাবে ৭০০ টাকা, মাতা পাবে ১৭৫ টাকা, স্ত্রী পাবে ১২৫ টাকা।
অনুপাত পদ্ধতিতে বন্টন হচ্ছে আউল বা রদ্দ নীতির সার্বিক প্রয়োগ তথা প্রত্যেকটি উল্লেখিত অংশকে আনুপাতিক অংশ সাব্যস্ত করার মাধ্যমে সকল অবস্থায় উপস্থিত ওয়ারিসদের মধ্যে সমস্ত সম্পদের বন্টন। যদি কিছু ক্ষেত্রে আউল বা রদ্দ নীতি প্রয়োগ করার মাধ্যমে বন্টন করা হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে কিছু অবশিষ্ট রাখা হয় তাহলে তা স্ববিরোধী বিষয় হয়ে যায়। কারণ আউল বা রদ্দ নীতি প্রয়োগের অর্থ হলো কুরআনে বর্ণিত/ প্রদত্ত ওয়ারিসদের অংশকে আনুপাতিক অংশ সাব্যস্ত করে সেটার মাধ্যমে ওয়ারিসদের মধ্যে যে অনুপাত তৈরি হয় তা প্রয়োগ করা। তাহলে কিছু ক্ষেত্রে অবশিষ্ট রেখে দেয়ার অর্থ হলো প্রদত্ত অংশকে তাদের আনুপাতিক অংশ হিসাবে স্বীকৃতি না দিয়ে কার্যকর করা। যদি প্রদত্ত অংশকে আনুপাতিক অংশ হিসাবে স্বীকৃতি না দেয়া হয় তবে কখনোই আউল বা রদ্দ নীতি প্রয়োগ করা যাবে না। আর যদি আউল বা রদ্দ নীতি প্রয়োগ করতে হয় তবে প্রদত্ত অংশকে সব ক্ষেত্রে আনুপাতিক অংশ হিসাবে কার্যকর করতে হবে তথা সব ক্ষেত্রে ওয়ারিসদের মধ্যে সমস্ত সম্পদ বন্টিত হবে, কখনো কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। 
১০. ওয়ালিদ ও ওয়ালাদ এবং আবু ও ইবনু
উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির সাথে সম্পর্কিত ৪:৭ ও ৪:৩৩ আয়াতে পিতা-মাতাকে বুঝানোর জন্য ‘ওয়ালিদান’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, আবার ৪:১১ আয়াতে পিতা-মাতাকে বুঝানোর জন্য ‘আবাওয়ান’ (আবাওয়ায়) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। সন্তানের প্রসঙ্গে ৪:১১ আয়াতে ‘আওলাদ’ এবং ‘ওয়ালাদ’ শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে, আবার ‘আবনাউ’ শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে। ‘ওয়ালিদান’ শব্দটি হচ্ছে ‘ওয়ালিদ’ শব্দের দ্বিবচন। ‘আবাওয়ান’ শব্দ হচ্ছে ‘আবুন’ শব্দের দ্বিবচন। ‘আওলাদ’ শব্দটি হচ্ছে ‘ওয়ালাদ’ শব্দের বহুবচন। আর ‘আবনাউ’ হচ্ছে ‘ইবনুন’ শব্দের বহুবচন। ‘ওয়ালিদ’ শব্দের অর্থও পিতা, ‘আবুন’ শব্দের অর্থও পিতা। ‘ওয়ালাদ’ শব্দের অর্থ পুত্র/সন্তান। ‘ইবনুন’ শব্দের অর্থ পুত্র। 
‘ওয়ালিদ’ শব্দটি বংশসূত্রের পূর্বপুরুষ এবং ‘ওয়ালাদ’ শব্দটি বংশসূত্রের উত্তর পুরুষকে বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। সম্বোধনের ক্ষেত্রে পিতাকে ‘ওয়ালিদ’ না বলে ‘আবুন’ বলা হয়। ‘আবুন’ শব্দে আবেগিক নৈকট্য প্রকাশ পায়। তাই যেখানে ‘আবুন’ (বা তার দ্বিবচন ‘আবাওয়ায়’ ও বহুবচন ‘আবাউ’) ব্যবহৃত হয়েছে সেই বক্তব্যের মাধ্যমে আবেগিক নৈকট্যের দিককে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে যেখানে ‘ওয়ালিদ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে সেই বক্তব্যের মধ্যে বংশসম্পর্কের দিককে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
পুত্রের ক্ষেত্রেও সম্বোধনের সময় ‘ওয়ালাদ’ শব্দের পরিবর্তে ‘ইবনু’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। ‘ইবনু’ শব্দে আবেগিক নৈকট্য প্রকাশ পায় তাই যেখানে ‘ইবনু’ বা তার বহুবচন ‘আবনাউ’ ব্যবহৃত হয়েছে সেই বক্তব্যের মাধ্যমে আবেগিক নৈকট্যের দিককে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে যেখানে ‘ওয়ালাদ’ বা তার বহুবচন ‘আওলাদ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে সেখানে বংশসম্পর্কের দিককে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
সাধারণভাবে পালিত পুত্রকেও ‘ওয়ালাদ’ বলা হয় (২৮:৯)। কিন্তু আল্লাহর বিধান অনুযায়ী পালিত পুত্রকে পুত্র ডাকলেও সে পুত্র হয়ে যায় না, তাই তার পিতার নামে ডাকার ক্ষেত্রে পালক পিতার নামে ডাকা যাবে না, বরং তাদের নিজ পিতার নামেই ডাকতে হবে। (৩৩:৪-৫)। 
‘আবাউ’ শব্দটি দ্বারা পিতার পাশাপাশি দাদা ও দাদার পিতা প্রমুখ ঊর্ধ্বতন পিতৃপুরুষকেও বুঝানো হয়। অনুরূপভাবে ‘আবানাউ’ শব্দটি দ্বারা পুত্রের পাশাপাশি নাতি, নাতির পুত্র প্রমুখকেও বুঝায়। ‘আবনাউ’ শব্দের মতো ‘আওলাদ’ শব্দটিও অধ:স্তন বংশধারার জন্য ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ পুত্রের অধ:স্তন স্তরের ক্ষেত্রে ‘ওয়ালাদ’ বলতে নাতিকে বুঝাবে।
দাদার ক্ষেত্রে ‘আবু’ শব্দের প্রয়োগের একটি উদাহরণ হচ্ছে ১২:৬ আয়াতে ‘আবু’ শব্দের দ্বিবচন ‘আবাওয়ায়’ (দুজন পিতৃপুরুষ) ব্যবহার করে দাদাকে ও দাদার পিতাকে বুঝানো হয়েছে। ‘আবাওয়ায়’ শব্দটি এখানে দুজন ‘আবু’ তথা দুজন পিতৃপুরুষ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আয়াতটিতে নবী ইউসুফের পিতা (নবী ইয়াকুব) নবী ইউসুফকে প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন যে, তোমার দুই পিতৃপুরুষ ইবরাহীম ও ইসহাকের উপর তোমার প্রভু যেভাবে নেয়ামত পূর্ণ করেছিলেন, সেভাবে তোমার উপর ও ইয়াকুবের অন্যান্য পরিজনের প্রতি নেয়ামত পূর্ণ করবেন। ১২:৬৮ আয়াত থেকে জানা যায় যে, নবী ইউসুফের পিতা ছিলেন নবী ইয়াকুব। সুতরাং আয়াতটিতে ব্যবহৃত ‘আলাইকা ও আলা আলি ইয়া’কূবা’ অর্থ হচ্ছে ‘তোমার প্রতি ও ইয়াকুবের অন্যান্য পরিজনের প্রতি’। ‘আলে’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘পরিবার, পরিজন, কর্মচারী, সমমনা ব্যক্তিবর্গ প্রমুখ’। সুতরাং আয়াতটিতে নবী ইউসুফের দাদা ইসহাক এবং দাদার পিতা ইবরাহীমকে তাঁর দুজন ‘আবু’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। 
এমনকি ভাবাবেগমূলক অর্থে চাচাকেও ‘আবু’ শব্দের আওতাভুক্ত করা হয়। যেমন, ২:১৩৩ আয়াতে নবী ইয়াকুবের পিতা ইসহাক, চাচা ইসমাইল এবং দাদা ইবরাহীমকে একসাথে বুঝানোর জন্য ‘আবু’ শব্দের বহুবচন ‘আবায়ি’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। দাদা পিতৃতুল্য হওয়ার যুক্তি অনুসারে চাচা ভ্রাতৃতুল্য হয়। কিন্তু চাচা পিতার ভাই এবং চাচার পুত্র চাচাতো ভাই বিধায় চাচা পিতৃতুল্য হিসেবেই সাব্যস্ত হয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে চাচা ভ্রাতৃতুল্য হওয়ার যুক্তিটিকে অগ্রাহ্য করে মানবীয় মনস্তত্ত্বভিত্তিক যে যুক্তিটি প্রতিষ্ঠিত হবে তা হলো: পিতৃতুল্য হওয়ার দুটি মাত্রা রয়েছে, পিতার পিতৃপুরুষ হওয়া এবং পিতার ভ্রাতৃপুরুষ হওয়া। এ দুটি মাত্রার মধ্যে আবার পিতার পিতৃপুরুষ হওয়া পিতৃপুরুষ হিসেবে আইনগত ধারায় অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু পিতার ভ্রাতৃপুরুষ হওয়া পিতৃপুরুষ হিসেবে আইনগত ধারায় অন্তর্ভুক্ত হয় না। অর্থাৎ আইনগত কোনো ধারাতে ‘আবু’ শব্দের আওতায় দাদাকে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও চাচাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। এর প্রমাণ হলো বিবাহ ও পর্দা সম্পর্কিত আয়াতসমূহ থেকে বুঝা যায় যে, দাদার প্রসঙ্গে পিতা থেকে আলাদা শব্দে আইনের ধারা উল্লেখ করা হয় না, কিন্তু চাচার প্রসঙ্গে পিতা থেকে আলাদা শব্দে আইনের ধারা উল্লেখ করা হয়। 
সুতরাং উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধিতে চাচা, মামা, ফুফু, খালা প্রমুখ পিতৃতুল্য-মাতৃতুল্য হিসেবেও সাব্যস্ত হবে না, ভ্রাতৃতুল্য-ভগ্নীতুল্য হিসেবেও সাব্যস্ত হবে না। শুধুমাত্র যখন নির্দিষ্ট কোনো ওয়ারিস জীবিত থাকবে না তখন চাচা, মামা, ফুফু, খালাকে উত্তরাধিকার দেয়া যেতে পারে এবং সেক্ষেত্রে তাঁরা পিতৃতুল্য-মাতৃতুল্য হিসেবে সাব্যস্ত হতে পারেন এবং চাচাতো ভাই-বোন, মামাতো ভাই-বোন, ফুফাতো ভাই-বোন ও খালাতো ভাই-বোনকে ভাই-বোনতুল্য সাব্যস্ত করা যেতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে এভাবে বণ্টনকে বলা যেতে পারে, কুরআনে নির্ধারিত কোনো ওয়ারিস উপস্থিত না থাকা অবস্থায় উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধির ছায়া অবলম্বনে উত্তরাধিকার বণ্টনের নির্বাহী বিধির একটি সুপারিশমাত্র। এক্ষেত্রে সম্পদ কিভাবে বণ্টিত হবে সে বিষয়ে উলিল আমর (ঈবহঃৎধষ অঁঃযড়ৎরঃু) যথোপযুক্ত পরামর্শকদের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। 
১১. আখু, উখতু, ইখওয়াত (ভাই বোন)
ভাই-বোনকে বুঝাতে আরবিতে যেসব শব্দ ব্যবহৃত হয় তা নিম্নরূপ:
‘আখু’ শব্দের অর্থ ভাই। ‘আখু’ শব্দের দ্বিবচন হচ্ছে ‘আখাওয়ান’ এবং বহুবচন হচ্ছে ‘ইখওয়ান’ এবং ‘ইখওয়াত’। ‘উখতু’ শব্দের অর্থ বোন। ‘উখতু’ শব্দের দ্বিবচন হচ্ছে ‘উখতান’ এবং বহুবচন হচ্ছে ‘আখাওয়াত’।
৪৯:১০ আয়াতে বলা হয়েছে, ইন্নামাল মু’মিনূনা ইখওয়াতুন, ফাআসলিূ বায়না আখাওয়ায়কুম। অর্থাৎ নিশ্চয় মু’মিনগণ ভাই-ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দুই (বিবদমান) ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। এ আয়াতে ঈমানের ভিত্তিতে যে ভ্রাতৃত্ব তথা আদর্শিক ভ্রাতৃত্বের জন্য ‘আখাওয়ায়’ ও ‘ইখওয়াত’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু যেখানে এরূপ প্রসঙ্গ থাকে না সেরূপ আইনগত ধারাতে ‘আখাওয়ায় ও ইখওয়াত’ বলতে পূর্ণ আপন/বৈমাত্রেয়/বৈপিত্রেয় ভাইদেরকে বুঝাবে। যেমন, ৪:২২ আয়াতে ‘উখতায়’ বলতে পূর্ণ আপন/বৈমাত্রেয়/বৈপিত্রেয় দুই বোনকে বুঝানো হয়েছে। আয়াতটির সংশ্লিষ্ট অংশ হলো: ওয়া আন তাজমাউ বায়নাল উখতায়নি (৪:২৩)। অর্থাৎ তোমাদের উপর হারাম করা হয়েছে .................. দুই বোনকে একত্র করা (দুই বোনকে একত্রে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করা)। এটি আইনগত ধারা যাতে দুই বোনকে একসাথে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করাকে হারাম করা হয়েছে। অথচ ভাবমূলক বা আদর্শিক কারণে যারা পরস্পরের বোন (যারা পূর্ণ আপন/বৈপিত্রেয়/বৈমাত্রেয় বোন নয়) তারা এ আয়াতের আওতাভুক্ত নয়। কারণ যদি তারা এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে তো বহুবিবাহ মাত্রেই নিষিদ্ধ হয়ে যায়। অথচ কুরআনে বহুবিবাহকে হারাম করা হয়নি। এমন কি এ আয়াতের আওতায় চাচাতো, ফুফাতো, মামাতো ও খালাতো বোনকে একসাথে বিবাহ করাও নিষিদ্ধ নয়। এখানে ভাষারীতির দিক থেকে দুই বোনকে একত্র করার অর্থ হচ্ছে দুই বা ততোধিক বোনকে একত্র করা। কারণ দুইয়ের বেশি বোনকে একত্র করলে তাতেও দুই বোনকে একত্র করা হয়। তাই দুই বা দুইয়ের বেশি বোনকে একত্র করা না বলে বলা হয়েছে দুই বোনকে একত্র করা। এভাবে সংক্ষেপে পূর্ণ কথা উপস্থাপিত হয়ে যায়। এভাবে কুরআনে শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে বক্তব্যের স্পষ্টতা, সরলতা ও পরিপূর্ণতার পাশাপাশি ভাষারীতির সকল সূত্রকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো হয়েছে এবং যেখানে যেভাবে শব্দের গাঁথুনি ও বাক্যের বিন্যাস প্রয়োজন, সেখানে সেভাবেই করা হয়েছে। 
সূরা ইউসুফ ১২:৫৯ আয়াতে সুনির্দিষ্টভাবে বৈমাত্রেয় ভাই বুঝাতে বিআখিল লাকুম মিন আবীকুম’ (তোমাদের বৈমাত্রেয় ভাই/ তোমাদের পিতৃ শরিক ভাই) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। শুধুমাত্র ‘আখু’ শব্দ দ্বারা সাধারণভাবে ভাই বুঝায়, সে পূর্ণ আপন ভাই হোক বা বৈমাত্রেয়/পিতৃ শরিক ভাই হোক বা বৈপিত্রেয়/মাতৃ শরিক ভাই হোক। 
১২. ওয়ালাদ, জওজ ও আখু : ব্যাকরণগত ব্যবহারিক ধরনের মিল ও অমিল
‘ওয়ালাদ’ শব্দটি পুংলিঙ্গ, একবচন হলেও এটি পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। ‘ওয়ালাদ’ এর স্ত্রীলিঙ্গ হচ্ছে ‘ওয়ালাদা’। কিন্তু আসলে ‘কন্যা সন্তান’ বুঝানোর জন্যও ‘ওয়ালাদ’ শব্দই ব্যবহার করা হয়। যেমন বাংলায় ‘সন্তান’ বললে ছেলে ও মেয়ে যে কোনো সন্তানকে বুঝায়। সুতরাং ‘ওয়ালাদ’ শব্দের অর্থ পুত্র বা কন্যা। এ বিষয়ে উদাহরণস্বরূপ ২:২৩৩ আয়াত লক্ষণীয়।
‘ওয়ালাদ’ শব্দের মত আরেকটি শব্দ ‘জওজ’, যা পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। ‘জওজ’ শব্দটি পুংলিঙ্গ, একবচন এবং এর অর্থ হলো ‘স্বামী’। ‘জওজ’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ হলো ‘জওজা’। অথচ স্ত্রীকে বুঝানোর জন্যও ‘জওজ’ ব্যবহার করা হয়। ‘জওজ’ শব্দের ব্যবহার ইংরেজি ঝঢ়ড়ঁংব এর মতো, যা স্বামীর বিপরীতে স্ত্রী এবং স্ত্রীর বিপরীতে স্বামীকে বুঝায়।
‘ওয়ালাদ’ দ্বারা বুঝায় এক বা একাধিক পুত্র বা কন্যা বা পুত্র-কন্যা। ‘ওয়ালাদ’ এর বহুবচন হলো ‘আওলাদ’। ‘আওলাদ’ এর অর্থ ‘পুত্রগণ’। অথচ এটি দ্বারা ‘পুত্র-কন্যা’ এমনকি ‘কন্যাগণ’ও বুঝায়। ৪:১১ আয়াত অনুাযায়ী, ‘আওলাদ’ হিসেবে কখনো কখনো শুধু কন্যাগণ থাকতে পারে। 
অনুরূপভাবে ‘জওজ’ এর বহুবচন ‘আজওয়াজ’। নারীর জন্য একই সাথে বহুবিবাহ বৈধ না হওয়ায় কোনো নারীর জন্য বহুবচনে ‘আজওয়াজ’ (স্বামীগণ) শব্দের প্রয়োগ ঘটে না। কিন্তু পুরুষের জন্য শর্তসাপেক্ষে বহুবিবাহ বৈধ বিধায় কোনো পুরুষের জন্য বহুবচনে ‘আজওয়াজ’ (স্ত্রীগণ) শব্দের প্রয়োগ ঘটতে পারে। ৪:১২ আয়াতে স্ত্রীগণকে বুঝাতে বুঝাতে বহুবচনে ‘আজওয়াজ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
৪:১১ আয়াত অনুযায়ী, ‘আওলাদ’ শব্দের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে কখনো শুধুমাত্র একটি কন্যা থাকতে পারে, যার সাথে কোনো পুত্র নেই। অনুরূপভাবে ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত ‘আজওয়াজ’ শব্দের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে কখনো একটিমাত্র স্ত্রী এবং কখনো একাধিক স্ত্রী থাকতে পারে।
অন্যদিকে ‘ওয়ালাদ’ ও ‘আখু’ শব্দের মধ্যে ব্যাকরণগত ব্যবহারিক ধরনের ক্ষেত্রে ‘ওয়ালাদ’ ও ‘জওজ’ শব্দের মধ্যকার মিল পাওয়া যায় না। ‘আখু’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ভাই। ‘আখু’ শব্দটি শুধুমাত্র পুরুষের জন্য ব্যবহৃত হয় এবং তা দ্বারা একবচনই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। তবে ‘আখু’ শব্দের বহুবচন ‘ইখওয়াত’ দ্বারা ‘ভাইগণ’ বুঝানোর পাশাপাশি ‘ভাই-বোন’ও বুঝায়, এবং বাস্তবে কখনো একটিমাত্র ভাই বা একটিমাত্র বোনও ‘ইখওয়াত’ শব্দের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। 
‘ইখওয়াত’ শব্দটি বহুবচন। বহুবচন হওয়ার একটি প্রমাণ হলো, ৪:১৭৬ আয়াতে বলা হয়েছে- ‘ওয়া ইন কানূ ইখওয়াতার রিজালাওঁ ওয়া নিসাআন ফালিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’। অর্থাৎ ‘যদি থাকে ভাই বোন, পুরুষেরা (ভাইয়েরা) ও নারীরা (বোনেরা) তাহলে, এক পুরুষ (ভাই) পাবে দুই নারীর (বোনের) সমান’। এখানে ‘ইখওয়াতান’ এর জন্য ব্যবহৃত ক্রিয়া বহুবচন, ‘ইখওয়াতান’ এর ব্যাখ্যামূলক বদল হিসাবে ব্যবহৃত ‘রিজালান’ এবং তার সাথে সংযুক্ত ‘নিসাআন’ উভয়টি বহুবচন। তাই ব্যাকরণগতভাবে ‘ইখওয়াতার রিজালাওঁ ওয়া নিসাআন’ কথাটির ব্যাখ্যা দাঁড়ায়, ‘ইখওয়াতান’ অর্থ ‘ভাইগণ’, ‘বোনগণ’, ‘ভাই-বোন’ এবং প্রত্যেক অবস্থায় এটি বহুবচন তথা দুইয়ের বেশি। 
বচনের ব্যবহারবিধি অনুসারে, ভগ্ন বহুবচন পুরুষবাচক হলেও তা নারী পুরুষের সম্মিলিত অবস্থার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে, এবং এমনকি শুধু নারীদের বহুবচনের জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে। ৪:১১ ও ৪:১২ আয়াতেও এর প্রমাণ রয়েছে। যেমন, ৪:১১ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’। তারপর এই ‘আওলাদের’ দুটি অবস্থা এভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, (ক) লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি। অর্থাৎ যখন নারী-পুরুষ সম্মিলিত অবস্থায় থাকে। (খ) ফাইন কুন্না নিছাআন। অর্থাৎ যখন ‘আওলাদ’ হিসাবে ‘নিসাআন’ বা নারীরা থাকে। সুতরাং এখানে শুধু নারীদের বহুবচনও ‘আওলাদ’ হিসাবে সাব্যস্ত হয়েছে। 
এ বিষয়ে আরেকটি উদাহরণ হলো ৪:১২ আয়াতে ‘জওজ’ এর ভগ্ন বহুবচন ‘আজওয়াজ’ পুংলিঙ্গের শব্দ হলেও তা দ্বারা স্ত্রীদেরকে বুঝানো হয়েছে তথা তা শুধু নারীদের বহুবচনের অর্থ প্রকাশ করেছে। প্রসঙ্গত পুনরুল্লেখ্য যে, ‘আজওয়াজ’ এর একবচন ‘জওজ’ শব্দটি পুংলিঙ্গ হলেও তা দ্বারা স্বামীকে যেমন বুঝায়, তেমনি স্ত্রীকে বুঝানোর জন্যও ‘জওজ’ ব্যবহৃত হয়, যদিও এজন্য স্ত্রীলিঙ্গের শব্দ হচ্ছে ‘জওজাহ’। 
আরেকটি বিশেষ বিষয় হচ্ছে সুনির্দিষ্টভাবে দুই বুঝানোর জন্য দ্বিবচন ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সাধারণভাবে বহুসংখ্যকের ধারণাকে গুরুত্ব দেয়ার জন্য বহুবচন ব্যবহৃত হয়, যাতে কখনো কখনো অন্তত দুই সংখ্যার অন্তর্ভুক্তিরও অবকাশ থাকে। যেমন, ৪:১২ আয়াতে বলা হয়েছে, ফা-ইন কানূ আকছারা মিন যালিকা ফাহুম শুরাকাউ। এতে ব্যবহৃত কানূ, ফাহুম, শুরাকাউ শব্দ তিনটি হচ্ছে বহুবচন। অথচ পূর্বে ‘আখুন আও উখতুন’ এর কথা তথা ‘এক ভাই’ বা ‘এক বোন’ এর কথা বলা হয়েছিল। সুতরাং আকছারা মিন যালিকা বলতে বুঝানো হয়েছে ‘একের বেশি ভাই’ বা ‘একের বেশি বোন’ বা ‘ভাই বোন’ যার ন্যুনতম সংখ্যা হয় দুই। 
উপর্যুক্ত ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে প্রতীয়মান হয় যে, ৪:১২ আয়াতে ব্যবহৃত ‘আখু’ শব্দটি একবচন এবং এর দ্বারা সুনির্দিষ্টভাবে এক ভাইকে বুঝাবে এবং ‘উখতু’ শব্দটি একবচন এবং এর দ্বারা সুনির্দিষ্টভাবে এক বোনকে বুঝাবে। যদিও কখনো কখনো সাধারণত একবচন দ্বারা এক বা একাধিক এর অর্থ গ্রহণ করার অবকাশ থাকে। কিন্তু এখানে পরের অংশে ফা-ইন কানূ আকছারা মিন যালিকা বাক্যাংশের মাধ্যমে ‘আখু’ ও ‘উখতু’ কে এক ভাই ও এক বোনের জন্য সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে, ৪:১৭৬ আয়াতে ব্যবহৃত ‘উখতু’ শব্দটিও এক বোনের জন্য সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। কারণ ঐ আয়াতে পরের অংশে বলা হয়েছে, ফা-ইন কানাতাছনাতাইনি বা যদি তারা (বোনেরা) হয় দুজন। তাই ফা-ইন কানাতাছনাতাইনি বাক্যাংশের পূর্বে ব্যবহৃত ‘উখতু’ শব্দটি একবচন হওয়ার পাশাপাশি এটি দ্বারা সুনির্দিষ্টভাবে এক বোনকেই বুঝায়, এখানে একাধিক বোন অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অবকাশ নেই। 
একবচন দ্বারা একজনকে বুঝায়, যদিও একবচনের মাধ্যমে প্রদত্ত বক্তব্য একাধিক ব্যক্তির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে, যদি ভিন্ন কোনো নির্দেশনা না থাকে। অর্থাৎ এক বা একাধিক ব্যক্তিকে বুঝাতে সাধারণভাবে একবচন ব্যবহৃত হয়। অন্য কথায়, সাধারণ বিবৃতি প্রকাশের জন্য একবচন ব্যবহৃত হয়। কিন্তু যদি একাধিক ব্যক্তির জন্য ভিন্ন নির্দেশনা থাকে, সেক্ষেত্রে একবচন সুনির্দিষ্টভাবে একজনকে অন্তর্ভুক্ত করে, একাধিক ব্যক্তির ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হয় না। 
১৩. ওয়ালাদ, আওলাদ, ইখওয়াত, মাওয়ালিয়া : বচন ও লিঙ্গ প্রসঙ্গ
‘ওয়ালাদ’ শব্দটি ৪:১১, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে একবচনের গঠনগত রূপে ব্যবহৃত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি অনুধাবনযোগ্য বিষয় হলো, যেহেতু ‘ওয়ালাদ’ শব্দের দ্বারা বহুজনকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় বা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তা সত্ত্বেও ৪:১১ আয়াতে প্রথমবার ‘আওলাদ’ বা বহুবচন ব্যবহৃত হওয়ার কারণ কী? প্রশ্নটি নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয় যে, যখন পুরুষ ও নারী উভয়কে অন্তর্ভুক্ত করে বহুবচনের অবকাশ সৃষ্টি করা হয়, বাস্তবে এর আওতায় কখনো কখনো মাত্র একজন থাকতে পারে তা ভিন্ন কথা, তখন বহুবচন ব্যবহৃত হয়। যেমন, ৪:১১ আয়াতে প্রথমবার ‘আওলাদ’ শব্দ ব্যবহৃত হওয়ার পরবর্তীতে কয়েকবার সাধারণভাবে এক বা একাধিক পুত্র বা কন্যা বুঝাতে ‘ওয়ালাদ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু প্রথমবার ‘আওলাদ’ শব্দ ব্যবহারের কারণ তার পরপরই বলা হয়েছে, লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি (এক পুরুষের জন্য দুই নারীর অংশের মতো)। অর্থাৎ এতে নারী-পুরুষ উভয়কে অন্তর্ভুক্ত করে বক্তব্য শুরু করা হয়েছে। বচনের ব্যবহার সম্পর্কিত এরূপ আরেকটি উদাহরণ হলো, ৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোন প্রসঙ্গে ‘ইখওয়াত’ (বহুবচন) ব্যবহৃত হওয়ার পরপর ‘রিজালাওঁ ওয়া নিসাআন’ (পুরুষগণ ও নারীগণ) শব্দের মাধ্যমে ‘ইখওয়াত’ এর পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে যে, তাতে পুরুষ ও নারী তথা ভাই ও বোন উভয়ে অন্তর্ভুক্ত। 
৪:১১ এর ফাইন কুন্না নিসাআন ফাওক্বাছনাতাইনি .........., ওয়া ইন কানাত ওয়াহিদাতান........... দ্বারা বুঝা যায় যে, ‘আওলাদের’ (বহুবচনের) আওতায় বাস্তবে কখনো মাত্র একজনও উপস্থিত থাকতে পারে। 
উপরিউক্ত ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অনুসারে নিম্নের দুটি সিদ্ধান্ত প্রতিপাদিত হয়- 
(ক) ৪:৩৩ এর ‘মাওয়ালিয়া’ (বহুবচন) এর আওতায় কখনো মাত্র একজনও উপস্থিত থাকতে পারে। 
(খ) ৪:১১ আয়াতে ব্যবহৃত ‘ইখওয়াত’ (বহুবচন) এর আওতায় কখনো মাত্র একজন ভাই বা একজন বোন উপস্থিত থাকতে পারে। 
১৪. যাকার, উনছা, ইমরুউন, রিজাল, ইমরাআত, নিসা
৪:১১ আয়াতে বলা হয়েছে, লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি। ‘যাকার’ শব্দটির শব্দমূল হলো ‘যাল কাফ র’। ‘উনছায়ায়নি’ শব্দটি হলো ‘উনছা’ শব্দের দ্বিবচন। ‘উনছা’ শব্দের শব্দমূল হলো ‘আলিফ নূন ছা’। ‘যাকার’ ও ‘উনছা’ শব্দ পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গকে নির্দেশ করে, তা মানুষের ক্ষেত্রে হোক বা পশুর ক্ষেত্রে হোক। এ বিষয়ে সূরা আনআম ৬:১৪৩ আয়াতে ‘যাকার’ ও ‘উনছা’ শব্দের ব্যবহার লক্ষণীয়। 
‘যাকার’ অর্থ পুরুষ (male), যা যে কোন প্রাণীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অন্যদিকে ‘পুরুষ মানুষ’ (man) বুঝাতে ‘রজুল’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। বস্তুত ‘যুল আক্বল’ বা বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন পুরুষ বুঝাতে ‘রজুল’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। তাই পুরুষ জিনকে বুঝাতেও ‘রজুল’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে (দ্র. ৭২:৬)। 
যখন আওলাদকে দুটি লিঙ্গগত বিভাজনে বিভক্ত করা হলো তখন কন্যা প্রসঙ্গে ‘উনছা’ তথা Female শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু যখন ‘আওলাদ’ শব্দের প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষেত্রে শুধু কন্যাদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে তখন তাদের জন্য ‘ইনাছা’ (‘উনছা’ এর বহুবচন) শব্দ ব্যবহার না করে ‘নিসা’ (নারী,Women) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ যখন লিঙ্গগত পরিচয়ের মাধ্যমে শ্রেণি চিহ্নিত করা হয়েছে তখন ‘উনছা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আর যখন লিঙ্গগত শ্রেণি চিহ্নিত করার প্রয়োজন হয়নি, তখন ‘নিসা’ (স্ত্রীলিঙ্গের শব্দ কিন্তু যাতে লিঙ্গগত পরিচিতির প্রতি আলোকপাত করার প্রসঙ্গ নেই) ব্যবহার করা হয়েছে। এভাবে কুরআনে প্রতিটি শব্দকে প্রয়োগস্থানভিত্তিক সর্বোত্তম প্রয়োগরীতি অনুযায়ী প্রয়োগ করা হয়েছে। 
‘মারউ/ইমরুউ’ শব্দের শব্দমূল হলো ‘মীম র আলিফ’ এবং অর্থ হলো ‘পুরুষ মানুষ’। এ শব্দটির একটি প্রতিশব্দ হলো ‘রজুল’। ‘রজুল’ শব্দটির শব্দমূল হলো ‘র জীম লাম’। ‘মারউ/ ইমরুউ’ এবং ‘রজুল’ শব্দের বহুবচন হলো ‘রিজাল’। 
‘রজুল’ এবং ‘মারউ/ইমরুউ’ শব্দদ্বয়ের মধ্যে ‘রজুল; শব্দটি সাধারণ এবং এতে কিছুটা শক্তিসামর্থ্যে কঠোরতার দিক রয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে ‘মারউ/ইমরুউ’ শব্দের অর্থের মধ্যে সহমর্মিতার দিকটিকে প্রধান করে দেখা হয়। তাই প্রসঙ্গ অনুসারে যদি ‘রিজাল’ শব্দটি কোথায় ‘রজুল’ এর বহুবচন হিসেবে এবং কোথায় ‘মারউ/ইমরুউ’ এর বহুবচন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে তা নির্ণয় করা যায় তবে শব্দটির অর্থগত ধরনে সেরূপ প্রভাবের বিষয়টিও বিবেচনা করা যেতে পারে। 
‘রিজাল’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ হলো ‘নিসা’। ‘নিসা’ শব্দটির শব্দমূল হলো ‘নূন ছীন ওয়াও’। ‘নিসা’ শব্দটি ‘ইমরাআত’ শব্দের বহুবচন। অন্যভাবে বলা যায়, মারউন/ইমরুউ এবং রজুল উভয় শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ হলো ইমরাআত। ইমরাআত শব্দটি একবচন (৪:১২, ২৭:২৩) এবং এর দ্বিবচন হলো ‘ইমরাআতান’ (২:২৮২, ২৮:২৩)। 
‘মারউ/ইমরুউ’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ ‘ইমরাআত’ এবং এক্ষেত্রে পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গের মূল অক্ষরসমূহ (Root Letters) একই। কিন্তু ‘রজুল’ শব্দটির একই মূল অক্ষরসমূহ থেকে গঠিত স্ত্রীলিঙ্গ ‘রজুলাহ’ হলেও ‘রজুল’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ হিসেবেও ‘ইমরাআত’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। 
‘মারউ/ইমরুউ’ এবং এর বহুবচন ‘রিজাল’ ভিন্ন ভিন্ন শব্দমূল থেকে গঠিত। অনুরূপভাবে ‘ইমরাআত’ এবং এর বহুবচন ‘নিসা’ ভিন্ন ভিন্ন শব্দমূল থেকে গঠিত।
‘ইমরাআত’ বা ‘নিসা’ শব্দটি যখন কারো সাথে সম্পর্কিত করে প্রকাশ করা হয় তখন তা দ্বারা স্ত্রী বুঝায় যদি পূর্বাপর বক্তব্য প্রসঙ্গ থেকে তা দ্বারা স্ত্রী বুঝানোর বিষয়টি স্পষ্ট হয়; অন্যথায় তা দ্বারা সমাজস্থ নারীগণকে সাধারণভাবে বুঝায়, দাম্পত্য সম্পর্কীয় স্ত্রী বুঝায় না। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে ‘ইমরাআত’ বা ‘নিসা’ শব্দের আওতায় বোন বা কন্যাও অন্তর্ভুক্ত হয়। সুনির্দিষ্টভাবে দাম্পত্য সম্পর্কীয় স্ত্রী বুঝাতে ‘জওজ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু যদি বক্তব্য বিষয় ব্যাপক বা সাধারণ পর্যায়ের হয় সেক্ষেত্রে ‘জওজ’ শব্দটি দ্বারা সাধারণভাবে পুরুষের বিপরীতে নারীকে বুঝায় যারা দাম্পত্য সম্পর্কে আবদ্ধ বা দাম্পত্য সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার উপযোগী। এক কথায়, ‘জওজ/ আজওয়াজ’ শব্দটির আওতায় কোনো অবস্থায় বোন বা কন্যা অন্তর্ভুক্ত হবে না। আরবী ভাষারীতির এ তথ্য সামনে থাকলে কোথায় ‘ইমরাআত’, ‘নিসা’, ‘জওজ/ আজওয়াজ’ ইত্যাদি শব্দ কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এবং কোন স্থানে এ শব্দগুলোর মধ্য থেকে কোনটি কেন ব্যবহার করা হয়েছে তা বুঝা সহজ হয়। 
১৫. হালাকা শব্দের অর্থ
মিরাসের বন্টন বিধির আয়াত ৪:১৭৬ আয়াতে ‘ইনিমরুউন মাতা’ (যদি কোনো পুরুষ মৃত্যুবরণ করে) শব্দের পরিবর্তে ‘ইনিমরুউন হালাকা’ (যদি কোনো পুরুষ হালাক হয়) ব্যবহার করার কারণে অর্থের কোনো তারতম্য ঘটে কিনা সে বিষয়ে কারো দ্বিধাদ্বন্দ্বতৈরি হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, মওত এবং হালাক সমার্থক শব্দ। তবে হালাক শব্দটি মওত শব্দের চেয়ে বেশিমাত্রায় মৃত্যু ধারণাটির গভীরতার অনুভূতি সৃষ্টি করে।
১৬. হাযযু ও নাসীব/নসীব 
‘অংশ’ বুঝাতে ৪:১১ ও ৪:১৭৬ আয়াতে ‘হাযযু’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এবং ৪:৭ ও ৪:৩৩ আয়াতে ‘নাসীব’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। তাই অনেকের মধ্যে এ দুটি শব্দের পার্থক্য সম্পর্কে কৌতুহল থাকতে পারে। সাধারণভাবে অংশ, (ব্যক্তিগত বা) সমষ্টিগত অংশ ইত্যাদি বুঝাতে ‘হাযযু’ শব্দ ব্যবহৃত হয় এবং ‘প্রাপ্য অংশ’ বুঝাতে ‘নাসীব’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। উভয় শব্দই অনুগ্রহস্বরূপ প্রদত্ত কোনো অংশকে (Grace) বুঝাতেও ব্যবহৃত হয়।
৪:১১ ও ৪:১৭৬ আয়াতে দুই নারীর সমষ্টিগত অংশ বুঝাতে ‘হাযযু’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, যা অংশ হিসাবে সাধারণ প্রকৃতির গুরুত্ববহ। আর ৪:৭ ও ৪:৩৩ আয়াতে ‘প্রাপ্য অংশ’ অর্থে ‘নাসীব’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এই প্রাপ্যতা তৈরি হয়েছে তাদের জন্য কোনো অংশ নির্ধারণ করে দেয়ার কারণে। সুতরাং যেভাবেই প্রাপ্যতা তৈরি হোক না কেন, প্রাপ্য অংশ বুঝাতে ‘নাসীব’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ কর্মের গুণে হোক বা গ্রেস (Grace) হিসাবে নির্ধারণ করে দেয়ার কারণে হোক, প্রকৃত প্রাপ্য অংশ হোক বা কল্পিত/ মনগড়া প্রাপ্য অংশ হোক, প্রাপ্য অংশ বুঝাতে নাসীব শব্দ ব্যবহৃত হয়।
১৭. ‘ওয়া ইন’ এবং ‘ফা ইন’ প্রসঙ্গ
‘ওয়া ইন’ ও ‘ফা ইন’ শব্দ দুটি নিয়েও কেউ কেউ জটিলতা অনুভব করতে পারেন। ‘ওয়া ইন’ অর্থ ‘এবং যদি’, ‘ফা ইন’ অর্থ ‘তারপর যদি’। এটি ধারাবাহিক বিবৃতির একটি বাক-রীতি। নিয়ম অনুসারে যেখানে যে শব্দটি ব্যবহারযোগ্য সেখানে সে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু এ শব্দদ্বয়ের পার্থক্যের কারণে শব্দদ্বয়ের প্রত্যেকটির পরে উল্লেখিত ভগ্নাংশসমূহের ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য সূচিত হয় না। 
‘ওয়া ইন’ ব্যবহৃত হয়েছে আলোচ্য প্রসঙ্গের বড় বড় বিভাজনকে সংযোজনের ক্ষেত্রে বা ‘ফা-ইন’ ব্যবহারের পর সেটার সাথে নিকটবর্তী প্রসঙ্গের সংযোজনের ক্ষেত্রে। আর ‘ফা-ইন’ ব্যবহৃত হয়েছে সাধারণভাবে কোনো প্রসঙ্গ উল্লেখ করার পর (তা ‘ওয়া ইন’ দ্বারা সংযোজিত প্রসঙ্গ হোক বা সাধারণভাবে বর্ণিত প্রসঙ্গ হোক), সেটার সাথে কোনো শর্তযুক্ত প্রসঙ্গ প্রথমবারের মতো সংযোজনের ক্ষেত্রে বা একই প্রসঙ্গের মধ্যে কোনো নতুন শর্ত সংযোজনের ক্ষেত্রে। 
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, ৪:১১, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত প্রতিটি অংশ সুনির্দিষ্ট ও সমমর্যাদার, সেটাকে ‘ওয়া ইন’ এর দ্বারা শর্তযুক্তভাবে বিবৃত করা হোক বা ‘ফা-ইন’ এর দ্বারা শর্তযুক্তভাবে বিবৃত করা হোক, সকল অবস্থায় তা আরবী ভাষারীতির সংশ্লিষ্ট যাবতীয় শর্ত পূরণ করে ব্যবহৃত হয়েছে এবং একই ধরনের অর্থকে ধারণ করেছে।
১৮. ‘মা তারাকা’ এবং ‘মিম্মা তারাকা’
উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি প্রসঙ্গে উল্লেখিত ভগ্নাংগুলোর একবচন, দ্বিবচন ও বহুবচন নিয়েও জটিলতা অনুভব হতে পারে। আবার ‘মা তারাকা’ ও ‘মিম্মা তারাকা’ শব্দদ্বয়ের প্রয়োগ সম্পকের্ও জটিলতা অনুভব হতে পারে। তাই এ প্রসঙ্গটি বিশেষভাবে আলোচনা করা প্রয়োজন। 
কুরআনে উল্লেখিত ভগ্নাংগুলোর একটি সারসংক্ষেপ তালিকা দেয়া হলো: 
ক) দুইয়ের বেশি কন্যার জন্য = ছুলুছা (দ্বিবচন) মা তারাকা 
খ) এক কন্যার জন্য = আন নিসফু। 
গ) পিতা মাতা উভয়ের প্রত্যেকের জন্য (ওয়ালাদ থাকলে) = আছ ছুদুছু মিম্মা তারাকা 
ঘ) মাতার জন্য (ওয়ালাদ না থাকলে) (পিতা-মাতা ওয়ারিস হলে) = আছ ছুলুছু (একবচন)। 
ঙ) মাতার জন্য (ইখওয়াত থাকলে) = আছ ছুদুছু 
চ) স্বামীর জন্য (ওয়ালাদ না থাকলে) = নিসফু মা তারাকা আজওয়াজুকুম 
ছ) স্বামীর জন্য (ওয়ালাদ থাকলে) = আর রুবুউ মিম্মা তারাকনা 
জ) স্ত্রীর জন্য (ওয়ালাদ না থাকলে) = আর রুবুউ মিম্মা তারাকতুম 
ঝ) স্ত্রীর জন্য (ওয়ালাদ থাকলে) = আছ ছুমুনু মিম্মা তারাকতুম 
৪:১২ আয়াতে বর্ণিত কালালাহ এর সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে 
ঞ) এক ভাই বা এক বোন = আছ ছুদুছু 
ট) একাধিক ভাই বা বোন (শরিক হবে) = ফিছ্ ছুলুছি (একবচন) 
৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত কালালাহ ভাইবোনের ক্ষেত্রে 
ঠ) ওয়ালাদ না থাকা পুরুষের একটিমাত্র বোন = নিসফু মা তারাকা 
ড) ওয়ালাদ না থাকা নারীর ভাইটি = ইয়ারিছুহা 
ঢ) ওয়ালাদ না থাকা পুরুষের দুটি বোন = আছ ছুলুছানি (দ্বিবচন) মিম্মা তারাকা 
যদি আমরা উপর্যুক্ত তালিকা থেকে নিম্নের শব্দগুলো বিশেষভাবে লক্ষ্য করি তাহলে আমাদের কাছে ‘মা তারাকা’ এবং ‘মিম্মা তারাকা’ শব্দের ব্যবহারের নিয়মটি স্পষ্ট হবে। 
১. আন নিসফু  ২. নিসফু মা তারাকা ৩. ছুলুছা মা তারাকা ৪. আছ ছুলুছানি মিম্মা তারাকা
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, যেখানে উল্লেখিত কোনো ভগ্নাংশের পূর্বে ‘আলিফ লাম’ বা ‘আল’ যুক্ত করা হয়েছে সেখানে পরে হয়তো ‘মা তারাকা’ বা ‘মিম্মা তারাকা’ কোনোটিই ব্যবহৃত হয়নি, নয়তো ‘মিম্মা তারাকা’ ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু যেখানে উল্লেখিত কোনো অংশের পূর্বে ‘আলিফ লাম’ বা ‘আল’ যুক্ত করা হয়নি সেখানে পরে ‘মা তারাকা’ ব্যবহৃত হয়েছে। 
সুতরাং ‘মা তারাকা’ ও ‘মিম্মা তারাকা’ শব্দদ্বয় আরবী ভাষার বিশেষ রীতি অনুসারে ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু কোথায় এ দুটি শব্দগুচ্ছের কোনটি ব্যবহৃত হয়েছে বা কোনোটি ব্যবহৃত হয়নি তার ভিত্তিতে উল্লেখিত আনুপাতিক ভগ্নাংশগুলোর বণ্টনের ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য হবে না। 
কোনো ভগ্নাংশকে ‘আল’ দ্বারা যুক্ত করলে তা নির্দিষ্ট হয়। নির্দিষ্ট হওয়ার পরে তা অন্য শব্দের সাথে সংযুক্ত হয় না। যেমন ‘আন নিসফু’। আর যদি কোনো ভগ্নাংশ অন্য শব্দের সাথে সম্পর্কিত হয় তাহলে ঐ ভগ্নাংশটির প্রথমে ‘আল’ যুক্ত করা ছাড়াই তা নির্দিষ্ট হয়। যেমন ‘নিসফু মা তারাকা’ অর্থ ‘যা সে তরক করে তার অর্ধেক (নিসফু)।’ এখানে ‘নিসফু’ ভগ্নাংশটি পরের ‘মা’ শব্দটির সাথে সম্পর্কিত হয়ে নির্দিষ্ট হয়েছে। সুতরাং ‘আন নিসফু’ এবং ‘নিসফু মা তারাকা’ শব্দদ্বয়ের অর্থ একই। 
উল্লেখিত ভগ্নাংশের শুরুতে ‘আল’ যোগ করা বা না করার ক্ষেত্রে রীতি হলো, যখন কোনো প্রসঙ্গে প্রথমবার ভগ্নাংশ উল্লেখ করা হয় তখন ‘মা তারাকা’ যোগ করা এবং যখন ঐ প্রসঙ্গের ধারাবাহিকতার সাথে সম্পর্কিত আরেকটি ভগ্নাংশ উল্লেখ করা হয় তখন ‘মা তারাকা’ বাদ দিয়ে ভগ্নাংশটির শুরুতে ‘আল’ যুক্ত করা। 
যেখানে কোনো বিষয়ে স্পষ্টতার খাতিরে ভগ্নাংশটি সমগ্র বণ্টনীয় সম্পদের উপর কার্যকর হওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করার প্রয়োজন হয়, তখন ‘মা তারাকা’ বা সমজাতীয় শব্দ সংযোজন করা হয়। তারপর যখন এ ধরনের শব্দ সংযোজন ব্যতীত ঐ প্রসঙ্গ স্বত:সিদ্ধভাবে স্পষ্ট থাকে, তখন তা সংযোজন করা হয় না। 
যখন ‘মা তারাকা’ যোগ করলে অংশটির পূর্বে ‘আল’ যুক্ত করা যায় না অথচ ‘আল’ যুক্ত না করলে উচ্চারণের দিক থেকে ছন্দ পতন হয়, তখন অংশটির পূর্বে ‘আল’ যুক্ত করে পরে ‘মা তারাকা’ এর পরিবর্তে ‘মিম্মা তারাকা’ বলা হয়। যেমন, ‘আছ ছুদুছু মিম্মা তারাকা’ অর্থ ‘যা সে তরক করে তা থেকে ১/৬   (ছুদুছু)’। এখানে ‘মিম্মা’ শব্দের কারণে বক্তব্যের অর্থ একই থাকে কিন্তু ‘ছুদুছু’ শব্দটি ‘মা’ শব্দের সাথে সম্পর্কিত না হয়ে আলাদা থাকে, সে কারণে ‘ছুদুছু’ এর পূর্বে ‘আল’ যুক্ত করে তাকে নির্দিষ্ট করতে হয়। কিন্তু ‘আছ ছুদুছু মা তারাকা’ ব্যবহৃত হলে তা শুদ্ধ হতো না। কারণ এক্ষেত্রে ‘ছুদুছু’ শব্দটি ‘আল’ দ্বারা নির্দিষ্ট হয়, তারপর আবার ‘মা তারাকা’ দ্বারাও নির্দিষ্ট হতো, যা ব্যাকরণগত দৃষ্টিকোণ থেকে অশুদ্ধ হতো। অথবা ‘আছ ছুদুছু মা তারাকা’ ব্যবহৃত হলে সেক্ষেত্রে বাক্যাংশটির অর্থ হতো ‘এক ষষ্ঠাংশ, যা তরক করা হয়েছে’। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে ‘মা তারাকা’ শব্দটি হতো ‘আছ ছুদুছু’ এর বিশেষণ। অন্য কথায়, সেক্ষেত্রে কথাটির তাৎপর্য হতো, মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদের পরিমাণই হলো এক ষষ্ঠাংশ, বাকি পাঁচ ষষ্ঠাংশ সে তরক করেনি। এ ধরনের তথ্যটি অর্থবহ হতো না। এজন্য ‘আছ ছুদুছু মা তরাকা’ বাক্যাংশ ব্যবহার করলে তা শুদ্ধ হতো না। তাই সকল শর্ত রক্ষা করে এ ধরনের ক্ষেত্রে ‘আছ ছুদুছু মিম্মা তারাকা’ ব্যবহৃত হয়েছে।  
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয় যে, ৪:১১, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত প্রতিটি আনুপাতিক ভগ্নাংশ সুনির্দিষ্ট ও সমমর্যাদার। কোনো আনুপাতিক ভগ্নাংশের পূর্বে ‘আল’ যুক্ত করা হোক বা না হোক, এবং সেটার পরে ‘মা তারাকা’ বা ‘মিম্মা তারাকা’ শব্দগুচ্ছ দুটির মধ্য থেকে যেটিই যুক্ত করা হোক বা কোনোটিই যুক্ত করা না হোক, সকল অবস্থায় তা আরবী ভাষারীতির সংশ্লিষ্ট যাবতীয় শর্ত পূরণ করে ব্যবহৃত হয়েছে এবং একই ধরনের অর্থকে ধারণ করেছে। 
১৯. ছুলুছাা, আছ ছুলুছানি (ثُلُثَا, الثُّلُثَانِ )
ফা-ইন কুন্না নিছাআন ফাওক্বাছনাতাইনি ফালাহুন্না ছুলুছাা মা তারাকা (৪:১১) 
ফা-ইন কানাতাছনাতাইনি ফালাহুমাছ ছুলুছানি মিম্মা তারাকা (৪:১৭৬) 
‘ছুলুছাা মা তারাকা’ বাক্যাংশে ‘ছুলুছানি’ না হয়ে ‘ছুলুছাা’ হওয়ার কারণ হচ্ছে তা ‘মা তারাকা’ এর সাথে সম্পর্কিত হয়ে নির্দিষ্ট হয়েছে এবং এরূপ অবস্থায় ‘নি’ বাদ পড়ে। কিন্তু ‘আছ ছুলুছানি মিম্মা তারাকা’ বাক্যাংশে ‘আছ ছুলুছানি’ শব্দ ‘আল’ শব্দাংশের মাধ্যমে নির্দিষ্ট হয়েছে এবং এখানে ‘মিন’ অব্যয়ের মাধ্যমে তা ‘মা তারাকা’ থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে বা তা কোনো শব্দের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে নির্দিষ্ট হয়নি। তাই এখানে ‘ছুলুছানি’ শব্দের ‘নি’ বাদ পড়েনি। সুতরাং ‘ছুলুছাা মা তারাকা’ অর্থ ‘যা তরক করে সেটার দুই তৃতীয়াংশ’ যা নির্দিষ্ট এবং ‘আছ ছুলুছানি মিম্মা তারাকা’ অথ ‘যা তরক করে তা থেকে দুই তৃতীয়াংশ’ যা নির্দিষ্ট। উভয়টি নির্দিষ্ট, কিন্তু দুটি দুই নিয়মে নির্দিষ্ট হয়েছে এবং ভিন্ন ভিন্ন নিয়মের কারণে একটি ‘ছুলুছাা’ এবং অন্যটিতে ‘ছুলুছানি’ হয়েছে। কিন্তু ‘ছুলুছাা’ এবং ‘ছুলুছানি’ উভয়ের অর্থ একই আর তা হলো ‘দুই তৃতীয়াংশ’। 
দুইয়ের অধিক কন্যার অংশ ‘ছুলুছাা’ তথা ‘দুই তৃতীয়াংশ’। যদি এখানে শেষে খালি আলিফ থাকা সত্ত্বেও তার পূর্ব দুই যবর থাকতো তথা ‘ছুলুছান’ হতো তাহলে এটি একবচন হিসেবে সাব্যস্ত হতো এবং এর অর্থ হতো ‘এক তৃতীয়াংশ’। কিন্তু শেষে ‘আলিফ’ এবং তার পূর্বের ‘ছা’ এর উপর এক যবর থাকার কারণে এর অর্থ হচ্ছে ‘দুই তৃতীয়াংশ’। ছুলুছাা এর মত শেষে শুধু আলিফ দ্বারা সমাপ্ত হওয়া দ্বিবচনের উদাহরণ রাসূলাা (২০:৪৭) যার অর্থ দুজন রাসূল। যেখানে ‘রসূলানি’ শব্দের পরিবর্তে ‘রসূলাা’ হয়েছে তা পরবর্তী শব্দের (রব্বিকা) সাথে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে। ‘রসূলাা রব্বিকা’ অর্থ ‘তোমার রবের দুজন রসূল’। ‘ছুলুছু’ এর দ্বিবচন তিনভাবে হতে পারে: ছুলুছাা, ছুলুছান, ছুলুছায়। আর কখনো কখনো এটি হতে পারে ছুলুছায়নি। 
৪:১১ আয়াতে ব্যবহৃত ‘ছুলুছাা’ শব্দটি যে ‘ছুলুছ’ (১/৩) এর দ্বিবচন (১/৩ + ১/৩) এবং ‘ছুলুছাা’ এর অর্থ যে ২/৩ এ বিষয়টি সাধারণ যৌক্তিকতা বিবেচনার মাধ্যমেও সহজ বোধগম্য। একটিমাত্র কন্যার জন ১/২  নির্ধারণ করা অথচ শুধু দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যার জন্য ১/৩   নির্ধারণ করা কোনো যুক্তিসিদ্ধ বণ্টন হয় না। সুতরাং দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যার জন্য উল্লেখিত ‘ছুলুছাা’ অর্থ  ১/৩  নয়, বরং এটি হলো দ্বিবচন তথা এর অর্থ হলো ২/৩  ।
এ বিষয়টি এত বিশদভাবে আলোচনা করার কারণ হলো কেউ কেউ এখানে একবচন ও দ্বিবচন এর পার্থক্য নির্ণয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব অনুভব করতে পারেন। বিশেষ করে ৪:১১ ও ৪:১২ আয়াতে ‘ছুলুছাা’ ও ‘ছুলুছানি’ দুটি ভিন্ন প্যাটার্নে থাকার কারণে এ দ্বিধাদ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে পারে। উভয়টি দ্বিবচন এবং এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। অর্থাৎ উভয়টির অর্থ একই আর তা হলো ‘দুই তৃতীয়াংশ’ (২/৩ )।

২০. ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ এর সাধারণ তাৎপর্য
উত্তরাধিকার বণ্টন বিধির অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হলো, ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ অর্থাৎ একজন পুরুষ পাবে দুজন নারীর অংশের মতো। 
মিছলু এর দুটি অর্থ হলো: (ক) সমান বা প্রায় সমান (খ) অনুরূপভাবে (যা ধরনগত মিল বুঝায়, পরিমাণগত সমতা নয়)। বক্তব্যের ধরন থেকে মিছলুন শব্দটি সমান অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে নাকি অনুরূপভাবে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা নির্ধারিত হবে। 
‘একজন পুরুষ পাবে দুজন নারীর অংশের মতো’ বাক্যটির ধরন অনুসারে দুজন নারীর অংশের যোগফল এবং একজন পুরুষের অংশ সমানুপাতিক তথা সমান। একজনের সাথে একজনের তুলনা না হয়ে একজনের সাথে দুজনের তুলনা হওয়ায় এখানে ‘সমান’ অর্থ বুঝাতে ‘মিছলু’ শব্দটি বাছাই করা হয়েছে। এছাড়া এখানে ‘মিছলু’ শব্দ বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রথমেই একটি সহজতা সৃষ্টি করা হয়েছে, তা হলো বন্টনের ক্ষেত্রে দশমিক পর্যায়ে যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বন্টন অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় সেক্ষেত্রে প্রায় সমান হয় এরূপ বন্টনই যথেষ্ট। 
পুত্র-কন্যার এবং ভাই-বোনের অংশ নির্ণয়ের সূত্র বিশ্লেষণ : (লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি)
পুত্র-কন্যার এবং ভাইবোনের অংশ নির্ণয়ের সূত্র লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ৪:১১ আয়াতে পুত্র-কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ বর্ণনার উপর ভিত্তি করে কৃত নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলো নিয়ে চিন্তা ভাবনা করলে এ বিষয়ে চমৎকার কিছু তথ্য আবিষ্কৃত হবে। প্রশ্নগুলো হলো:
- ৪:১১ আয়াতে কেন ‘ফাইন কুন্না নিছাআন ফাওক্বাছনাতাইনি’ বলা হলো? 
- কেন এখানে ‘নিছাআন’ বলতে হলো? 
- কেন এখানে ‘ফাওক্বাছনাতাইনি’ বলতে হলো? 
- তারপর কেন ‘ওয়া ইন কানাত ওয়াহিদাতান’ বলা হলো? 
- কেন এখানে ‘ইমরাআতুন’ বলা হলো না? 
- কেন এখানে ‘ওয়াহিদাতান’ বলতে হলো? 
- যদি শুধু দুজন নারী হয় তাদের বিষয়ে কেন সরাসরি কিছু বলা হলো না? 
- কেন এক বা একাধিক পুরুষ কত পাবে তা বলা হলো না? 
- কেন পুরুষ ও নারী একসাথে থাকলে তারা মোট কতটুকু পাবে তা বলা হলো না? 
উপর্যুক্ত প্রশ্নগুলোর প্রেক্ষিতে বর্ণনারীতির উপর গভীর মনোনিবেশ করলে কিছু বিশেষ তথ্য জানা যায়। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:
৪:১১ আয়াতে প্রথমে বলা হলো ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’। এ বক্তব্যের প্রাথমিক বিস্তৃতি/ পরিসর হলো ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ পর্যন্ত। এখানে ‘আয যাকার’ = একজন পুরুষ। কারণ তাকে তুলনা করা হয়েছে সুনির্দিষ্ট সংখ্যাসম্পন্ন নারীদের সাথে তথা ‘উনছায়ায়নি’ বা ‘দুজন নারীর’ সাথে। তাই এখানে ‘আয যাকার’ ≠ এক বা একাধিক পুরুষ। কিন্তু পরবর্তীতে ব্যবহৃত একবচন ‘ওয়ালাদ’ অর্থ ‘এক বা একাধিক পুত্র/ এক বা একাধিক কন্যা/ পুত্র-কন্যা’। পক্ষান্তরে ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম এর অব্যবহিত পরে এবং মূল ধারা হিসেবে লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি উল্লেখ করায় প্রথমে ‘ওয়ালাদ’ শব্দের পরিবর্তে ‘আওলাদ’ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়েছে। 
এরপর বলা হলো ‘ফাইন কুন্না নিছাআন ফাওক্বাছনাতাইনি ফালাহুন্না ছুলুছা মা তারাকা’। বাক্যটিতে ‘মা তারাকা’ শব্দের মাধ্যমে এ অংশটিকে ‘আওলাদিকুম’ এর ‘কুম’ থেকে বিচ্ছিন্ন করে মৃত ব্যক্তিকে Third Person Singular Number হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, ফলে এটি আওলাদ সম্পর্কিত মূল ধারার থেকে একটু ভিন্নমাত্রা লাভ করেছে। অর্থাৎ এটি মূল ধারার সাথে উপধারার মতো। এটি যে আওলাদ সম্পর্কিত ধারার অন্তর্ভুক্ত, ‘ফাইন কুন্না নিছাআন’ শব্দের মাধ্যমে তা স্পষ্ট হয়। এখানে ‘কুন্না’ দ্বারা কাদেরকে বুঝানো হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়। তা হলো, এখানে ‘কুন্না’ শব্দ দ্বারা পূর্বে থাকা ‘আওলাদ’কে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ এখানে ‘ফাইন কুন্না’ শব্দের তাৎপর্য হলো, যদি আওলাদ হিসেবে যারা থাকে তারা হয়। তারা কী হয়? ‘খবরে কানা’ (‘কানা’ ক্রিয়ার তথ্যটি) হলো, ‘নিসাআন’ তথা ‘নারীগণ’। এরপর দ্বিতীয় ‘খবরে কানা’ হলো ‘ফাওক্বাছনাতাইনি’। এখানে ‘ফাওক্বাছনাতাইনি’ তথা ‘দুই থেকে ঊর্ধ্বসংখ্যক/ দুই থেকে তদুর্ধ্ব’ শব্দ ব্যবহারের কারণ হলো, ‘নিসাআন’ বহুবচন, তাই বহুবচনের সাথে মিল রেখে বহুবচনকে মূল গুরুত্ব দিয়ে ফাওক্বাছনাতাইনি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। 
‘ফাওক্বাছনাতাইনি’ শব্দটি ব্যবহার করার মাধ্যমে নারী সংখ্যা যত বেশিই হোক না কেন তারা ২/৩  শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশকে পরস্পর সমান হারে ভাগ করে নেবে তথ্যটি নিশ্চিত হয়ে যায়। তাই এ শব্দটি ব্যবহার করার প্রয়োজন ছিল। আবার এর মাধ্যমে পূর্ববর্তী অংশে থাকা মূল ধারাটির ব্যাখ্যা হয়ে যায়, যাতে বলা হয়েছে, ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’, কিন্তু তারা কতটুকু অংশ পাবে তা সরাসরি বলা হয়নি। 
যেহেতু দুইয়ের বেশি নারী পাবে ২/৩  , তাই নারী-পুরুষ একসাথে পাবে ২/৩ । কারণ এক পুরুষকে দুই নারীর মতো বিবেচনা করা হবে। যদি শুধু এক বা একাধিক পুরুষ থাকে তাহলে তারা কতটুকু পাবে? উত্তর হলো ২/৩ । যেহেতু তারা দুই বা দুইয়ের বেশি নারীর মতো। 
সুতরাং ‘ফাইন কুন্না নিছাআন’ তথা ‘যদি আওলাদ হয় নারীগণ’ তারা যা পাবে (২/৩ ), আওলাদের জন্য তা-ই বরাদ্দ, তাদের আওতায় পুরুষ বা নারী এককভাবে বা সম্মিলিতভাবে যতসংখ্যকই থাকুক না কেন, যদি না কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যার জন্য আলাদাভাবে কোনো অংশ উল্লেখ করা হয়। 
পুত্র-কন্যার জন্য আনুপাতিক অংশের শেষ ধারা হিসেবে বলা হয়েছে ‘ফাইন কানাত ওয়াহিদাতান ...’। এ বাক্যে ‘কানাত’ এবং ‘ওয়াহিদাতান’ শব্দের মাধ্যমে দুটি বিষয় স্পষ্ট, তা হলো ‘আওলাদের আওতায় আছে একজনমাত্র নারী এবং তার সাথে কোনো পুরুষ নেই’। অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির সন্তান হিসেবে শুধু একটি কন্যা আছে এবং মৃত ব্যক্তির কোনো পুত্রও নেই। 
এখানে ‘ইমরাআত’ শব্দ ব্যবহার না করার কারণ পূর্বে ‘নিসাআন’ ব্যবহার করার কারণে ‘ইমরআত’ ব্যবহার করা ছাড়াই এ উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে গেছে। এরূপ অন্য একটি উদাহরণ হলো ৪:১৭৬ আয়াতে পূর্বে ‘উখতু’ ব্যবহার করার কারণে পরে ‘উখতায়ায়নি’ ব্যবহার করা ছাড়াই এ উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে গেছে। 
ফাইন কানাত ওয়াহিদাতান বাক্যে ‘ওয়াহিদাতান’ ব্যবহার করার কারণ ‘খবরে কানা’ (‘কানা’ ক্রিয়ার তথ্য) হিসেবে নারীটির সংখ্যাকে গুরুত্ব দেয়া। ‘ফাইন কুন্না নিসাআন ফাওক্বাছনাতাইনি’ বাক্যাংশে দুটি ‘খবরে কানা’, উভয়টির প্রয়োজন ছিল, একটি আওলাদের সাথে সম্পর্কিত কারণে, অন্যটি সংখ্যাগত বিষয়ে গুরুত্ব দেয়ার জন্য। যদিও ‘কানাত’ দ্বারা একবচন স্ত্রীলিঙ্গ, ‘কানাতা’ দ্বারা দ্বিবচন স্ত্রীলিঙ্গ, ‘কুন্না’ দ্বারা বহুবচন স্ত্রীলিঙ্গ বুঝায় তবু ‘খবরে কানা’ হিসেবে কোনো শব্দ ব্যবহার করা আরবি ভাষারীতির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য, এ বৈশিষ্ট্যগত কারণে এবং পূর্বাপর বক্তব্যের কিছু বিশেষ দিকের উপর গুরুত্ব আরোপের প্রয়োজনে আয়াতগুলোতে ‘নিসাআন’, ‘ফাওক্বাছনাতাইনি’, ‘ওয়াহিদাতান’ এবং ‘ইছনাতাইনি’ শব্দগুলোকে ‘খবরে কানা’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। 
যদি ‘ওয়া ইন কানাত ওয়াহিদাতান ফালাহান্নিসফু’ ধারাটি সংযোজিত না হতো তাহলে শুধু একটিমাত্র কন্যা থাকা অবস্থায় সেও ২/৩  অংশই পেতো এবং সেক্ষেত্রে পূর্বে বর্ণিত সকল ধারা ভিন্নভাবে উল্লেখ করতে হতো। 
‘এক পুত্র পাবে দুই নারীর অংশের মতো’ কথাটি গাণিতিকভাবে ‘এক পুত্র পাবে এক নারীর দ্বিগুণ’ কথাটির সমতুল্য হলেও ভাষাগত প্রকাশের দিক থেকে এখানে যে ভিন্নতা আছে তার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। প্রথমত এখানে নারীদের অংশকে পুরুষের অংশের সাথে তুলনা করে নির্ধারণ করা হয়নি বরং পুরুষের অংশকে নারীদের অংশের সাথে তুলনা করে নির্ধারণ করা হয়েছে। ৪:১৭৬ আয়াতেও নারীর অংশকে ভিত্তি বানানো হয়েছে। ‘এক পুরুষের অংশ দুই নারীর অংশের মতো’ বলায় পুত্র না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র কন্যা ১/২  পাওয়া এবং কন্যা ছাড়া একটিমাত্র পুত্র ২/৩  পাওয়া কোনো সাংঘর্ষিক ধারা নয়। 
৪:১১ ও ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত ‘এক পুরুষের জন্য দুই নারীর অংশের মতো সূত্রটি পুত্র-কন্যা ও ভাই-বোনের মধ্যে প্রযোজ্য এমন একটি সাধারণ সূত্র যা পুত্র-কন্যা মিলিতভাবে থাকুক বা বিচ্ছিন্নভাবে (তথা শুধু পুত্র বা শুধু কন্যাগণ) থাকুক, উভয় অবস্থায় প্রযোজ্য। ভাই-বোনদের ক্ষেত্রেও একই কথা। পার্থক্য হচ্ছে, একটিমাত্র কন্যা থাকলে (যখন পুত্র নেই) বা একটিমাত্র বোন থাকলে (যখন ভাই নেই) সে পাবে ১/২ , যা উল্লেখিত সূত্রের এক ধরনের ব্যতিক্রমসদৃশ হলেও পুরোপুরি ব্যতিক্রম নয়, কারণ সূত্রটিকে ‘এক পুরুষের জন্য এক নারীর দ্বিগুণ’ বা ‘এক নারীর জন্য এক পুরুষর অর্ধেক’ এভাবে উল্লেখ করা হয়নি।
৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত ‘সে (ভাই) তার (বোনটির) উত্তরাধিকার পাবে’ তথ্যটিতে ভাই কতটুকু অংশ পাবে তা সরাসরি উল্লেখ করা না হলেও পরবর্তী বাক্যের মাধ্যমে তা নির্ণিত হয়ে যায় যে, ভাই পাবে ঐ পরিমাণ যা ভাইটির পরিবর্তে দুই বোন থাকলে পায় তথা ভাই পাবে ২/৩ অংশ (শ্রেণিগত আনুপাতিক অংশ হিসেবে)। আয়াতটিতে বক্তব্য প্রসঙ্গ একটি ভাইয়ের সম্পদ বণ্টন থেকে শুরু করা হয়েছে বিধায় ‘ওয়া হুয়া ইয়ারিছুহা’ বলা হয়েছে। কিন্তু যদি বোনটির ভাইসংখ্যা এক ভাইয়ের তুলনায় একাধিক ভাই হয়, তবে সেক্ষেত্রেও তারা বোনটির উত্তরাধিকার পাবে তথা সেক্ষেত্রে ‘ওয়া হুম ইয়ারিছূহা’ (তারা/ ভাইয়েরা তার/বোনটির উত্তরসূরী হবে) তথ্যটি প্রযোজ্য হবে, যদিও তা আলাদাভাবে বলার প্রয়োজন নেই বিধায় আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়নি। এক্ষেত্রে এক ভাই থাকলে সে যে অংশ পায়, ভাইয়েরা যৌথভাবে সে অংশ পাবে। দুই ভাইয়ের অংশ মানে চার বোনের অংশ। অন্য কথায় দুই বোন যা পায় দুইয়ের বেশি বোনও তাই পায়। যদি এক ভাই এবং এক বোন থাকে তবে তারা একসাথে তা-ই পাবে শুধু দুই বোন থাকলে সে যা পায় এবং এক্ষেত্রে ঐ অংশটি ভাই-বোনের মধ্যে এভাবে বণ্টিত হবে যে, এক ভাই পাবে দুই বোনের অংশের মতো। অন্যভাবে বলা যায়, এক ভাই ও এক বোন একসাথে ২/৩ অংশ পাবে এবং তাতে আবার এক ভাই পাবে দুই বোনের অংশের মতো। 
৪:১১ আয়াতে এক বা একাধিক পুত্রের এবং পুত্র-কন্যা একসাথে থাকলে তাদের আনুপাতিক অংশ কত হবে তা নির্ণয়ের সূত্র লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে ৪:১৭৬ আয়াতে এক বা একাধিক ভাইয়ের এবং ভাই-বোন একসাথে থাকলে তাদের আনুপাতিক অংশ কত হবে তা নির্ণয়ের সূত্র লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি শেষে উল্লেখ করা হয়েছে। 

২১. ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ একটি সাধারণ ধারা নাকি শুধুমাত্র পুত্র-কন্যা ও ভাই-বোনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ধারা?
লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি বাক্যটিকে একটি সাধারণ সূত্র সাব্যস্ত করার যুক্তি
৪:১১ আয়াতে উল্লেখিত ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ (এক পুরুষের জন্য দুই নারীর অংশের মতো) বাক্যটিকে কেউ কেউ একটি সাধারণ সূত্র হিসেবে সাব্যস্ত করেন। নিম্নোক্ত যুক্তির ভিত্তিতে এটিকে একটি সাধারণ সূত্র হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়: 
‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ বাক্যের পরপরই প্রথমে বলা হয়েছে ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’। তারপর ৪:১১ ও ৪:১২ আয়াতে এটি আর পুনরুল্লেখিত হয়নি। ৪:১১ আয়াতে পুত্র-কন্যা ও পিতা-মাতার অংশ বলার পর ৪:১২ আয়াতে স্বামী-স্ত্রী ও ভাই-বোনের অংশ বলা হয়েছে। ৪:১২ আয়াত ‘ওয়া’ (এবং) দিয়ে শুরু হয়েছে যা প্রমাণ করে যে, এটি ৪:১১ আয়াতের সাথে সম্পর্কিত। ৪:১৩ আয়াতে বলা হয়েছে ‘তিলকা হুদুদুল্লাহ’ (এটি আল্লাহর সীমা)। এখানে ‘তিলকা’ শব্দ দ্বারা ৪:১১ ও ৪:১২ আয়াতকে একসাথে সংযুক্ত করে একটি একক বক্তব্য হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুতরাং ৪:১১ আয়াতে প্রথমে বলে নেয়া ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ হচ্ছে একটি সাধারণ নিয়ম, যা ৪:১১ ও ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত সকল অনুল্লেখিত ওয়ারিসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু ৪:১৭৬ আয়াত ‘ওয়া’ দ্বারা সংযুক্ত না হওয়ায় তা ৪:১৭৫ আয়াতের সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং তা একটি একক বক্তব্য, যা সূরা নিসার শেষে পরিশিষ্ট আকারে রয়েছে। ৪:১৭৬ আয়াত ৪:১১ ও ৪:১২ আয়াত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় তাতে শেষদিকে আবার ‘লিয যাকারি হাযযিল উনছায়ায়নি’ বলে দেয়া হয়েছে, যাতে কোনো অস্পষ্টতা না থাকে। আর তাই এর পরপরই বলা হয়েছে ‘ইউবায়্যিনু লাকুম আন তাদিল্লূ’ (আল্লাহ তোমাদের কাছে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন পাছে তোমরা বিভ্রান্ত হবে)। এ কারণে ৪:১২ আয়াত অনুসারে যখন একাধিক ভাই-বোন ১/৩  অংশে শরিক হবে তখন তাদের মধ্যেও পুরুষ : নারী = ২ : ১ সূত্রটি প্রয়োগ করতে হবে। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, সর্বত্র নারীর অংশ স্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে, কিন্তু সর্বত্র পুরুষের অংশ উল্লেখ করা হয়নি। সুতরাং যে যে ক্ষেত্রে পুরুষের অংশ উল্লেখ করা হয়নি সে সে ক্ষেত্রে পুরুষটি কোনো নারীর সাথে অংশীদার হলে তার দ্বিগুণ পাবে এবং কোনো পুরুষের সাথে অংশীদার হলে উভয় পুরুষ পরস্পরের সমান পাবে। 
পর্যালোচনা
৪:১১ আয়াতে বর্ণিত ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ বা ‘এক পুরুষের জন্য দুই নারীর অংশের মতো’ বাক্যটি কি যেকোনো নারী পুরুষের জন্য প্রযোজ্য? অর্থাৎ এটি কি পুত্র ও কন্যা, পুত্র ও মাতা, পুত্র ও স্ত্রী, পুত্র ও বোন, পিতা ও কন্যা, পিতা ও মাতা, পিতা ও স্ত্রী, পিতা ও বোন, স্বামী ও কন্যা, স্বামী ও মাতা, স্বামী ও বোন, ভাই ও কন্যা, ভাই ও মাতা, ভাই ও স্ত্রী, ভাই ও বোন এই সকল অবস্থায় প্রযোজ্য? যদি ‘একটি পুরুষ পাবে দুজন নারীর সমান’ কথাটি একটি সাধারণ নিয়ম হয়, তবে এর অর্থ হচ্ছে দুজন পুরুষ পরস্পরের সমান পাবে এবং দুজন নারী পরস্পরের সমান পাবে’। যেমন, পুত্র ও পিতা, পুত্র ও স্বামী, পুত্র ও ভাই, পিতা ও স্বামী, পিতা ও ভাই, স্বামী ও ভাই, কন্যা ও মাতা, কন্যা ও স্ত্রী, কন্যা ও বোন, মাতা ও স্ত্রী, মাতা ও বোন পরস্পরের সমান পাওয়ার কথা। 
‘এক পুরুষের জন্য দুই নারীর অংশের মতো’ এটি একটি সাধারণ নিয়ম কিনা তথা এটি যেকোনো নারী পুরুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিনা, এই প্রশ্নের সমাধান হলে এর সাথে সম্পর্কিত নিচের প্রশ্নগুলোর সমাধান পাওয়া যাবে। যথা :  
(ক) যখন পুত্র সন্তান না থাকা অবস্থায় একটি কন্যা সন্তান থাকে, তখন ঐ কন্যা পায় ১/২ , পিতা পায় ১/৬  , মাতা পায় ১/৬ । এখানে প্রথমত পিতা কন্যার চেয়ে তথা ১ জন নারীর চেয়ে কম পাচ্ছে এবং মাতার সমান তথা ১ জন নারীর সমান পাচ্ছে। আবার এ অবস্থায় কন্যা ও মাতা উভয়ে নারী হওয়া সত্ত্বেও একজন অন্যজনের তুলনায় বেশি পাচ্ছে। এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম? মাতা পিতার সাথে যখন দুইয়ের বেশি কন্যা অংশীদার হয় তখন কন্যারা একত্রে পায় ২/৩ যাতে প্রত্যেক কন্যার অংশ কত হবে তা কন্যাদের সংখ্যার উপর নির্ভর করে (যেমন কন্যা সংখ্যা ৩ না ৪ না ৫ ইত্যাদি)। এ অবস্থায়ও প্রত্যেক নারীর (মা ও মেয়ের) পারস্পরিক অংশ সমান হয় না এবং পুরুষের অংশ দুজন নারীর অংশের সমান হয় না। এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম?
(খ) যখন পিতার সাথে ১ টি পুত্র ও ২ টি কন্যা অংশীদার হয় তখন ঐ পুত্র-কন্যার সম্মিলিত অংশ কতটুকু? তারা কি পিতার অংশের পর অবশিষ্ট সম্পদে তথা ৫/৬ ভাগ সম্পদে পুরুষ : নারী = ২ : ১ এভাবে পাবে? নাকি পিতা পাবে ১/৬, পুত্র পাবে ১/৬ এবং ২ কন্যার প্রত্যেকে পাবে ১/১২? যদি তা হয়, তাহলে যখন পুত্র না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র কন্যা পিতার সাথে অংশীদার হয় সে কিভাবে ১/১২ না পেয়ে ১/২   পেতে পারে? এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম? 
অন্যদিকে যখন মাতার সাথে ১ টি পুত্র ও ২ টি কন্যা অংশীদার হয় তখন ঐ পুত্র-কন্যার সম্মিলিত অংশ কতটুকু? তারা কি মাতার অংশের পর অবশিষ্ট সম্পদে তথা ৫/৬ ভাগ সম্পদে পুরুষ : নারী = ২ : ১ এভাবে পাবে? নাকি মাতা পাবে ১/৬ , পুত্র পাবে ১/৩   এবং ২ কন্যার প্রত্যেকে পাবে ১/৬  ? যদি তা হয়, তাহলে যখন পুত্র না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র কন্যা মাতার সাথে অংশীদার হয় সে কিভাবে ১/৬  না পেয়ে ১/২   পেতে পারে? এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম? 
(গ) কন্যা না থাকা অবস্থায় এক বা একাধিক পুত্র থাকলে তাদের অংশ কিভাবে নির্ধারিত হবে? তারা কি তাদের সাথে কোনো পুরুষ অংশীদার থাকলে তার সমতুল্য অংশ পাবে? যেমন যদি দুই পুত্র ও পিতা থাকে তাহলে পিতা পাবে ১/৬  এবং দুই পুত্রের প্রত্যেকে পাবে ১/৬ ? অনুরূপভাবে যদি দুই পুত্র ও মাতা থাকে তাহলে কি পুরুষ নারীর দ্বিগুণ পাওয়ার সূত্রমতে, মাতা পাবে ১/৬  এবং দুই পুত্রের প্রত্যেকে পাবে ১/৩  ? 
(ঘ) ৪:১৭৬ আয়াত অনুযায়ী যখন ভাই না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র বোন থাকে, তখন ঐ বোন পায়  ১/২ । তার সাথে মৃতের স্বামী থাকলে সে পায় ১/৪  । এখানে দেখা যায় ১ টি নারী ১ টি পুরুষের দ্বিগুণ পাচ্ছে। এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম? আর বোনটির সাথে যদি মৃতের স্ত্রী থাকে তবে বোন পায় ১/২  , স্ত্রী পায় ১/৮  । এ অবস্থায় বোন ও স্ত্রী উভয়ে নারী হওয়া সত্ত্বেও একজন অন্যজনের তুলনায় বেশি পাচ্ছে। এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম? আবার যদি এ অবস্থায় দুই বোন থাকে তারা পায় ২/৩   তথা প্রত্যেক বোন পায় ১/৩  , আর তাদের সাথে মৃতের স্বামী থাকলে সে পায় ১/৪  , অন্যদিকে তাদের সাথে মৃতের স্ত্রী থাকলে সে পায় ১/৮  । এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম? 
(ঙ) ৪:১৭৬ আয়াত অনুযায়ী ভাই তার বোনের ওয়ারিস হবে। কিন্তু কতটুকু অংশের ওয়ারিস হবে? ভাই কি তার সাথে থাকা পুরুষ অংশীদারের সমান ওয়ারিস হবে? যেমন ভাই ও স্বামী ওয়ারিস হলে, স্বামী পাবে ১/৪  এবং ভাই পাবে ১/৪  ? অথবা নারী অংশীদারের দ্বিগুণ পাবে যেমন ভাই ও স্ত্রী ওয়ারিস হলে, স্ত্রী পাবে ১/৮ , ভাই পাবে ১/৪  ? 
(চ) ৪:১৭৬ আয়াত অনুযায়ী যদি ১ ভাই ও ২ বোন এবং স্বামী থাকে, তাহলে ভাই-বোন কতটুকু করে পাবে? তারা কি স্বামীর অংশের পর অবশিষ্ট সম্পদে তথা ৩/৪  ভাগ সম্পদে পুরুষ : নারী = ২ : ১ এভাবে পাবে? নাকি স্বামী পাবে ১/৪ , ভাই পাবে ১/৪  এবং ২ বোনের প্রত্যেকে পাবে ১/৮  ? যদি তা হয়, তাহলে ভাই না থাকা অবস্থায়, ১ টি মাত্র বোন মৃতের স্বামীর সাথে অংশীদার হয় সে কিভাবে ১/৮  না পেয়ে ১/২ পায়? এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম? 
অন্যদিকে, ৪:১৭৬ আয়াত অনুযায়ী যদি ১ ভাই ও ২ বোন এবং স্ত্রী থাকে, তাহলে ভাই বোন কতটুকু করে পাবে? তারা কি স্ত্রীর অংশের পর অবশিষ্ট সম্পদে তথা ৭/৮  ভাগ সম্পদে পুরুষ : নারী = ২ : ১ এভাবে পাবে? নাকি স্ত্রী পাবে ১/৮ , ভাই পাবে ১/৪  এবং ২ বোনের প্রত্যেকে পাবে ১/৮  ? যদি তা হয়, তাহলে ভাই না থাকা অবস্থায়, ১ টি মাত্র বোন মৃতের স্বামীর সাথে অংশীদার হয় সে কিভাবে ১/৮  না পেয়ে ১/২  পায়? এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম? 
(ছ) মৃতের ওয়ারিস যদি হয় পুত্র না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র কন্যা ও স্বামী। তাহলে কন্যা পায় ১/২  এবং স্বামী পায় ১/৪ । এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম? 
মৃতের ওয়ারিস যদি হয় পুত্র না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র কন্যা ও স্ত্রী। তাহলে কন্যা পায় ১/২  এবং স্ত্রী পায় ১/৮ । এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম? 
(জ) মৃতের ওয়ারিস পুত্র না থাকা অবস্থায় দুইয়ের বেশি বোন এবং স্বামী হলে তখন কন্যারা একত্রে পায় ২/৩   যাতে প্রত্যেক কন্যার অংশ কত হবে তা কন্যাদের সংখ্যার উপর নির্ভর করে (যেমন কন্যা ৩ না ৪ না ৫ ইত্যাদি)। আর স্বামী পায় ১/৪  । এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম? 
মৃতের ওয়ারিস পুত্র না থাকা অবস্থায় দুইয়ের বেশি বোন এবং স্ত্রী হলে তখন কন্যারা একত্রে পায় ২/৩  যাতে প্রত্যেক কন্যার অংশ কত হবে তা কন্যাদের সংখ্যার উপর নির্ভর করে (যেমন কন্যা ৩ না ৪ না ৫ ইত্যাদি)। আর স্ত্রী পায় ১/৮ । এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম? 
(ঝ) যখন স্বামীর সাথে ১ টি পুত্র ও ২ টি কন্যা অংশীদার হয় তখন ঐ পুত্র-কন্যার সম্মিলিত অংশ কতটুকু? তারা কি স্বামীর অংশের পর অবশিষ্ট সম্পদে তথা ৩/৪   ভাগ সম্পদে পুরুষ : নারী = ২ : ১ এভাবে পাবে? নাকি স্বামী পাবে ১/৪  , পুত্র পাবে ১/৪   এবং ২ কন্যার প্রত্যেকে পাবে ১/৮  ? যদি তা হয়, তাহলে যখন পুত্র না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র কন্যা স্বামীর সাথে অংশীদার হয় সে কিভাবে ১/৮  না পেয়ে ১/২  পেতে পারে? এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম? 
অন্যদিকে যখন স্ত্রীর সাথে ১ টি পুত্র ও ২ টি কন্যা অংশীদার হয় তখন ঐ পুত্র-কন্যার সম্মিলিত অংশ কতটুকু? তারা কি স্ত্রীর অংশের পর অবশিষ্ট সম্পদে তথা ৭/৮   ভাগ সম্পদে পুরুষ : নারী = ২ : ১ এভাবে পাবে? নাকি স্ত্রী পাবে ১/৮ , পুত্র পাবে ১/৪  এবং ২ কন্যার প্রত্যেকে পাবে ১/৮  ? যদি তা হয়, তাহলে যখন পুত্র না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র কন্যা স্ত্রীর সাথে অংশীদার হয় সে কিভাবে ১/৮  না পেয়ে ১/২   পেতে পারে? এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম? 
(ঞ) কন্যা না থাকা অবস্থায় এক বা একাধিক পুত্র থাকলে তাদের অংশ কিভাবে নির্ধারিত হবে? তারা কি তাদের সাথে কোনো পুরুষ অংশীদার থাকলে তার সমতুল্য অংশ পাবে? যেমন যদি দুই পুত্র ও স্বামী থাকে তাহলে স্বামী পাবে ১/৪   এবং দুই পুত্রের প্রত্যেকে পাবে ১/৪  ? অনুরূপভাবে যদি দুই পুত্র ও স্ত্রী থাকে তাহলে কি পুরুষ নারীর দ্বিগুণ পাওয়ার সূত্রমতে, স্ত্রী পাবে ১/৮  এবং দুই পুত্রের প্রত্যেকে পাবে ১/৪  ? 
(ট) ওয়ারিস হচ্ছে পিতা, মাতা ও স্বামী। তাহলে স্বামী পাবে ১/৪ , মাতা পাবে ১/৩ । এখন পিতা কি স্বামীর সমান তথা ১/৪  পাবে? পিতার অংশ অনুল্লেখিত থাকায় যদি স্বামীর অংশের সাথে মাতার অংশের তুলনা করা হয়, তাহলেও দেখা যায় পুরুষ নারীর তুলনায় কম পাচ্ছে। এটা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম? 
ওয়ারিস হচ্ছে পিতা, মাতা ও স্ত্রী। তাহলে স্ত্রী পাবে ১/৮ , মাতা পাবে ১/৩ । এখন পিতা কি মাতার দ্বিগুণ পাবে না স্ত্রীর দ্বিগুণ পাবে? এখানে দেখা যায় দুই নারীর একজনের তুলনায় অন্যজন কম বেশি পাচ্ছে। এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম? 
(ঠ) ওয়ারিস হচ্ছে কয়েকজন ভাই থাকা অবস্থায় পিতা, মাতা ও স্বামী। তাহলে স্বামী পাবে ১/৪ , মাতা পাবে ১/৬  । এখন পিতা কি স্বামীর সমান তথা ১/৪   পাবে? নাকি মাতার দ্বিগুণ তথা ১/৩   পাবে? 
ওয়ারিস হচ্ছে কয়েকজন ভাই থাকা অবস্থায় পিতা, মাতা ও স্ত্রী। তাহলে স্ত্রী পাবে ১/৮ , মাতা পাবে ১/৬ । এখন পিতা কি মাতার দ্বিগুণ পাবে না স্ত্রীর দ্বিগুণ পাবে? এখানে দেখা যায় দুই নারীর একজনের তুলনায় অন্যজন কম বেশি পাচ্ছে। এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম? 
উপরিউক্ত সমস্যাগুলোর পর্যালোচনার মাধ্যমে বলা যায়, এটি একটি সাধারণ নিয়ম হলে এই একটি নিয়মের মাধ্যমেই বিধান সমাপ্ত হয়ে যেতে পারত এবং এক্ষেত্রে শুধু ওয়ারিস কে কে হবে তাদের তালিকা (পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, স্বামী/ স্ত্রী, ভাই, বোন) উল্লেখ করলে এবং কার উপস্থিতিতে কে বঞ্চিত হবে তা জানিয়ে দিলেই যথেষ্ট হতো। 
এমতাবস্থায় সূত্রটিকে ওয়ারিসদের মধ্যে একটি সর্বজনীনভাবে গৃহীত সূত্র সাব্যস্ত করার পক্ষে বলা যেতে পারে, এটি একটি সাধারণ নিয়ম, কিন্তু এর অনেক ব্যতিক্রম রয়েছে। তাই বিভিন্ন ওয়ারিসের প্রাপ্য সম্পর্কে যা বলা হয়েছে সেসব ক্ষেত্রে এটি খাটবে না, শুধু যার অংশ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি (এক বা একাধিক পুত্র, পুত্র-কন্যা, সন্তান ও ভাই-বোন না থাকা অবস্থায় পিতা, সন্তান না থাকা কিন্তু ভাই-বোন থাকা অবস্থায় পিতা, ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত একাধিক ভাই বা একাধিক বোন বা ভাই-বোন, ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত এক বা একাধিক ভাই, এবং ভাই-বোন) শুধু তাদের ক্ষেত্রে সাধারণ সূত্রটি প্রযোজ্য হবে আর যাদের অংশ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোতে সাধারণ সূত্রের সাথে যে ব্যাতিক্রম পাওয়া যায় তা ব্যাতিক্রম হিসাবেই সাব্যস্ত হবে। 
এ দাবির পর্যালোচনায় বলা যায়, যাদের অংশ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি তাদের ক্ষেত্রে এই সাধারণ সূত্র প্রযোজ্য ধরলেও প্রশ্ন দেখা দেয়। যেমন, ওয়ারিস হচ্ছে কয়েকজন ভাই থাকা অবস্থায় পিতা, মাতা ও স্ত্রী। তাহলে স্ত্রী পাবে ১/৮ , মাতা পাবে ১/৬ । এখন পিতা কি মাতার দ্বিগুণ পাবে না স্ত্রীর দ্বিগুণ পাবে? 
সূত্রটিকে ওয়ারিসদের মধ্যে একটি সর্বজনীনভাবে গৃহীত সূত্র সাব্যস্ত করার পক্ষে পরিশেষে বলা যেতে পারে, এটি শ্রেণি-ভিত্তিক প্রযোজ্য সূত্র, যেমন: পুত্র-কন্যা এক শ্রেণি, পিতা-মাতা এক শ্রেণি, স্বামী/স্ত্রী এক শ্রেণি এবং ভাই-বোন এক শ্রেণি। পিতা ও মাতা এক গ্রুপ, স্ত্রী ভিন্ন গ্রুপ, তাই পিতা মাতার দ্বিগুণ পাবে, স্ত্রীর দ্বিগুণ নয়। 
এ দাবির পর্যালোচনায় বলা যায়, তাহলেও সমস্যা থেকে যায়। যেমন: যদি পুত্র, মা ও স্ত্রী থাকে তাহলে পুত্র কার দ্বিগুণ পাবে? মায়ের না স্ত্রীর? এক্ষেত্রে তো মা ও স্ত্রী কেউই পুত্রের গ্রুপে পড়ে না। তবে কি পুত্র অবশিষ্টাংশ পাবে? অথচ অবশিষ্টাংশের ধারণা গ্রহণযোগ্য হলে পিতার ক্ষেত্রেও তা গ্রহণ করা যেতে পারে। এ অবস্থায়, এক পুরুষ পাবে দুই নারীর অংশের সমান, ধারাটি সাধারণ ধারায় পরিণত হয় না। 
তথ্যগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রকৃত সমাধান নির্ণয়
৪:১১ আয়াতের বক্তব্য শুরু হয়েছে ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ বাক্যের মাধ্যমে। তার পরপরই বলা হয়েছে ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’। এরপর বলা হয়েছে, ‘ফা-ইন কুন্না নিছাআন ফাওক্বাছনাতাইনি ফালাহুন্না ছুলুছাা মা তারাকা, ওয়া ইন কানাত ওয়াহিদাতান ফালাহান নিসফু’। এর মধ্য দিয়ে আওলাদের প্রাপ্য অংশ বর্ণনা শেষ হয়ে গেছে। এর পরপরই বলা হয়েছে ‘ওয়া লিআবাওয়ায়হি .............’ তথা আওলাদের অংশের পর পিতা-মাতার অংশ বলা হয়েছে। সুতরাং ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ বাক্যে ‘আওলাদ’ প্রসঙ্গে আল্লাহ যে ওয়াসিয়াতের কথা বলেছেন তা ‘ওয়া লিআবাওয়ায়হি’ বাক্যাংশের পূর্বেই শেষ হয়েছে। অন্য কথায় ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ বাক্যের পরিসীমা হচ্ছে ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি, ফা-ইন কুন্না নিছাআন ফাওক্বাছনাতাইনি ফালাহুন্না ছুলুছা মা তারাকা, ওয়া ইন কানাত ওয়াহিদাতান ফালাহান নিসফু’। অন্য কথায়, ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ বাক্যটি কোনো সাধারণ নিয়ম নয়, বরং এটি ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ বাক্যের সাথে সুনির্দিষ্টভাবে জড়িত তথা আওলাদের মধ্যকার এক পুরুষের জন্য আওলাদের মধ্যকার দুই নারীর অংশের মতো। এটি যে আওলাদের প্রসঙ্গে সুনির্দিষ্ট তার প্রমাণ হচ্ছে ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ বলার পর আওলাদের অংশ বর্ণনার মধ্যেই এটি বলা হয়েছে। এছাড়া ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ বলার পর এ বাক্যটি উল্লেখ করে তারপর নারীদের তথা আওলাদের অন্তর্ভুক্ত নারীদের অংশ বর্ণনা শুরু করা হয়েছে ‘ফা-ইন কুন্না নিছাআন’ শব্দগুচ্ছের মাধ্যমে, যা প্রমাণ করে যে, ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ বাক্যাংশটি এর পূর্ববর্তী ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ এবং এর পরবর্তী ‘ফা-ইন কুন্না নিছাআন’ বাক্যাংশ দুটির মধ্যবর্তী এমন বক্তব্য যা এ দুটি বক্তব্যের সাথে সুনির্দিষ্টভাবে জড়িত। যদি এটি এমন একটি সাধারণ নিয়ম হতো যা পুত্র-কন্যার পাশাপাশি পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তাহলে এ বাক্যাংশটি ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ এর পরপর এবং সেটার পরিসরের ভিতরে বলা হতো না, বরং সেক্ষেত্রে এ আয়াতটি ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ এর মাধ্যমে শুরু না করে অন্যভাবে শুরু করা হতো, যাতে ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ বাক্যাংশের আগেই ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ বলে নেয়া হতো। 
৪:১১ ও ৪:১২ আয়াত একটির সাথে অন্যটি সংযুক্ত। কারণ ৪:১১ আয়াতে উত্তরাধিকারের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে এবং পুত্র-কন্যা ও পিতা-মাতার অংশ বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু ৪:১২ আয়াতে উত্তরাধিকারের বিধান বর্ণনার ধারাবাহিকতায় স্বামী-স্ত্রী ও ভাই-বোনের অংশ বলা হয়েছে। এভাবে ৪:১১ ও ৪:১২ উভয়টি মিলে যে একক (Unit), সেটাকে ৪:১৩ আয়াতে ‘তিলকা হুদুদুল্লাহ’ (এটা আল্লাহর নির্ধারিত সীমা) বলা হয়েছে। ৪:১২ আয়াত যেমন ‘ওয়া’ দিয়ে শুরু হয়েছে তথা ‘ওয়া’ দিয়ে স্বামীর অংশ বর্ণনা করা শুরু করা হয়েছে তেমনি এর পূর্বে ৪:১১ আয়াতে পিতা-মাতার অংশও ‘ওয়ালিআবাওয়ায়হি’ তথা ‘ওয়া’ দিয়ে শুরু করা হয়েছে এবং এর পর তথা স্বামীর অংশের পর ৪:১২ আয়াতে স্ত্রীর অংশও ‘ওয়া’ দিয়ে শুরু করা হয়েছে, এমনকি ভাই বোনের অংশ যেহেতু তারা কালালাহর ভাই-বোন হওয়ার প্রেক্ষিতে পায় তাই কালালাহর প্রসঙ্গও ‘ওয়া’ দিয়ে শুরু করা হয়েছে। সুতরাং পুত্র-কন্যার অংশ প্রথমে বলা হয়েছে এবং তারপর পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন সবার অংশ ‘ওয়া’ দিয়ে শুরু করে সবার অংশকে একই বক্তব্যে যুক্ত করা হয়েছে। সুতরাং ৪:১২ আয়াত ‘ওয়া’ দিয়ে শুরু হওয়ার হওয়ার উপর ভিত্তি করে ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ বাক্যাংশটিকে একটি সাধারণ নিয়ম হিসাবে সাব্যস্ত করা যথাযথ যুক্তিযুক্ত হবে না। বরং ৪:১২ আয়াতটি ‘ওয়া’ দিয়ে শুরু হওয়া সত্ত্বেও ৪:১১ আয়াতে উল্লেখিত ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ বাক্যাংশটি শুধুমাত্র আওলাদের প্রসঙ্গে প্রযোজ্য। 
৪:১৭৬ আয়াতে পুনরায় ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ বলা হয়েছে। এর কারণ হলো, ৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোন পাচ্ছে পুত্র-কন্যার অবর্তমানে এবং তাদের জন্য পুত্র-কন্যার সমানুপাতিক অংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই ভাই-বোনের মধ্যকার এক পুরুষ পাবে ভাই-বোনের মধ্যকার এক নারীর অংশের মতো। 
অন্যদিকে ৪:১২ আয়াতে ভাই-বোনের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, ফা-ইন কানূ আকছারা মিন যালিকা ফাহুম শুরাকা-উ ফিছ ছুলুছি তথা ‘যদি ভাই-বোন একাধিক হয় তাহলে তারা ১/৩  অংশে শরিক হবে’। এখানে ১ ভাই : ১ বোন = ১ : ১। কারণ এক্ষেত্রে বোনের জন্য কোনো আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করে ভাইয়ের আনুপাতিক অংশ অনুল্লেখিত রাখা হয়নি বরং ভাই-বোন উভয়ের অংশ অনুল্লেখিত রাখা হয়েছে। তাই তারা উভয়ে পরস্পরের সমানুপাতে পাবে। অন্যভাবে বলা যায়, ৪:১২ আয়াতে ভাই-বোন একসাথে থাকা অবস্থায় তাদের অংশকে ২:১ আকারে উল্লেখ করা হয়নি বিধায় তারা পরস্পর সমানুপাতে পাবে। ৪:১২ আয়াত অনুযায়ী শুধু ভাই বা শুধু বোন থাকলে সে ১/৬ পাবে তথা এক্ষেত্রে ভাই বা বোন ভিন্ন অনুপাতে পাবে না। অনুরূপ উদাহরণ দেখা যায়, ৪:১১ অনুযায়ী পুত্র-কন্যা থাকা অবস্থায় পিতা ও মাতা পরস্পর সমানুপাতে পায় তথা উভয়ের প্রত্যেকে ১/৬  পায় কিন্তু পুত্র-কন্যা না থাকলে তাদের পারস্পরিক অনুপাতে হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে। 
এ পর্যায়ে বিবেচ্য প্রশ্ন হলো, যদি লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি ধারাটি শুধু পুত্র-কন্যার ক্ষেত্রে এবং ভাই-বোনের  ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ধারা হয়, তাহলে পুত্র-কন্যা ও ভাই-বোন শব্দের পরিবর্তে পুরুষ ও নারী শব্দ ব্যবহার করার কারণ কী হতে পারে? এর যে কারণ বুঝা যায় তা নিম্নরূপ:
১. যেন উভয় স্থানে একই সূত্র প্রয়োগ করা যায়। 
২. পুরুষ ও নারী শব্দ প্রয়োগ করলেও কাদের প্রসঙ্গে শব্দটি উল্লেখ করা হচ্ছে সে প্রসঙ্গ কাঠামো পূর্বেই আওলাদ এবং ইখওয়াত শব্দের মাধ্যমে সেট করা হয়েছে।
লক্ষণীয় যে, ধারাটির ক্ষেত্রে ‘যাকার’ ও ‘উনছা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, ‘রজুল’ ও ‘ইমরাআত’ শব্দ নয়। ‘যাকার’ ও ‘উনছা’ শব্দ সাধারণভাবে পুরুষ লোক ও নারী লোক বুঝায় না, বরং প্রসঙ্গ কাঠামোর মধ্য থেকে একেকটি লিঙ্গগত (Gender based) গ্রুপকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। 
আরো লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম শব্দের দুটি ব্যাপ্তি আছে। প্রাথমিক ব্যাপ্তি হচ্ছে, ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ এবং এর চূড়ান্ত ব্যাপ্তি হচ্ছে ‘............ ফালাহান নিসফু’ পর্যন্ত। এরপর ‘ওয়া লিআবাওয়ায়হি’  থেকে আরো বিভিন্নজনের উত্তরাধিকার বন্টন বিধি সংযোজন করা হয়েছে কিন্তু তা ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ এর ব্যাপ্তিকে ছাড়িয়ে গেছে। 
৪:১১ আয়াতে বর্ণিত ‘লিয যাকারি হাযযিল উনছায়ায়নি’ বাক্যটিকে ৪:১৭৬ আয়াতে পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। এই পুনরাবৃত্তি দুটি তথ্যগত সিদ্ধান্ত গঠনে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে। একটি হলো, এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে, ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত ভাই-বোনের অংশ হলো ৪:১১ আয়াতে বর্ণিত পুত্র-কন্যার অংশের সমতুল্য এবং এর একটি অপরটিকে ব্যাখ্যা করে। অন্যটি হলো, ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত ‘ওয়া হুয়া ইয়ারিছুহা’ বাক্যে বর্ণিত ভাই তার বোনের উত্তরাধিকারী হওয়ার ক্ষেত্রে ভাইয়ের শ্রেণিগত আনুপাতিক অংশ কত হবে তা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এ বাক্যটিই সমাধানসূত্র হিসেবে কাজ করে।
উপরিউক্ত তথ্যগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি (এক পুরুষের জন্য দুই নারীর অংশের অনুরূপ) বাক্যটি হলো শুধুমাত্র পুত্র-কন্যা ও ভাই-বোনের মধ্যে প্রযোজ্য সূত্র।
২২. ‘যাদের অংশ অনুল্লেখিত তারা অবশিষ্টাংশ পাবে’ মতের ভিত্তিতে পুত্র-কন্যা ও ভাই-বোনের প্রাপ্য অংশ নির্ধারণের পর্যালোচনা
৪:১১ আয়াতে দুই কন্যার ও ৪:১৭৬ আয়াতে দুইয়ের বেশি বোনের প্রাপ্য অংশ অনুল্লেখিত। অথচ ৪:১১ আয়াতে বলা হয়েছে এক পুত্র পাবে দুই কন্যার সমান অংশ। একটি মতে, ‘দুই কন্যার অংশও অনুল্লেখিত’। দুই কন্যার অংশ জানা না থাকলে এক পুত্রের অংশও অজানা থেকে যায়। এক্ষেত্রে একটি অভিমত হলো, যাদের অংশ অনুল্লেখিত তারা পাবে অবশিষ্টাংশ। কিন্তু এটি কি যৌক্তিক হতে পারে যে, যখন পিতা বা মাতা দুজনের একজন জীবিত নেই, তখন এক পুত্র বা দুই কন্যা অবশিষ্টভোগী হিসেবে পাবে ছয় ভাগের পাঁচ ভাগ ( ৫/৬   )  এবং সেক্ষেত্রে কন্যার সংখ্যা দুইয়ের বেশি হলে তাদের জন্য তিনভাগের দুই ভাগই (২/৩   ) নির্ধারিত থাকবে? 
এছাড়া, ৪:১৭৬ আয়াত অনুসারে বন্টনের ক্ষেত্রে বোনের সংখ্যা দুইয়ের বেশি হলে তারা কতটুকু পাবে তাও সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। সেই সাথে ৪:১১ আয়াতে পুত্রের ও ৪:১৭৬ আয়াতে ভাইয়ের প্রাপ্য অংশও সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। 
সুতরাং ৪:১১ আয়াতে থাকা ‘এক পুরুষ পাবে দুই নারীর সমান’ সূত্রটি পুত্র-কন্যার ক্ষেত্রে একটি সাধারণ সূত্র যা পুত্র-কন্যা মিলিতভাবে থাকলেও প্রযোজ্য এবং পুত্র-কন্যার মধ্য থেকে যেকোনো একটির উপস্থিতিতেও প্রযোজ্য। 
৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোন মিলিতভাবে থাকা অবস্থার প্রেক্ষিতে ‘এক পুরুষ পাবে দুই নারীর সমান’ বলা হয়েছে। কিন্তু তারা মিলিতভাবে কতটুকু সম্পদের ওয়ারিস হবে তা উল্লেখ করা হয়নি। সাধারণত ধরা হয়, অন্যদের অংশ বন্টনের পর অবশিষ্ট অংশ পুত্র-কন্যা বা ভাই-বোন পাবে। অথচ আনুপাতিক অংশ হিসাবে বন্টনের ক্ষেত্রে অবশিষ্ট অংশরূপে কিছু থাকে না। যেহেতু পুত্র-কন্যা হচ্ছে একাধিক কন্যার সমতুল্য এবং ভাই-বোন হচ্ছে একাধিক বোনের সমতুল্য তাই এটা একটা স্বত:সিদ্ধ ব্যাপার যে, একাধিক কন্যা বা একাধিক বোন যে অনুপাতের উত্তরাধিকারী অর্থাৎ তিন ভাগের দুই ভাগ সেটাই পুত্র-কন্যার মধ্যে বা ভাই-বোনের মধ্যে এমনভাবে ভাগ হবে যে, এক পুরুষ পাবে দুই নারীর অংশের সমান। কিন্তু একটিমাত্র কন্যা বা বোন থাকলে তার আনুপাতিক অংশ ১/২  , কারণ তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ বা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। 
পুত্র-কন্যার অংশ বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে-
দুইয়ের বেশি কন্যা .... ২ কন্যা .... ১ কন্যা। 
বিপরীতক্রমে, 
ভাই-বোনের অংশ বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে-
১ বোন .... ২ বোন .... দুইয়ের বেশি বোন। 
একইভাবে, পুত্র : কন্যা = ২:১ বলা হয়েছে সর্বপ্রথম দিকে। 
আর, বিপরীতক্রমে, ভাই : বোন = ২:১ বলা হয়েছে সর্বশেষে। 
তাই, এক পুত্র কতটুকু পাবে তা যে সূত্র থেকে পাওয়া যায়, শুধু এক ভাই কতটুকু পাবে তা সেই একই সূত্র থেকে পাওয়া যায়। সূত্রটি হলো, লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি (এক পুরুষ পাবে দুই নারীর অংশের অনুরূপ)।
অন্য কথায়, শুধু এক পুত্র পাবে ২/৩  । পুত্র কন্যা না থাকা অবস্থঅয় শুধু এক ভাই পাবে ২/৩ ।

২৩. ‘ফাইন কুন্না নিছাআন’ এবং ‘ওয়া ইন কানাত ওয়াহিদাতান’
ফাইন কুন্না নিছাআন = যদি তারা হয় নারী = যদি পুত্র না থাকা অবস্থায় শুধু নারী থাকে। (৪:১১) 
ওয়া ইন কানাত ওয়াহিদাতান = যদি সে হয় একজনমাত্র নারী = যদি পুত্র না থাকা অবস্থায় শুধু একজন নারী থাকে (৪:১১) 
‘নিসাআন’ এবং ‘ওয়াহিদাতান’ উভয়টি ‘খবরে কানা’ হওয়ায় পুত্র না থাকা অবস্থার কথা সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়। ‘ওয়াহিদাতান’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ‘ফাওক্বাছনাতাইনি’ এর ধারাক্রমে এবং এটি বুঝাচ্ছে যে, আওলাদ হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করছে শুধু একজন (স্ত্রীলিঙ্গ ওয়াহিদাতান, কারণ সে নারী)। প্রথমে ‘নিসাআন’ শব্দ দ্বারা পুত্র না থাকার শর্তটি সাব্যস্ত হয়েছে, আর পরে ‘ওয়াহিদাতান’ শব্দ দ্বারা পুত্র না থাকার বিষয়টি সাব্যস্ত হয়েছে। সেই সাথে ‘ওয়াহিদাতান’ শব্দ দ্বারা আওলাদ এর প্রতিনিধিত্বকারী মাত্র একজন হওয়ার বিষয়টি বুঝানো হয়েছে। উপর্যুক্ত আলোচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ‘ওয়াহিদাতান’ শব্দটি কেন ব্যবহৃত হয়েছে বা শব্দটি ব্যবহারগত গুরুত্ব কী ছিল, তা স্পষ্ট হওয়া। ‘খবরে কানা’ (‘কানা’ ক্রিয়ার তথ্য) ‘নিসাআন’ হওয়ায় ক্রিয়া হিসেবে ‘কুন্না’ ব্যবহৃত হয়েছে, ‘খবরে কানা’ (‘কানা’ ক্রিয়ার তথ্য) ‘ওয়াহিদাতান’ হওয়ায় ক্রিয়া হিসেবে ‘কানাত’ ব্যবহৃত হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রে ‘কুন্না’ ও ‘কানাত’ হিসেবে যারা বা যে আছে তারা বা সে ‘আওলাদ’ এর প্রতিনিধিত্ব করছে। 
‘ফাইন কুন্না নিছাআন ফাওক্বাছনাতাইনি’ এবং ‘ওয়া ইন কানাত ওয়াহিদাতান’ বাক্যাংশদ্বয়ে ‘যখন পুত্র সন্তান নেই’ কথাটি আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু বাক্যাংশদ্বয়ের অর্থই হচ্ছে ‘যখন পুত্র সন্তান নেই’। কারণ পুত্রদের সাথে থাকা কন্যাদের জন্য এ অংশগুলো বন্টিত হয়নি। বরং পুত্রদের সাথে থাকা কন্যারা কিভাবে পাবে তার নির্দেশনা রয়েছে লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি বাক্যে আর তা হলো ‘দুই কন্যা মিলে এক পুত্রের সমান পাবে’। এখানে যে পুত্র না থাকা অবস্থাকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে তার প্রমাণ হলো ‘ফাইন কুন্না নিছাআন’ বাক্যের অর্থই হলো ‘যদি তারা হয় নারীগণ’। অর্থাৎ এখানে আওলাদ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, ‘যদি তারা হয় নারীগণ’। অন্যকথায় যদি অবস্থা এমন হয় যে, ‘যদি আওলাদ বলতে শুধু নারীগণ হয়, নারী-পুরুষ একসাথে নয় বা শুধু পুরুষ নয়’। এ ধরনের বর্ণনাভঙ্গি থেকে স্পষ্ট হয় যে, নারী-পুরুষ একসাথে যেমন আওলাদ হতে পারে, তেমনি শুধু পুরুষগণও আওলাদ হতে পারে, এমনকি শুধু নারীগণও আওলাদ হতে পারে, তাই বাক্যটিতে যদি এ তিন অবস্থার তৃতীয়টি হয় সেই শর্তের উল্লেখ করা হয়েছে। 
‘ওয়া ইন কানাত ওয়াহিদাতান’ বাক্যের অর্থ হলো ‘আর যদি সে হয় একজন’। এখানে বুঝানো হয়েছে ‘আওলাদের  মধ্য থেকে যে আছে সে যদি একজন নারী হয়। আওলাদ হচ্ছে বহুবচন, তাই এখানে সম্পূর্ণ বক্তব্য হচ্ছে ‘যদি আওলাদের স্থলে বা আওলাদ সম্পর্কিত নির্দেশনার প্রতিনিধিত্বকারী একজনমাত্র ওয়ালাদ হয়, আর সে হয় নারী, একজন’। এখানে, ‘ওয়াহিদাতান’ শব্দের মাধ্যমে কন্যাটি একজনমাত্র হওয়ার বা কন্যাটির সংখ্যাগত অবস্থা প্রকাশ করা হয়েছে। আর এ অবস্থায় তার সাথে কোনো পুত্র না থাকার শর্তটি দুটি উপায়ে বুঝানো হয়েছে। (ক) এ বাক্যাংশ পূর্বের বাক্যাংশের সাথে সম্পর্কিত, পূর্বের বাক্যাংশে পুত্র না থাকা অবস্থায় কন্যাদের কথা বলা হয়েছে এবং এখানে অনুরূপ অবস্থায় একটিমাত্র কন্যার কথা বুঝানো হয়েছে। (খ) ‘ওয়া ইন কানাত’ বাক্যাংশের অর্থ হলো ‘আর যদি সে হয়’, এতে ব্যবহৃত ক্রিয়া হচ্ছে ‘কানাত’ যা হলো স্ত্রীলিঙ্গ, একবচন। তাই এখানে স্বত:সিদ্ধভাবে পুত্র না থাকা অবস্থার কথা বলা হয়েছে বলে সাব্যস্ত হয়। তারপর পরবর্তী ‘ওয়াহিদাতান’ শব্দটিও পূর্বের ক্রিয়ার সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ তথা এটিও স্ত্রীলিঙ্গ, একবচন এবং সেই সাথে ‘ওয়াহিদাতান’ শব্দের অর্থ হলো ‘একজন’। 
‘ওয়া ইন কানাত’ এরপর পূর্ববর্তী বাক্যাংশের ‘নিসা’ বা ‘উনছায়ায়নি’ শব্দের পরিবর্তে ‘ইমরাআত’ বা ‘উনছা’ শব্দ ব্যবহার না করে ‘ইসমে কানা’ (‘কানা’ ক্রিয়ার তথ্য) হিসেবে ‘ওয়াহিদাতান’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ ‘কানাত’ ক্রিয়া ব্যবহারের কারণে এ পর্যায়ে ‘উনছা’ বা ‘ইমরাআত’ শব্দের ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা থাকেনি। যদিও পূর্বের বাক্যাংশে ‘নিছাআন’ শব্দ ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা ছিল বিধায় তাতে ‘নিসাআন’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। তাতে ‘নিসাআন’ শব্দ ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা ছিল ‘আওলাদ’ শব্দের আওতায় শুধুমাত্র নারীগণ থাকার দিকটি উল্লেখ করার জন্য বা ‘আওলাদ’ এর একটি অবস্থা তুলে ধরার জন্য এবং প্রথমবার ক্রিয়ার সাথে তা কাদের বিপরীতে ব্যবহৃত হয়েছে তা স্পষ্ট উল্লেখ করার জন্য। 
‘ওয়া ইন কানাত ওয়াহিদাতান’ বাক্যাংশে ‘ওয়াহিদাতান’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে পূর্বের বাক্যাংশের ‘ফাওক্বাছনাতাইনি’ এর বিপরীতে সংখ্যার উল্লেখ করার জন্য। অর্থাৎ পূর্বের বাক্যাংশে নারীগণের সংখ্যা সম্পর্কিত যে তথ্যটি উল্লেখিত হয়েছে তার সাথে সমন্বয় রেখে পরবর্তী আয়াতে নারীর সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে, যা একইসাথে সংখ্যা বিষয়ক ধারা প্রকাশ করে এবং বক্তব্য উপস্থাপনের রীতিগত উৎকর্ষকে ধারণ করে। 
ফাইন কুন্না নিসাআন ফাওক্বাছনাতাইনি (৪:১১) শব্দগুচ্ছের মাধ্যমে দেয়া অংশটি হচ্ছে ‘আওলাদের’ জন্য নির্ধারিত অংশ, কারণ এটি পূর্ববর্তী ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম এর ব্যাখ্যামূলক বদল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি পরবর্তীতে যদি একটিমাত্র কন্যার জন্য আলাদা অংশ উল্লেখ করা না হতো তবে তার জন্যও একই অংশ প্রযোজ্য হতো। সুতরাং আওলাদের আওতায় এক বা একাধিক পুত্র/ একাধিক কন্যা/ পুত্র-কন্যা থাকলে তারা পাবে ২/৩  । শুধুমাত্র একটি কন্যা থাকলে (কোনো পুত্র না থাকলে) সে পাবে ১/২  ।

২৪. ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু .....’ (৪:১১) 
‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ বাক্যাংশের মাধ্যমে একদিকে যেমন মাতার আনুপাতিক অংশ উল্লেখিত হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি পিতার আনুপাতিক অংশ নির্ধারিত হয়েছে যদিও তা সরাসরি উল্লেখ না করে উহ্য রেখে দেয়া হয়েছে। যেহেতু ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ বাক্যাংশের মাধ্যমে মাতার আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করার দ্বারা পিতার আনুপাতিক অংশ সহজেই নির্ধারিত হয়ে যায় তাই তা উহ্য রেখে দেয়া হয়েছে। এভাবে ভাষারীতির উৎকর্ষসম্পন্ন প্রয়োগ ঘটেছে এবং উত্তরাধিকার বিধানে নারীর অংশকে অধিক আলোকপাত করা হয়েছে। 
‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ বাক্যোংশের দুটি সুস্পষ্ট প্রভাব হচ্ছে: 
(১) পিতা-মাতার সাথে তথা পিতা-মাতা শ্রেণির সাথে অন্য বিবেচনাযোগ্য ওয়ারিস (তথা ভাই-বোন) না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতা ওয়ারিস হলে মাতা কতটুকু পাবে (এবং পিতা কতটুকু পাবে) তা নির্ধারণ করা। এখানে  মাতার অংশ বলা হয়েছে যা পিতা থাকা বা না থাকা উভয় অবস্থায় প্রযোজ্য। এমন কি যখন পুত্র-কন্যা থাকলে পিতা কতটুকু পাবে ও মাতা কতটুকু পাবে তা বলা হয়েছে তাও এভাবে কার্যকর হবে যে, সে অবস্থায় পিতা থাকুক বা না থাকুক মাতা পাবে ১/৬  , আর মাতা থাকুক বা না থাকুক পিতা পাবে ১/৬ । 
(২) পিতা-মাতা ওয়ারিস হলে মাতার অংশ কত হবে তা উল্লেখিত হয়েছে অথচ পিতার অংশ অনুল্লেখিত রয়েছে। এখন ‘ওয়া ওয়ারিছাহু আবাওয়াহু’ = আর তার ওয়ারিস হয় তার পিতা-মাতা (৪:১১) = তার পিতা-মাতা একমাত্র ওয়ারিস হলে মাতা পাবে ১/৩ । তখন স্বাভাবিকভাবেই পিতা পাবে অবশিষ্ট অংশ তথা ২/৩ । আর যদি অন্য ওয়ারিস থাকে তাহলে তাদের প্রাথমিক পারস্পরিক অনুপাত অন্যদের সাপেক্ষেও একই শ্রেণিগত আনুপাতিক অংশ হিসাবে কার্যকর হবে। কারণ, পিতা-মাতা ও তিন কন্যার ক্ষেত্রে আনুপাতিক অংশসমূহের যোগফল ১/৬  + ১/৬  + ২/৩  = ১। কিন্তু যদি সাথে অন্য ওয়ারিস থাকে তবুও তাদের এ শ্রেণিগত আনুপাতিক অংশ পরিবর্তিত হবে না, বরং তা একই শ্রেণিগত আনুপাতিক অংশ হিসাবে কার্যকর হবে। যেমন, যদি স্বামী থাকে তবে স্বামীর ১/৪   এর বিপরীতে তিন কন্যার আনুপাতিক অংশ ২/৩  , এবং পিতার আনুপাতিক অংশ ১/৬  ও মাতার আনুপাতিক অংশ ১/৬  বহাল থাকে। এর কারণ হলো আনুপাতিক অংশের যোগফল ১ এর চেয়ে বেশি হওয়া কোনো সমস্যা নয়। আনুপাতিক অংশ আনুপাতিক হারে হ্রাস-বৃদ্ধি হতে পারে এটাই আনুপাতিক অংশের বৈশিষ্ট্য। তবে শর্ত হলো আনুপাতিক হারে হ্রাস-বৃদ্ধি হতে হবে যোগফল ১ হওয়ার জন্য এবং যারা প্রাপক তাদের মধ্যে সম্পূর্ণটি বন্টনের জন্য, কিন্তু কোনোক্রমে তাদেরকে একই অনুপাতে দিয়ে সম্পত্তির কোনো অংশ আলাদা করে নেয়া যাবে না। 
ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু বাক্যাংশটি পিতা-মাতা ওয়ারিস হলে তথা জীবিত থাকলে তারা এভাবে পাবে, ওয়ারিস না হলে তথা জীবিত না থাকলে তারা পাবে না, এরূপ অযৌক্তিক কথা বলার জন্য ব্যবহৃত হয়নি। কারণ যদি তারা জীবিত না থাকে তাহলে তারা কিছু পাবে না এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার এবং এটা অন্য যেকোনো ওয়ারিসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সুতরাং বক্তব্যটি এরূপ হলে তা শুধু পিতা-মাতা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা অর্থবহ হতো না। এ বক্তব্যের প্রকৃত তাৎপর্য কী তা আয়াতের পরবর্তী অংশ থেকে স্পষ্ট হয়। পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে, যদি ইখওয়াতুন থাকে তাহলে মা পাবে ১/৬  । অন্যকথায়, পরবর্তী অংশে পিতা-মাতার সাথে ভাই-বোন থাকলে মাতার অংশ কত হবে তা উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং, ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ তথ্যটির প্রকৃত তাৎপর্য হলো যদি পুত্র কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোনও না থাকে। কারণ, পুত্র কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলে পিতা-মাতার আনুপাতিক অংশ বদলে যায়। কিন্তু স্বামী/ স্ত্রী থাকুক বা না থাকুক পিতা-মাতার আনুপাতিক অংশ বদলে যায় না। সুতরাং এখানে পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকা না থাকাকে বিবেচনা করা হয়েছে কিন্তু স্বামী/ স্ত্রী থাকা বা না থাকাকে বিবেচনা করা হয়নি। সুতরাং, ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ এর মর্মার্থ হলো, ‘এবং (যদি) তার ওয়ারিস হয় তার পিতা-মাতা এ অবস্থায় যে, বিবেচনাযোগ্য অন্য কোনো ওয়ারিস তথা ভাই-বোন নেই’। পরবর্তী অংশ থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, বিবেচনাযোগ্য অন্য ওয়ারিস হচ্ছে ভাই-বোন, স্বামী/ স্ত্রী নয়। সুতরাং মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকা অবস্থায় ভাই-বোনও না থাকলে মাতা পাবে ১/৩  , পিতা পাবে ২/৩  । যেহেতু স্বামী/ স্ত্রীকে বিবেচনা করা হয় না তাই তারা জীবিত থাকুক বা না থাকুক উভয় অবস্থায় মাতা ও পিতার আনুপাতিক অংশ একইরূপ থাকবে। কিন্তু যদি ভাই-বোন থাকে তাহলে ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ এর অবস্থা বদলে যায় বা বহাল থাকে না। কারণ সেক্ষেত্রে পিতা-মাতার সাথে বিবেচনাযোগ্য অন্য ওয়ারিস থাকে। 
সুতরাং ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ বাক্যাংশটি প্রমাণ করে যে, পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতার সাথে ভাই-বোন থাকলে তারাও ওয়ারিস হবে, যেহেতু সে অবস্থায় পিতা-মাতা এমন ওয়ারিস নয়, যাদের সাথে বিবেচনাযোগ্য অন্য ওয়ারিস নেই। পুত্র-কন্যা, পিতা-মাতা, স্বামী/ স্ত্রী সব অবস্থায় ওয়ারিস, কিন্তু ভাই-বোন সব অবস্থায় ওয়ারিস নয়। পুত্র-কন্যা থাকা বা না থাকা উভয় অবস্থায় স্বামী/ স্ত্রী এমন ওয়ারিস নয়, যার থাকা বা না থাকা সাপেক্ষে পিতা-মাতা বা পুত্র-কন্যার জন্য ভিন্ন ভিন্ন অংশ উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ভাই-বোন এমন ওয়ারিস যে, পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় তারা না থাকলে পিতা-মাতা প্রসঙ্গে বলা যায়, ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’, কিন্তু তারা (ভাই বোন) থাকলে, তখন তারাও পিতা-মাতার সাথে ওয়ারিস হয়, যারা ওয়ারিস হওয়ার কারণে পিতা-মাতার অংশ পরিবর্তিত হয় এবং সেক্ষেত্রে পিতা-মাতা প্রসঙ্গে ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ তথ্যটিতে প্রদত্ত আনুপাতিক অংশ বহাল রাখা হয়নি বরং অন্যরূপ আনুপাতিক অংশ প্রদান করা হয়েছে। 
অনুরূপভাবে ৪:১৭৬ আয়াতে উল্লেখিত ‘ওয়া হুয়া ইয়ারিসুহা’ বাক্যটির তাৎপর্য হলো ‘কোনো ভাই তার বোনের ওয়ারিস হবে এবং এক্ষেত্রে অন্য কোনো ওয়ারিস (পিতা-মাতা এবং স্বামী/ স্ত্রী) থাকুক বা না থাকুক, তারা বিবেচনায় আসবে না, বরং সে তার জন্য একই নির্ধারিত আনুপাতিক অংশ পাবে’। আর বন্টনবিধির বিশ্লেষণ থেকে বুঝা যায়, তার জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক অংশ হচ্ছে ২/৩  । ৪:১৭৬ আয়াতে পুত্র-কন্যার অবর্তমানে ভাই-বোন ওয়ারিস হওয়ার কথা বলা হয়েছে, আর ৪:১১ আয়াতে পুত্র-কন্যার অংশও এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, পিতা-মাতা বা স্বামী/ স্ত্রী থাকা বা না থাকার কারণে তাদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন অংশ উল্লেখ করা হয়নি। 
যদি দুটি শ্রেণির মধ্যে বন্টন হয়, যার একটি শ্রেণির আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করা হয়েছে, অন্য শ্রেণির আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করা হয়নি, তখন এর নিম্নোক্ত দুটি তাৎপর্য হয়:
(ক) যার আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করা হয়েছে সেটাই তার আনুপাতিক অংশ, অপর শ্রেণির অনুপস্থিতিতে যে আনুপাতিক অংশ দ্বারা প্রাপ্ত প্রকৃত অংশ হবে সম্পূর্ণ সম্পত্তি। 
(খ) যার আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করা হয়নি সে যদি প্রথম পক্ষের সাথে উপস্থিত থাকে তাহলে তার অনুল্লেখিত আনুপাতিক অংশ হবে সম্পূর্ণ অংশ থেকে প্রথম শ্রেণির আনুপাতিক অংশের বিয়োগফল। আর প্রথম শ্রেণির অনুপস্থিতিতে এ বিয়োগফলরূপ আনুপাতিক অংশের দ্বারা প্রাপ্ত প্রকৃত অংশ হবে সম্পূর্ণ সম্পত্তি। যেহেতু প্রথম শ্রেণির আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করা হয়েছে তার সাথে (তথা দ্বিতীয় শ্রেণির সাথে) সহঅবস্থানের সাপেক্ষে এবং তার (তথা দ্বিতীয় শ্রেণির) আনুপাতিক অংশ অনুল্লেখিত, তাই প্রথম শ্রেণির জন্য উল্লেখিত আনুপাতিক অংশ ও তার জন্য অনুল্লেখিত আনুপাতিক অংশের যোগফল হবে ১, তা ১ এর বেশি বা কম হবে না। কারণ বহু জ্ঞাত আনুপাতিক অংশের যোগফল ১ এর বেশি বা কম হতে পারে, যার ফলে শ্রেণিগুলোর বাস্তব উপস্থিতির বিভিন্ন সংমিশ্রণে প্রত্যেক শ্রেণির প্রকৃত অংশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন হয় কিন্তু উপস্থিত এক শ্রেণির সাথে অন্য শ্রেণির অনুপাত সব ক্ষেত্রে স্থির থাকে। কিন্তু কোনো অনুল্লেখিত আনুপাতিক অংশ ও উল্লেখিত আনুপাতিক অংশের যোগফল ১ এর চেয়ে কম বা বেশি হয় না, বরং ১ হয়। কারণ একমাত্র সেই ক্ষেত্রেই কোনো শ্রেণির আনুপাতিক অংশ অনুল্লেখিত রাখা যৌক্তিক হয় যখন তার সাথে যে শ্রেণির উপস্থিত থাকার সাপেক্ষে তার আনুপাতিক অংশ অনুল্লেখিত রাখা হয়েছে সেই শ্রেণির উল্লেখিত অংশ ও তার জন্য নির্ধারিত অথচ অনুল্লেখিত আনুপাতিক অংশের যোগফল ১ হয়, ১ এর চেয়ে কম বা বেশি হয় না। এটি একটি সাধারণ যুক্তিসিদ্ধ বিষয়। 
সুতরাং পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় মায়ের অংশ ১/৩  হওয়ার অর্থ হচ্ছে এ অবস্থায় পিতার অংশ হচ্ছে ২/৩ । 
অন্যদিকে যদি যে শ্রেণির আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করা হয়েছে কোনো শর্ত সাপেক্ষে তার আনুপাতিক অংশকে কমানো বা বাড়ানো হয়, তাহলে যে শ্রেণির আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করা হয়নি এ অবস্থায় তার আনুপাতিক অংশ তার প্রথম পর্যায়ের আনুপাতিক অংশের তুলনায় একই শর্তে বাড়বে কিনা বা কমবে কিনা এবং যদি বাড়ে বা কমে তবে বেড়ে বা কমে তার নতুন আনুপাতিক অংশ কত হবে তা নির্ভর করবে ঐ শর্ত দ্বিতীয় শ্রেণির উপর প্রযোজ্য হয় কিনা এবং শর্তের ধরন কী তার উপর। 
যেহেতু পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলে মাতার আনুপাতিক অংশ ১/৬   হয়, যা হচ্ছে পুত্র-কন্যা থাকা অবস্থায় মাতার আনুপাতিক অংশ, তাই এ থেকে বুঝা যায় যে, পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোনকে পুত্র-কন্যার সমান গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাই এ অবস্থায় পিতার আনুপাতিক অংশও ১/৬  হবে, যেহেতু পুত্র-কন্যা থাকা অবস্থায় পিতার আনুপাতিক অংশও মাতার মতোই ১/৬  হয়। 
৪:১১, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ একসাথে বিবেচনা করলে এ কথা স্পষ্ট যে,  সন্তান না থাকা অবস্থায় মাতার আনুপাতিক অংশ সন্তান থাকা অবস্থায় মাতার আনুপাতিক অংশের দ্বিগুণ হয় এবং পিতার আনুপাতিক অংশ মাতার আনুপাতিক অংশের দ্বিগুণ হয়। এটা বিভিন্ন অবস্থায় ভাই-বোনের প্রাপ্য অংশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন, সন্তান থাকা অবস্থায় ভাই-বোনের প্রাপ্য অংশ পরস্পরের সমান হলেও সন্তান না থাকা অবস্থায় ভাই পায় বোনের দ্বিগুণ। 
পরিশেষে বলা যায়, ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু (যদি তাকে পূর্বসূরী করে তার পিতা-মাতা) দ্বারা বুঝানো হয়েছে, (সন্তান না থাকা অবস্থায়) তার পিতা-মাতার সাথে (আনুপাতিক অংশের হ্রাসবৃদ্ধির জন্য বিবেচনায় নেয়ার মতো ওয়ারিস ছাড়া) অন্য কোনো ওয়ারিস থাকুক বা না থাকুক, তার পিতা-মাতা তার ওয়ারিস হিসেবে থাকলে, তারা এভাবে পাবে। তবে তার ভাই-বোন থাকলে সে ভাই-বোনকে পিতা-মাতার আনুপাতিক অংশের হ্রাসবৃদ্ধির জন্য বিবেচনায় নেয়া হবে।  ভাই-বোন ছাড়া অন্য কারো উপস্থিতির জন্য সন্তান না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতার আনুপাতিক অংশে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে না। 

২৫. ‘ওয়া হুয়া ইয়ারিছুহা’ (৪:১৭৬) 
৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত ওয়া হুয়া ইয়ারিছুহা (তার ভাই তার ওয়ারিস হবে) তথ্যটি দ্বারা কী বুঝায়? মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকা অবস্থায় তার ভাই কি তার সম্পূর্ণ সম্পত্তির ওয়ারিস হবে? নাকি সে কোনো নির্দিষ্ট আনুপাতিক অংশের প্রাপক হবে? 
৪:১১ আয়াতে যেমন ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ (এবং তার ওয়ারিস হলে তার পিতা-মাতা) বলার পর মাতার আনুপাতিক অংশ কত হবে সে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তেমনি, ‘ওয়া হুয়া ইয়ারিছুহা’ বা ‘সে (ভাইটি) তার (বোনটির) ওয়ারিস হবে’ বলার পর তার আনুপাতিক অংশ কত হবে সে নির্দেশনা পাওয়া যায় পরবর্তী বাক্যাংশ ‘ফালিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ থেকে। 
‘ওয়া হুয়া ইয়ারিছুহা’ বলতে বুঝায় তার আনুপাতিক অংশে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটানোর জন্য কোনো ওয়ারিসকে বিবেচনা করা হবে না। এটা দ্বারা সে সমস্ত সম্পদের বা অবশিষ্ট সমস্ত সম্পদের ওয়ারিস হবে বুঝায় না। কারণ ৪:১১ আয়াতে পিতা-মাতার বিষয়ে ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ বলার পর মাতার আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু তারপর ‘ইখওয়াত’ থাকা অবস্থায় মাতার আনুপাতিক অংশকে হ্রাস করা হয়েছে। কিন্তু ‘স্বামী/ স্ত্রীর’ উপস্থিতি অনুপস্থিতিকে মাতার আনুপাতিক অংশকে হ্রাসবৃদ্ধির জন্য বিবেচনায় নেয়া হয়নি। এ থেকে বুঝা যায়, ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ দ্বারা বুঝিয়েছে ‘যদি পিতা-মাতার সাথে এমন কেউ না থাকে যার উপস্থিতিকে তাদের আনুপাতিক অংশকে হ্রাস বৃদ্ধির জন্য বিবেচনায় নেয়া হয়’। অনুরূপভাবে ৪:১৭৬ আয়াতে ‘ওয়া হুয়া ইয়ারিসুহা’ দ্বারা বুঝাবে ‘সে ভাইটি তার  বোনটির ওয়ারিস হবে এমনভাবে যে, তার আনুপাতিক অংশকে হ্রাস-বৃদ্ধি করার জন্য কাউকে বিবেচনায় নেয়া হবে না’। কিন্তু তার আনুপাতিক অংশ কত তা উল্লেখ করা হয়নি, তা পরবর্তী নির্দেশনা থেকে পরোক্ষভাবে পাওয়া যায়। 
সুতরাং ওয়া হুয়া ইয়ারিসুহা [আার সে (ভাই) তাকে (বোনকে) পূর্বসূরী করবে] বাক্যটির তাৎপর্য হলো, ভাইটির সাথে অন্য কোনো ওয়ারিস থাকুক বা না থাকুক ভাইটি তার নির্দিষ্ট আনুপাতিক অংশই পাবে, তার নির্দিষ্ট আনুপাতিক অংশের (তথা দুই বোনের সমান অংশ প্রাপ্তির) হ্রাস-বৃদ্ধির জন্য অন্য কাউকে বিবেচনায় নেয়া হবে না। কিন্তু ভাইয়ের আনুপাতিক অংশ কত তা এখান থেকে স্পষ্ট নয়। তা পাওয়া যায়, পরবর্তী বক্তব্য থেকে যাতে বলা হয়েছে ‘ফালিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’।
২৬. ৪:১১ ও ৪:১৭৬ আয়াতের মধ্যে তিনটি প্রত্যক্ষ সামঞ্জস্য এবং দুইয়ের বেশি বোন, পুত্র ও ভাইয়ের অংশ নির্ণয়ের উপায়  
৪:১১ ও ৪:১৭৬ আয়াতের মধ্যে তিনটি প্রত্যক্ষ সামঞ্জস্য : 
(১) পুত্র-কন্যা একসাথে থাকলে এবং ভাই-বোন একসাথে থাকলে উভয় ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি (এক পুরুষ পাবে দুই নারীর অংশের মতো)। 
(২) একজনমাত্র কন্যা থাকলে সে পাবে ১/২ । একইভাবে বলা হয়েছে, একজনমাত্র বোন থাকলে সে পাবে ১/২ । 
(৩) ৪:১১ আয়াতে বর্ণিত তথ্যানুযায়ী, পুত্র-কন্যা ও ভাই-বোনের অবস্থার ক্ষেত্রে আরেকটি সাধারণ অবস্থা হচ্ছে এই যে, যখন পুত্র-কন্যা থাকে তখন পিতা ও মাতা প্রত্যেকে পাবে ১/৬ । (এক্ষেত্রে, ৪:১৭৬ আয়াত অনুযায়ী, ভাই-বোনের কোনো অংশ নেই তথা পিতা ও মাতার সাথে পুত্র কন্যা থাকা অবস্থায় ভাই-বোন কিছু পাচ্ছে না। আর এক্ষেত্রে ৪:১১ আয়াতেও ভাই-বোনের কোনো অংশ উল্লেখিত হয়নি)। তারপর, পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায়, ভাই-বোন না থাকলে মাতা পাবে ১/৩ । আর পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলে মাতা পাবে ১/৬ । 
লক্ষণীয় যে, পুত্র-কন্যা থাকা অবস্থায় মাতা পাবে ১/৬  (ভাই-বোন থাকুক বা না থাকুক); আর পুত্র কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলে সেক্ষেত্রেও মাতা পাবে ১/৬ । আর ৪:১৭৬ অনুযায়ী পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোনের অংশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং পিতা ও মাতার সাথে পুত্র কন্যা থাকলে ভাই-বোনের কোনো অংশ নেই কিন্তু পুত্র-কন্যা না থাকলে ভাই-বোনের অংশ আছে। আর পিতা ও মাতার সাথে পুত্র-কন্যা থাকলে মাতা যতটুকু লাভ করে, পুত্র-কন্যা না থেকে ভাই-বোন থাকলেও মাতা সেরূপ অংশ লাভ করে। আর এটাই হচ্ছে ৪:১১ ও ৪:১৭৬ আয়াতে থাকা তৃতীয় প্রত্যক্ষ সামঞ্জস্য। 
দুইয়ের বেশি বোন, পুত্র ও ভাইয়ের অংশ নির্ণয়ের উপায়:
উপর্যুক্ত তিনটি সাধারণ অবস্থা বা সামঞ্জস্য বিবেচনায় রেখে আরো কিছু সামঞ্জস্য সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সহজ হয়, যার মাধ্যমে দুইয়ের বেশি বোন, পুত্র ও ভাইয়ের অংশ নির্ণয় করা যায়।  
(১) ৪:১১ আয়াতে পুত্র ও কন্যার জন্য প্রদত্ত অংশ পুত্র-কন্যা না অবস্থায় ভাই-বোনের জন্য প্রযোজ্য যা ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং ৪:১১ আয়াতে এ বিষয়টি অন্তর্নিহিত রয়েছে কিন্তু ফতোয়া জানতে চাওয়ার প্রেক্ষিতে ৪:১৭৬ আয়াতে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং আয়াতটিকে ৪:১১, ৪:১২ আয়াত থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বা সূরা নিসার শেষ আয়াত হিসাবে সংস্থাপিত করা হয়েছে। এটি কুরআনের অন্য সকল সূরার শেষ আয়াতের ধরনের থেকে ব্যতিক্রম। অন্য সব সূরার শেষ আয়াত পূর্ববর্তী কাছাকাছি আয়াতসমূহের সাধারণ শেষকথা। সেভাবে অব্যবহিত পূর্ব বক্তব্যের ধারাবাহিকতা ৪:১৭৫ আয়াতে শেষ হয়েছে, তারপর ৪:১৭৬ আয়াতটি পরিশিষ্ট হিসেবে সংযোজিত হয়েছে। এভাবে ৪:১৭৬ আয়াতের সংস্থাপনের মাধ্যমে মূল অধ্যায় শেষ হওয়ার পর যে পরিশিষ্ট বা সংযোজনী লেখা হয় তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। (অবশ্য এতদসত্ত্বেও সূরার প্রথম আয়াতকে জন্ম সম্পর্কিত এবং শেষ আয়াতকে মৃত্যু সম্পর্কিত করার মাধ্যমে একটি যোগসূত্র তৈরি করা হয়েছে)। 
(২) ৪:১১ আয়াতে দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যার জন্য উল্লেখিত আনুপাতিক অংশ ২/৩ । ৪:১৭৬ আয়াতে দুই কন্যার জন্য উল্লেখিত আনুপাতিক অংশ ২/৩ । তাতে দুইয়ের বেশি কন্যার অংশ সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু একটিমাত্র কন্যার অংশ যেমন ১/২  , একটিমাত্র বোনের অংশও তেমনি ১/২ । এ থেকে বুঝা যায় যে, কন্যাদের ক্ষেত্রে যেমন দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যার আনুপাতিক অংশের মধ্যে পার্থক্য নেই, বোনদের ক্ষেত্রেও তেমনি দুই বোনের আনুপাতিক অংশই দুইয়ের বেশি বোনের আনুপাতিক অংশ হিসেবেও প্রযোজ্য হবে। কিন্তু দুইয়ের বেশি বোনের অংশ সরাসরি উল্লেখ না করার একটি ভাষারীতিগত কারণ বিবেচনা করা যাক। 
কন্যাদের অংশ এভাবে বলা হয়েছে, দুইয়ের বেশি বা দুই কন্যার অংশ ২/৩  এবং একটিমাত্র কন্যার অংশ ১/২ । 
বোনদের অংশ এভাবে বলা হয়েছে, একটিমাত্র বোনের অংশ ১/২  এবং দুই বোনের অংশ ২/৩ । 
অর্থাৎ কন্যাদের অংশ বর্ণনার ক্ষেত্রে কন্যাদের সংখ্যার ঊর্ধ্ব থেকে নিম্নক্রম তথা দুইয়ের বেশি কন্যা, দুই কন্যা, এক কন্যা এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। অন্যদিকে বোনদের অংশ বর্ণনার ক্ষেত্রে বোনদের সংখ্যার নিম্ন থেকে ঊর্ধ্বক্রম তথা এক বোন, দুই বোন এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। সুতরাং এমতাবস্থায় দুইয়ের বেশি বোনের অংশ উল্লেখ করলে তা উল্লেখের স্থান ছিল দুইয়ের বেশি বোনের অংশ বর্ণনার শেষে। কিন্তু যেহেতু পূর্বাপর বক্তব্য অনুসারে এবং ৪:১১ আয়াতের ওজনে (তুলনামূলক বিবেচনার ভিত্তিতে) দুইয়ের বেশি বোনের অংশ হিসেবে দুই বোনের অংশটিই প্রযোজ্য হবে বলে বুঝা যায় (Understood) তাই তা অনুক্ত (Non-expressed) রেখে দেয়া হয়েছে। এরূপ অবস্থায় বক্তব্যের অংশবিশেষ উহ্য রেখে দেয়ার রীতি আরবি ভাষায় প্রচলিত রয়েছে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে কুরআনেও এ রীতিটি অবলম্বন করা হয়েছে। 
উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বুঝা যায় যে, ৪:১১ আয়াত অনুযায়ী, পুত্র না থাকা অবস্থায় শুধু দুই কন্যার আনুপাতিক অংশ ২/৩  এবং দুইয়ের বেশি কন্যার আনুপাতিক অংশও ২/৩ । অনুরূপভাবে ভাই না থাকা অবস্থায় শুধু দুই বোনের আনুপাতিক অংশ ২/৩  এবং দুইয়ের বেশি বোনের আনুপাতিক অংশও ২/৩ । 
দুইয়ের বেশি বোনের আনুপাতিক অংশ সরাসরি উল্লেখ না করা সত্ত্বেও দুই বোনের জন্য উল্লেখিত আনুপাতিক অংশই তার জন্য প্রযোজ্য হওয়ার বিষয়টি বা দুইয়ের বেশি বোনের আনুপাতিক অংশ সরাসরি উল্লেখ না করার কারণ বুঝার ক্ষেত্রে পুত্র কন্যা ও ভাই বোনের মধ্যে বণ্টনের জন্য প্রযোজ্য সূত্রটি লক্ষণীয়। ৪:১১ আয়াতে পুত্র-কন্যা প্রসঙ্গে এবং ৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোনের প্রসঙ্গে উল্লেখিত লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি এর মাধ্যমে দুইয়ের বেশি বোনের অংশ এবং এছাড়াও এক বা একাধিক পুত্রের অংশ ও এক বা একাধিক ভাইয়ের অংশ হিসেবে ২/৩  সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি শিরোনামে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
(৩) শুধুমাত্র এক বা একাধিক পুত্র থাকলে তারা সেভাবে পাবে পুত্র কন্যা না থাকা অবস্থায় শুধুমাত্র এক বা একাধিক ভাই থাকলে তারা যেভাবে পায়। ৪:১৭৬ আয়াতে ভাইয়ের অংশের বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘ওয়া হুয়া ইয়ারিছুহা’। শুধুমাত্র একাধিক ভাই থাকলে তাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আরবি ভাষারীতি অনুযায়ী এরূপ অনুরূপতার বিষয়টি উল্লেখের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই; কারণ তা বক্তব্যের সৌন্দর্য ও গাম্ভীর্য নষ্ট করে। শুধু এক ভাই থাকলে সে যতটুকু অংশের ওয়ারিস হয়, একাধিক ভাই থাকলে তারা সম্মিলিতভাবে পরস্পর সমান হারে ততটুকু অংশের ওয়ারিস হয়। 
(৪) যখন পুত্র-কন্যা আছে তখন পিতা ও মাতা প্রত্যেকে পাবে ১/৬  (এ অবস্থায় ভাই-বোন থাকলেও তাদের জন্য তথা ভাই-বোনের জন্য কোনো অংশ নেই)। যখন পুত্র-কন্যা নেই এবং ভাই-বোনও নেই তখন মাতা পাবে ১/৩ । আবার যখন পুত্র-কন্যা নেই কিন্তু ভাই-বোন আছে তখন মাতা পাবে ১/৬ । অর্থাৎ পুত্র-কন্যা থাকলে মাতা যেরূপ ১/৬  পেত, তেমনি পুত্র-কন্যার পরিবর্তে ভাই-বোন থাকলেও মাতা পাবে ১/৬ । সুতরাং পুত্র-কন্যা থাকলে পুত্র-কন্যা যে অংশ পেত, পুত্র-কন্যা না থাকলে ভাই-বোন সেই অংশ পাবে। এখন পুত্র-কন্যাও নেই, ভাই-বোনও নেই এ অবস্থায় মাতার অংশ বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১/৩  । তাহলে পুত্র-কন্যা থাকলে যেভাবে মাতার মত পিতাও ১/৬  পায়, পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলে সেভাবেই মাতার মত পিতাও ১/৬  পাবে। এ তথ্যটি স্বত:সিদ্ধ যৌক্তিক তথ্য হিসাবে আসে বিধায় পিতার অংশ আলাদাভাবে বলার প্রয়োজনীয়তা থাকে না, তাই পিতার অংশ আলাদাভাবে বলা হয়নি। 
পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতার অংশ যে ধারাবাহিকতায় বলা হয়েছে সে ধারাবাহিকতায় যে দুই স্থানে শুধু মাতার অংশ উল্লেখ করা হয়েছে সে দুই স্থানের কোন স্থানে পিতার অংশ কত হবে তা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কয়েকটি পয়েন্ট লক্ষণীয়। যেমন, প্রথমত লক্ষণীয় যে, পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতার অংশ বর্ণনা শুরু হয়েছে ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ (আর তার ওয়ারিস হয় তার পিতা-মাতা) বাক্যাংশের মাধ্যমে। এরপর এ অবস্থায় মাতা কতটুকু পাবে এবং ভাই-বোন থাকলে মাতা কতটুকু পাবে তা বলা হয়েছে। অর্থাৎ এ দুই স্থানে মাতার সাথে সাথে পিতাও ওয়ারিস, কিন্তু পিতার অংশ সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। তা সত্ত্বেও আয়াতের বক্তব্যধারার বিশ্লেষণাত্মক অধ্যয়নের মাধ্যমে তা নির্ণয় করা যায়। নিম্নে বিষয়টি আলোচনা করা হলো।
প্রথম স্থান, যেখানে বলা হয়েছে, মাতা পাবে ১/৩  , তাতে পিতার আনুপাতিক অংশ কত তা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হলো: ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ বাক্যটির ক্ষেত্রে দুটি অবস্থান হতে পারে, (ক) পিতা-মাতা একমাত্র ওয়ারিস। (খ) অন্য এক বা একাধিক ওয়ারিসের পাশাপাশি পিতা-মাতাও ওয়ারিস। 
যদি পুত্র-কন্যা থাকে তাহলে পিতা পায় ১/৬ , মাতা পায় ১/৬ । তাদের সাথে পুত্র-কন্যা ছাড়া অন্য ওয়ারিস (স্বামী/স্ত্রী)  থাকুক বা না থাকুক উভয় অবস্থায় তাদের আনুপাতিক অংশ একইরূপ। তেমনি পুত্র-কন্যা ও ভাই-বোন না থাকা অবস্থায় (যেহেতু পরে পুত্র-কন্যা নেই কিন্তু ভাই-বোন আছে এরূপ অবস্থায় মাতার অংশ উল্লেখ করা হয়েছে) অন্য ওয়ারিস (স্বামী/ স্ত্রী) থাকলেও মাতার অংশ হবে ১/৩ । সুতরাং ‘পিতা-মাতা ওয়ারিস হয়’ কথাটির অর্থ হচ্ছে (ক) যদি পিতা-মাতা একমাত্র ওয়ারিস হয় তাহলে তাদের অংশ এরূপ এবং (খ) অন্য ওয়ারিস থাকলে তাদের এই আনুপাতিক অংশ সেই ওয়ারিসদের আনুপাতিক অংশের সাথে কার্যকর হবে। 
এরূপ অবস্থায় মাতা ১/৩  পাওয়ার অর্থই হচ্ছে অবশিষ্ট অংশ পিতার তথা পিতার অংশ হচ্ছে ২/৩ । কারণ এখানে অন্য ওয়ারিস থাকলেও এই ১/৩  + ২/৩  = ১ হবে পিতা-মাতার আনুপাতিক অংশ, অন্য ওয়ারিসের আনুপাতিক অংশের তুলনায়। যেমন, তিন কন্যা ও পিতা-মাতা থাকলে, তিন কন্যা পাবে ২/৩ , পিতা ও মাতা পাবে (১/৬  + ১/৬  =) ১/৩ । সাথে স্বামী/ স্ত্রী থাকলেও তাদের আনুপাতিক অংশ এটিই থাকবে। 
এরপর পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলে মাতার অংশ হয় ১/৬  যা পুত্র কন্যা থাকা অবস্থার অনুরূপ। সুতরাং পুত্র-কন্যার প্রভাব ও ভাই-বোনের প্রভাব সমান। তাই এরূপ অবস্থায় পিতার অংশও ১/৬ । কারণ, পুত্র-কন্যা থাকা অবস্থায় পিতার অংশ ১/৬ । 
(৫) এক পুরুষের জন্য এক নারীর দ্বিগুণ বলা হয়নি। তাই যদি এক পুত্র ও এক কন্যা থাকে, তবে পুত্র যদিও কন্যার দ্বিগুণ পায় তবু তা কন্যার দ্বিগুণ হিসাবে পায় না, বরং এক পুত্রকে দুই কন্যা বিবেচনা করার ভিত্তিতে পায়। অর্থাৎ ধরা হবে তিন কন্যা আছে। তাই সম্পদ তিন ভাগ করা হবে। তারপর কন্যাটি তার এক ভাগ এবং পুত্রটি দুই কন্যার মতো (১ ভাগ + ১ ভাগ) = ২ ভাগ পাবে। এভাবে যখন পুত্র না থাকা অবস্থায় দুই কন্যা (বা দুইয়ের বেশি কন্যা) থাকে তখন তারা সম্মিলিতভাবে যে ২/৩  আনুপাতিক অংশ পায়, কন্যা না থাকা অবস্থায় এক পুত্র (বা একাধিক পুত্র) সেই ২/৩  আনুপাতিক অংশ পায়। এভাবে শুধু (দুই বা) দুইয়ের বেশি কন্যা থাকলে তারা যেমন শুধু এক কন্যা থাকলে সে যা পায় তার দ্বিগুণ পাওয়া হয় না, তেমনি শুধু এক পুত্র থাকলে সে শুধু এক কন্যা থাকলে সে যা পায় তার দ্বিগুণ পাওয়া হয় না। সুতরাং এক পুরুষ (পুত্র) পাবে দুই নারীর (কন্যার) (সম্মিলিত) অংশের মতো, কথাটি নারী পুরুষ সম্মিলিতভাবে থাকুক বা স্বতন্ত্রভাবে থাকুক উভয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কারণ এটি সাধারণ সূত্র। (যদি কথাটি হতো এক পুত্রের জন্য এক কন্যার দ্বিগুণ তবে প্রদত্ত বন্টন বিধির ধারাসমূহের সাপেক্ষে কথাটি সাধারণ সূত্র হিসাবে উল্লেখ করা যেতো না।) 

শুধু পিতা থাকলে তার অংশ এবং শুধু মাতা থাকলে তার অংশ:
পুত্র কন্যা থাকলে মাতা পাবে  ১/৬  (পিতা থাকুক বা না থাকুক), পিতা পাবে  ১/৬  (মাতা থাকুক বা না থাকুক)। অনুরূপভাবে, পুত্র কন্যা না থাকা অবস্থায়, মাতা পাবে ১/৩  (যদি ভাই-বোন না থাকে), (পিতা থাকুক বা না থাকুক)। আর এ অবস্থায় পিতা পাবে ২/৩  (যদি ভাই-বোন না থাকে), (মাতা থাকুক বা না থাকুক)। কারণ, কোনো ওয়ারিসের জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক অংশ অন্য ওয়ারিসের অনুপস্থিতিতে হ্রাস পায় না, যদি না তা শর্ত হিসাবে উল্লেখ থাকে এবং যদি না হ্রাসকৃত আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করা হয়। অন্যথায় এক ওয়ারিসের অনুপস্থিতিতে অন্য ওয়ারিসের আনুপাতিক অংশে হ্রাসবৃদ্ধি হয় না, শুধু প্রকৃত প্রাপ্ত অংশ হ্রাসবৃদ্ধি হয়। যেমন যদি শুধুমাত্র একজন ওয়ারিস থাকে তাহলে তার জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক অংশ যাহাই হোক না কেন বাস্তবে অন্য কোনো ওয়ারিস না থাকায় তার প্রকৃত প্রাপ্ত অংশ হয় ১ তথা সম্পূর্ণ সম্পত্তি। 
২৭. ৪:১১ ও ৪:১৭৬ আয়াতে পুত্র-কন্যা ও ভাই-বোনের অংশের পরে ওয়াসিয়্যাত প্রসঙ্গ অনুল্লেখিত থাকার সাদৃশ্য ও তার কার্যকারণ সম্পর্কিত চিন্তাধারা
৪:১১ আয়াতে পুত্র-কন্যার অংশ বলার পর মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণের ও ঋণ পরিশোধের কথা উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু পিতা-মাতার অংশ বলার পর মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণের এবং ঋণ পরিশোধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ৪:১২ আয়াতে স্বামীর অংশ বলার পর, স্ত্রীর অংশ বলার পর এবং ভাই-বোনের অংশ বলার পর এই তিনবার মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোনের অংশ বলার পর ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা উল্লেখ করা হয়নি। এখানে ৪:১১ আয়াতে পুত্র-কন্যার অংশের পর মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা না বলার সাথে ৪:১৭৬ আয়াতে ভাইবোনের অংশ বলার পর মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা না বলার একটি মিল রয়েছে। 
আনুপাতিক অংশ নির্ধারণ পদ্ধতি ও বর্ণনারীতির ভিত্তিতে চিন্তা গবেষণার মাধ্যমে ৪:১১ আয়াতে পুত্র-কন্যার অংশ বলার পর মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা উল্লেখ না করার তাৎপর্য উপলব্ধি করা যায়। সাধারণত কারো আনুপাতিক অংশ সৃষ্টি হয় অন্য কারো আনুপাতিক অংশের তুলনায়। তাই পুত্র-কন্যার আনুপাতিক অংশ বলার পর যখন পিতা-মাতার আনুপাতিক অংশও বলা হলো, তখন মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা বলা হয়েছে। এরপর বলা হয়েছে, ‘তোমরা জানো না তোমাদের পিতা-মাতা ও তোমাদের পুত্র-কন্যার মধ্যে কে উপকারের দিক থেকে তোমাদের অধিক নিকটবর্তী’। এভাবে পুত্র-কন্যা ও পিতা-মাতার অংশ সম্পর্কিত ধারা শেষ হওয়ার পর ৪:১২ আয়াতে স্বামীর অংশ উল্লেখ করা হয়েছে, এরপর স্ত্রীর অংশ উল্লেখ করা হয়েছে, এরপর ভাই-বোনের অংশ উল্লেখ করা হয়েছে এবং প্রত্যেকের অংশের পরপর মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা বলা হয়েছে। 
৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোনের অংশ বলার পর মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা উল্লেখ না করার তাৎপর্য হতে পারে: যেহেতু ভাই-বোন পাচ্ছে পুত্র-কন্যা না থাকায় এবং পুত্র-কন্যার অনুরূপভাবে, তাই পুত্র-কন্যার অংশের পর যেমন মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা বলা হয়নি সেটার সাথে মিল রাখার জন্য এখানেও মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা বলা হয়নি। 
পুত্র-কন্যার আনুপাতিক অংশের পর এবং পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোনের আনুপাতিক অংশের পর ওয়াসিয়্যাতের দাবি পূরণ ও ঋণ পরিশোধের ধারাটি উল্লেখ না করার মানে এ নয় যে, পুত্র-কন্যা ও ভাই-বোনের অংশ বন্টনের সাথে মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের সম্পর্ক নেই। বরং সমগ্র বক্তব্য কাঠামো নিয়ে চিন্তা করলে বুঝা যায় যে, যদি পিতা-মাতার অংশ উল্লেখ করার মাধ্যমে বক্তব্য শুরু হতো এবং পুত্র-কন্যার অংশ পরে বলা হতো তাহলে পিতা-মাতার অংশের পর মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা না বলে পুত্র-কন্যার অংশের পর মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা বলা হতো। ৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোনের অংশের পর মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা উল্লেখ না করার মাধ্যমে ৪:১১ আয়াতে পুত্র-কন্যার অংশ বর্ণনার সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখা হয়েছে।

২৮. আউল সমস্যা সমাধানকল্পে কৃত একটি ব্যাখ্যা এবং তার পর্যালোচনা
আউল সমস্যা সমাধানকল্পে কৃত একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে, দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যা পাবে ২/৩   এবং একটিমাত্র কন্যা থাকলে সে পাবে ১/২  ; এটি শুধু তখন যখন পিতা-মাতা ও স্বামী/ স্ত্রী নেই, সাথে কোনো পুত্র থাকুক বা না থাকুক। এক পুত্র পাবে দুই কন্যার সমান তথ্যটি শুধুমাত্র যখন পুত্র-কন্যা মিলিতভাবে আছে তখন প্রযোজ্য। 
যদি পিতা-মাতা ও স্বামী/স্ত্রী থাকে, তাহলে প্রথমে পিতা-মাতা ও স্বামী/ স্ত্রী তাদের অংশ পাবে, তারপর বাকি সম্পূর্ণ অংশ দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যা পাবে বা একটিমাত্র কন্যা পাবে, যেমন এক বা একাধিক পুত্র বা পুত্র-কন্যা পায়। 
আর যেখানে পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতার ওয়ারিস হওয়ার কথা বলা হয়েছে তার অর্থ হলো পিতা-মাতা একমাত্র ওয়ারিস হওয়া। এ অবস্থায় মাতা ১/৩  এবং পিতা পাবে ২/৩ । কিন্তু যদি পিতা-মাতার সাথে অন্য কেউ থাকে তাহলে তার অংশ দেয়ার পর অবশিষ্ট থেকে মাতা পাবে ১/৩  এবং পিতা পাবে ২/৩ । অনুরূপভাবে ৪:১৭৬ আয়াতে ভাইকে বোনের ওয়ারিস করা হয়েছে তার অর্থ হলো সম্পূর্ণ বা অবশিষ্ট সম্পূর্ণ অংশের ওয়ারিস হওয়া। 
পর্যালোচনা
এ ব্যাখ্যা অনুসারে একজন ব্যক্তির যদি একটিমাত্র পুত্র থাকে সে বা একটি পুত্র ও একটি কন্যা থাকে তারা পাবে সম্পূর্ণ, যেমন ৬/৬ , যদি পুত্র না থাকা অবস্থায় একটি মাত্র কন্যা থাকে সে পাবে অর্ধেক, যেমন ৩/৬ , যদি পুত্র না থাকা অবস্থায় ১০ টি কন্যা থাকে তবু তারা পাবে দুই তৃতীয়াংশ, যেমন ৪/৬  । প্রশ্ন হলো, কেন একটি মাত্র কন্যা শুধু কন্যাদের সংখ্যা যদি ১০ জনও হয় তাদের চেয়ে বিশেষ গুরুত্ব পায়? কেন ১ পুত্রের সাথে থাকা একটি কন্যা এক তৃতীয়াংশ পায় অথচ পুত্র না থাকা অবস্থায় দশ কন্যা মিলে ২/৩  পায়? কেন পুত্র না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র বা একাধিক কন্যা ১/২   বা ২/৩  পায় তথা কেন তারা সম্পূর্ণ সম্পত্তি পায় না? অবশিষ্ট সম্পত্তি কেন অবন্টিত অবস্থায় থেকে যাবে? আর যদি বন্টন করা হয় তবে তা কে পাবে? একটি ব্যাখ্যা হতে পারে যে, তা জাতীয় সম্পত্তির আওতাভুক্ত হবে। কিন্তু এছাড়া অন্য যত ব্যাখ্যা দেয়া হোক তাতে আপত্তি থেকে যায় যে, কিভাবে অন্যান্য ওয়ারিস নির্ধারণ করা হবে যাদেরকে কুরআনে ওয়ারিস করা হয়নি? 
এ ব্যাখ্যা অনুসারে, যদি একটিমাত্র কন্যা থাকে সাথে আর কেউ না থাকে তবে কন্যাটি পাবে অর্ধেক যেমন ৩/৬ । কিন্তু যদি পিতা ও কন্যা থাকে, তবে পিতা পাবে ১/৬  এবং কন্যাটি পাবে ৫/৬ । প্রশ্ন হচ্ছে, পিতা থাকা অবস্থায় সে বেশি পাচ্ছে অথচ তার সাথে কেউ না থাকলে সে কম পাচ্ছে এর কারণ কী? 
এ ব্যাখ্যাতে যে তথ্যটি তুলে ধরা হয়েছে যে, ‘একটিমাত্র কন্যা ১/২  পাবে এবং দুইয়ের বেশি কন্যা ২/৩  পাবে যখন তার বা তাদের সাথে অন্য কোনো ওয়ারিস নেই’, এ তথ্যটির কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি। কারণ একইভাবে বলা যায়, পুত্র থাকা অবস্থায় পিতা-মাতার যে অংশ বলা হয়েছে স্বামী/ স্ত্রী থাকলে তা কার্যকর হবে না, পুত্র থাকা অবস্থায় স্বামী/ স্ত্রীর যে অংশ বলা হয়েছে পিতা-মাতা থাকলে তা কার্যকর হবে না ইত্যাদি। সুতরাং এরূপ ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। বরং যার থাকা বা না থাকাকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে সে ছাড়া অন্য কেউ থাকুক বা না থাকুক উভয় অবস্থায় বর্ণিত অংশ কার্যকর হবে, এটাই যৌক্তিক ব্যাখ্যা হয়। 
সুতরাং যে আউল সমস্যা সমাধানের জন্য শুধু কন্যার বা শুধু কন্যাদের অংশ তারা একমাত্র ওয়ারিস হওয়ার সময় কার্যকর বলা হচ্ছে সে আউল সমস্যা আসলে কোনো সমস্যাই নয়। কারণ প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেকের জন্য বর্ণিত অংশ হচ্ছে তার শ্রেণিগত আনুপাতিক অংশ। এ ব্যাখ্যাটি আউল সমস্যাকে সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত না করে বরং আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিকেই উত্তরাধিকার বণ্টনের পদ্ধতি হিসেবে চিহ্নিত করে। 
 
২৯. পুত্র-কন্যার অংশ নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ব্যাখ্যা ও তার পর্যালোচনা
পুত্র-কন্যার অংশ নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ব্যাখ্যা হলো: এক পুত্র পাবে দুই কন্যার সমান, কিন্তু যদি কন্যা সংখ্যা দুইয়ের বেশি হয় তাহলে কন্যারা পাবে ২/৩  এবং এক বা একাধিক পুত্র পাবে ১/৩ । অন্যদিকে যদি কন্যা সংখ্যা মাত্র একজন হয় তাহলে কন্যাটি পাবে ১/২  এবং এক বা একাধিক পুত্র পাবে ১/২ । 
এ ব্যাখ্যাটির পর্যালোচনায় বলা যেতে পারে, ব্যাখ্যাটি আক্ষরিকতাবাদের প্রভাবে প্রভাবিত যুক্তির ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু আরবি ভাষারীতি এবং যৌক্তিকতা যাচাই করলে ব্যাখ্যাটি গ্রহণযোগ্য হয় না। কারণ ৪:১১ আয়াতে ব্যবহৃত শব্দাবলির বিন্যাস থেকে স্পষ্ট যে, দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যার অংশ ২/৩  এবং একটিমাত্র কন্যার অংশ ১/২  কার্যকর হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সাথে কোনো পুত্র না থাকার শর্ত প্রযোজ্য। আর যৌক্তিকতা চিন্তা করলেও বুঝা যায় যে, একটিমাত্র কন্যার বিপরীতে যত পুত্রই থাকুক না কেন কন্যাটি পাবে ১/২   এবং পুত্ররা সম্মিলিতভাবে ১/২ , আবার একটিমাত্র পুত্রের বিপরীতেও যদি দশজন কন্যা থাকে তবুও ঐ দশ কন্যা সম্মিলিতভাবে পাবে ২/৩  এবং পুত্রটি একাই পাবে ১/৩  এটি যুক্তিসিদ্ধ নয়।

৩০. পুত্র-কন্যার অংশ নির্ধারণের ক্ষেত্রে আরও একটি ব্যতিক্রমধর্মী ব্যাখ্যা ও তার পর্যালোচনা
পুত্র-কন্যার অংশ নির্ধারণের ক্ষেত্রে আরও একটি ব্যতিক্রমধর্মী ব্যাখ্যা হলো: প্রতি এক পুত্র পাবে প্রতি দুই কন্যার সমান। যদি প্রতি এক পুত্রের বিপরীতে মাত্র একজন করে কন্যা থাকে তাহলে প্রতি এক কন্যা পাবে প্রতি এক পুত্রের অর্ধেক। কিন্তু যদি প্রতি এক পুত্রের বিপরীতে দুইয়ের বেশি কন্যা থাকে তাহলে তারা পাবে ২/৩  এবং পুত্র বা পুত্ররা পাবে ১/৩ । 
এ ব্যাখ্যাটির পর্যালোচনায় বলা যেতে পারে, ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত ভাইবোনের ক্ষেত্রেও কি অনুরূপ কথা প্রযোজ্য? এর উত্তর হলো, না। বরং আয়াতটি থেকে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, একজনমাত্র বোন থাকলে এবং ভাই না থাকলে বোন পাবে ১/২ । দুইজন বোন থাকলে এবং ভাই না থাকলে তারা পাবে ২/৩ । শুধু ভাই (বা ভাইয়েরা) থাকলে সে (বা তারা) ওয়ারিস হবে। ভাই-বোন মিলিতভাবে থাকলে এক ভাই পাবে দুই বোনের সমান।  সুতরাং ৪:১১ আয়াতে বর্ণিত পুত্র/কন্যার অংশ সম্পর্কে আরবি ভাষারীতি এবং আয়াতসমূহের সমন্বিত তথ্যভিত্তিক অনুবাদের বিপরীতে উপরিউক্ত প্রস্তাবনাটি গ্রহণযোগ্য নয়।
৩১. ‘আও’ এর অর্থ
‘অথবা’ ও ‘এবং’ এ দুটি শব্দের পাশাপাশি আরেকটি প্রয়োজনীয় শব্দগুচ্ছ হচ্ছে ‘অথবা/ এবং’। অর্থাৎ ‘অথবা’ ‘এবং’ শব্দ দুটি দ্বারা যে বিপরীত দুটি অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়, তার সাথে আরেকটি অভিব্যক্তির জন্য ‘অথবা/ এবং’ শব্দগুচ্ছের প্রয়োজন হয়। 
‘অথবা/ এবং’ ও ‘এবং/ অথবা’ একই অর্থ প্রকাশক। যদি আরবিতে ‘অথবা’ বুঝাতে একটি শব্দ এবং ‘এবং’ বুঝাতে অন্য একটি শব্দ ব্যবহৃত হয়, কিন্তু ‘অথবা/ এবং’ বুঝাতে ঐ দুটি শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ ব্যবহৃত না হয়, তাহলে ঐ দুটি শব্দের কোনো একটি একই সাথে ‘অথবা/ এবং’ অভিব্যক্তির জন্যও ব্যবহৃত হওয়ার কথা। 
‘অথবা’ এর আরবী ‘আও’। ‘এবং’ এর আরবী ‘ওয়া’। প্রশ্ন হচ্ছে ‘অথবা/ এবং’ এর আরবি হিসেবে ‘আও’ ব্যবহৃত হবে নাকি ‘ওয়া’ ব্যবহৃত হবে? যদি এজন্য ‘আও’ ব্যবহৃত হয়, তাহলে এর অর্থ হবে ‘অথবা/ এবং’। কারণ ‘আও’ এর প্রাথমিক অর্থ হচ্ছে ‘অথবা’। আর যদি এজন্য ‘ওয়া’ ব্যবহৃত হয়, তাহলে এর অর্থ হবে ‘এবং/ অথবা’। কারণ ‘ওয়া’ এর প্রাথমিক অর্থ হচ্ছে ‘এবং’। তাই শব্দার্থ লেখার ক্ষেত্রে ‘/’ চিহ্নের আগে প্রাথমিক অর্থ এবং পরে দ্বিতীয় ধরনের অর্থ লেখা হবে। 
যদি ‘আও’ এর অর্থ ‘অথবা/ এবং’ হয়, তাহলে ‘ওয়া’ এর অর্থ ‘এবং/ অথবা’ হতে পারে না। কারণ সেক্ষেত্রে ‘আও’ এবং ‘ওয়া’ এর অর্থের মধ্যে কোনো তফাৎ থাকে না। সুতরাং ‘অথবা/ এবং’ বা ‘এবং/ অথবা’ যা-ই বলা হোক, এ অভিব্যক্তি প্রকাশের জন্য হয় ‘আও’ ব্যবহৃত হবে, না হয় ‘ওয়া’ ব্যবহৃত হবে, এ দুটির উভয়টি ব্যবহৃত হতে পারে না। 
উপর্যুক্ত যুক্তিটি গাণিতিক ধরনের যুক্তি। তাই এ যুক্তির ভিত্তিতে শব্দ দুটির প্রায়োগিকতা পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি। উত্তরাধিকার বন্টন বিধিতে দুই স্থানে এ অর্থ নির্ণয়ের প্রভাব রয়েছে। একটি হচ্ছে, ওয়াসিয়্যাত ও দাইন (ঋণ) বিষয়ে ‘আও’ শব্দের ব্যবহার। অন্যটি হচ্ছে, ওয়া লাহু আখুন আও উখতুন ............ ফাইন কানূ আকছারা মিন যালিকা ........ বাক্যে ‘আও’ শব্দের ব্যবহার ও পরবর্তী বাক্যাংশের অর্থ নির্ণয়ে এর প্রভাব। 
আল কুরআনে ‘আও’ এর প্রায়োগিকতা তথা প্রায়োগিক অর্থ হিসেবে ‘অথবা/এবং’ সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়। কারণ ২৩:৫-৭ আয়াতে ‘আজওয়াজিহিম’ এবং ‘মা মালাকাত আইমানুহুম’ এর মধ্যে ‘আও’ ব্যবহৃত হয়েছে। আর বক্তব্যের স্বত:সিদ্ধ অভিব্যক্তি থেকেই সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, এখানে ‘আও’ এর অর্থ ‘অথবা/ এবং’। শুধু ‘আও’ শব্দ দ্বারা শুধু ‘অথবা’ নয়, বরং ‘অথবা/ এবং’ বুঝায়। এ বিষয়ে আরেকটি উদাহরণ হলো ৭৬:২৪ আয়াত :: ফাসবির লিহুকমি রব্বিকা ওয়া লা তুতি’ মিনহুম আছিমান আও ইছমান। এ আয়াতে ব্যবহৃত ‘আও’ শব্দটিরও অর্থ হলো ‘অথবা/এবং’।
‘আও’ দ্বারা যুক্ত দুটি অপশনের একটি অথবা উভয়টি একসাথে প্রযোজ্য হতে পারে। আবার ‘ওয়া’ দ্বারা যুক্ত দুটি বিষয়ের মধ্য থেকেও কখনও একটি বিষয় এবং কখনও উভয় বিষয় উপস্থিত থাকতে পারে। সুতরাং ‘আও’ এবং ‘ওয়া’ এর পার্থক্য হলো: যখন একাধিক বিষয়ের কোনো একটি বা সবকটির প্রযোজ্যতা নির্দেশ করা হয় তখন ‘আও’ ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে যখন একাধিক বিষয়ের সংযোজনকে গুরুত্ব দেয়া হয় তখন ‘ওয়া’ ব্যবহার করা হয়, বাস্তবে কখনো কখনো তার মধ্যকার কোনো কোনো বিষয়ের উপস্থিতি নাও থাকতে পারে।
শুধুমাত্র অভিধান থেকে ‘আও’ শব্দের এ ধরনের ব্যবহারিক অর্থ নাও বুঝা যেতে পারে। কুরআনে ব্যবহৃত আরবি শব্দগুলো আল কুরআনে কি অর্থে প্রয়োগ করা হয়েছে তার জন্য দুটি মূল ভিত্তিগত উপাদান হচ্ছে: ক. শব্দটির শব্দমূল খ. কুরআনে শব্দটির প্রায়োগিকতা। 
‘ওয়া’ শব্দ দ্বারা সবসময় দুটি ভিন্ন বিষয়কে যোগ করা হয় না, বরং অনেক সময় একই বিষয়ের দুটি ভিন্ন ব্যাখ্যাকে বা বিশেষণকেও যোগ করা হয়। তবে ‘ওয়া’ শব্দটির অর্থ ‘এবং’। অন্যদিকে ‘আও’ শব্দের অর্থ দুটি (১) ‘অথবা’ (২) ‘অথবা/এবং’।

৩২. ‘ফাইন কানূ আকছারা মিন যালিকা’
ফাইন কানূ = তারপর যদি তারা হয়। আকছারা মিন যালিকা = সেটার চেয়ে বেশি। 
‘ফা-ইন কানূ আকছারা মিন যালিকা’ বলতে বুঝায় যদি তারা সেটার চেয়ে বেশি হয় তথা একাধিক হয়। অর্থাৎ একাধিক ভাই হোক বা একাধিক বোন হোক বা ভাই-বোন হোক।
‘ফা-ইন কানূ আকছারা মিন যালিকা’ (৪:১২) এর অনুবাদ অনেকে এভাবে করেন যে, ‘যদি তারা সেটার চেয়ে বেশি হয় তথা দুইয়ের বেশি হয়’। কিন্তু এর পূর্বের অংশে এক ভাই বা এক বোন এর কথা বলা হয়েছে। এখন, সেটার চেয়ে বেশি হওয়ার অর্থ হলো একের চেয়ে বেশি হওয়া তথা একাধিক হওয়া। যেমন,একাধিক ভাই বা একাধিক বোন বা ভাই-বোন। সুতরাং সঠিক অর্থ হবে, যদি তারা সেটার চেয়ে বেশি হয় তথা একের বেশি (বা একাধিক) হয়’। 

একাধিক এর ন্যুনতম পরিমাণ হলো দুই। যারা একের বেশি হওয়ার পরিবর্তে দুইয়ের বেশি হওয়ার অনুবাদ করেছেন তাঁরা এক ভাই বা এক বোন এর বিষয়কে মোট দুজন হিসাবে নিয়েছেন, যা যৌক্তিক নয়। এছাড়া, তাঁরা ‘ফালিকুল্লি ওয়াহিদিম মিনহুমা’ এর দ্বারা মনে করেছেন এক ভাই ও এক বোন একসাথে উপস্থিত। অথচ ‘আখুন আও উখতুন’ শব্দগুচ্ছের ‘আও’ শব্দ দ্বারা স্পষ্ট যে, এক ভাই থাকা অবস্থায় কোনো বোন নেই আর এক বোন থাকা অবস্থায় কোনো ভাই নেই, এরূপ অবস্থাও আয়াতে বিবৃত হয়েছে। সুতরাং ‘ফালিকুল্লি ওয়াহিদিম মিনহুমা’ বাক্যাংশের একটি অর্থ হবে, ‘তাদের দুজনের যেই থাকুক সেই একজনের জন্য’। আর ‘ফা-ইন কানূ আকছারা মিন যালিকা’ দ্বারা যেমন ভাই একাধিক হতে পারে, তেমনি বোন একাধিক হতে পারে আবার ভাই-বোন উভয়েও থাকতে পারে, তাতে কোনো আপত্তি নেই। কারণ এখানে ভাই ও বোনদের মধ্য থেকে ভাইদের সাথে বোনেরা থাকতে পারবে না বা বোনদের সাথে ভাইয়েরা থাকতে পারবে না এরূপ কোনো শর্ত প্রযোজ্য নয়। বরং ‘আও’ শব্দের একটি অর্থ ‘অথবা/এবং’ হওয়ায় এক ভাই ও এক বোন মিলে মোট দুজন থাকলেও তাদের প্রত্যেকে সমানভাবে তথা এক ষষ্ঠাংশ ১/৬  করে পাবে, যার স্বাভাবিক যোগফল দাঁড়াচ্ছে তারা উভয়ে মিলে মোট এক তৃতীয়াংশ ১/৩  পাবে। 

এখন প্রশ্ন দাঁড়ায় যদি একাধিক ভাই বা একাধিক বোন অথবা একাধিক ভাই ও একাধিক বোন থাকে তাহলে তাদের সম্মিলিত অংশ কত হবে? এবং তাতে তারা পরস্পর সমানুপাতে পাবে কিনা? পরবর্তী অংশে যদি তারা এর বেশি হয় তথা একাধিক হয় বিচ্ছিন্নভাবে ভাইয়ের সংখ্যা বা বোনের সংখ্যা বা সম্মিলিতভাবে ভাই ও বোনের সংখ্যা, তবে তারা একত্রে এক তৃতীয়াংশ পাবে, অর্থাৎ এক ভাই ও এক বোন মোট এ দুজনে মিলে যেমন এক তৃতীয়াংশ পায়, এক্ষেত্রেও তাদের জন্য তেমনি মোট এক তৃতীয়াংশই বরাদ্দ থাকবে, তাদের সংমিশ্রণ যেভাবেই হোক না কেন। আর যেহেতু এক ভাই বা এক বোন অথবা মিলিতভাবে এক ভাই ও এক বোন থাকা অবস্থায় এক ভাই ও এক বোন পরস্পর সমানুপাতে পায়, সুতরাং স্বত:সিদ্ধভাবে এক্ষেত্রেও তারা শরিক হবে কথাটির অর্থ হচ্ছে তারা পরস্পর সমানুপাতে/ সমান হারে শরিক হবে। এখানে তাদেরকে অসমান হারে (যেমন ভাই পাবে  বোনের দ্বিগুণ এরূপভাবে) দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।

৩৩. ‘ফাহুম শুরাকাউ’ (৪:১২)
ফাহুম = তাহলে তারা (হবে)। শুরাকাউ (শরীক এর বহুবচন) = শরিকগণ/ অংশীদারগণ। 
৪:১২ আয়াতে বর্ণিত, ‘যদি তারা সেটার অধিক হয় তবে তারা ১/৩  অংশে শরিক হবে’ বলতে বুঝানো হয়েছে একাধিক ভাই বা একাধিক বোন বা ভাই-বোন থাকলে তারা ১/৩   অংশে শরিক হবে। আর এখানে তারা প্রত্যেকে সমানভাবে শরিক হবে। কারণ, বক্তব্যের প্রথম অংশে এক ভাইয়ের জন্য ১/৬   অথবা এক বোনের জন্যও ১/৬  দেয়া হয়েছে তথা ভাই বা বোন যেই হোক উভয়ে একই পরিমাণ পাচ্ছে। সুতরাং এখানে ভাই-বোন মিলিতভাবে থাকলেও তারা পরস্পর সমানভাবে পাবে, এক ভাই দুই বোনের সমান পাবে না। 

৩৪. ‘ইসমে কানা’ ও ‘খবরে কানা’
‘ইসমে কানা/ইয়াকুন’ (‘কানা’ ক্রিয়ার বিশেষ্য) হিসেবে যদি কোনো বিশেষ্য উল্লেখ থাকে তাহলে সেটাই হলো ‘ইসমে কানা’। অন্যথায় ‘হুয়া/হিয়া’ কে ‘ইসমে কানা’ হিসেবে ধরা হয়। আর ‘কানা’ ক্রিয়ার কর্তা (্ইসমে কানা) সম্পর্কে যে তথ্যটি উল্লেখ করা হয় সেটাই হলো ‘খবরে কানা’ (‘কানা’ ক্রিয়ার তথ্য)।
৪:১১, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে উল্লেখিত ‘ইসমে কানা/ইয়াকুন’ এবং ‘খবরে কানা/ইয়াকুন’
৩৫. ‘ওয়ারযুক্বূহুম ফীহা’ বনাম ‘ফারযুক্বূহুম মিনহু’ (৪:৫, ৪:৮)
৪:৫ আয়াতে ইয়াতীমরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাদের সম্পদের ব্যবস্থাপনাকারী অভিভাবকদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, ওয়ারযুক্বূহুম ফীহা। আর ৪:৮ আয়াতে ওয়ারিস আত্মীয়দের মধ্যে সম্পদ বণ্টনের সময়কালে উপস্থিত ওয়ারিস নয় এমন আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম এবং অভাবগ্রস্তদেরকে বণ্টিত সম্পদ থেকে খরচ করে কিছু দেয়ার জন্য বলা হয়েছে, ফারযুক্বুহুম মিনহু। এই প্রেক্ষিতে ওয়ারযুক্বুহুম ফীহা এবং ফারযুক্বুহুম মিনহু বাক্য দুটির মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে আলোকপাত করা প্রয়োজন। 
ওয়ারযুক্বুহুম ফীহা (সেটার মধ্যে তাদেরকে উপজীবিকা দাও) বাক্যটির অর্থ হলো ইয়াতীমদেরকে তাদের সম্পদের মধ্যে উপজীবিকা দিয়ে যেতে হবে, অর্থাৎ এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সম্পদে তাদের মালিকানা বজায় থাকবে কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মালিকানার প্রয়োগ/ ব্যবস্থাপনা তাদের হাতে থাকবে না, তাই তাদেরকে তাদের সম্পদ থেকে উপজীবিকা দিয়ে যেতে হবে, ব্যবস্থাপনা করবে অন্য কেউ। এতে ইয়াতীমদের সম্পদের ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে তোমাদের সম্পদ শব্দটি দ্বারা বুঝানো হয়েছে, তোমরা (ব্যবস্থাপনা পরিষদ) ও তারা (স্বত্বাধিকারী) মিলে যে ‘বৃহত্তর তোমরা’, এই তোমাদের সম্পদকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে নষ্ট হতে দেয়া যাবে না। যেহেতু সম্পদ সুষ্ঠুভাবে আবর্তিত হলে তা সবার সম্পদে পরিণত হতে থাকে, তাই বিশেষ তাৎপর্যমন্ডিতভাবে একে তোমাদের সম্পদ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। 
ফারযুক্বূহুম মিনহু (তাদেরকে তা থেকে উপজীবিকা দাও) বাক্যটির অর্থ হলো, বণ্টিত সম্পদ থেকে যাদের দ্বারা সাধ্যানুসারে সম্ভব তারা ওয়ারিস নয় এমন আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও অভাবগ্রস্তদেরকে এককালীন কিছু উপজীবিকার সরবরাহ করতে হবে, অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। একটি কল্যাণ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য এ নির্দেশনা পরিপালনের ক্ষেত্রে লক্ষ রাখা উচিত যে, এটি যেন নামমাত্র আদেশ পালন না হয়, বরং মানবতাবোধ, কল্যাণ মনোভাব এবং আল্লাহর আদেশ পালনে নিষ্ঠার ভিত্তিতে আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও অভাবগ্রস্তদেরকে সাধ্যমতো অনুদান দেয়া উচিত।
পরিশিষ্ট ২: কালালাহ: প্রচলিত ধারণা ও প্রকৃত সংজ্ঞা
প্রথম ভাগ: কালালাহ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা ও তার পর্যালোচনা
উত্তরাধিকার বণ্টন বিধির ক্ষেত্রে কালালাহ এর সংজ্ঞা সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়। অভিধানে ও আরবি সাহিত্যে ‘কালালাহ’ শব্দ যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তাতে এর অর্থ নিয়ে মতভেদ তৈরি হয়েছে এবং কোনো অর্থকে সুনির্দিষ্ট করা কঠিন হয়েছে। কারণ মৃত ব্যক্তিকে যেমন কালালাহ বলা হয় তেমনি আবার মৃত ব্যক্তির ভাই-বোনকেও কালালাহ বলা হয়। এছাড়া কালালাহ হওয়ার শর্ত হিসেবে তিন ধরনের শর্তের ধারণা রয়েছে। যেমন: (১) মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকা, অথবা (২) মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা না থাকা অথবা (৩) মৃত ব্যক্তির সন্তান ও পিতা-মাতা না থাকা। লক্ষণীয় যে, কে এবং কোন শর্তে কালালাহ এ দুটি পয়েন্টের উপর ভিত্তি করে গাণিতিকভাবেই কালালাহ এর ছয়টি সংজ্ঞা তৈরি হয়। এর মধ্য থেকে একেকজন একেক সংজ্ঞাকে অগ্রাধিকার দিতে পারেন কিন্তু অন্য সংজ্ঞাগুলোকে ভুল বলতে পারেন না। 
কে এবং কোন শর্তে কালালাহ এর ভিত্তিতে কালালাহ এর সংজ্ঞাসমূহ
কে কালালাহ (মৃত ব্যক্তি নাকি মৃত ব্যক্তির ভাই-বোন?) এবং কোন শর্তে কালালাহ (মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকলে? নাকি মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা না থাকলে নাকি মৃত ব্যক্তির সন্তান ও পিতা-মাতা না থাকলে?) এ দুটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে কালালাহ এর নিম্নোক্ত ছয়টি সংজ্ঞা তৈরি হয়: 
১. যে মৃত ব্যক্তির সন্তান নেই সে কালালাহ। 
২. যে মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা নেই সে কালালাহ। 
৩. যে মৃত ব্যক্তির সন্তান ও পিতা-মাতা নেই সে কালালাহ। 
৪. যে মৃত ব্যক্তির সন্তান নেই তার ভাই-বোন (বা ভাই-বোন ও চাচা, মামা, ফুফু খালা) কালালাহ। 
৫. যে মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা নেই তার ভাই-বোন (বা ভাই-বোন ও চাচা, মামা, ফুফু খালা) কালালাহ। 
৬. যে মৃত ব্যক্তির সন্তান ও পিতা-মাতা নেই তার ভাই-বোন (বা ভাই-বোন ও চাচা, মামা, ফুফু খালা) কালালাহ। 
এ ছয়টি সংজ্ঞার মধ্য থেকে কোনো একটি সংজ্ঞাকে ১০০% নিশ্চয়তা দিয়ে একমাত্র সঠিক না বলে বরং কেউ একটি সংজ্ঞাকে অগ্রাধিকারযোগ্য মনে করেন এবং কেউ অন্য একটি সংজ্ঞাকে অগ্রাধিকারযোগ্য মনে করেন। এর ফলে কালালাহ এর বিধান এক ধরনের অনিশ্চিত অবস্থায় পতিত হয়। 
সাধারণ বিবেকবুদ্ধি (Common sense) অনুযায়ী বলা যায় যে, এর মধ্য থেকে কোনো একটি সংজ্ঞাই সঠিক হতে পারে অথবা একাধিক সংজ্ঞা সঠিক হলে সংজ্ঞাগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় থাকবে বা কোন সংজ্ঞাটি কোন অবস্থায় প্রযোজ্য হবে তার নির্দিষ্টতা থাকবে। উত্তরাধিকারের বন্টনবিধি সম্বলিত শেষ আয়াতটিতে (যা কালালাহ সম্পর্কিত আয়াত) উল্লেখ করা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ এমনভাবে বিধান বর্ণনা করেছেন যে, মানুষ বিভ্রান্ত হবে না। সুতরাং কালালাহর সংজ্ঞা এমন অনিশ্চিত হওয়া অসম্ভব। উত্তরাধিকার সম্পর্কিত আয়াতসমূহকে গভীর চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে (হক আদায় করে) তিলাওয়াত করলে নিশ্চয় সঠিক সংজ্ঞা নির্ণয় করা সম্ভব। 
এক্ষেত্রে প্রথম বিবেচ্য হচ্ছে প্রচলিত সংজ্ঞাগুলোর মধ্যে সঠিক সংজ্ঞা পাওয়া যাবে কিনা? তথা মৃত ব্যক্তির সন্তান/ পিতা-মাতা/ সন্তান ও পিতা-মাতা না থাকার শর্ত সম্পর্কিত ধারণাটি সঠিক কিনা তা নির্ণয় করা। তারপর দ্বিতীয় বিবেচ্য হচ্ছে শর্ত সম্পর্কিত উপরোল্লিখিত ধারণা সঠিক হলে তার মধ্যকার কোন শর্তটি বা কোন অবস্থার ক্ষেত্রে কোন শর্তটি প্রযোজ্য হবে তা নির্ণয় করা। এক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য বিষয় হলো, আয়াতসমূহ থেকে কিভাবে কালালাহ এর সংজ্ঞা নির্ণয় করা যায়?  
কালালাহ সম্পর্কিত দুটি আয়াত (৪:১২ ও ৪:১৭৬) ভাই-বোনের অংশ বর্ণনা করে। ৪:১৭৬ আয়াতে মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকার শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে। এখান থেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট যে, (ক) কালালাহ এর সংজ্ঞার ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির ভাই-বোন একটি অনিবার্য প্রসংগ, কালালাহ মৃত ব্যক্তি নিজে হোক বা তার ভাই-বোন হোক তা নির্ণয় করতে হবে কিন্তু এ দুটির যেটিই হোক, ভাই-বোন একটি অনিবার্য প্রসংগ। (খ) কালালাহ এর সংজ্ঞার ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকার শর্তটি কালালাহর সংজ্ঞা নির্ণয়ে একটি শর্ত অন্তত ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত কালালাহর সংজ্ঞা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এ শর্তটিই প্রযোজ্য। সুতরাং ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত কালালাহ এর ক্ষেত্রে ভিন্ন কোনো শর্ত রয়েছে কিনা এবং সেই প্রেক্ষিতে কোন আয়াতে কাকে (মৃত ব্যক্তি বা তার ভাই-বোন) কালালাহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেটাই নির্ণেয় বিষয়। কারণ ৪:১২ আয়াতে ভাই-বোনের জন্য যে আনুপাতিক অংশ নির্ধারিত করা হয়েছে ৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোনের জন্য তা থেকে ভিন্নরূপ আনুপাতিক অংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। 
৪:১২ আয়াতে মৃত ব্যক্তিকে কালালাহ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ৪:১২ আয়াতে কালালাহ এর সন্তান বা পিতা-মাতা বা সন্তান ও পিতা-মাতা না থাকার কথা সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। পক্ষান্তরে ৪:১৭৬ আয়াতে মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকার শর্ত স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু মৃত ব্যক্তি কালালাহ নাকি তার ভাই-বোন কালালাহ তা সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোনের জন্য প্রদত্ত অংশ ভিন্নরূপ হওয়ার কারণেই কালালাহ এর সংজ্ঞা নির্ণয় এবং কোন সংজ্ঞার ভিত্তিতে ভাই-বোন কোন আয়াতে বর্ণিত আনুপাতিক অংশ লাভের অধিকারী হবে তা উত্তরাধিকারের বিধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ সমস্যার সমাধানের জন্য বিভিন্ন বিকল্প সমাধান প্রস্তাব করা হয়। এসব সমাধান প্রস্তাবনার পর্যালোচনার মাধ্যমে কোনটি প্রকৃত সমাধান হিসেবে গ্রহণযোগ্য তা নির্ণয় করা প্রয়োজন।
কালালাহ সমস্যার প্রথম সমাধান প্রস্তাবনা ও তার পর্যালোচনা
প্রস্তাবনা: একটি সমাধান চিন্তা করা হয়েছে এভাবে যে, ৪:১৭৬ আয়াত ৪:১২ আয়াতের কালালাহ সম্পর্কিত অংশকে মানছুখ (রহিত) করেছে। 
পর্যালোচনা: এ সমাধান স্পষ্টত কুরআন পরিপন্থী সমাধান, তাই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ কুরআন স্ববিরোধমুক্ত এবং তাই এর কোনো আয়াত বা আয়াতাংশ মানছুখ (রহিত) হয়নি। 
কালালাহ সমস্যার দ্বিতীয় সমাধান প্রস্তাবনা ও তার পর্যালোচনা
প্রস্তাবনা: ৪:১২ আয়াতে ভাই-বোন বলতে বৈপিত্রেয়/ মাতৃশরিক ভাই-বোনের অংশ বর্ণনা করা হয়েছে এবং ৪:১৭৬ আয়াতে বৈমাত্রেয়/ পিতৃশরিক ও পূর্ণ আপন/ পিতৃমাতৃ উভশরিক ভাই-বোনের অংশ বর্ণনা করা হয়েছে। 
পর্যালোচনা: এ সমাধানটিও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ আয়াতদুটিতে ব্যবহৃত ‘আখুন, উখতুন, ইখওয়াতুন’ এর অর্থ এক আয়াতে এক ধরনের ভাই-বোন, অন্য আয়াতে অন্য ধরনের ভাই-বোন ধরে নেয়া একটি চাপিয়ে দেয়া বিষয় যার কোনো অবকাশ নেই। এছাড়া ৪:১৭৬ আয়াতে নি:সন্তান ব্যক্তির ভাই-বোনের সম্পদে তার ভাই-বোনকে উত্তরাধিকার প্রদান করে তাদেরকে কালালাহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, ঐ মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক। তাই এ দাবিটি গ্রহণযোগ্য নয়। 
কালালাহ সমস্যার তৃতীয় সমাধান প্রস্তাবনা ও তার পর্যালোচনা
প্রস্তাবনা: ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত কালালাহ এবং ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত কালালাহ হওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত ভিন্ন। এক্ষেত্রে আবার তিনটি ভিন্ন অভিমত তৈরি হয়েছে। যথা: 
অভিমত ১: কালালাহ বলতে ৪:১২ আয়াতে বুঝিয়েছে সেই মৃত ব্যক্তি যার সন্তান নেই এবং ৪:১৭৬ আয়াতে বুঝিয়েছে সেই মৃত ব্যক্তি যার সন্তান ও পিতা-মাতা নেই। 
অভিমত ২: কালালাহ বলতে ৪:১২ আয়াতে বুঝিয়েছে সেই মৃত ব্যক্তি যার পিতা-মাতা নেই এবং ৪:১৭৬ আয়াতে বুঝিয়েছে সেই মৃত ব্যক্তি যার সন্তান ও পিতা-মাতা নেই। 
অভিমত ৩: কালালাহ বলতে ৪:১২ আয়াতে বুঝিয়েছে সেই মৃত ব্যক্তি যার সন্তান ও পিতা-মাতা নেই এবং ৪:১৭৬ আয়াতে বুঝিয়েছে সেই মৃত ব্যক্তি যার সন্তান নেই। 
পর্যালোচনা:
অভিমত ১ ও ২ এর পর্যালোচনা 
৪:১৭৬ আয়াতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যদি কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে যার সন্তান নেই এবং ........। আয়াতে যে বর্ণনারীতিতে কালালাহ সম্পর্কিত সম্পত্তির বন্টনবিধির বন্টন বিধি উল্লেখ করা হয়েছে তাতে এ আয়াতে বর্ণিত কালালাহ এর সংজ্ঞা হিসেবে মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকার কারণে তার ভাই-বোনের সাথে তার কালালাহ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট, মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক উভয় অবস্থায় এ কথা প্রযোজ্য। এছাড়া যদি এ আয়াতে বলা হতো যে, যে কালালাহ এর সন্তান/পিতা-মাতা নেই, .... অথবা যদি এ আয়াতে বলা হতো যে, যদি কোনো ব্যক্তি নি:সন্তান হয় এবং তার পিতা-মাতাও না থাকে, ..........; শুধু এ দুটি বর্ণনার কোনো একটি উল্লেখ থাকলে অভিমত ১ বা ২ গ্রহণযোগ্য হতে পারতো। কিন্তু আয়াতটিতে এ দুটি বর্ণনার কোনো একটিও উল্লেখ করা হয়নি। বরং বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নি:সন্তান অবস্থায় মারা যায় এবং ..........। তাই অভিমত ১ ও ২ গ্রহণযোগ্য নয়। 

অভিমত ১ এর পক্ষে বিশেষ যুক্তি ও তার পর্যালোচনা
যুক্তি: যদি মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা না থাকে কিন্তু পিতা-মাতা থাকে এবং ভাই-বোনও থাকে এরূপ অবস্থার ক্ষেত্রে ৪:১১ আয়াতে মাতার আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করা হয়েছে এবং ভাইবোনের আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করা হয়নি। আবার ৪:১১ ও ৪:১২ আয়াত দুটির বক্তব্য ‘ওয়া’ (এবং) দ্বারা যুক্ত। এই প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত ভাই-বোনের আনুপাতিক অংশ হলো ৪:১১ আয়াতে বর্ণিত অবস্থায় তথা মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা নেই কিন্তু পিতা-মাতা এবং ভাই-বোন আছে এরূপ অবস্থায় ভাই-বোনের প্রাপ্য আনুপাতিক অংশ। অন্য কথায় ৪:১১ আয়াত ও ৪:১২ আয়াত ‘ওয়া’ দ্বারা সংযুক্ত থাকার কারণে ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত ‘কালালাহ’ এর অর্থ হলো ‘যার পুত্র-কন্যা নেই কিন্তু পিতা-মাতা আছে’ এবং ৪:১৭৬ আয়াতের ‘কালালাহ’ এর অর্থ হলো ‘যার পুত্র-কন্যাও নেই এবং পিতা-মাতাও নেই’। ৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোনের উত্তরাধিকারের বিষয়ে মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকার শর্ত দেয়া হয়েছে বিধায় ৪:১২ আয়াতেও কালালাহ বলতে তাকেই বুঝাবে যার সন্তান নেই। আবার ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত কালালাহর পিতা-মাতা থাকার প্রেক্ষিতে বুঝা যায় যে, ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত কালালাহর পিতা-মাতা নেই, যদিও তা সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি।
পর্যালোচনা: উপরিউক্ত যুক্তিটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ ৪:১৭৬ আয়াতে উল্লেখিত মৃত ব্যক্তির পুত্র/কন্যা না থাকা এবং ভাই/বোন থাকার বিষয়টি স্পষ্ট। কিন্তু পিতা-মাতা জীবিত না থাকার শর্ত দেয়া হয়নি, বরং আয়াতটির বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক, সন্তান না থাকলে ভাই-বোন উত্তরাধিকারী হবে।
আবার যে মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা নেই তার পিতা-মাতা থাকলেও যেহেতু তার ভাই-বোনের প্রাপ্য আনুপাতিক অংশ ৪:১৭৬ আয়াত অনুুযায়ী নির্ধারিত হবে, তাই ৪:১২ আয়াতের কালালাহর সংজ্ঞা এটি হতে পারে না যে, যে মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা নেই কিন্তু পিতা-মাতা আছে এবং ভাই-বোন আছে সে কালালাহ এবং তার ভাই-বোন ৪:১২ আয়াত অনুযায়ী পাবে। বরং পুত্র-কন্যা না থাকা ব্যক্তির ভাই-বোন যেহেতু ৪:১৭৬ আয়াত অনুযায়ী উত্তরাধিকার পাবে, তাই ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত কালালাহর ক্ষেত্রে তার সন্তান না থাকার ধারণা গ্রহণযোগ্য নয়। একই কারণে ৪:১১ ও ৪:১২ আয়াত ‘ওয়া’ (এবং) দ্বারা যুক্ত হওয়ার ভিত্তিতে ৪:১২ আয়াতের ক্ষেত্রে পিতা-মাতা আছে বলে ধারণা প্রকাশ করলে তাও গ্রহণযোগ্য নয়। এক্ষেত্রে ‘ওয়া’ (এবং) সম্পর্কিত যুক্তিটির ভিত্তি দুর্বল। কারণ পুত্র-কন্যার অংশ বর্ণনার পর পিতা-মাতার অংশ, স্বামী/ স্ত্রীর অংশ, ভাই-বোনের অংশ সবই ‘ওয়া’ (এবং) দ্বারা সংযুক্ত হয়েছে। তাই বাক্যগুলো ‘ওয়া’ দ্বারা যুক্ত হওয়া মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা জীবিত থাকার ধারণাকে নিশ্চিত করে না। 
অভিমত ৩ এর পর্যালোচনা  
৪:১৭৬ আয়াত অনুযায়ী, যার সন্তান নেই এবং তার ভাই-বোন আছে সে ও তার ভাই-বোনের মধ্যে কালালাহ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার পিতা-মাতা থাকা না থাকাকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। তাই সন্তান না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতা থাকলে বা না থাকলে উভয় অবস্থায় কালালাহ সম্পর্কের প্রেক্ষিতে ভাই-বোন এ আয়াত অনুসারে তাদের অংশ পাবে। এছাড়া অভিমত ৩ অনুযায়ী সন্তান ও পিতা-মাতা না থাকলে ভাই-বোন যা পায় (৪:১২), সন্তান নেই কিন্তু পিতা-মাতা আছে এ অবস্থায় ভাই-বোন তার চেয়ে বেশি পায় (৪:১৭৬), এটি স্পষ্টত যুক্তিবিরোধী কথাও বটে। তাই যেকোনো বিচারে অভিমত ৩ গ্রহণযোগ্য নয়। 
কালালাহ সমস্যার চতুর্থ সমাধান প্রস্তাবনা ও তার পর্যালোচনা
প্রস্তাবনা: কালালাহ বলতে বুঝায় পিতা-মাতা ও সন্তান ছাড়া রক্তসম্পর্কীয় অন্য আত্মীয়, যেমন ভাই, বোন, চাচা, ফুফু, মামা, খালা। যদি একজন ব্যক্তির উত্তরাধিকার বন্টনের পর কিছু অবশিষ্ট থাকে তাহলে পুত্র-কন্যা, পিতা-মাতা, স্বামী/ স্ত্রীর মধ্য থেকে যারা উপস্থিত আছে তাদের সাথে উত্তরাধিকার থেকে পাওয়ার জন্য কালালাহ এর মধ্য থেকে কাউকে মৃত ব্যক্তি নির্বাচিত করে যেতে পারবে। সেক্ষেত্রে যাকে নির্বাচিত করা হবে তার যদি ভাই/বোন থাকে তাহলে তারা অবশিষ্ট অংশ থেকে কতটুকু পাবে তা ৪:১২ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, উল্লেখিত অংশের পর অবশিষ্ট সমগ্র অংশ নির্বাচিত কালালাহ পাবে। যেমন যদি কালালাহর একজন ভাই থাকে তবে সে পাবে অবশিষ্ট অংশের ১/৬  এবং নির্বাচিত কালালাহ পাবে অবশিষ্ট অংশের ৫/৬ । এভাবে সমগ্র অবশিষ্ট অংশ কালালাহ ও তার ভাইয়ের মধ্যে বন্টিত হয়ে যাবে। তবে যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকে (পিতা মাতা ও স্বামী/স্ত্রী থাকুক বা না থাকুক) এ অবস্থায় তার ভাই-বোনের মধ্যে কিভাবে বন্টন হবে তা-ই জানানো হয়েছে ৪:১৭৬ আয়াতে। 
চতুর্থ প্রস্তাবনার যুক্তি
৪:১২ আয়াতের কালালাহ সম্পর্কিত বক্তব্য হলো: ওয়া ইন কানা রজুলুইঁ ইউরাসু কালালাতান আভিমরাতুওঁ ওয়া লাহু আখুন আও উখতুন ফালিকুল্লি ওয়াহিদিম মিনহুমাছ ছুদুছু ফা-ইন কানূ আকছারা মিন যালিকা ফাহুম শুরাকাউ ফিছ ছুলুছি মিম বা’দি ওয়াসিয়্যাতিইঁ ইউসা বিহা আও দাইনিন। (৪:১২) 
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা যেতে পারে যে, এখানে যে রজুল বা পুরুষকে কালালাহ বলা হয়েছে এবং যার প্রসঙ্গে ‘ইউরাসু’ কর্মবাচ্য ব্যবহৃত হয়েছে সে মৃত ব্যক্তি নয়, বরং মৃত ব্যক্তি কর্তৃক উত্তরাধিকারের অংশ দেয়ার জন্য মনোনীত ব্যক্তি। এই মনোনীত ব্যক্তি হতে হবে এমন কেউ যে নির্দিষ্ট ওয়ারিস নয়। যেমন- চাচা, মামা, ভাই, ফুফু, খালা, বোন। অন্য কথায়, মৃত ব্যক্তিকে নয়, বরং মৃত ব্যক্তির কর্তৃক উত্তরাধিকারের অংশ দেয়ার জন্য মনোনীত ব্যক্তিকে কালালাহ বলা হয়। কিন্তু ৪:১৭৬ আয়াতে কালালাহ বলতে মৃত ব্যক্তির ভাই-বোনকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ ৪:১৭৬ আয়াতে কালালাহ হিসাবে মৃত ব্যক্তির ভাই-বোন সুনির্দিষ্ট। অন্যদিকে ৪:১২ আয়াতে কালালাহ বলতে যেমন ভাই-বোন হতে পারে, তেমনি চাচা, ফুফু, মামা, খালাও হতে পারে। আর ৪:১২ আয়াতে উল্লেখিত ‘ওয়া লাহু আখুন আও উখতুন’ (আর তার এক ভাই বা এক বোন থাকে) বলতে  মৃত কর্তৃক মনোনীত কালালাহর ভাই-বোনের কথা বলা হয়েছে, মৃত ব্যক্তির ভাই-বোন নয়। অবশ্য যদি সে তার কোনো ভাইকে কালালাহ হিসাবে মনোনীত করে সেক্ষেত্রে কালালাহর ভাই-বোন এবং মৃত ব্যক্তির ভাই-বোন অভিন্ন হয় তা ভিন্ন বিষয়। সংক্ষেপে বলা যায়, ৪:১২ আয়াতে উল্লেখিত ভাই-বোন বলতে বুঝায় কালালাহর ভাই-বোন এবং ৪:১৭৬ আয়াতে উল্লেখিত ভাই-বোন বলতে বুঝায় মৃত ব্যক্তির ভাই-বোন, যারা মৃত ব্যক্তির কালালাহ হিসেবে সাব্যস্ত।
চতুর্থ প্রস্তাবনা অনুসারে ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত অবস্থায় কালালাহ ও তার ভাই-বোনের প্রাপ্য অংশ 
এ প্রস্তাবনা অনুসারে ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত অবস্থায় কালালাহ ও তার ভাই-বোনের প্রাপ্য অংশ নির্ধারণের ক্ষেত্রে আবার দুটি উপমত তৈরি হয়েছে। 
উপমত ১: এক্ষেত্রে একটি মত হলো, ৪:১২ আয়াত অনুসারে, মৃত ব্যক্তি কর্তৃক মনোনীত কালালাহর যদি কোনো ভাই বা বোন থাকে তবে কালালাহ + ঐ ভাই বা বোন = দুই জন, এবং এ দুইজনের প্রত্যেকের অংশ ১/৬ । আর যদি কালালাহ এবং তার ভাই-বোন মিলে দুইয়ের বেশি হয় তাহলে তারা সকলে মিলে পাবে ১/৩ । 
উপমত ২: অন্য একটি মত হলো, ৪:১২ আয়াত অনুসারে, কালালাহ যতটুকু অংশের ওয়ারিস হবে তার ১/৬  পাবে তার ভাই বা বোন আর সে পাবে ৫/৬ , আর সে (নির্বাচিত কালালাহ) ছাড়া তার ভাই-বোন যদি দুই বা দুইয়ের বেশি হয় তবে তারা পাবে ১/৩  অংশ আর সে পাবে ২/৩ । 
চতুর্থ প্রস্তাবনার পর্যালোচনা
এক: এ অভিমত অনুসারে, ৪:১২ আয়াতে কালালাহ বলতে মৃত ব্যক্তিকে না বুঝিয়ে তার মনোনীত ব্যক্তিকে বুঝায় এবং ৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোনকে কালালাহ সাব্যস্ত করা হয়। অথচ ৪:১৭৬ আয়াতে মৃত ব্যক্তির ভাই-বোনকে মৃত ব্যক্তি কর্তৃক মনোনীত করা বা না করার জন্য অপেক্ষমান রাখা হয়নি, বরং আল্লাহ নিজেই কালালাহ হিসাবে সাব্যস্ত করে তাদের জন্য বন্টনবিধি উল্লেখ করেছেন। ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে কালালাহ প্রসঙ্গে ভাই-বোন ব্যতীত অন্য কাউকে ওয়ারিস করার উল্লেখ নেই এবং ভাই-বোনকে মৃত ব্যক্তি মনোনীত করলেই শুধু পাবে, অন্যথায় পাবে না এরূপ তথ্যও নেই, একাধিক ভাই থাকলে তাদের কাউকে মনোনীত করা ও কাউকে মনোনীত না করার অবকাশ দেয়া হয়েছে মর্মেও কোনো প্রমাণ নেই। 
৪:১৭৬ আয়াতে যেভাবে ভাই-বোনের প্রাপ্য অংশ নির্ধারণ করা হয়েছে তার সাথে তুলনা করলে ৪:১২ আয়াতের ব্যাখ্যা হিসাবে এ কথা গ্রহণযোগ্য নয় যে, মৃত ব্যক্তি কাউকে কালালাহ হিসাবে মনোনীত করবে অথচ সেই কালালাহর ভাই-বোনকে মৃত ব্যক্তি নিজে কালালাহ হিসাবে মনোনীত করবে না তবু তারা কালালাহর ভাই-বোন হওয়ার কারণে কালালাহসহ দুই ভাই ১/৩   পাবে, অথবা কালালাহর এক ভাই পাবে ১/৬  আর কালালাহ পাবে ৫/৬ ।  এক কথায়, যদি ৪:১২ আয়াতের ব্যাখ্যায় কালালাহ বলতে মৃত ব্যক্তি কর্তৃক মনোনীত এমন ব্যক্তি যে সচরাচর ওয়ারিস নয় এরূপ বুঝায় তবে ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে সাংঘর্ষিকতা দেখা দেয়। 
দুই: যদি ৪:১২ এবং ৪:১৭৬ উভয় আয়াতে কালালাহ বলতে মৃত ব্যক্তির ভাই-বোনকে বুঝায় এবং ৪:১২ আয়াতে যে মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা আছে এবং ৪:১৭৬ আয়াতে যে মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা নেই এরূপ দুই অবস্থার কথা বুঝায় তাহলেও প্রশ্ন আসে যে, ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত ভাই-বোন হচ্ছে মৃত ব্যক্তির ভাই-বোন। অথচ এ প্রস্তাবনা অনুসারে ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত ভাই-বোন হচ্ছে সেই রজুলের ভাই-বোন যে রজুল হচ্ছে কালালাহ, অর্থাৎ কালালাহর ভাই-বোন; এ দুই ধরনের বর্ণনার কারণে উভয় আয়াতে কালালাহ বলতে ভাই-বোনকে বুঝাতে পারে না। 
তিন: একটি অবস্থা হতে পারে যে, ৪:১৭৬ আয়াতে মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থার কথা বলা হয়েছে এবং ৪:১২ আয়াতে কালালাহ ওয়ারিস হয় পুত্র-কন্যার সাথে। এক্ষত্রে বিবেচ্য প্রশ্ন হলো, কেন এখানে মৃত ব্যক্তিকে কালালাহ হিসেবে বা মৃত ব্যক্তির ভাই-বোনকে কালালাহর ভাই-বোন হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে? অর্থাৎ কেন মৃত ব্যক্তির সাথে তার ভাই-বোনের সম্পর্ককে কালালাহ সম্পর্ক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে? অন্যভাবে বলা যায়, কালালাহ সম্পর্ক কিভাবে তৈরি/ প্রতিষ্ঠিত হয়? এটা কি যৌক্তিক দাবি সাব্যস্ত হতে পারে যে, পুত্র-কন্যা না থাকলে ভাই-বোন সরাসরি কালালাহ, আর পুত্র-কন্যা থাকলে ভাই-বোনদের মধ্য থেকে যাকে মৃত ব্যক্তি মনোনীত করে শুধু সে-ই কালালাহ? 
চার: ৪:১৭৬ আয়াতে কালালাহ বলতে ভাই-বোন এবং ৪:১২ আয়াতে কালালাহ বলতে ভাই-বোন ছাড়া অন্য কালালাহ যথা চাচা, ফুফু, মামা, খালা ইত্যাদি বুঝায় বলে কৃত দাবির ক্ষেত্রেও প্রশ্ন আসে যে, যেখানে ৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোন সরাসরি কালালাহ সাব্যস্ত হয়, সেখানে ৪:১২ আয়াতে কেন সব চাচা সরাসরি কালালাহ সাব্যস্ত না হয়ে কোনো চাচা কালালাহ সাব্যস্ত হয় এবং অন্য চাচা ঐ কালালাহর ভাই হিসাবে সাব্যস্ত হয়? এছাড়া এক্ষেত্রে আরো প্রশ্ন হতে পারে যে, কেন মৃত ব্যক্তি তার কোনো চাচাকে কালালাহ সাব্যস্ত করে যাবে এবং তখন তার অন্য চাচারা ও ফুফুরাও ওয়ারিস হবে অথচ মামারা ও খালারা ওয়ারিস হবে না? আবার বিপরীতক্রমে কেন মৃত ব্যক্তি তার কোনো মামাকে কালালাহ সাব্যস্ত করে যাবে এবং তখন তার অন্য মামারা ও খালারা ওয়ারিস হবে অথচ চাচারা ওয়ারিস হবে না? এছাড়া, কেন যাকে কালালাহ করা হয়েছে তার ভাই (তথা মৃতের এক চাচা) পাবে ১/৬  এবং কালালাহ (মৃতের কালালাহ রূপ চাচা) পাবে ৫/৬  ? এরূপ বিধান কি সামঞ্জস্যপূর্ণ? 
পাঁচ: ৪:৮ অনুযায় যে আত্মীয়-স্বজন ওয়ারিস নয়, তারা হচ্ছে ‘উলুল ক্বুরবা’। সুতরাং চাচা, ফুফু, মামা, খালা হচ্ছেন উলুল ক্বুরবা। আর ভাই-বোনকে যেহেতু ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে ওয়ারিস করা হয়েছে তাই তারা ‘উলিল ক্বুরবা’ নয়, বরং তারা ‘আক্বরাবূন’। তবে মৃত ব্যক্তির সাথে তার ভাই-বোনের কালালাহ সম্পর্ক তৈরি হলে শুধু সেক্ষেত্রে ভাই-বোন ওয়ারিস হয়, অন্যথায় তারা ওয়ারিস হয় না। যখন ভাই-বোন ওয়ারিস হয় না ঐ অবস্থায় ভাই-বোনও ‘উলিল ক্বুরবা’ হিসেবে সাব্যস্ত হয। উত্তরাধিকার বণ্টনকালে (বণ্টনের অব্যবহিত পরে) উলিল ক্বুরবাকেও তা থেকে উপজীবিকা হিসেবে কিছু দেয়ার নির্দেশ রয়েছে। 
এমতাবস্থায় যদি উলিল ক্বুরবার মধ্য থেকে কাউকে কালালাহ হিসাবে এক ধরনের ওয়ারিস করা হয় তাহলে সে অন্যান্য ‘উলিল ক্বুরবার’ চেয়ে আলাদা গুরুত্ব পেয়ে যায়। অথচ এরূপ প্রয়োজন থাকলে তার জন্য ওয়াসিয়্যাত করে যাওয়ার সুযোগ তো আছেই। তা সত্ত্বেও তাকে আলাদাভাবে ওয়ারিস করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বলে দাবি করলে তা যাচাই ছাড়া গ্রহণযোগ্য নয়। 
ছয় : চতুর্থ প্রস্তাবনাটি যে সঠিক নয় নিচে তা ‘ইউরাসু’ শব্দের বিশ্লেষণের মাধ্যমে বুঝা যেতে পারে। উত্তরাধিকারের বন্টন বিধি বর্ণিত হয়েছে তিনটি আয়াতে ৪:১১, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াত। এই তিনটি আয়াতে একই প্রসঙ্গে তথা উত্তরাধিকার বন্টন প্রসঙ্গে ‘ওয়ারিসা’ ক্রিয়ার বর্তমান কর্তৃবাচ্য, বর্তমান কর্মবাচ্য এবং অতীত কর্তৃবাচ্য ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং এ শব্দগুলোর অর্থ একইভাবে নির্ণিত হবে।
ওয়ারিসা (৪:১১) = অতীত কর্তৃবাচ্য। 
ইউরাসু (৪:১২) = বর্তমান কর্মবাচ্য। 
ইয়ারিসু (৪:১৭৬) = বর্তমান কর্তৃবাচ্য। 
৪:১১ আয়াতে ‘ওয়ারিসা’ এর কর্তা (Subject)  হচ্ছে ‘জীবিত পিতা-মাতা’ এবং কর্ম (Object)  হচ্ছে ‘মৃত ব্যক্তি’। অর্থাৎ ‘মৃত ব্যক্তিকে ওয়ারিসা বা পূর্বসূরী করার’ কথা বলা হয়েছে। । 
৪:১৭৬ আয়াতে ‘ইয়ারিসু’ এর কর্তা (Subject)  হচ্ছে ‘হুয়া’ তথা ‘সে’ আর এখানে ‘হুয়া’ বলতে মৃত ব্যক্তি হিসাবে যার প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল সেই ‘ইমরুউ’ (পুরুষটি তথা ভাইটি) যদি জীবিত থাকতো আর অন্যদিকে তার একটি বোন মৃত হতো তাহলে সেই জীবিত ‘ইমরুউ’কে (পুরুষ তথা মৃত বোনের ভাইটি) বুঝানো হয়েছে। অন্য কথায়, ৪:১৭৬ আয়াতের কর্তা (ঝঁনলবপঃ) হচ্ছে জীবিত ভাই এবং কর্ম (Object)  হচ্ছে মৃত বোন (হা)। 
৪:১২ আয়াতে ‘ইউরাসু’ শব্দটি ‘রজুল’ তথা ‘কালালাহর’ বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ ঐ বাক্যটিতে ইউরাসু শব্দটি হচ্ছে প্রথম ইসমে কানা (‘কানা’ ক্রিয়ার তথ্য)। আর মৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রে ইউরাসু (যাকে পূর্বসূরী করা হয়েছে) শব্দটি ব্যবহার করার অর্থ ‘তার জীবিত কোনো ওয়ারিস/পূর্বসূরীকারী/ উত্তরাধিকারী আছে’। আর বাক্যটির দ্বিতীয় ইসমে কানা (‘কানা ক্রিয়ার তথ্য) হলো ব্যক্তিটি কালালাহ। অর্থাৎ বাক্যটিতে ‘ইউরাসু’ এবং ‘কালালাহ’ শব্দ দুটি একই ব্যক্তির বিশেষণকে প্রকাশ করে এবং ব্যক্তিটি হলো মৃত ব্যক্তি। এর কারণ ‘ইউরাসু’ হচ্ছে কর্মবাচ্য। আর কর্তৃবাচ্যের ‘ওয়ারিসা’ ও ‘ইয়ারিসা’ এর কর্তা যদি জীবিত ব্যক্তি হয়, তাহলে তখন মৃত ব্যক্তি হয় কর্মবাচ্য ‘ইউরাসু’ তথা ‘যাকে পূর্বসূরী করা হয়েছে’। ৪:১২ আয়াতের কালালাহ হওয়া সম্পর্কিত শর্তটির বিশ্লেষণাত্মক অর্থ হলো যদি কোনো মৃত ব্যক্তি কালালাহ হয়, ........। আর ‘ইউরাসু’ কর্মবাচ্য হওয়ার কারণে তার সাথে সম্পর্ক রেখে তার ওয়াসিয়্যাতের প্রসঙ্গেও কর্মবাচ্য ‘ইউসা’ ব্যবহার করা হয়েছে, যদিও ৪:১১ আয়াতে কর্তৃবাচ্য ‘ইউসী’ ব্যবহৃত হয়েছিল এবং ৪:১২ আয়াতে অন্য দুবার কর্তৃবাচ্য ‘ইউসীনা’ এবং ‘তূসূনা’ ব্যবহৃত হয়েছে। 
সর্বোপরি যদি মৃত ব্যক্তি যাকে কালালাহ সাব্যস্ত করে যায় কথাটি এ দিক থেকেও অগ্রহণযোগ্য যে, মৃত ব্যক্তি কিভাবে কাউকে উত্তরাধিকারের অংশীদার করতে পারে, যেহেতু মৃত ব্যক্তি কাউকে কিছু দেয়ার কথা বলে গেলে তা হচ্ছে ওয়াসিয়্যাত। আর ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণের পরেই উত্তরাধিকার বন্টন হবে, তার আগে নয়। 
সুতরাং মৃত ব্যক্তি যাকে কালালাহ সাব্যস্ত করে যায় সেই হলো কালালাহ তথ্যটি গ্রহণযোগ্য নয়। ৪:১২ আয়াতে বলা হয়েছে যদি ব্যক্তিটি কালালাহ হয় এবং তার একটি ভাই থাকে, ..........। এই প্রেক্ষিতে মৃত ব্যক্তির ভাই-বোন মাত্রই কালালাহ, এরূপ সরল সিদ্ধান্ত গ্রহণেরও কোনো অবকাশ নেই। বরং ৪:১২ আয়াতে মৃত ব্যক্তিকে কালালাহ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং ৪:১৭৬ আয়াতে মৃত ব্যক্তির ভাই-বোনকে কালালাহ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। 
সাত: চতুর্থ প্রস্তাবনার একটি সম্পূরক ব্যাখ্যা ও তার পর্যালোচনা:
সম্পূরক ব্যাখ্যা: পুত্র-কন্যা পাবে অবশিষ্টাংশ। যদি শুধু পুত্র বা শুধু কন্যা থাকে তারাও পাবে অবশিষ্টাংশ। শুধু এক কন্যা থাকলে সে পাবে অবশিষ্টাংশ থেকে অর্ধেক। দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যা থাকলে তারা পাবে অবশিষ্টাংশ থেকে দুই তৃতীয়াংশ। অনুরূপভাবে পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন কালালাহ হিসেবে পাবে ৪:১৭৬ আয়াত অনুসারে পুত্র-কন্যার অনুরূপভাবে। আর ৪:১২ আয়াতে কালালাহ মৃত ব্যক্তি নয় বরং মৃত ব্যক্তি কর্তৃক ওয়ারিস হিসাবে নমিনী করে যাওয়া বাড়তি ওয়ারিস। ‘ইউরাসু’ অর্থ যাকে (মৃত ব্যক্তি কর্তৃক) ওয়ারিস করা হয়েছে। এরূপ যে পুরুষ বা নারীকে নমিনী করা হয়েছে তার তথা কালালাহর যদি ভাই-বোন থাকে তারা কিভাবে পাবে তা-ই বলা হয়েছে ৪:১২ আয়াতে। এটা তারা পাবে অবশিষ্টাংশ থেকে। এখানে ১/৬  বলতে বুঝাবে অবশিষ্টাংশের ১/৬  তথা কালালাহর জন্য থাকা অংশের ১/৬ । 
পর্যালোচনা: এ ব্যাখ্যার পর্যালোচনায় পূর্ববর্তী পর্যালোচনাটি প্রযোজ্য এবং সেই সাথে এই প্রশ্নটি যুক্ত হবে যে, ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত ভাই-বোন যে অবশিষ্টাংশ থেকে পাবে তা কিভাবে আয়াতের বক্তব্য থেকে প্রমাণ করা যাবে? আর ৪:১২ আয়াতের কালালাহ ও তার ভাই-বোনেরা যে অবশিষ্টাংশ থেকে পাবে তা কিভাবে আয়াতের বক্তব্য থেকে প্রমাণ করা যাবে? প্রকৃতপক্ষে, কন্যাগণ ও ভাই-বোনকে অবশিষ্টাংশ থেকে দিতে হবে দাবিটি আয়াত দ্বারা প্রমাণ করা সম্ভব নয়, তাই এ দাবিটি গ্রহণযোগ্য নয়।
কালালাহ সমস্যার পঞ্চম সমাধান প্রস্তাবনা (একটি ব্যতিক্রমধর্মী ব্যাখ্যা) ও তার পর্যালোচনা
প্রস্তাবনা: কালালাহ এর দুটি অবস্থান। ৪:১২ এর কালালাহ হচ্ছে যার পিতা নেই এবং স্বামী/ স্ত্রী নেই (যখন তার সন্তান আছে)। ৪:১৭৬ এর কালালাহ হচ্ছে যার পিতা নেই এবং স্বামী/ স্ত্রী নেই (যখন তার সন্তান নেই)। 
৪:১৭৬ অনুযায়ী, কালালাহ এর এক বোন পাবে ১/২  যখন কোনো ভাই নেই, দুই বোন পাবে ২/৩ , যখন কোনো ভাই নেই। কিন্তু ভাই-বোন একসাথে থাকলে ভাইয়ের সংখ্যা যতই হোক আর বোনের সংখ্যা যতই হোক, এক ভাই পাবে দুই বোনের সমান। 
৪:১১ আয়াতে ব্যবহৃত ইখওয়াত বলতে বুঝাবে অন্তুত দুই ব্যক্তি, যার একজন পুরুষ (তথা একাধিক ভাই বা ভাই-বোন)। কারণ, ৪:১১ তে আছে, সন্তান না থাকা অবস্থায় ইখওয়াত থাকলে মাতা পাবে ১/৬ । অথচ ৪:১৭৬ অনুযায়ী যেহেতু সন্তান না থাকা অবস্থায় এক ভাই সম্পূর্ণ সম্পত্তি পায় তাহলে মাতার অংশ শূন্য। তাই, একাধিক ভাই বা ভাই-বোন থাকলে মাতা পাবেন ১/৬  এবং তারা পাবে ১/৬  এর পরবর্তী বাকি অংশ। কিন্তু একটি মাত্র ভাই থাকলে মাতা কিছু পাবে না। 
পর্যালোচনা : এ ব্যাখ্যাটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ ৪:১৭৬ আয়াতে, যখন কালালাহ এর সন্তান নেই একথা বলা হয়নি। বরং বলা হয়েছে যখন কোনো পুরুষ মৃত্যুবরণ করে যার সন্তান নেই। আর কালালাহ এর সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্বামী/স্ত্রী জীবিত থাকা বা না থাকাকে বিবেচনা করার অবকাশ নেই। কারণ উত্তরাধিকার বণ্টন বিধির আয়াতসমূহে কারো জন্য উল্লেখিত আনুপাতিক অংশকে হ্রাস বা বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে স্বামী/স্ত্রী জীবিত থাকা বা না থাকাকে শর্ত করা হয়নি। 
৪:১১ আয়াতে ইখওয়াত বা ভাই-বোনের অংশ সম্পর্কেও এ ব্যাখ্যাতে কৃত দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। বরং ৪:১১ আয়াতে বর্ণিত ‘ইখওয়াত’ এর আওতায় এক বা একাধিক ভাই/বোন থাকতে পারে। এক ভাই পাবে সম্পূর্ণ, অথচ একাধিক ভাই পাবে ৫/৬  কথাটি যুক্তিসিদ্ধও নয়। 
কালালাহ সমস্যার ষষ্ঠ সমাধান প্রস্তাবনা ও তার পর্যালোচনা
প্রস্তাবনা : কালালাহ সম্পর্কিত বিধানের ক্ষেত্রে ৪:১২ আয়াতে বুঝিয়েছে, যে মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা নেই কিন্তু সন্তান আছে, তার ভাই-বোন কতটুকু পাবে এবং ৪:১৭৬ আয়াতে বুঝিয়েছে, যে মৃত ব্যক্তির সন্তান নেই, পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক, তার ভাই-বোন কতটুকু পাবে। 
পর্যালোচনা : প্রাথমিকভাবে বলা যেতে পারে যে, পূর্বে উল্লেখিত অভিমত, উপলব্ধি বা বিকল্প প্রস্তাবনাগুলো গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় একমাত্র বাকি থাকা উপলব্ধি/ অভিমত/ বিকল্প প্রস্তাবনা ৬ গ্রহণযোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। আবার ‘উপলব্ধি ৬ সঠিক’ কথাটি নিশ্চিতভাবে বলা যাবে আয়াতসমূহে থাকা তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে ষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত হওয়ার পর।
দ্বিতীয় ভাগ: কালালাহ এর প্রকৃত সংজ্ঞা নির্ণয়
কুরআনে কালালাহ শব্দটি দুই বার ব্যবহৃত হয়েছে, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে। কুরআন সংজ্ঞা দেয়ার ভঙ্গিতে বক্তব্য উপস্থাপন করে না, বরং সাধারণ বিবৃতির ধরনে বক্তব্য উপস্থাপন করে। এই বিবৃতি থেকে সংজ্ঞা নির্ণয় করা সম্ভব হয়। কালালাহ কাকে বলে? এর একটি সাধারণ পরম্পরাগত ভাষাগত উপলব্ধি আরবি ভাষায় প্রসিদ্ধ ছিল। তাই কুরআনে যদি কালালাহ সম্পর্কে কোনো বিধান দেয়া হয় তাহলে তাকে আলাদাভাবে বলে দেয়া দরকার নেই কাকে কালালাহ বলে। আবার যদি এমন হয় যে, কালালাহ এর মৌলিক দুটি অবস্থা রয়েছে ক এবং খ। তাহলে উভয় অবস্থার মধ্য থেকে যখন যে অবস্থার প্রেক্ষিতে একজন ব্যক্তি কালালাহ হোক, যদি বিধান একই হয়ে থাকে তাহলে আলাদাভাবে দুটি অবস্থা উল্লেখ না করলেও যথেষ্ট হয়। কিন্তু যদি এমন হয় যে, যে ব্যক্তি ক নং অবস্থার প্রেক্ষিতে কালালাহ তার সাথে সম্পর্কিত ধারা এবং যে ব্যক্তি খ নং অবস্থার প্রেক্ষিতে কালালাহ তার সাথে সম্পর্কিত ধারা আলাদা তাহলে ধারা দুটি আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। কুরআনের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যখন তা নাযিল হয়েছে তখন প্রচলিত ভাষারীতির কারণে এবং সরাসরি নাযিলকালীন পরিস্থিতিতে উপস্থিত থাকায় এবং পূর্ব থেকে মনোভাবগত প্রস্তুতি অর্জনের সুযোগ ঘটায় উপস্থিত মু’মিনগণ তাৎক্ষণিকভাবে তার সঠিক অর্থ সহজেই বুঝতে পেরেছেন এবং এজন্য অত্যধিক সুস্পষ্ট ক্ষেত্রে তাদের আলাদা কোনো জিজ্ঞাসা ও জবাবের প্রয়োজন হয়নি। এরই পাশাপাশি কুরআনে বর্ণনারীতি এমন যে, বিভিন্ন আয়াতে উল্লেখিত বিষয়গুলো একত্র করলে পরবর্তীতে সময়ের ব্যবধানে সংজ্ঞা ও সামগ্রিক ধারা বিশ্লেষণের জন্য যা প্রয়োজন তার পূর্ণ জবাব পাওয়া যাবে, এজন্য দ্বিতীয় কোনো উৎসের প্রতি মুখাপেক্ষী হতে হবে না, শুধুমাত্র জীবন্ত ভাষা ও চিরন্তন বাস্তবতাজ্ঞান ব্যবহার করে কুরআনের পাতা উল্টালেই যথেষ্ট। কালালাহ এর বিষয়টিও এরূপ। 

কুরআনের কোনো বক্তব্য বুঝতে গিয়ে যে সমস্যা তৈরি হয় কুরআনের অন্য বক্তব্যের মাধ্যমে তার সমাধান পাওয়া যায়। কালালাহ বিষয়ে দুটি আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াত। আয়াতদ্বয়ের সমন্বিত বিশ্লেষণ থেকে কালালাহ সমস্যার সমাধান নির্ণয় সম্ভব। অবশ্য যখন তা প্রথম নাযিল হয় তখন কালালাহর প্রকৃত সংজ্ঞাটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত থাকায় তাদের জন্য হয়তো ব্যাপক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তা নির্ণয় করার প্রয়োজন হয়নি। অবশ্য ৪:১২ আয়াতে কালালাহ সম্পর্কিত যে দিকটি উল্লেখ রয়েছে, তার প্রেক্ষিতে অন্য একটি দিকের বিষয়ে প্রশ্ন তৈরি হওয়ায় ৪:১৭৬ আয়াত নাজিল হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে কালালাহ বিষয়ে বিষয়ে কিছু অস্পষ্টতা তৈরি হওয়ায় আমাদেরকে ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতের সমন্বিত তথ্য বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে কালালাহর সংজ্ঞা নির্ণয় করতে হবে। একবার সমাধান নির্ণয়ের পর যদি বিষয়টি সঠিকভাবে চর্চা করা হয় তাতে বণ্টন বিধির উপলব্ধি ও অনুশীলনের ক্ষেত্রে উদ্ভুত জটিলতা থাকবে না। অন্যথায় আবার জটিলতা তৈরি হতে পারে এবং তাহলে পরবর্তীতে কাউকে আবার গবেষণার মাধ্যমে নতুন করে সমাধানে উপনীত হতে হবে। 
কোনো ক্ষেত্রে উপলব্ধির জটিলতা তৈরি হলে ঐ বিষয় সম্পর্কিত আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমে সমাধান নির্ণয়ের একটি উদাহরণ হলো, ৪:৩ আয়াতে বর্ণিত ‘নিসা’ বলতে যে ইয়াতীম ছেলে-মেয়ের মাতা তথা ইয়াতীম ছেলে-মেয়ে থাকা বিধবাকে বুঝানো হয়েছে ৪:৬ ও ৪:১২৭ আয়াতের মাধ্যমে তা স্পষ্টভাবে নির্ণিত হয়। এক্ষেত্রেও অসম্ভব নয় যে, যখন ৪:৩ নাযিল হয়েছিলো তখন তৎকালীন মু’মিনরা হয়তো তাৎক্ষণিকভাবেই আয়াতটিতে ‘নিসা’ বলতে কাদেরকে বুঝানো হয়েছে তা বুঝে গিয়েছিলো। কারণ তারা জানতো যে, ইয়াতীম বয়সী মেয়েকে বিবাহের কথা বুঝানো স্বাভাবিক নয়, বরং তাদের মাকে তথা ইয়াতীম সন্তান থাকা বিধবাকে বিবাহের কথা বুঝানোই স্বাভাবিক। তবু আমরা দেখেছি সময়ের ব্যবধানে ইয়াতীম মেয়েকে বিবাহের অর্থ প্রচলিত হয়ে গেছে। তাই এখন আমাদেরকে আবার গবেষণার মাধ্যমে সঠিক অর্থ নির্ণয় করতে হচ্ছে।
৪:১৭৬ আয়াতে বলা হয়েছে তারা তোমার কাছে ফতোয়া জানতে চায়, বলো, আল্লাহ ফতোয়া জানাচ্ছেন, আল কালালাহ এর বিষয়ে। ৪:১২ আয়াতে মৃত ব্যক্তিকে (যার সম্পদ বণ্টন করতে হবে) কালালাহ হিসেবে উপস্থাপন করে তার ভাই-বোনের কে কতটুকু পাবে সে বিধান দেয়া হয়েছে। কালালাহ কাকে বলে তা সমকালীন লোকেরা জানতো। কিন্তু কুরআন আমাদেরকে এজন্য অতীতের আলাদা কোনো উৎসের মুখাপেক্ষী করেনি। উপস্থিত মুহুর্তে তারা যেভাবে বুঝেছিল, আমরা কুরআনের মধ্যে গবেষণা করলেই তা বুঝতে পারবো। এমনকি যদি তারা বুঝেছিল হিসেবে আমাদের কাছে এমন কোনো আলাদা তথ্যসূত্র পৌঁছে যা কুরআনের মধ্যে গবেষণা করে উন্মোচিত তথ্যের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে আমাদের কাছে পৌঁছা ঐ দ্বিতীয় তথ্যসূত্র বাতিল বলে গণ্য হবে, কারণ কুরআন সুরক্ষিত এবং ঐ দ্বিতীয় তথ্যসূত্রের সেরূপ কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর তাই কুরআন আমাদেরকে কুরআনের মধ্যে গবেষণা করে কুরআনের বক্তব্য উপলব্ধি করা যেতে পারে এমন বর্ণনারীতির মাধ্যমেই তার বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। 

৪:১৭৬ আয়াতে কালালাহর বিষয়ে ফতোয়া জানানো হয়েছে। কিন্তু এই এই অবস্থায় কোনো ব্যক্তিকে কালালাহ বলা হয়, এভাবে আল্লাহ সংজ্ঞা উপস্থাপন না করে, যেভাবে বিধানটি বর্ণনা করেছেন তাতেই সংজ্ঞাটি স্পষ্ট হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ বলেননি যে, যে ব্যক্তি নি:সন্তান অবস্থায় মারা যায় তার ভাই বা বোন থাকলে সেই মৃত ব্যক্তিকে বা তার ভাই বোনকে কালালাহ বলে। কিন্তু আল্লাহ বলেছেন, যদি কোনো পুরুষ নি:সন্তান অবস্থায় মারা যায় এবং তার ভাই বা বোন থাকে, তাহলে ভাই বা বোনটি এরূপ এরূপ সম্পত্তি পাবে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এটি কালালাহর বিষয়ে ফতোয়া। সুতরাং এটি স্পষ্ট যে, এ বর্ণনারীতির মাধ্যমে কালালাহর সংজ্ঞাটি উপস্থাপিত হয়ে গেছে। আর এক্ষেত্রে তা হচ্ছে যে ব্যক্তি নি:সন্তান অবস্থায় মারা যায় এবং তার ভাই বা বোন থাকে সে মৃত ব্যক্তির ভাই-বোন তার কালালাহ হিসেবে সাব্যস্ত হয়। যখন ভাই-বোনের সাথে সম্পর্কের দিক থেকে মৃত ব্যক্তিকে কালালাহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তা ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। 
৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে মৃত ব্যক্তির ভাই-বোনের জন্য প্রদত্ত অংশ ভিন্ন ভিন্ন। এমতাবস্থায়, উভয় অবস্থায় মৃত ব্যক্তির সাথে তার ভাই-বোনের কালালাহ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন শর্তের ভিত্তিতে এ কথা স্বত:সিদ্ধভাবে প্রমাণিত। কিন্তু সেই ভিন্ন ভিন্ন শর্ত কী কী? ৪:১৭৬ আয়াতে স্পষ্টভাবে উল্লেখিত শর্তটি হচ্ছে মৃত ব্যক্তির সন্তান নেই (পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক, তাকে শর্ত করা হয়নি)। সুতরাং যখন এ শর্তে কালালাহ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়, তথা যখন মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকার কারণে তার ভাই-বোন কালালাহ হিসেবে তার ছেড়ে যাওয়া সম্পদ পায় তা-ই ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং ৪:১২ আয়াতে মৃত ব্যক্তিকে তার ভাই-বোনের কালালাহ বলার ক্ষেত্রে অন্য কোনো শর্ত রয়েছে যা মৃত ব্যক্তিকে তার ভাই-বোনের কালালাহ সম্পর্কে সম্পর্কিত করে এবং তার ভাই-বোন তার ছেড়ে যাওয়া সম্পদের অংশ পায়। সেই শর্তটি যা মৃত ব্যক্তিকে তার ভাই-বোনের সাথে কালালাহ সম্পর্কে সম্পর্কিত করে এবং তার ভাই-বোনকে একটি নির্দিষ্ট অংশের প্রাপক বানায়, শর্তটি আবিষ্কারই কালালাহ এর সম্পূর্ণ সংজ্ঞা নির্ণয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
৪:১২ আয়াতে মৃত ব্যক্তিকে কালালাহ বলা হয়েছে এবং তার সম্পদ থেকে তার ভাই-বোনের অংশ উল্লেখ করা হয়েছে। আবার ৪:১৭৬ আয়াতেও কালালাহর সম্পদ বন্টন প্রসঙ্গে দেওয়া ফতোয়ায় তার সম্পদ থেকে তার ভাই-বোনের অংশ উল্লেখ করা হয়েছে। কালালাহ প্রসঙ্গ ছাড়া সাধারণভাবে ভাই-বোনের অংশ কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। বরং ৪:১২ আয়াতে মৃত ব্যক্তি কালালাহ হওয়ার শর্তে ভাই-বোনের অংশ বলা হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে এ শর্ত উপস্থিত না থাকলে ভাই-বোন থাকলেও ভাই-বোন উত্তরাধিকার পাবে না। অন্য কারো অংশ উল্লেখের ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তিকে কালালাহ শব্দ দ্বারা বিশেষিত করা হয়নি। অন্য কথায় বলা যায়, মৃত ব্যক্তি কালালাহ হওয়া না হওয়ার বিষয়টি ভাই-বোনের উত্তরাধিকার পাওয়া না পাওয়ার সাথে সম্পর্কিত বিষয়, অন্য কারো উত্তরাধিকার পাওয়া না পাওয়ার সাথে সম্পর্কিত বিষয় নয়। আর তাই ভাই-বোন না থাকা অবস্থায় মৃত ব্যক্তি কালালাহ হওয়ার ঘটনাটি ঘটা সম্ভব নয়। অন্য কথায় মৃত ব্যক্তি কালালাহ হিসাবে সাব্যস্ত হতে হলে তার ভাই-বোন থাকতে হবে। অন্য কথায়, কালালাহ হচ্ছে মৃত ব্যক্তির সাথে তার ভাই-বোনের এক ধরনের সম্পর্ক যে সম্পর্কের অবস্থায় ভাই-বোন উত্তরাধিকার পায় এবং ঐরূপ বিশেষ অবস্থায় সৃষ্ট সম্পর্ক ছাড়া সাধারণভাবে ভাই-বোন হিসাবে যে সম্পর্ক তা ভাই-বোন উত্তরাধিকার পাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। 
৪:১৭৬ আয়াতে উল্লেখিত যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছে এ অবস্থায় যে তার পুত্র/কন্যা নেই কিন্তু ভাই/বোন আছে তার ভাই/বোন কতটুকু পাবে তা উল্লেখ করা হয়েছে। এখান থেকে বলা যায় যে, পুত্র/কন্যা না থাকা এবং ভাই/বোন থাকা হচ্ছে কালালাহ সম্পর্ক তৈরি হওয়ার একটি অবস্থা। কিন্তু এটাই কি কালালাহ সম্পর্ক তৈরি হওয়ার একমাত্র অবস্থা? না। কারণ এটা কালালাহ সম্পর্ক তৈরি হওয়ার একমাত্র অবস্থা হলে ৪:১২ আয়াত ও ৪:১৭৬ আয়াতের বক্তব্য স্ববিরোধী হয়ে যায় তথা উভয় আয়াতে উল্লেখিত ভাই-বোনের অংশ সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। সুতরাং এখান থেকে ধারণা পাওয়া যায় যে, কালালাহ হওয়ার জন্য একাধিক অবস্থা হতে পারে, যার একটি অবস্থা ৪:১৭৬ আয়াতে স্পষ্ট যে, মৃত ব্যক্তির পুত্র/কন্যা নেই কিন্তু ভাই-বোন আছে এবং এ অবস্থায় মৃত ব্যক্তি ও তার ভাই-বোনের মধ্যে কালালাহ সম্পর্ক তৈরি/প্রতিষ্ঠিত হয়। 
৪:১৭৬ আয়াতে একটা নির্দিষ্ট অবস্থার ক্ষেত্রে কালালাহ সম্পর্কের ভাই-বোনের প্রাপ্য অংশের বিষয়ে ফতোয়া জানতে চাওয়ার জবাবে প্রদত্ত ফতোয়ায় ভাই-বোনের প্রাপ্য অংশ উল্লেখ করা হয়েছে। যদি এ ফতোয়া জানতে চাওয়া না হতো তবে কি উত্তরাধিকারের বন্টনবিধি অসম্পূর্ণ থাকতো? তা অসম্ভব। বরং ফতোয়া জানতে না চাইলে সাধারণ বর্ণনাভঙ্গিতে এই ধারা সংযোজিত হতে পারতো কিন্তু ফতোয়া জানতে চাওয়ার প্রেক্ষিতে পরিপ্রেক্ষিত উল্লেখসহ তা সংযোজিত হয়েছে। এরূপ বিবৃতি থেকে লোকেরা কোনো বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করে আরো স্পষ্ট হওয়ার জন্য কিভাবে ব্যাকুলতা অনুভব করতো তা বুঝা যায়। বরং গভীর চিন্তা ভাবনার মাধ্যমে এটা বুঝা যায় যে, ৪:১৭৬ আয়াতে যে ফতোয়া দেয়া হয়েছে ৪:১১ ও ৪:১২ আয়াতে প্রদত্ত বন্টন বিধিতে তা অন্তর্নিহিত ছিল, শুধুমাত্র ফতোয়া জানতে চাওয়ার প্রেক্ষিতে ৪:১৭৬ আয়াতে সেটাকে আরো সুস্পষ্ট করা হয়েছে এবং শেষে বলা হয়েছে ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য বয়ান করলেন পাছে তোমরা বিভ্রান্ত হবে’। সুতরাং ৪:১৭৬ আয়াতের মাধ্যমে উত্তরাধিকারের বন্টনবিধির যাবতীয় দিক এমনভাবে প্রতিভাত হওয়ার সুযোগ ঘটেছে যে, আর বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই। 
৪:১৭৬ আয়াতের বক্তব্য একটি সম্পূরক তথ্য মাত্র, যা ৪:১১ আয়াতে অন্তর্নিহিত ছিল, বিষয়টি এভাবেও বুঝা যায় যে, ৪:১১-১২ আয়াতে উত্তরাধিকার সম্পর্কিত বিধি-বিধান বর্ণনার পর ৪:১৩ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তিলকা হুদুদুল্লাহ’ তথা ‘উত্তরাধিকারের বিষয়ে এটাই আল্লাহর নির্ধারিত সীমা’। সুতরাং ৪:১৭৬ আয়াতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের নতুন কোনো বিধান দেয়া হয়নি, বরং একটি অন্তর্নিহিত বিধানকে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র। 
৪:১১-১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতের শব্দাবলি ও বক্তব্য কাঠামো থেকে যুক্তিসঙ্গতভাবে বিভিন্ন সূত্র পাওয়া যায় যার মাধ্যমে ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত কালালাহ সম্পর্কের দ্বিবিধ শর্ত বা অবস্থা এবং শর্তের ভিন্নতার প্রেক্ষিতে ভিন্নভাবে ভাই-বোনের প্রাপ্য নির্ধারণের বিষয়টি নির্ণয করা সম্ভব। 
ভাই-বোন সর্বাবস্থায় ওয়ারিস নয়, তারা শর্তসাপেক্ষ ওয়ারিস। শর্তটি হচ্ছে মৃত ব্যক্তি বা তার ঐ ভাই-বোন কালালাহ হওয়া। ৪:১৭৬ আয়াতে যার পুত্র/কন্যা নেই এবং তার ভাই/বোন আছে তার ভাই-বোন উত্তরাধিকার পায় তথা এ অবস্থায় তার ও তার ভাই-বোনের মধ্যে কালালাহ সম্পর্ক তৈরি/প্রতিষ্ঠিত হয়, আবার ৪:১২ আয়াতে মৃত ব্যক্তিকে কালালাহ বলা হয়েছে। সুতরাং কালালাহ হচ্ছে ব্যক্তিসত্তা। ৪:১৭৬ আয়াতে প্রথমেই বলা হয়েছে যে, লোকেরা ফতোয়া জানতে চায় এবং আল্লাহ ফতোয়া জানাচ্ছেন কালালাহর বিষয়ে। সুতরাং এখানে কালালাহ শব্দটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় শর্ত তৈরি করে। অন্য কথায় ভাই-বোনের মধ্যে কালালাহ সম্পর্ক তৈরি/প্রতিষ্ঠিত হওয়া একটি শর্ত হিসেবে কার্যকর থাকে। ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত স্বামী/ স্ত্রীকে উত্তরাধিকার প্রদানের প্রসঙ্গে ভাই-বোনের উপস্থিতি অনুপস্থিতির কোনো শর্ত নেই। 

সুতরাং কালালাহর সংজ্ঞা, প্রকার ও কালালাহ সম্পর্কিত বন্টনবিধির শর্তাদি বুঝার জন্য দুটি বিশেষ বিবেচ্য বিষয় হলো:
(ক) ভাই-বোনের উপস্থিতি অনুপস্থিতির বিবেচনা শুধুমাত্র পিতা/মাতা ও পুত্র/কন্যার সাথে সম্পর্কিত যা ৪:১১ ও ৪:১৭৬ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট। যেমন ৪:১১ আয়াতে বলা হয়েছে, যদি (পুত্র/কন্যা না থাকা অবস্থায়) ভাই-বোন থাকে, তবে মাতার অংশ কত হবে। আর ৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোন উপস্থিত থাকলে উত্তরাধিকার পাবে, যদি মৃতের পুত্র/কন্যা না থাকে। 
(খ) কালালাহ শব্দের সাথে ভাই-বোনের প্রসঙ্গ ওতপ্রোতভাবে জড়িত যা ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট। অর্থাৎ কালালাহ হচ্ছে ভাই-বোনের বিশেষ এক ধরনের (তথা একটি বিশেষ অবস্থায়) পারস্পরিক সম্পর্ক। আর কালালাহ শব্দের সাথে মৃত ব্যক্তির পুত্র/কন্যা না থাকার অবস্থাটি ৪:১৭৬ আয়াতের প্রসঙ্গ, ৪:১২ আয়াতের প্রসঙ্গ নয়। 
এ দুটি বিষয় স্মরণ রেখে আরো কিছু পয়েন্টে মনোনিবেশ করা যাক। ৪:১১ আয়াতে পিতা-মাতা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু (আর তাকে পূর্বসূরী করে তার পিতা-মাতা)। ৪:১৭৬ আয়াতে কোনো মৃত বোনের ভাই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ওয়া হুয়া ইয়ারিছুহা [আর সে (ভাই) তাকে (বোনকে) পূর্বসূরী করে।] এ দুটি তথ্য হচ্ছে হচ্ছে দুটি রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়ের উত্তরাধিকার সম্পর্কিত বিষয়, যার একটিতে পিতা-মাতা তথা রক্তসম্পর্কের ঊর্ধ্বধারা ওয়ারিস, অন্যটিতে ভাই-বোন তথা রক্তসম্পর্কের পার্শ্বধারা ওয়ারিস। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায়, রক্ত সম্পর্কের নিম্নধারা তথা পুত্র-কন্যা হচ্ছে সর্বপ্রথম বিবেচ্য ওয়ারিস। 
সুতরাং ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত ইন কানা রজুলুন ইউরাসু কালালাতান (যদি কোনো পুরুষ, যাকে পূর্বসূরী করা হয়, সে হয় কালালাহ), বাক্যটিতে ‘ইউরাসু’ বা ‘যাকে পূর্বসূরী করা হয়’ বলতে বুঝানো হয়েছে, ‘যাকে স্বাভাবিক অবস্থায়, সবচেয়ে প্রাথমিক বিবেচনায়, তার সন্তান কর্তৃক পূর্বসূরী করা হয়/ যে তার সন্তানকে উত্তরসূরী হিসেবে রেখে যায়’। অর্থাৎ ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত কালালাহ এর স্বাভাবিক অবস্থা হচ্ছে, মৃত ব্যক্তির সন্তান আছে, সাথে পিতা বা মাতা থাকতে পারে বা নাও থাকতে পারে, কিন্তু সন্তান ও পিতা-মাতা উভয়ে থাকতে পারে না। কারণ, সন্তান এবং পিতা-মাতা উভয়ে থাকলে মৃত ব্যক্তি কালালাহ হতে পারে না, বরং সে অবস্থায় সে একজন সাধারণ ব্যক্তি হয়। কারণ মৃত ব্যক্তির ভাই-বোন উত্তরাধিকার পেতে পারে মৃত ব্যক্তি কালালাহ হওয়ার শর্তে। এটি এ থেকেও বুঝা যায় যে, উত্তরাধিকার বিধান বর্ণনা শুরুই করা হয়েছে ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ বক্তব্যের মাধ্যমে, এবং সেখানে আওলাদের অংশ বর্ণনার পর ‘ওয়া’ তথা ‘এবং’ শব্দ দ্বারা পিতা-মাতার অংশ, তারপর স্বামী/ স্ত্রীর অংশ এবং তারপর ভাই-বোনের অংশ বলা হয়েছে। (পিতা মাতার অংশ ও স্বামী/ স্ত্রীর অংশ বর্ণনার ক্ষেত্রে প্রসঙ্গত ওয়ালাদ থাকা না থাকার দ্বিবিধ অবস্থা স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।) এই বর্ণনাভঙ্গির মধ্যে যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকার কারণে সে তার ভাই-বোনের সাথে উত্তরাধিকারগত সম্পর্কে কালালাহ হয়, সেক্ষেত্রে ভাই-বোনের প্রাপ্য অংশ ভিন্ন হওয়ার ইঙ্গিত অন্তর্নিহিত ছিল। 
আবার ৪:১১ আয়াতে মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা থাকা অবস্থায় সন্তান না থাকলে কিন্তু ভাই-বোন থাকলে ভাই-বোনের কোনো অংশ উল্লেখিত হয়নি ঠিকই, কিন্তু সে অবস্থায় মাতার অংশ (এবং সঙ্গতভাবে পিতার অংশও) সেটাই করা হয়েছে, সন্তান থাকলে মাতার অংশ (এবং সঙ্গতভাবে পিতার অংশও) যেটা হয়। এ ক্ষেত্রে সন্তান না থাকা অবস্থায় মৃত ব্যক্তির ভাই-বোনকে সন্তানের অনুরূপ অনুঘটকে (Factor)  পরিণত করা হয়েছে। ভাই-বোনকে এরুপ অনুঘটক বানানোর মধ্যে ‘যদি সন্তান না থাকা অবস্থায় ভাই-বোনকে ওয়ারিসে পরিণত করা হয়, তবে ভাই-বোনের অংশ হবে সন্তানের অংশের অনুরূপ’ এই ইঙ্গিত অন্তর্নিহিত ছিল। ৪:১৭৬ আয়াতে এ অন্তর্নিহিত বিষয়কে উত্থাপিত ফতোয়া জিজ্ঞাসার জবাবে প্রদত্ত ফতোয়ার মাধ্যমে সুস্পষ্ট করা হয়েছে। 
৪:১২ আয়াতে ‘ইউরাছু কালালাহ’ এর স্বাভাবিক তাৎপর্য হচ্ছে, ‘কালালাহর সন্তান কালালাহকে পূর্বসূরী করে’। কারণ পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতা যাকে ওয়ারিস করে সেই কালালাহর প্রসঙ্গ ৪:১১ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, যদি এখানে সেই কালালাহর প্রসঙ্গ হতো তবে ভাই-বোনের এ অংশটি সেখানেই বলা যেতো এবং বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় অধিক খাপ খেতো এবং এরূপ মৃত ব্যক্তিকে কালালাহ হিসেবে উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তাও থাকতো না। বরং ৪:১১ আয়াতের শেষাংশে এরূপ কালালাহর বিধান পরোক্ষভাবে অন্তর্নিহিত আছে, যদিও তাতে কালালাহ শব্দ উল্লেখ করা হয়নি। 
লক্ষণীয় যে, ভাই-বোনের প্রাপ্য অংশ বলার ক্ষেত্রেই শুধু কালালাহ শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে, পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা বা স্বামী/স্ত্রীর প্রাপ্য অংশ বলার ক্ষেত্রে কালালাহ শব্দ উল্লেখ করা হয়নি। আরো লক্ষণীয় হলো, পুত্র-কন্যা থাকলে পুত্র-কন্যার জন্য যেরূপ অংশ নির্ধারণ করা হয়েছে, ৪:১৭৬ আয়াতে পুত্র-কন্যা না থাকলে ভাই-বোনের জন্য সেরূপ অংশই নির্ধারণ করা হয়েছে। 
আসলে ৪:১৭৬ আয়াত অধ্যয়নের মাধ্যমে বুঝা যায় যে, ৪:১২ আয়াত নাজিলের সময়কালে লোকেরা যে ব্যক্তির পিতা-মাতা নেই কিন্তু সন্তান আছে তাকেই কালালাহ হিসেবে জানতো। কিন্তু ৪:১৭৬ আয়াতে যে ব্যক্তির সন্তান নেই (তার পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক) তার ভাই-বোন কিভাবে পাবে তা জানতে চাওয়া হয়েছিল। তারপর কুরআনে তাদের এ ফতোয়া জানতে চাওয়াকে একটি শিরোনামের মাধ্যমে প্রকাশ করেছে যে, তারা ফতোয়া জানতে চায়, বলো, আল্লাহ ফতোয়া জানাচ্ছেন, ‘আল কালালাহর’ বিষয়ে। তারা যে ‘আল কালালাহ’ শব্দযোগে বিধান জানতে চেয়েছে তা আবশ্যক নয়। কারণ কুরআনের নিজস্ব বর্ণনারীতি হচ্ছে যে বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় সে জানতে চাওয়া বিষয়টিকে একটি শিরোনামের আওতায় প্রথমে উল্লেখ করা হয়, যেমন ২:১৮৯ (আনিল আহিল্লাতি), ৪:১২৭ (ফিন্নিছায়ি), অনুরূপভাবে ৪:১৭৬ (ফিল কালালাতি)। এভাবে, যে ব্যক্তির সন্তান নেই, পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক, তার ভাই-বোন থাকলে ভাই-বোনের সাথে তার সম্পর্কও কালালাহ সম্পর্ক এ বিষয়টি তুলে ধরা হলো। অন্য কথায়, লোকেরা সাধারণভাবে কালালাহ এর যে সংজ্ঞা জানতো সে প্রেক্ষিতে ৪:১২ আয়াতে বিধান দেয়া হয়েছে। আর অন্য একটি অবস্থার কালালাহ (যে অবস্থায় থাকা ভাই-বোনকে লোকেরা সাধারণত কালালাহ হিসেবে চিহ্নিত নাও করতে পারে বিধায় এবং তাদের ধারণায় নি:সন্তান ব্যক্তির ভাই-বোন কিভাবে উত্তরাধিকার পাবে তা অনুল্লেখিত রয়ে গেছে বিধায় তারা এ বিষয়টিতে ফতোয়া জানতে চেয়েছে। ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত তথ্য অনুযায়ী যে ব্যক্তি তার সন্তান কর্তৃক পূর্বসূরী হয় না (পিতা-মাতা কর্তৃক পূর্বসূরী হোক বা না হোক), তাই ভাই-বোন তার কালালাহ হিসেবে সাব্যস্ত হয়। কিন্তু ৪:১২ আয়াতের কালালাহ হচ্ছে যে ব্যক্তি তার সন্তান কর্তৃক পূর্বসূরী হয় (কিন্তু তার পিতা-মাতা নেই) তথা এরূপ ব্যক্তি কালালাহ বলে সাব্যস্ত হবে এবং তার পিতা-মাতা নেই বিধায় ভাই-বোন তার সম্পদের উত্তরাধিকার পাবে। 
কিভাবে নাজিলকালীন লোকেরা ৪:১২ আয়াতে ‘ইউরাসু’ বলতে সন্তান কর্তৃক পূর্বসূরী করা হয় বুঝেছিল, যদিও সন্তান কর্তৃক কথাটি উল্লেখ নেই এবং কেন সন্তান কর্তৃক কথাটি উল্লেখ নেই? এর জবাব হচ্ছে, কুরআনে যখন কোনো বিষয়ে সাধারণভাবে বলা হয় তখন তার স্বাভাবিক মূল অবস্থান বলা হয়, আনুষংগিক অবস্থান নয়। তাই ইউরাসু বললে স্বত:সিদ্ধভাবে বুঝা যাবে যে, এখানে মূলগতভাবে সন্তান কর্তৃক পূর্বসূরী করার কথা বুঝানো হয়েছে, কোনো সংযোজিত ওয়ারিস থাকুক বা না থাকুক। আর এখানে সন্তান কর্তৃক কথাটি যোগ করা হয়নি, কারণ ভাষারীতির স্বাভাবিকতা অনুযায়ী যে বিষয়টি স্বত:সিদ্ধভাবে বুঝা যাবে তা উল্লেখ করে দেয়া ভাষারীতির উৎকর্ষের পরিপন্থী। যেহেতু কুরআনে ভাষারীতির উৎকর্ষ রক্ষা করা হয়েছে তাই কুরআনে এ স্থানে কার কর্তৃক পূর্বসূরী করা হয় তা উহ্য রাখা হয়েছে। আর পিতা-মাতা না থাকার বিষয়টি এখানে স্বত:সিদ্ধভাবে প্রযোজ্য হবে, কারণ ৪:১১ আয়াতে বর্ণিত বণ্টনের নিয়ম অনুসারে প্রতীয়মান হয় যে, সন্তান ও পিতা-মাতা একসাথে উপস্থিত থাকলে ‘কালালাহ’ প্রসঙ্গটি থাকে না এবং ভাই-বোন ওয়ারিস হয় না।
৪:১১, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতের সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমে বুঝা যায় যে, যদি দুটি ভাই একে অপরের উত্তরাধিকার পাওয়ার যোগ্য হয় তবে তারা একে অপরের কালালাহ। দুটি ভাই একে অপরেরর কালালাহ হওয়ার জন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে তাদের পিতা-মাতা না থাকা। যেহেতু পিতা-মাতার মাধ্যমে ভাই-বোন পরস্পরের রক্তসম্পর্কের আত্মীয় তাই পিতা-মাতার অনুপস্থিতিই তাদেরকে পরস্পরের কালালাহতে পরিণত করতে পারে। মৃত ব্যক্তি কালালাহ হওয়ার অর্থই হচ্ছে তার জীবিত ভাইও কালালাহ হওয়া। 
মৃত ব্যক্তি কালালাহ হওয়ার অর্থ হচ্ছে যদি সে মৃত না হয়ে জীবিত হতো আর তার জীবিত ভাইটি জীবিত না হয়ে মৃত হতো তবে বিপরীতক্রমে সে তার ভাইটির উত্তরাধিকার থেকে পেতো। এরূপ ধারার যথার্থতা যাচাই করার জন্য ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত ‘ওয়া হুয়া ইয়ারিসুহা’ তথ্যটি লক্ষনীয়। ৪:১৭৬ আয়াতের প্রথমাংশের প্রেক্ষিতে ‘ওয়া হুয়া ইয়ারিসুহা’ কথাটির অর্থ হচ্ছে, ‘বিপরীতক্রমের যদি বোনটি মৃত্যুবরণ করে আর ভাইটি জীবিত থাকে তবে ভাইটি বোনটির ওয়ারিস হবে’। ৪:১২ আয়াতে মৃত ব্যক্তিকে কালালাহ বলা হয়েছে। এ কথার একটিই অর্থ হয়, আর তা হচ্ছে বিপরীতক্রমে তার জীবিত ভাইও কালালাহ তথা মৃতব্যক্তির পিতা-মাতা জীবিত নেই। কিন্তু সন্তান জীবিত আছে কিনা সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। 
৪:১২ আয়াতে প্রথম শর্ত হিসেবে/ প্রথম ‘খবরে কানা’ (‘কানা’ ক্রিয়ার তথ্য) হিসেবে/ মৃত ব্যক্তির প্রথম সিফাত (বিশেষণ) হিসেবে ‘ইউরাসু’ শব্দের ব্যবহারের মাধ্যমে সে কারো না কারো কর্তৃক পূর্বসূরী হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এখানে প্রত্যক্ষভাবে সন্তান জীবিত থাকার কথা বলা না হলেও পরোক্ষভাবে তা বলা হয়েছে। কারণ প্রথমত, এখানে ইউরাসু ক্রিয়ার কর্তা পিতা-মাতা হতে পারে না, যেহেতু পিতা-মাতা ও সন্তান উভয়ের উপস্থিতিতে কালালাহ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না এবং ভাই-বোন উত্তরাধিকার পেতে পারে না, আবার, পিতা-মাতা না থাকার কারণেই ভাই-বোন পরস্পরের কালালাহ হতে পারে বিধায় পিতা-মাতার অনুপস্থিতিহেতু তারা (তথা পিতা-মাতা) স্বাভাবিকভাবেই ‘ইউরাসু’ ক্রিয়ার কর্তা হওয়া অসম্ভব/ অবাস্তব। দ্বিতীয়ত, এখানে ইউরাসু ক্রিয়ার কর্তা ভাই-বোন হতে পারে না, যেহেতু ভাই-বোন সর্বাবস্থায় ওয়ারিস হয় না এবং ভাই-বোন থাকার কথাটি ‘ওয়া লাহু আখুন আও উখতুন’ শব্দে আলাদাভাবে বলা হয়েছে। তাহলে এখানে ইউরাসু ক্রিয়ার কর্তা হিসেবে প্রাথমিকভাবে দুটি বিকল্পের কথা ভাবা যেতে পারে যথা : স্বামী/স্ত্রী অথবা সন্তান। তৃতীয়ত, এখানে ইউরাসু ক্রিয়ার কর্তা স্বামী/স্ত্রী হতে পারে না, যদিও সন্তানের পাশাপাশি তারাও ওয়ারিস হিসেবে থাকতে পারে। কিন্তু তারা ওয়ারিস হিসেবে থাকুক বা না থাকুক উভয় অবস্থায় ইউরাসু ক্রিয়া কার্যকর থাকার একমাত্র উপায় হচ্ছে ইউরাসু ক্রিয়ার মূলগত কর্তা হিসেবে সন্তানকে সাব্যস্ত করা। যদি সন্তান না থাকে কিন্তু স্বামী/স্ত্রী থাকে তবে ইউরাসু ক্রিয়াটি মৃত ব্যক্তির সিফাত হিসেবে যথাযথ হয় না। কারণ, মৃত ব্যক্তির কালালাহ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পিতা-মাতা ও সন্তানের একসাথে উপস্থিতি প্রতিবন্ধক, স্বামী/স্ত্রীর উপস্থিতি নয়। তাই কালালাহ এর সিফাত হিসেবে ব্যবহৃত ইউরাসু ক্রিয়ার কর্তা হিসেবে স্বামী/স্ত্রী বিবেচ্য নয়। আসলে পিতা-মাতা হচ্ছে রক্তসম্পর্কের ঊর্ধ্বধারা, সন্তান হচ্ছে রক্তসম্পর্কের নিম্নধারা এবং ভাই-বোন হচ্ছে রক্তসম্পর্কের পার্শ্বধারা। রক্তসম্পর্কের এ তিনটি গ্রুপকে ওয়ারিস করা হয়েছে। এর মধ্যে পিতা-মাতা ও সন্তান সবসময় ওয়ারিস, ভাই-বোন শুধু কালালাহ সম্পর্ক তৈরি হওয়ার শর্তে ওয়ারিস। স্বামী/স্ত্রী রক্তসম্পর্কীয় নয়। তাই স্বামী/স্ত্রী বিবেচনা বহির্ভূত। কালালাহ শব্দের অর্থের ক্ষেত্রেও স্বামী/স্ত্রীর কোনো যোগসূত্র নেই এবং তাই স্বাভাবিকভাবেই ইউরাসু ক্রিয়ার কর্তা হিসেবেও স্বামী/স্ত্রীর কোনো গুরুত্ব নেই। এভাবে পরোক্ষভাবে ইউরাসু ক্রিয়ার কর্তা হিসেবে সন্তান থাকার বিষয়টি নির্দিষ্ট হয়ে যায়। 
৪:১২ আয়াতে কালালাহ এবং ইউরাসু শব্দ দুটি ব্যবহারের মাধ্যমে বুঝানো হয়েছে যে, মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা তো নেই ঠিকই কিন্তু সে সন্তান কর্তৃক ইউরাসু তথা তার সন্তান আছে। আর এটাই সর্বাধিক স্বাভাবিক অবস্থার প্রসংগ কাঠামোকে অবলম্বন করে উপস্থাপিত বক্তব্যরীতি। এ বিষয়ে ৪:১১ আয়াতের সূচনা অংশ লক্ষনীয়। ৪:১১ আয়াতে ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ বাক্যের মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে, মূলগত ওয়ারিস হলো সন্তান, তারপর সংযোজিত ওয়ারিস হলো পিতা-মাতা, স্বামী/স্ত্রী এবং ভাই-বোন। সুতরাং ইউরাসু ক্রিয়ার কর্তা হচ্ছে সন্তান এবং কালালাহ দ্বারা যাদের অনুপস্থিতি বুঝায় তারা হচ্ছেন পিতা-মাতা। আর এটাই সর্বাধিক স্বাভাবিক অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যশীল। রজুল এর সিফাত হিসেবে ব্যবহৃত ইউরাসু হচ্ছে প্রথম ‘খবরে কানা’ এবং এটি কর্মবাচ্য, যার অর্থ হচ্ছে ‘যাকে পূর্বসূরী করা হয়’ তথা ‘যার উত্তরসূরী থাকে’। আসলে পিতা-মাতা হচ্ছে পূর্বপুরুষ, সন্তান হচ্ছে উত্তরপুরুষ, তাই ইউরাসু এর কর্তা হিসেবে সন্তান হচ্ছে সর্বাধিক স্বাভাবিক অবস্থা। রজুল এর সিফাত (ইউরাসু) ব্যবহার করার কারণ হচ্ছে মৃতব্যক্তিটি কালালাহ হওয়ার পাশাপাশি তার স্বাভাবিক মূলগত ওয়ারিসের উপস্থিতির তথ্য জানিয়ে দেয়া, (সাথে সংযোজিত ওয়ারিস থাকুক বা না থাকুক)। এভাবে এখানে যে প্রকৃতপক্ষে পিতা-মাতা ও সন্তান এ দু শ্রেণির উভয় শ্রেণি অনুপস্থিত নয়, তা নিশ্চিত করা হয়েছে। অন্যথায় বুঝা যেতো যে, মৃত ব্যক্তিটির পিতা-মাতা নেই, সন্তান থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। 
প্রশ্ন হতে পারে যে, কেন ৪:১২ আয়াতে কালালাহ এর সন্তান থাকার বিষয়টি আরো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হলো না? এর জবাব হচ্ছে, আরবি ভাষারীতির শৈল্পিক উৎকর্ষসম্পন্ন বর্ণনারীতিতে বিধানটি বর্ণিত হয়েছে, যে বর্ণনারীতিতে তথ্যটি পরোক্ষ হলেও অস্পষ্ট নয়। কিন্তু তবুও এ সম্পর্কে প্রশ্ন তৈরি হওয়ায় ৪:১৭৬ আয়াতে ‘যার সন্তান নেই (তার পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক)’ তার ভাই-বোন তার কালালাহ (সে নিজে কালালাহ হোক বা না হোক) এবং এক্ষেত্রে তার ভাই-বোনের প্রাপ্য অংশ ৪:১২ এর তুলনায় ভিন্নরূপ তথ্যটি সুনির্দিষ্ট করে দেয়ায়, এ বিষয়ে আর কোনো ধরনের অস্পষ্টতা অবশিষ্ট থাকেনি। এছাড়া, যার সন্তান নেই তার ভাই-বোন কতটুকু পাবে তা ৪:১১ আয়াতে অন্তর্নিহিত ছিল, কিন্তু এ বিষয়ে অনেকের মধ্যে অস্পষ্টতা থাকায় তারা ফতোয়া জানতে চাওয়ার প্রেক্ষিতে ৪:১৭৬ আয়াতে এটি স্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে। 
৪:১৭৬ আয়াতে মৃতব্যক্তির সন্তান না থাকায় তার ভাই-বোন ‘কালালাহ’, মৃতব্যক্তির পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক। যদি মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতাও না থাকে, তাহলে মৃত ব্যক্তি ও তার ভাই-বোন পরস্পরের কালালাহ এবং সেক্ষেত্রেও এ আয়াত (৪:১৭৬) অনুযায়ী বন্টন হবে, কারণ মৃত ব্যক্তির সন্তান নেই। মৃত ব্যক্তির সন্তান নেই কিন্তু পিতা-মাতা আছে এ অবস্থায় তার ভাই-বোন তো তার কালালাহ, কিন্তু সে নিজে ভাই-বোনের কালালাহ নয় (ঐ ভাই-বোনের ছাড়া যে ভাই-বোনের সন্তান নেই)। 
এক কথায় একজন ব্যক্তির সন্তান না থাকলে সে কালালাহ তা ঠিক নয়। বরং যার সন্তান নেই তার ভাই-বোন তার কালালাহ। আর যার পিতা-মাতা নেই তার ভাই-বোন ও সে পরস্পরের কালালাহ, এ অবস্থায় মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকলে বন্টন হবে ৪:১২ অনুযায়ী। আর যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকে তাহলে তার পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক, তার ভাই-বোন তার কালালাহ, আর বন্টন হবে ৪:১৭৬ অনুযায়ী। ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে ব্যবহৃত কালালাহ শব্দের মধ্য থেকে ৪:১২ আয়াতে মৃত ব্যক্তিকে বুঝাতে ‘কালালাহ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এবং ৪:১৭৬ আয়াতে ‘মৃত ব্যক্তির ভাই-বোনকে’ বুঝাতে গিয়ে ‘কালালাহ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, ৪:১১ আয়াতে ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ বলতে ‘আওলাদের মধ্যে সম্পদ বণ্টন প্রসঙ্গে ওয়াসিয়্যাতকে’ বুঝানো হয়েছে, অনুরূপভাবে ৪:১৭৬ আয়াতে ‘আল্লাহু ইউতীকুম ফিল কালালাহ’ বলতে ‘কালালাহর মধ্যে সম্পদ বণ্টন প্রসেঙ্গে ফতোয়াকে’ বুঝানো হয়েছে। 
কালালাহ সম্পর্কিত ৪:১২ আয়াতে ওয়াসিয়্যাত প্রসঙ্গে ব্যবহৃত ক্রিয়াটির বাচ্য সম্পর্কেও ধারণা রাখা প্রয়োজন। ৪:১১ ও ৪:১২ আয়াতের প্রথমার্ধে তিনবার কর্তৃবাচ্য ‘ইউসী, ইউসীনা, তূসূনা’ ব্যবহৃত হওয়া সত্ত্বেও ৪:১২ আয়াতে কালালাহ সম্পর্কিত বিধানের শেষাংশে ‘ইউসা’ শব্দটি কর্মবাচ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। আয়াতগুলো ভালোভাবে লক্ষ্য করলে এর কারণ বুঝা সহজ হয়। ৪:১২ আয়াতের কালালাহ সম্পর্কিত অংশে কালালাহ এর সিফাত হিসেবে ‘ইউরাসু’ তথা কর্মবাচ্য ব্যবহৃত হওয়ায় তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে কর্মবাচ্যে ‘ইউসা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এটা আল কুরআনের শব্দ চয়নে সর্বাধিক যথোপযুক্ত পদ্ধতির প্রয়োগের একটি উদাহরণ। ‘ইউসা’ শব্দ ব্যবহারের কারণে এখানে বিধানের ধারাটি উত্তরাধিকার বন্টন সম্পর্কিত অন্য ধারাসমূহের চেয়ে ভিন্ন ধরনের বলে সাব্যস্ত হয় না। আর ‘ইউরাসু’ শব্দটি কর্মবাচ্য হলেও এটি মৃতব্যক্তির সিফাত, জীবিত ওয়ারিসের সিফাত নয়, তাই ‘ইউরাসু’ শব্দের কারণে ‘কালালাহ’ বলতে ‘জীবিত ওয়ারিসকে’ বুঝানো হয়েছে এমন নয়, বরং এ আয়াতে ‘ইউরাসু’ এবং ‘কালালাহ’ শব্দ দুটি হচ্ছে একই মৃত ব্যক্তির দুটি অবস্থা। অবশ্য পিতা-মাতা না থাকার কারণে মৃত ব্যক্তি কালালাহ হওয়ার অর্থ হচ্ছে তার জীবিত ভাই-বোনও কালালাহ হওয়া। 
কালালাহ সম্পর্কিত ৪:১২ আয়াতে ‘কালালাতান’ এবং ৪:১৭৬ আয়াতে ‘আল কালালাতি’ ব্যবহৃত হওয়ার বিষয়টিও তাৎপর্যপূর্ণ। ‘কালালাহ’ শব্দটি অনির্দিষ্টভাবে ব্যবহৃত শব্দ এবং ‘আল কালালাহ’ শব্দটি নির্দিষ্টভাবে ব্যবহৃত শব্দ। যেহেতু ফতোয়া জানতে চাওয়ার প্রেক্ষিতে ফতোয়া জানানো হচ্ছে, তাই ‘কালালাহ’ শব্দটি নির্দিষ্ট হয়েছে। এরূপ আরো উদাহরণ হচ্ছে, ২:১৮৯ আয়াতে ‘আল আহেল্লা’ সম্পর্কিত তথ্য এবং ৪:১২৭ আয়াতে ‘আন নিসা’ সম্পর্কিত তথ্য।
উপর্যুক্ত আলোচনার মাধ্যমে ‘কালালাহ সম্পর্কিত সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে’ নিম্নোক্ত চারটি প্রশ্নের উত্তর সুস্পষ্ট হয়। 
(১) ৪:১৭৬ আয়াতে ‘কালালাহর সম্পর্কিত সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে’ মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকার শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে। তা থেকে ৪:১২ আয়াতে বক্তব্য কাঠামোতে মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকার সম্ভাবনা বুঝা যায়। কিন্তু ৪:১৭৬ আয়াতকে বাদ দিয়ে (ফতোয়া জানতে চাওয়ার এবং ৪:১৭৬ আয়াত নাজিলের আগে) কিভাবে ৪:১২ থেকে এ কথা বুঝা যেতে পারে যে, এখানে সন্তানের উপস্থিতি ধর্তব্য? মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকা যদি ‘কালালাহ সম্পর্কিত সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে’ একটি শর্ত হয়, তবে একই সাথে সন্তান থাকা অবস্থায়ও ‘কালালাহ সম্পর্কিত সম্পদ বণ্টন’ বিষয়টি কিভাবে সামঞ্জস্যশীল হতে পারে?
(২) ৪:১২ আয়াতে কেন রজুল এর সিফাত হিসেবে কর্মবাচ্য ‘ইউরাসু’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে? ইউরাসু এর কর্তা কে? 
(৩) ৪:১১ ও ৪:১২ আয়াতের প্রথমার্ধে তিনবার কর্তৃবাচ্য ‘ইউসী, ইউসীনা, তূসূনা’ ব্যবহৃত হওয়া সত্ত্বেও ৪:১২ আয়াতে কালালাহ সম্পর্কিত বিধানের শেষাংশে ‘ইউসা’ শব্দটি কর্মবাচ্যে ব্যবহারের কারণ কী? 
(৪) ৪:১২ আয়াতে ‘কালালাতান’ এবং ৪:১৭৬ আয়াতে ‘আল কালালাহ’ শব্দ ব্যবহার করার তাৎপর্য কী?
কুরআনের আয়াতে এ বিষয়গুলো বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতিতে বিবৃত করা হয়নি বরং প্রয়োগকৃত শব্দ ও বক্তব্য কাঠামো বিশ্লেষণের মাধ্যমে সব সূত্র পাওয়া যাবে এরূপ বর্ণনাভঙ্গিতে সংক্ষেপকরন করে বিবৃত করা হয়েছে। কুরআন অনুশীলনের ক্ষেত্রে যখন ছেদ পড়েছে তখন বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে কুরআনের বক্তব্য অনুধাবন এবং সেটার প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভুল কথা ও রীতির প্রচলন ঘটেছে। তখন পূর্ববর্তী হাদীসগুলোও লেজেগোবরে অবস্থায় কিছু সঠিক তথ্য ও কিছু অসঠিক ধারণামূলক কথার সংমিশ্রণে সামনে এসেছে। আবার ঐ হাদীসগুলোর বক্তব্যের আকস্মিক সমন্বয়ের জন্য কিছু হাদীস বানিয়েও নেয়া হয়েছে। আমরা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে প্রাপ্ত হাদীসসমূহে এর নমুনা দেখতে পাই। কথায় বলে, যা কিছু রটে কিছু না কিছু বটে। হাদীসের ক্ষেত্রেও এরূপ দশাই ঘটেছে। তাতে অনেক ভুল কথা থাকলেও সেই সাথে কিছু সঠিক তথ্য মিশে আছে। তাই বিদ্যমান হাদীস শাস্ত্রে কুরআনের কোনো তথ্যের উপলব্ধির ক্ষেত্রে যেসব অবিন্যস্ত উপাত্ত রয়েছে তা থেকে কতটুকু কুরআনের বক্তব্য কাঠামো অনুসারে গ্রহণযোগ্য তা চিহ্ণিত করার ক্ষেত্রেও কুরআনের বক্তব্য কাঠামো নিয়ে চিন্তা গবেষণা করাই যথার্থ উপায়। হাদীসের নামে পৌঁছা তথ্যকে সরাসরি রসূলের কথা মনে করার কোনো অবকাশ নেই। বরং হাদীসকে প্রশ্নবিদ্ধ ইতিহাস ও অভিধানশাস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করে কুরআনের কোনো তথ্যের বিষয়ে সঠিক সমাধানে পৌঁছার জন্য কুরআনের আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়নকেই মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
পরিভাষা
এ বইটিতে উল্লেখিত উত্তরাধিকারের বিধান অনুধাবনের সাথে সম্পর্কিত কুরআনিক পরিভাষাসমূহের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পাঠকের সুবিধার্থে এখানে (বাংলা বর্ণানুক্রমে) তুলে ধরা হলো:

আক্বরাবূন أَقْرَبُونَ
‘আক্বরাবূন’ শব্দটি ‘আক্বরাব’ শব্দের বহুবচন। ‘আক্বরাব’ শব্দটি ‘ক্বারীব’ শব্দের কম্পারেটিভ ও সুপারলেটিভ ডিগ্রী। ‘ক্বারীব’ শব্দের অর্থ হলো ‘নিকটবর্তী’। সুতরাং ‘আক্বরাব’ শব্দের অর্থ হলো ‘নিকটতম’। শব্দটি ‘নিকটতম আত্মীয়’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধিতে শব্দটি ‘নিকটতম আত্মীয়’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআন অনুসারে যাদের মধ্যকার কেউ জীবিত থাকলে তাদের মধ্যে মৃত ব্যক্তির সমস্ত উত্তরাধিকার বণ্টিত হবে তাদেরকে ‘আক্বরাবূন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়জন ‘রক্তসম্পর্কের আত্মীয়’। তাঁরা হলেন: পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, ভাই, বোন। আর বৈবাহিক সম্পর্কের আত্মীয় হিসেবে শুধুমাত্র স্বামীর ক্ষেত্রে স্ত্রী এবং স্ত্রীর ক্ষেত্রে স্বামীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দাদা, দাদী ও নানা, নানী পিতা-মাতার সূত্রে ঊর্ধ্বতন বিধায় তাঁরা দ্বিতীয় স্তরের আক্বরাবূন। অনুরূপভাবে পোতা, পুতিন, নাতি, নাতিন পুত্র-কন্যার সূত্রে অধ:স্তন বিধায় তারা দ্বিতীয় স্তরের আক্বরাবূন।

আরহাম  أَرْحَامُ
‘আরহাম’ শব্দটি ‘রেহেম’ শব্দের বহুবচন। ‘রেহেম’ শব্দের দুটি অর্থ রয়েছে, যথা: গর্ভ, গর্ভসম্পর্কিত/রক্তসম্পর্কিত আত্মীয়তা। কুরআনে রক্তসম্পর্কের আত্মীয়দেরকে ‘আরহাম’ ও ‘উলুল আরহাম’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যাদেরকে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে তাদের মধ্যে স্বামী/স্ত্রী ছাড়া বাকি সবাই রক্তসম্পর্কের আত্মীয়। কুরআনের বিধান অনুসারে রক্তসম্পর্কের আত্মীয়রা পরস্পরের উত্তরাধিকার লাভের জন্য অগ্রাধিকারী এবং তাই রক্তসম্পর্কের আত্মীয়তার দিক থেকে সবচেয়ে নিকটতমদেরকেই উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। 

ওয়ারিস  وَارِثُ
‘ওয়ারিস’ শব্দের অর্থ ‘উত্তরাধিকারী’। তবে ‘উত্তরাধিকারী’ অর্থে ‘ওয়ারিস’ শব্দটি সাধারণ পর্যায়ের। কুরআনে যাদেরকে উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে তারা যেমন ‘ওয়ারিস’, তেমনি কুরআনে নির্দিষ্টকৃত উত্তরাধিকারীদের কেউ জীবিত না থাকলে আল্লাহর বিধানকে লংঘন না করে যারা ঐ উত্তরাধিকার লাভ করে তারাও ‘ওয়ারিস’ হিসেবে সাব্যস্ত হবে।

ওয়াসিয়্যাত  وَصِيَّةُ
‘ওয়াসিয়্যাত’ শব্দের অর্থ হলো: বিশেষ নির্দেশ, নাজুক পরিস্থিতিতে করণীয় বিষয়ে অগ্রিম নির্দেশনা, স্বীয় মৃত্যু পরবর্তীকালে সম্পদের বণ্টনের বিষয়ে নির্দেশনা। ইংরেজি পরিভাষায় একে উইল (Will)  বলা হয়। 
৪:১১ আয়াতে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে কে কতটুকু পাবে তার উল্লেখ শুরু করা হয়েছে ‘ইউসীকুমুল্লাহু’ (আল্লাহ তোমাদেরকে ওয়াসিয়্যাত করছেন) বাক্যের মাধ্যমে। ৪:১২ আয়াতে উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধিকে ‘ওয়াসিয়্যাতাম মিনাল্লাহ’ (আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ওয়াসিয়্যাত/বিশেষ নির্দেশ) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ২:২৪০ আয়াতে আল্লাহর একটি ওয়াসিয়্যাত উল্লেখ করা হয়েছে বিধবা নারীদেরকে এক বছর তাদের গৃহ থেকে বের করে না দিয়ে ভরণপোষণের ব্যবস্থা করার জন্য। এ ওয়াসিয়্যাত কে কার্যকর করবে তা উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। এ থেকে স্বত:সিদ্ধভাবে বুঝা যায় যে, এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক দায়িত্ব হলো মৃত ব্যক্তির পরিবার পরিজনের এবং প্রয়োজনে সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও এ ওয়াসিয়্যাত প্রযোজ্য হবে।
২:১৮০ আয়াতে যদি কোনো ব্যক্তি বার্ধক্য অবস্থায় বা এমন অবস্থায় উপনীত হলে যাতে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সে মৃত্যুর সন্নিকটে রয়েছে বলে ধারণা হয় তার উপর তার পিতা-মাতা ও অন্যান্য নিকটতম আত্মীয়দের জন্য ওয়াসিয়্যাত (Will)  করে যাওয়াকে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধিতে যে উত্তরাধিকারীদের জন্য যে আনুপাতিক অংশ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে সেটা কার্যকর করতে হবে মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাতের দাবি পূরণ এবং ঋণ পরিশোধের পরে।

কালালাহ  كَلَالَة
‘কালালাহ’ শব্দটি দ্বারা বুঝায় ‘কোনো ব্যক্তি তার মৃত ভাই বা বোনের উত্তরাধিকারী হওয়ার পর্যায়ে উপনীত আত্মীয়তা’। দুই অবস্থায় একজন পুরুষ বা নারী কালালাহ হিসেবে তার মৃত ভাই বা বোনের উত্তরাধিকার লাভ করে। যদি মৃত ব্যক্তির কোনো সন্তান না থাকে সে অবস্থায় ভাই-বোন ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত আনুপাতিক অংশের অধিকারী হবে। আর যদি মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা না থাকে কিন্তু সন্তান থাকে সে অবস্থায় ভাই-বোন ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত আনুপাতিক অংশের অধিকারী হবে। 

ছিহর  صِهْر
‘ছিহর’ শব্দের অর্থ হলো ‘বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তা’। বংশগত আত্মীয়তার বিপরীতে বৈবাহিক সম্পর্কের আত্মীয়তা বুঝাতে ‘ছিহর’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। বৈবাহিক সম্পর্কে আত্মীয়দের মধ্যে রয়েছে স্বামী/স্ত্রী, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, শ্যালক, শ্যালিকা দেবর, ননদ প্রভৃতি। বৈবাহিক সূত্রের আত্মীয়দের মধ্যে শুধুমাত্র স্বামী/স্ত্রী আক্বরাবূন (সবচেয়ে নিকটতম আত্মীয়) হিসেবে উত্তরাধিকারী। অন্যরা উলিল ক্বুরবা (উত্তরাধিকারী নন এমন আত্মীয়) হিসেবে সাব্যস্ত।

তুরাস تُرَاث
‘তুরাস’ শব্দটির অর্থ হলো ‘উত্তরাধিকার’। কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার পরিত্যক্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করাকে ‘তুরাস’ বলা হয়। ৮৯:১৯ আয়াতে নির্বিচারে অন্যের উত্তরাধিকারকে গ্রাস করার বিষয়ে তিরস্কার করা হয়েছে।

দাইন   دَيْن
‘দাইন’ শব্দটির অর্থ হলো ‘ঋণ, দেনা’। ২:২৮২ আয়াতে ঋণ লেনদেন সম্পর্কিত বিধি-বিধান দেয়া হয়েছে। ঋণ লেনদেন লিখিত এবং পরিশোধের সময়সীমা নির্দিষ্টকৃত হতে হবে। তবে যদি বাস্তবসম্মত অসুবিধার কারণে যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে ঋণ প্রাপককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ঋণ ফেরত দেয়ার মতো স্বচ্ছলতা পর্যন্ত অবকাশ দেয়ার জন্য। যদি কোনো ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে তবে তার পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে প্রথমে ঋণ পরিশোধ করতে হবে এবং মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত থাকলে তার দাবি পূরণ করতে হবে। তারপর বাকি সম্পদ উত্তরাধিকারীদের মধ্যে নির্ধারিত হারে বণ্টন করতে হবে।

মাওয়ালিয়া  مَوَالِيَ
‘মাওয়ালিয়া’ শব্দটি হচ্ছে ‘মাওলা’ শব্দের বহুবচন। ‘মাওলা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘রক্ষাকর্তা, উত্তরাধিকারী’। তবে ‘মাওয়ালিয়া’ শব্দটি ‘নির্দিষ্ট উত্তরাধিকারী’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অন্য কথায়, পিতা-মাতা ও নিকটতম আত্মীয়গণের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে যাদেরকে উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে তাদেরকে মৃত ব্যক্তির ‘মাওয়ালিয়া’ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে।

মীরাস  مِيرَاثُ
‘মীরাস’ শব্দটির অর্থ ‘স্বত্ব, উত্তরাধিকার’। কুরআনে ‘মীরাস’ শব্দটি দুইবার ব্যবহৃত হয়েছে (৩:১৮০:২৪, ৫৭:১০:৯) এবং উভয়স্থানে শব্দটি ‘আল্লাহর মালিকানা’ বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। অন্যদিকে মানুষের পরস্পরের উত্তরাধিকার বুঝানোর জন্য কুরআনে ‘তুরাস’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে (৮৯:১৯:২)। তাই আমরা মানুষের পরস্পরের উত্তরাধিকার বুঝাতে ‘তুরাস’ শব্দ ব্যবহার করাই সঙ্গত হবে।

নাসাব نَسَب
‘নাসাব’ (বহুবচনে ‘আনসাব’) শব্দের অর্থ হলো ‘বংশগত আত্মীয়তা’। শব্দটি আত্মীয়তার দুটি মূল শ্রেণিকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ‘বৈবাহিক আত্মীয়তা’র বিপরীতে ব্যবহৃত হয়। ‘উলুল আরহাম’ শব্দটি রক্তসম্পর্কের সকল আত্মীয়কে অন্তর্ভুক্ত করে তা পিতৃকুলের সাথে সম্পর্কিত (চাচা, ফুফু) হোক বা মাতৃকুলের সাথে সম্পর্কিত (মামা, খালা) হোক এবং রক্তসম্পর্কের পূর্বপুরুষ (পিতা), উত্তরপুরুষ (সন্তান) ও পার্শ্বপুরুষ (ভাই) সকলকে অন্তর্ভুক্ত করে। অন্যদিকে ‘নাসাব’ শব্দটি দ্বারা বুঝায় কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ কোন পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে সেই সম্পর্ক নির্ধারণ করা।

নাসীব/নসীব نَصِيبٌ
‘নাসীব’ শব্দের অর্থ ‘প্রাপ্য অংশ’। এই প্রাপ্যতা কারো কর্মের গুণে হোক বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গ্রেস (Grace) হিসেবে নির্ধারণ করে দেয়া হোক উভয় অবস্থায় ‘নাসীব’ শব্দ ব্যবহৃত হতে পারে। ৪:৭ আয়াতে উত্তরাধিকারীদের প্রাপ্য অংশকে ‘নাসীবাম মাফরূদা’ (নির্ধারিত প্রাপ্য অংশ) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

যিল ক্বুুরবা/ উলুল ক্বুরবা  ذِي الْقُرْبَىٰ/ أُولُو الْقُرْبَىٰ
‘যিল ক্বুরবা’ শব্দটির অর্থ হলো ‘আত্মীয়তার/নৈকট্যের অধিকারী’। ‘যিল ক্বুরবা’ শব্দের বহুবচন হলো ‘উলুল ক্বুরবা’। ‘আক্বরাবূন’ (সবচেয়ে নিকটতম আত্মীয়গণ) তথা যাদের জন্য উত্তরাধিকার নির্ধারিত তারা ছাড়া অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনকে ‘উলিল ক্বুরবা’ বলা হয়। ৪:৮ আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে (আক্বরাবূনের মধ্যে) উত্তরাধিকার বণ্টনকালে যেসব ‘উলুল ক্বুরবা’ (উত্তরাধিকারী নন এমন আত্মীয়-স্বজন) উপস্থিত হবেন তাঁদের সাথে ন্যায়সঙ্গত ও ভদ্রোজনোচিত কথা বলতে হবে এবং তাঁদেরকেও উপজীবিকাস্বরূপ পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে কিছু দিতে হবে। আক্বরাবূনের মধ্য থেকে কেউ জীবিত না থাকলে উলিল আমর (Central Authority) উপযুক্ত ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শক্রমে মৃত ব্যক্তির ‘উলুল ক্বুরবার’ মধ্যে তা বণ্টন করতে পারেন অথবা অংশবিশেষ বা প্রয়োজনে সম্পূর্ণ সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করতে পারেন। এরূপ ক্ষেত্রে উলিল আমরের কল্যাণকর সিদ্ধান্তের আনুগত্য করতে হবে।

হাযযু  حَظّ
‘হাযযু’ শব্দের অর্থ হলো ‘অংশ, ব্যক্তিগত অংশ, সমষ্টিগত অংশ’। উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধি বর্ণনায় ৪:১১ ও ৪:১৭৬ আয়াতে পুত্র-কন্যার প্রাপ্য অংশ এবং পুত্র-কন্যা জীবিত না থাকলে সে অবস্থায় ভাইবোনের প্রাপ্য অংশ প্রসঙ্গে একটি মূলনীতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি (একজন পুরুষের জন্য দুইজন নারীর সমষ্টিগত অংশের অনুরূপ)। আয়াতটিতে ‘হাযযু’ শব্দটি ‘সমষ্টিগত অংশ’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ দুই কন্যা একসাথে যা পাবে এক পুত্র একাই তা পাবে। অনুরূপভাবে দুই বোন একসাথে যা পাবে এক ভাই একাই তা পাবে। এর কারণ হলো পুত্র ও ভাই পুরুষ হওয়ার কারণে তাদের উপর অর্পিত অর্থনৈতিক দায়িত্ব বেশি এবং কন্যা ও বোন নারী হওয়ার কারণে তাদের উপর অর্পিত অর্থনৈতিক দায়িত্ব কম।
-----------------------------------------



Popular posts from this blog

-ঃআল-কুরআনুল করীমঃ-

বিস‌মিল্লা‌হির রহমনুর রহিম -ঃআল-কুরআনুল করীমঃ- ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ বাংলা তরজমা ও সম্পাদনাঃ- শামসুল ‘উলামা বেলায়েত হোসেন  মাওলানা আবদুর রহমান কাশগরী  মুহম্মদ মাহমূদ মুস্তফা শা'বান  শামসুল উলামা মুহম্মদ আমীন 'আব্বাসী  ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্  প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ ডক্টর সিরাজুল হক ডক্টর কাজী দীন মুহম্মদ অধ্যক্ষ এ.এইচ. এম. আবদুল কুদ্দুস  মাওলানা মীর আবদুস সালাম অধ্যাপক শাহেদ আলী মাওলানা ফজলুল করীম  এ.এফ.এম. আবদুল হক ফরিদী  আহমদ হুসাইন  মাওলানা আলাউদ্দীন আল-আজহারী  মাওলানা মুহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ্  হাফেজ মঈনুল ইসলাম আবুল হাশিম -ঃ৩য়সংস্করণের সম্পাদকমণ্ডলীঃ- ডক্টর সিরাজুল হক ডক্টর কাজী দীন মুহম্মদ জনাব আ.ফ.ম. আবদুল হক ফরিদী ডক্টর এ.কে.এম. আইউব আলী  ডক্টর মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান ডক্টর এম. শমশের আলী জনাব দাউদ-উজ-জামান চৌধুরী জনাব আহমদ হুসাইন জনাব মাওলানা আতাউর রহমান খান জনাব মাওলানা ওবায়দুল হক জনাব আ.ত.ম. মুছলেহ্ উদ্দীন জনাব মোহাম্মদ ফেরদাউস খান জনাব মাওলানা রিজাউল করীম ইসলামাবাদী জনাব মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ জনাব এ.এফ.এম. আবদুর রহমান অধ্যাপক শাহেদ আলী  মুফতী মুহাম্মদ

Whey The Government Sector Are So Poor !

Add caption Whey The Government Sector Are So Poor ! ভাল ছাত্ররা কেন পুুলিশ বা আর্মীতে চাকুরী পায়না !! কথা সত্য ! স্কুলের প্রথম ব্রেঞ্চের ছাত্ররা খুব কমই সরকারী চাকুরী পায় !! কেননা মেধার জোর থাকলেও তাদের শুপারিশের জোর থাকেনা ! তাইতো সরকারী সেক্টরে তাদের চাকুরীও হয়না ! হলেও হয় কোন প্রায়ভেট ফোর্মে অথবা প্রবসে ! আর পুলিশের চাকুরী হয় সব সময় পেছনের ব্রেঞ্চের ছাত্রের ! কারন ওদের মেধা না থাকলেও খুটির জোর আছে !! তাছাড়া ও যখন পুলিশের চাকুরী হয় তখন ভাল ছাত্র, মেধাবীরা পড়া লেখায় ব্যস্ত থাকে, নিজেকে বিকশিত করে, আগামীতে বড় কোন অফিসার হবার !! কিন্তু ! তাদের পড়ালেখা যখন শেষ, তখন পুলিশের কোটাও শেষ ! আর্মি এর কোটা শেষ ! সরকারী চাকরীর কোটাতো রিজাভ আছে, কোন নেতা, বড় বাবু, তথা , এলিট বা ধনীক মহাশয়ের অযোগ্য পুত্র বা নাতি বা ভাতিজা অথবা ভাগ্নী ইত্যাদির জন্য ! তাইতো মেধাবী মধ্যবিত্ত ছেলেটির আর সরকারী দপ্তরে আসা হয়না ! যেতে হয় প্রায়ভেট ফোর্মে ! ফলা ফল প্রায়ভেট সেক্টর লাভ করলেও সরকারী সেক্টর সবসময় লোকসান গুনতেই থাকে !! কেননা মেধা তো মেধাই তাইনা !! প্রত্যেকটা সেক্টরের ‍দিকে তাকান, সম অবস্তা দেখবেন !

বিষয় : নোয়াখালীর সুবর্ণচর ট্রাজেডি

নোয়াখালীর সুবর্ণচর ট্রাজেডি   এই সেই ধর্ষক  "ধর্ষকের পরিচয় ধর্ষকই"   ধর্ষকের কোন দল নাই..  সে কারো আত্মীয় নয়  কারো ভাই বা সন্তন নয় তার একটাই পরিচয় ; সে ধর্ষক !! তাই আমি চাই; ধর্ষনকারীর কঠিন  শাস্তি হোক. . আমি সামগ্রিক ভাবে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে দুই সন্তানের জননীকে গণধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের সর্বোচ্চ্য ও কঠিন শাস্তি দাবী করছি। অন্যদিকে দুঃখজনক ভাবে এই ঘটনাকে নির্বাচন পরবর্তী সহিংস্রতায় রুপ প্রদানে ব্যস্ত মাহফুজ আনাম, ডেইলিস্টার, প্রথম আলো, যুগান্তর সহ একটা পক্ষ!গৃহবধূর গণধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনা সত্য তবে এটার সাথে আ'লীগের ভোট দেওয়া না দেওয়ার বিষয় জড়িত নয়। গৃহবধূর স্বামী জানান, রোববার দুপুরের দিকে তার স্ত্রী স্থানীয় ভোটকেন্দ্র চর জুবলীর ১৪নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট দিতে যান। তিনি ভোট দিয়ে ফেরার পথে স্থানীয় রুহুল আমিন নামে এক ব্যক্তি তাকে অনুসরণ করে এবং উত্ত্যক্ত করে। তার স্ত্রী এর প্রতিবাদ জানিয়ে দ্রুত বাড়ি ফিরে আসেন। এ অবস্থায় রুহুল আমিন ও তার লোকজন স্ত্রীর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। রোববার গভীর রাতে রুহুল আমিনের নেতৃত্বে ৮-১০ জনের একদল সন্ত্রাসী দরজা ভেঙ