স্যাটানিক ভার্সেস ও শয়তানের উপরে ঈমান আনার গল্প
মোঃ জাহাঙ্গীর আলম
-ঃস্যাটানিক ভার্সেস ও শয়তানের উপরে ঈমান আনার গল্পঃ-
কাহিনী সূত্রঃ কাহিনীটা মূলতঃ পবিত্র কোরানের সুরা নাজমের নাযিলের উপর ভিত্তি করেই এই স্যাটানিক ভার্সেস বা শয়তানের ওপরে ঈমান আনার গল্প সম্বলিত উপন্যাসটা রচিত! সুতরাং প্রথমে সুরা নাজমের বিষয়ে আমাদের যতোটুকু জানা সম্বব জানতে হবে! তবেই এর সত্য মিথ্যাটা আমাদের নিকট পরিস্কার হবে।
সুরা আন-নাজম, সুরা নং- ৫৩ আয়াত সংখ্যাঃ- ৬২
নামকরণঃ- এই সূরাটির প্রথম শব্দ وَالنَّجْمِ থেকে এই সূরার নামটি গৃহীত হয়েছে; অর্থাৎ, যে সূরাটি النّجْم (‘নাজম’) শব্দটি দ্বারা শুরু হয়েছে এটি সেই সূরা।
নাযিল হওয়ার সময় ও স্থানঃ- বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, ও নাসায়ীতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, সর্ব প্রথম যে সূরাটিতে সিজাদার আয়াত নাযিল হয়েছে, সেটি হচ্ছে, সূরা আন-নাজম । এ হাদীসের যে অংশসমূহ আসওয়াদ ইবনে ইয়াযীদ, আবু ইসহাক এবং যুহারের ইবনে মুয়াবিয়া কর্তৃক ইবনে মাসউদের রেওয়ায়াত সমূহে বর্ণিত হয়েছে তা থেকে জানা যায় যে, এটি কুরআন মজীদের প্রথম সূরা যা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরাইশদের এক সমাবেশে (ইবনে মারদুইয়ার বর্ণনা অনুসারে হারাম শরীফের মধ্যে) শুনিয়েছিলেন। সমাবেশে কাফের ও ঈমানদার সব শ্রেনীর লোক উপস্থিত ছিল। অবশেষে তিনি সিজদার আয়াত পড়ে সিজদা করলে, উপস্থিত সবাই তার সাথে সিজদা করে। এমনকি মুশরিকদের বড় বড় নেতা যারা তার (রসুল সঃ) বিরোধিতার অগ্রভাবে ছিল তারাও সিজদা না করে থাকতে পারেনি। ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন; "আমি কাফেরদের মধ্যে মাত্র এক ব্যক্তি অর্থাৎ উমাইয়া ইবনে খালফকে দেখলাম, সে সিজদা করার পরিবর্তে কিছু মাটি উঠিয়ে কপালে লাগিয়ে বললোঃ আমার জন্য এটাই যথেষ্ট। পরবর্তী সময়ে আমি নিজ চোখে তাকে কাফের অবস্থায় নিহিত হতে দেখেছি।"
এ ঘটনার অপর একজন প্রত্যক্ষদর্শী হলেন হযরত মুত্তালিব ইবনে আবী ওয়াদা’আ । তিনি তখনও মুসলমান হননি। নাসায়ী ও মুসনাদে আহমাদে তার নিজের বক্তব্য এভাবে উদ্ধৃত হয়েছে যে, নবী (সা) সূরা নাজম পড়ে সিজদা করলেন এবং উপস্থিত সবাই তার সাথে সিজদা করলো। কিন্তু আমি সিজদা করিনি। বর্তমানে আমি তার ক্ষতিপূরণ করি এভাবে যে, এ সূরা তিলাওয়াতকালে কখনো সিজদা না করে ছাড়ি না।
ইবনে সা’দ বর্ণনা করেন, ইতিপূর্বে নবুওয়াতের ৫ম বছরের রজব মাসে সাহাবা কিরামের একটি ছোট্ট দল হাবশায় হিজরত করেছিলেন। পরে ঐ বছর রমযান মাসেই এ ঘটনা ঘটে অর্থাৎ রসূলুল্লাহ সাঃ কুরাইশদের জনসমাবেশে সূরা নাজম পাঠ করে শোনান এবং এতে কাফের ও ঈমানদার সবাই তার সাথে সিজদায় পড়ে যায়। হাবশায় মুহাজিরদের কাছে এ কাহিনী এভাবে পৌছে যে, মক্কায় কাফেররা মুসলমান হয়ে গিয়েছে। এ খবর শুনে তাদের মধ্যেকার কিছু লোক নবুওয়াতের ৫ম বছরের শাওয়াল মাসে মক্কায় ফিরে আসেন। কিন্তু এখানে আসার পরে জানতে পারেন যে, জুলুম-নির্যাতন আগের মতই চলেছে। অবশেষে হাবশায় দ্বিতীয়বার হিজরত করার ঘটনা সংঘটিত হয়। এতে প্রথমবারের হিজরতের তুলনায় অনেক বেশি লোক মক্কা ছেড়ে চলে যায়। এভাবে প্রায় নিশ্চিতরূপে জানা যায় যে, সূরাটি নবুওয়াতের ৫ম বছরের রমযান মাসে নাযিল হয়েছিলো।
শানে নুযূলঃ- নাযিল হওয়ার সময়-কাল সম্পর্কে এ বিস্তারিত আলোচনা থেকে কিরূপ পরিস্থিতিতে এ সূরাটি নাযিল হয়েছিল তা জানা যায়। রসূলুল্লাহ সাঃ নবুওয়াত লাভের শুরু থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত শুধু ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং বিশেষ বিশেষ বৈঠকেই আল্লাহর বাণী শুনিয়ে মানুষকে আল্লাহর দীনের দিকে আহবান জানিয়ে আসছিলেন। এ সুদীর্ঘ সময়ে তিনি কখনো কোন জনসমাবেশে কুরআন শোনানোর সুযোগ পাননি। কাফেরদের চরম বিরোধীতাই ছিল এ প্রধান অন্তরায়। তার ব্যক্তিত্ব ও প্রচারণা মূলক তৎপরতায় কিরূপ প্রচণ্ড আকর্ষণ এবং কুরআন মজীদের আয়াতসমূহে কি সাংঘাতিক প্রভাব আছে তারা খুব ভাল করেই জানতো। তাই তাদের চেষ্টা ছিল তারা নিজেরাও এ বাণী শুনবে না, অন্য কাউকেও শুনতে দিবে না এবং তার বিরুদ্ধে নানা রকমের ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করে শুধু নিজেদের মিথ্যা প্রচার প্রোপাগাণ্ডার জোরে তার এ আন্দোলনকে দমিয়ে দেবে। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য একদিকে তারা বিভিন্ন স্থানে একথা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছিলো যে, মুহাম্মাদ সঃ বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হয়েছেন এবং লোকদেরকে পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। অপরদিকে তাদের স্থায়ী কর্মপন্থা ছিল এই যে, নবী (সাঃ) যেখানেই কুরআন শোনানোর চেষ্টা করবেন, সেখানেই হট্টগোল, চিৎকার হৈ হল্লা শুরু করিয়ে দিতে হবে। যাতে যে কারণে তাঁকে পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত লোক বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে, তা যেন লোকে আদৌ জানতে না পারে। এ পরিস্থিতিতে রসূলুল্লাহ সাঃ একদিন পবিত্র হারাম শরীফের মধ্যে কুরাইশদের একটি বড় সমাবেশে হঠাৎ বক্তৃতা করতে দাঁড়ালেন। সূরা আন নাজম আকারে এখন যে সূরাটি আমাদের সামনে বর্তমান, আল্লাহর পক্ষ থেকে রসূলে (সাঃ) মুখে তা বক্তৃতা আকারে পরিবেশিত হলো। এ বাণীর প্রচণ্ড প্রভাবে অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, তিনি সূরা আন নাজম শুনাতে আরম্ভ করলে এর বিরুদ্ধে বিরেধীদের হট্টগোল ও হৈ -হল্লা করার খেয়ালই হলো না। এবং এ সূরাটির তেলাওয়াত শুনে তারা এতটাই প্রভাবিত হয়েছিল যে, শেষের দিকে তিনি (মুহম্মদ সাঃ) যখন সিজদা করলেন তখন তারাও সিজদা করলো। পরে তারা এই ভেবে অত্যন্ত বিচলিত বোধ করলো যে, আমরা একি দুর্বলতা দেখিয়ে ফেললাম। এজন্য লোকজনও তাদেরকে এ বলে তিরস্কার করলো যে, এরা অন্যদের এ বাণী শুনতে নিষেধ করে ঠিকই, কিন্তু আজ তারা কান পেতে তা শুধু শুনলো না, (মুহাম্মাদ সাঃ) সাথে সিজদাও করে বসলো। তখন নিজেদের সন্মান ও লজ্জা ঢাকতে, অবশেষে তারা এ মর্মে মিথ্যা অপবাদ রটায় যে, আরে মিয়া, আমরা তো এমনি সেজদা করিানি, বরং যখন শুনতে পেলাম, (তোমরা কি ভেবে দেখেছ লাত ও উযযা সম্পর্কে? এবং আরেক (দেবী) মানাত সম্পর্কে?) (সুরা নাজম আয়ত- ১৯-২০) কথাটির পর মুহাম্মাদ (সাঃ) মুখ থেকে যখন উচ্চারিত হলো, (এরা সব উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন দেবী। তাদের শাফায়াতের আশা অবশ্যই করা যায়) কথাটি, তখন আমরা সিজদা করেছিলাম। কারন আমরা মনে করেছিলাম যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) আমাদের পথে ফিরে এসেছে।
অথচ তারা যে কথাটি শুনতে পেয়েছে বলে দাবী করেছিলো, এ সমগ্র সূরাটির পূর্বাপর প্রেক্ষিতের মধ্যে তা কোথাও খাটে না। এ ধরনের একটি উদ্ভট বাক্যের সাথে এ সূরার মিল খুঁজে পাওয়া একমাত্র কোন পাগলের পক্ষেই সম্ভব। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন তাফহীমূল কুরআন, সূরা আল -হাজ্জ, টীকা ৯৬ থেকে ১০১) ।
মক্কার কাফেররা কুরআন ও হযরত মুহাম্মাদ সাঃ এর প্রতি যে আচরণ ও নীতি অবলম্বন করে চলেছিলো তাদের ঐ নীতি ও আচরণের ভ্রান্তি সম্পর্কে সাবধান করে দেয়াই এ সুরার মূল বিষয়বস্তু। বক্তব্য শুরু করা হয়েছে এভাবে যে, মুহাম্মাদ সাঃ বিভ্রান্ত বা পথভ্রষ্ট ব্যক্তি নন যেমনটি, তোমরা রটনা করে বেড়াচ্ছা। আর ইসলামের এ শিক্ষা ও আন্দোলন তিনি নিজে মনগড়া ভাবে প্রচার করেছেন না যেমনটা তোমরা মনে করে বসে আছে। বরং তিনি যা কিছু পেশ করেছেন তা নির্ভেজাল অহী ছাড়া আর কিছুই নয়। এ অহী তার ওপর নাযিল করা হয়। তিনি তোমাদের সামনে যে সব সত্য বর্ণনা করেন তা তার অনুমান ও ধারণা নির্ভর নয়, বরং নিজ চোখ দেখা অকাট্য সত্য। যে ফেরেশতার মাধ্যমে তাঁকে এ জ্ঞান দেয়া হয় তাকে তিনি নিজ চোখে দেখেছেন। তাঁকে সরাসরি তার রবের বড় বড় নিদর্শনসমূহ পরিদর্শন করানো হয়েছে । তিনি যা কিছু বলছেন চিন্তা-ভাবনা করে বলছেন না, দেখে বলছেন। যে জিনিস একজন অন্ধ দেখতে পায় না অথচ একজন চক্ষুষ্মান ব্যক্তি দেখতে পায়, সে জিনিস নিয়ে চক্ষুষ্মানের সাথে অন্ধের বিতর্কে লিপ্ত হওয়া যেমন, মুহাম্মাদ (সা) এর সাথে তাওহীদ আখেরাত প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তোমাদের তর্ক করা ঠিক তেমনি। এরপর ক্রমান্বয়ে তিনটি বিষয়ে বক্তব্য পেশ করা হয়েছেঃ প্রথমত শ্রোতাদের বুঝানো হয়েছে তোমরা যে ধর্মের অনুসরণ করছো তা কতকগুলো ধারণা ও মনগড়া জিনিসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তোমরা লাত, মানাত ও উযযার মত কয়েকটি দেব-দেবীকে উপাস্য বানিয়ে রেখেছো, অথচ প্রকৃত খোদায়ীর ক্ষেত্রে তাদের নাম মাত্রও অংশ নেই। তোমরা ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর কন্যা ধরে নিয়ে বসে আছ। কিন্তু নিজেদের কন্যা সন্তান থাকাকে তোমরা লজ্জা ও অপমানের বিষয় বলে মনে কর। তোমরা নিজের পক্ষ থেকে ধরে নিয়েছো যে, তোমাদের এ উপাস্যরা আল্লাহ তা’আলার কাছে তোমাদের কাজ আদায় করে দিতে পারে। অথচ আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী সমস্ত ফেরেশতা সম্মিলিতভাবেও আল্লাহকে তাদের কোন কথা মানতে বাধ্য বা উদ্ধুদ্ধ করতে পারে না। তোমাদের অনুসৃত ও ধরনের আকীদা-বিশ্বাসের কোনটিই কোন জ্ঞান বা দলীল প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। এগুলো নিছক তোমাদের প্রবৃত্তির কিছু কামনা-বাসনা যার কারণে তোমরা কিছু ভিত্তিহীন ধারণাকে বাস্তব ও সত্য মনে করে বসে আছ। এটা একটা মস্ত বড় ভুল। এ ভুলের মধ্যেই তোমরা নিমজ্জিত আছ। সত্যের সাথে যার পূর্ণ সামঞ্জস্য আছে সেটিই প্রকৃত আদর্শ। সত্য মানুষের প্রবৃত্তি ও আকাংখার তাবেদার হয় না যে, সে যাকে সত্য মনে করে বসবে সেটিই সত্য হবে। প্রকৃত সত্যের সাথে সংগতির জন্য অনুমান ও ধারণা কোন কাজে আসে না। এজন্য দরকার জ্ঞানের। সে জ্ঞানই তোমাদের সামনে পেশ করা হলে তোমরা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে এবং উল্টা সে ব্যক্তিকেই পথভ্রষ্ট সাব্যস্ত করো যে তোমাদের সত্য কথা বলেছেন। তোমাদের এ ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হওয়ার মূল কারণ হলো, আখেরাতের কোন চিন্তাই তোমাদের নেই। কেবল দুনিয়াই তোমাদের উদ্দেশ্য হয়ে আছে। তাই সত্যের জ্ঞান অর্জনের আকাঙ্ক্ষা যেমন তোমাদের নেই, তেমনি তোমরা যা আকীদা-বিশ্বাসের অনুসরণ করছো তা সত্যের সাথে সংগতিপূর্ণ হোক বা না হোক তারও কোন পরোয়া তোমাদের নেই। দ্বিতীয়ত, লোকদের বলা হয়েছে যে, আল্লাহই সমগ্র -বিশ্ব-জাহানের একচ্ছত্র মালিক মোক্তার। যে তার পথ অনুসরণ করছে সে সত্য পথ প্রাপ্ত আর যে তার পথ থেকে বিচ্যুত সে পথ ভ্রষ্ট। পথভ্রষ্ট ব্যক্তির পথভষ্টতা এবং সত্য-পন্থীর সত্য পথ অনুসরণ তার অজানা নয়। তিনি প্রত্যেকের কাজ কর্মকে জানেন। তার কাছে অন্যায়ের প্রতিফলন অকল্যাণ এবং সুকৃতির প্রতিদান কল্যাণ লাভ অনিবার্য। তুমি নিজে নিজেকে যা-ই মনে করে থাকো এবং নিজের মুখে নিজের পবিত্রতার যত লম্বা চওড়া দাবিই করো না কেন তা দিয়ে তোমার বিচার করা হবে না। বরং আল্লাহর বিচারে তুমি মুত্তাকী কিনা তা দিয়ে তোমার বিচার করা হবে। তুমি যদি বড় বড় গোনাহ থেকে দূরে অবস্থান করো তাহলে তার রহমত এত ব্যাপক যে, তিনি ছোট ছোট গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন। তৃতীয়ত, কুরআন মজীদে নাযিল হওয়ার শত শত বছর পূর্বে দীনে হকের যে কয়টি মৌলিক বিষয় হযরত ইবরাহীম, ও মূসার সহীফাসমূহে বর্ণনা করা হয়েছিল তা মানুষের সামনে এজন্য পেশ করা হয়েছে যে, মানুষ যেন এরূপ ভ্রান্ত ধারণা পোষন না করে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি সম্পূর্ণ নতুন দীন নিয়ে এসেছেন, বরং মানুষ যাতে জানতে পারে যে, এগুলো মৌলিক সত্য এবং আল্লাহর নবীগণ সব সময় এ সত্যই প্রচার করেছেন। সাথে সাথে ঐসব সহীফা থেকে একথাও উদ্ধৃত করা হয়েছে যে, আদ, সামূদ, নূহ ও লূতের কওমের ধ্বংস হয়ে যাওয়া কোন আকস্মিক দুর্ঘটনার ফল ছিল না। আজ মক্কার কাফেররা যে জুলুম ও সীমালংঘন থেকে বিরত থাকতে কোন অবস্থাতেই রাজি হচ্ছে না, সে একই জুলুম ও সীমালংঘনের অপরাধেই আল্লাহ তা’আলা তাদের ধ্বংস করেছিলেন। এসব বিষয় তুলে ধরার পর বক্তৃতার সমাপ্তি টান হয়েছে এ কথা বলে যে, চূড়ান্ত ফায়সালার সময় অতি নিকটবর্তী হয়েছে। তা প্রতিরোধ করার মত কেউ নেই। চূড়ান্ত সে মুহুর্তটি আসার পূর্বে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও কুরআনের মাধ্যমে তোমাদেরকেও ঠিক তেমনিভাবে সাবধান করে দেয়া হচ্ছে যেভাবে পূর্ববর্তী লোকদের সাবধান করা হয়েছিল। এখনি এ কথাগুলোই কি তোমাদের কাছে অভিনব মনে হয়? এজন্যই কি তা নিয়ে তোমরা ঠাট্টা তামাসা করছো? এ কারণেই কি তোমরা তা শুনতে চাও না, শোরগোল ও হৈ চৈ করতে থাকো। যাতে অন্য কেউও তা শুনতে না পায়? নিজেদের এ নির্বুদ্ধিতার জন্য তোমাদের কান্না আসে না? নিজেদের এ আচরণ থেকে বিরত হও, আল্লাহর সামনে নত হও এবং তারই বন্দেগী করো। এটা ছিল বক্তব্যের অত্যন্ত মর্মস্পর্শী উপসংহার যা শুনে কট্টর বিরোধীরাও নিজেদের সংবরণ করতে পারেনি। তাই মূলতঃ রসূলুল্লাহ সাঃ আল্লাহর বাণীর এ অংশ পড়ে সিজদা করলে তারাও স্বাতঃষ্ফর্তভাবে সিজদায় পড়ে যায়।
The Satanic Verses পর্যালোচনাঃ-The Satanic Verses নামকরনঃ-
The Satanic Verses বইটা আসলে কী, এই প্রশ্ন একেক জনের কাছে করলে একেক রকম উত্তর পাবেন। কেউ বলে ভ্রান্ত ইতিহাস, কেউ বলে ধর্মবিরোধী পুস্তিকা, কেউ মনে করে একটি পুঁজিবাদী-ইহুদি চক্রান্ত, কারও কারও কাছে এই বইটা হলোকস্টের চেয়ে কোন অংশে কম জেনোসাইডাল নয়। আবার স্বয়ং রুশদির কাছে এটি কেবলই একটি উপন্যাস, একজন লেখকের কল্পনার সৃষ্টি। উপন্যাসকে অবশ্য হেলাফেলা করার কিছু নেই। পাঠের যোগ্য উপন্যাস মাত্রই ভাষা, রুপ ও ভাবনাকে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করে, ইংরেজি novel শব্দটি যেন জগতকে নতুন দৃষ্টিতে দেখার উপরই গুরুত্ব আরোপ করে। রুশদি তাঁর সমগ্র লেখক জীবনে সাহিত্যের একটি ভাষা সৃষ্টি করতে চেয়েছেন, সাহিত্যের এমন একটি রুপ যার মাধ্যমে প্রাক্তন উপনিবেশের বাসিন্দারা পূর্নরুপে আত্মপ্রকাশ করতে সমর্থ হবে।
স্যাটানিক ভার্সেস যদি কিছু হয়ে থাকে, তবে সেটি হল একজন পর্যটকের জগতদর্শন, রুশদির ভাষায় a migrant’s-eye view of the world। মূলোৎপাটন, বিচ্ছেদ, রুপান্তর- অভিপ্রয়াণের এই অভিজ্ঞতাকে সম্বল করেই রুশদি উপন্যাসটি লিখেছিলেন। সবাই হয়ত সশরীরে পাসপোর্ট হাতে বর্ডার পার হয় না, তবে ব্যক্তি জীবনে কোন না কোন বর্ডার কমবেশি সবাইকেই অতিক্রম করতে হয়। যৌবন অতিক্রমে করে মধ্যবয়সে পৌছুনোর বেদনাদায়ক যাত্রায় সবাইকেই অংশ নিতে হয়। অভিপ্রয়াণ একটা খুবই লোভনীয় উপমা, যেকোন প্রসঙ্গে যেকোন ব্যক্তির উপর একে প্রয়োগ করা যায়।
উপন্যাসের মূল চরিত্রগুলো ব্রিটিশ মুসলমান, তবে ধার্মিক মুসলমান না। প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীকে সঙ্করীকরণের বিরুদ্ধে লড়তে হয়, তারা পুরাতন ও নুতনের দ্বন্দ্বে ধরাশায়ী হয়। উপন্যাসটির কট্টর সমালোচকরা মনে করেন ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সাথে মেলামেশা নিজের সংস্কৃতি ধ্বংসেরই নামান্তর। অন্যদিকে স্যাটানিক ভার্সেস সঙ্করতা, তথাকথিত আপজাত্য, সংমিশ্রণ, এবং এসব কিছু থেকে উদ্ভূত নতুন সংস্কৃতি, রাজনীতি, চেতনা, চলচ্চিত্র ও সঙ্গীতকে উদযাপন করে। বইটা সঙ্করীকরণকে উপভোগ করে, পরমকে ভয় করে। এখান থেকে কিছু আর ওখান থেকে কিছু নিয়েই তো দুনিয়াতে নতুন কিছু একটা আসে। রুশদি গণঅভিপ্রয়াণের মাধ্যমে উত্থাপিত এই সম্ভাবনাকে আলিঙ্গন করেন। স্যাটানিক ভার্সেস সঙ্করীকরণের মাধ্যমে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে, বইটি সব সঙ্করদের প্রতি নিবেদিত একটি প্রেমগীতি। সব প্রশ্নের উত্তর জানার দাবিদার পরমের শিষ্যরা সঙ্কর জনসাধারণের মাঝে ত্রাস সৃষ্টি করেছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়, অস্বীকার করতে চেয়েছে এই সহজ সত্য যে, "প্রত্যেকটি মানুষ ইতিহাসের জারজ সন্তান।" সাদা, কালো, বাদামি একজন আরেকজনের ভেতর প্রবিষ্ট হচ্ছে, যেভাবে নানা পদের মশলা মিশে সৃজন হয় নতুন কোন অমৃত। রুশদি মনে করেন, খাঁটি আর ভেজালের এই প্রাচীন বিরোধ অব্যাহত থাকুক। মানুষ সবসময় নিজেকে এভাবেই বুঝেছে, কোন মানুষ, মূর্তি বা ভাবমূর্তির সামনে প্রণত হয়ে নয়।
রুশদি চেষ্টা করেছিলেন একটি প্রতিবাদী কর্ম সৃষ্টি করতে, যা পাঠকের পূর্বনির্মিত জগতচিত্রকে সংস্কার করবে। এই বইয়ে এমন কিছু নেই যার জন্য রাস্তায় নামতে হবে। মোল্লারা যেই বই নিয়ে বিলাপ করেছিল, ওই বইয়ের অস্তিত্ব নাই। এই বইটা নিয়ে যে ক্যাচাল হয়েছে, সেই ক্যাচালকে রুশদি প্রাচ্য আর পশ্চিমের স্বাধীনতার সংঘাত বলে মনে করেন না (যেমনটা অনেকে পরবর্তীতে দাবি করেছেন), কারণ তার পরিযায়ী অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছেন যে পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষই স্বাধীনতার প্রতি সমানভাবে আসক্ত। নিজেকে স্বাধীন ধরে নিয়েই তিনি স্যাটানিক ভার্সেস লিখতে বসেছিলেন।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতাটা আসলে কী? এটা যাই হোক, আঘাত করার স্বাধীনতা না থাকলে এর কোন অস্তিত্বই নাই। সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও নৈষ্ঠিকতাকে ব্যঙ্গ করতে না পারলে আর্ট টিকবে না, আর্ট না টিকলে নিজেদেরকে “মানুষ” মনে করার একটা যুক্তি গায়েব হয়ে যাবে। স্যাটানিক ভার্সেসের একাংশ একজন ধর্মহীন ব্যক্তির সাথে ধর্মবিশ্বাসের মোলাকাতকে তুলে ধরে। বইটি সর্বাঙ্গে বিশ্বাসের প্রতি বৈরী নয়। এই বইয়েরই একটি ভারতীয় চরিত্র প্রশ্ন করছে, “আমরা যদি প্রথমেই কোন বিশ্বাসকে ভুল ধরে লেখালেখি করি, তবে কি আমরা উন্নাসিকতার দোষে দুষ্ট নই? আমরা কি সাধারণের উপর নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গী চাপিয়ে দিচ্ছি না?”। তবে উপন্যাসটিতে কিছু সংশয়ও আছে, উপন্যাসটি কিছু প্রশ্ন তুলে ধরে যা ধার্মিকদের পছন্দ হবে না। কিন্তু এই ব্যাপারটা খোদ ইসলামী সাহিত্যেই প্রাচীন আমল থেকে প্রচলিত আছে, স্যাটানিক ভার্সেস এদিক দিয়ে অভিনব না।
উপন্যাসটা কিসের প্রতিবাদ করছে? ধর্মবিশ্বাসের অধিকার তো নয়ই। এই গল্প সব ধরণের নৈষ্ঠিকতা ও পরম দাবির বিরোধী। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার দরকার নাই, বিমান উড়িয়ে দেওয়া শিখ সন্ত্রাসেরও দরকার নাই, হাস্যকর খৃষ্টীয় সৃষ্টিবাদের দরকার নাই, ইসলামের সংকীর্ণ সংজ্ঞারও কোন দরকার নাই। এই প্রতিবাদ আর যাই হোক, খিস্তিখেউড় না। মুসলমানদের এসবে সমস্যা নেই, তাদের সমস্যা হল “রুশদি নবী মোহাম্মদকে সমকামী কইছে”, “রুশদি বলছে যে নবীজি আল্লাহর কাছে ব্যভিচারের অনুমতি চাইছে”, “রুশদি নবীজির স্ত্রীদেরকে বেশ্যা বলছে”, “রুশদি কোরানকে শয়তানের কর্ম বলছে” প্রভৃতি দাবি। এই দাবিগুলার চেয়েও বেশি বিস্ময়কর হল যে এই দাবিগুলো বারবার পুনরাবৃত্তির কারণে সত্যের মর্যাদা পেয়ে গিয়েছে, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ বইটা না পড়েই বই আর বইয়ের লেখককে গালাগালি করেছে এবং করছে।
স্যাটানিক ভার্সেস দু’টি বিভাজিত সত্ত্বার গল্প। একটি সত্ত্বা হল সালাদিন চামচা, তার ক্ষেত্রে বিভাজনটা সেকুলার ও সামাজিক; সালাদিন বোম্বে ও লন্ডন, প্রাচ্য ও পশ্চিমের টানাপোড়েনের শিকার। অন্যদিকে জিব্রিল ফারিশতার ক্ষেত্রে বিভাজনটি আধ্যাত্মিক; বিশ্বাস হারিয়েও জিব্রিল বিশ্বাস করতে চায়, কিন্তু বিশ্বাস তাকে দেখা দেয় না। এই দু’টি বিভাজিত সত্ত্বার দ্বান্দ্বিকতা ও একাগ্রতা অর্জনের অভিযাত্রাই এই উপন্যাসের আধেয়।
কেন “জিব্রিল ফারিশতা”? “আসল” জিব্রিল ফেরেস্তাকে হেয় করার জন্যই কি এই নাম বেছে নেওয়া হয়েছে?
নাহ! উপন্যাসের জিব্রিল একজন চলচ্চিত্র অভিনেতা। আর দশটা কুশীলব ও ফেরেস্তার মতই উপন্যাসের জিব্রিল আমপাবলিকের মাথার উপরে বসবাস করে, সে অর্ধেক দেবতা আর অর্ধেক মানুষ, সে জীবনের চেয়েও বড়। এই চরিত্রকে একজন ফেরেস্তার নাম দেওয়ার মানে হল তাকে ফেরেস্তাদের আধা-ঐশ্বরিকতার সেকুলার প্রতিমূর্তি প্রদান করা। তবে জিব্রিল যখন বিশ্বাস হারায়, এই নাম তখন তাকে তাড়া করে বেড়ায়।
এই গল্পে চামচা টিকে থাকে। সে প্রেম ও মরণের মত শাশ্বত সত্যকে গ্রহণ করতে সমর্থ হয়, সে পরিশেষে তার শেকড়ে ফিরে এসে একাগ্রতা অর্জন করে। জিব্রিল টিকতে পারে না। সে ইশ্বরের প্রতি ভালবাসা ফিরে পায় না, ইশ্বরপ্রেমকে সে ঐহিক প্রেম দিয়েও প্রতিস্থাপন করতে পারে না, জিব্রিল নির্ধারিত সময়ের আগেই তার জীবনের উপসংহার লিখে ফেলতে বাধ্য হয়।
জিব্রিলের যাতনাগুলো তার কাছে স্বপ্নের রূপে আবির্ভুত হয়। এই স্বপ্নগুলোতে সে নিজেকে সত্যকারের জিব্রিল ফেরেস্তার রুপে আবিস্কার করে, বিভিন্ন ধর্মীয় ন্যারেটিভের সে প্রত্যক্ষ সাক্ষ্মী হয় এবং সেগুলোতে সে অনিচ্ছায় অংশগ্রহনও করে। এই স্বপ্নগুলো অবশ্য পুরোপুরি সংশয়ী মনোভাবের না। একটা স্বপ্নে সে নিজেকে মির্জা সাইদ আকবর নামক এক জমিদারের দেহে আবিস্কার করে। এই জমিদারের গ্রামে হঠাত একদিন একটি রহস্যময়ী বালিকা আবির্ভূত হয়, সে গ্রামবাসীকে তার সাথে পদব্রজে মক্কায় যাত্রা করার আহবান জানায়, তাদের জন্য আরব সাগর পথ ছেড়ে দাঁড়াবে। পুরো গ্রামবাসী মেয়েটির পেছনে যাত্রা শুরু করে, তাদের সাথে যোগ দেয় জমিদারের ধর্মপরায়ণ, প্রিয়তমা স্ত্রী। জমিদার এই কাফেলার পিছু নেন। তিনি এসব অলৌকিকতায় বিশ্বাস করেন না, নিজের চোখেই তিনি দেখেন তাঁর স্ত্রীসহ গোটা গ্রাম আরব সাগরে ডুবে যাচ্ছে। তবে বহুকাল পরে তিনি বিশ্বাস ফিরে পান। মরণের আগ মুহুর্তে ইশ্বর তাঁকে দেখান যে সেদিন আরব সাগর ঠিকই দু’ভাগ হয়েছিল, তার স্ত্রী ঠিকই সেদিন ইশ্বরের রাজ্যে প্রবেশ করেছিল, সংশয়ের পর্দা ভেদ করে মির্জা সাইদ আকবর এই অলৌকিক পরিণতি অবলোকন করতে পারেননি। জিব্রিলের সবগুলো স্বপ্নই বিশ্বাস ও সংশয়ের মধ্যকার অস্থিরতাটা তুলে ধরে।
জিব্রিলের যে স্বপ্নগুলো নিয়ে গোটা বিশ্বের মুসলিম সমাজে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল, সেই স্বপ্নগুলো জিব্রিলের জন্য সবচেয়ে বেদনাদায়ক ছিল। স্বপ্নগুলোতে জিব্রিল “জাহিলিয়া” নামক এক মায়াবী বালুকা নগরীতে “সাবমিশন” নামক এক ধর্মের উত্থান পর্যবেক্ষণ করে। স্যাটানিক ভার্সেস বইটা নিয়ে যাবতীয় কুৎসা ও আপত্তি এই স্বপ্নগুলোর অধ্যায় থেকেই নেওয়া হয়েছে।
এই স্বপ্নগুলো স্বপ্নদ্রষ্টার জন্য ভয়াবহরকম বেদনাদায়ক ছিল। প্রতিটি রাতে এই স্বপ্নগুলো তাকে তার বিশ্বাসহীনতার জন্য শাস্তি দিত, বিশ্বাস ফিরে পাওয়ার তার প্রাণান্ত প্রচেষ্টার মাঝে তার উপরে সংশয়ের গুরুবোঝা চাপিয়ে দিত। ঘুমের মধ্যে জিব্রিল প্রাণপণে চেষ্টা করত স্বপ্নগুলো হতে মুক্ত হওয়ার জন্য, কিন্তু স্বপ্নগুলো এক সময় সজাগ দুনিয়াতেও জিব্রিলকে গ্রাস করল, জিব্রিল বদ্ধোন্মাদ হয়ে গেল। মক্কা শরিফকে ভেংচি কাটার জন্য এই স্বপ্নের শহরকে “জাহিলিয়া” নাম দেওয়া হয়নি, বরং জিব্রিলকে ওই শহরে জোরপূর্বক পাঠিয়ে তার মানসিক অবস্থা বোঝানোর জন্যই এই নাম ব্যবহার করা। স্বপ্নের এই দৃশ্যগুলোর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল মানবজীবনের উপর ইশ্বরহীনতার বিপর্যয়কর প্রভাবকে তুলে ধরা, ইসলামকে “ভুল” প্রমাণ করা নয়।
এই দৃষ্টিতে “আপত্তিকর” অধ্যায়গুলো দেখলে বাকি জিনিসগুলো নিজ থেকেই পরিস্কার হয়ে যায়। বইটির শিরোনাম “স্যাটানিক ভার্সেস” ইসলামের ইতিহাসের একটি বিতর্কিত অধ্যায়কে ইঙ্গিত করে। বলা হয়ে থাকে যে মোহাম্মদ সাঃ মক্কার কুরাইশ গোত্রের নেতাদের সাথে একটা বোঝাপড়ায় এসেছিলেন যে মোহাম্মদ কুরাইশদের তিনটি নারী দেবতাকে স্বীকৃতি দিয়ে কোরানের আয়াত নাযিল করালে কুরাইশরা মোহাম্মদের আল্লাহর উপাসনা করবে এবং মুসলমানদের সাথে মক্কায় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করবে। কিন্তু কুরাইশরা তাদের কথা রাখেনি, তাই মোহাম্মদ পরে শয়তান দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার দাবি করে ওই আয়াতগুলোকে কোরান থেকে বাতিল করে দেন, এর জন্য এর নাম “স্যাটানিক ভার্সেস”। জিব্রিলের সবচেয়ে পীড়াদায়ক স্বপ্নগুলার জন্য রুশদি এই ঘটনাকে বেছে নিয়েছেন কারণ বিশ্বাস ও সংশয়ের দ্বন্দ্বের চরম পরিণতি লেখকের পক্ষে এই ঘটনাটার মাধ্যমেই সবচেয়ে ভালভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। জিব্রিলের স্বপ্নের এই দৃশ্যগুলোতে পাঠক মোহাম্মদের চরিত্রে “মাহুন্ড” (Mahound) নামক এক চরিত্রকে দেখতে পান, উল্লেখ্য যে সেই সময়কার খৃষ্টানরা অবমাননার উদ্দেশ্যে মোহাম্মদ সাঃ কে এই নামে অভিহিত করত। মাহুন্ডের কর্মকান্ডের প্রতি সংশয় প্রকাশ করে “সালমান দ্যা পারসিয়ান” নামক এক চরিত্র, যার দায়িত্ব ছিল মাহুন্ডের উপর নাযিলকৃত আয়াতগুলো নথিভুক্ত করা। এই চরিত্রটি সাহাবী সালমান-আল ফারিসিকে হেয় করার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি, বরং উপন্যাসে রুশদির সরাসরি প্রতিনিধি হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। রুশদি স্বীকার করছেন যে এই সালমানের মুখ দিয়ে বের হওয়া কথাগুলো অনেক পাঠকের কাছেই কর্কশ মনে হবে, কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যেই জিব্রিলের স্বপ্নে এই দুর্মুখ ব্যক্তি আবির্ভূত হয়েছে, সেই জিব্রিল নিজেও একজন দুর্মুখ ব্যক্তি, মনযোগী পাঠক মাত্রই তা খেয়াল করবেন। আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে যে জিব্রিল তার উন্মাদনার শেষ পর্যায়ে এই স্বপ্নগুলো দেখছে যখন তার জীবনের নিশ্চয়তাগুলো সব একে একে ভেঙে পড়েছে। এই স্বপ্নগুলো তার বাতুলতাকে পরিপূর্ণ করেছে।
তবে রুশদি স্বীকার করেন যে মক্কাবাসীর ওই তিন নারী দেবতাকে মাহুন্ড দ্বারা প্রত্যাখিত হওয়ার মাধ্যমে নারীর প্রতি ইসলামের মনোভাবকেও তিনি খোঁটা দিয়েছেন। এ সংক্রান্ত আয়াতগুলো কোরানে এখনও আছে, [Qur’an 53:19-22]
‘Have ye seen Lat and ‘Uzza,
And another, the third (goddess), Manat?
What! for you the male sex, and for Him, the female?
Behold, such would be indeed a division most unfair!” [Qur’an 53:19-22]
সূরা আন-নাজম শুরু থেকে পড়লে প্রেক্ষাপটটা বুঝতে সুবিধা হবে।
আবার জিব্রিলের স্বপ্নের মধ্যেই সালমান দ্যা পারসিয়ান “সাবমিশন” ধর্মের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন যে এই ধর্মটা মানুষের জীবনের প্রত্যেকটি অংশের উপর নিজের আইন চাপিয়ে দিচ্ছে,
("ইয়াথ্রিবের মরূদ্যানে আত্মসমর্পণের নতুন বিশ্বাসের অনুসারীরা নিজেদেরকে ভূমিহীন এবং তাই দরিদ্র বলে মনে করেছিল। বহু বছর ধরে তারা জাহিলিয়াতে এবং যাওয়ার পথে ধনী উট-ট্রেন আক্রমণ করে ছিনতাইয়ের মাধ্যমে নিজেদের অর্থ যোগান দেয়। মাহাউন্ডের কাছে ক্ষোভের জন্য কোন সময় ছিল না, সালমান বালকে বলেছিলেন, শেষ এবং উপায় নিয়ে কোন দ্বিধা নেই। বিশ্বস্তরা অনাচারে জীবনযাপন করত, কিন্তু সেই বছরগুলোতে মাহাউন্ড – নাকি প্রধান দূত জিবরেল বলা উচিত? আল-লাহ বলা উচিত? আইন দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে. মরুদ্যানের খেজুর গাছের মাঝে জিবরীল নবী সঃ এর কাছে হাজির হয়েছিলেন এবং নিজেকে নিয়ম, নিয়ম, বিধি-বিধান বলতে দেখেন, যতক্ষণ না বিশ্বস্তরা আর কোন আপ্ত বাক্যের সম্ভাবনা কমই বহন করতে পারে, সালমান বলেছিলেন, প্রতিটি জঘন্য জিনিসের নিয়ম, যদি একজন মানুষ পার্শ করে। সে তার মুখ বাতাসের দিকে ঘুরিয়ে দেয়, কোন হাতটি নিজের পিছনে পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে হবে সে সম্পর্কে একটি নিয়ম। যেন মানুষের অস্তিত্বের কোনো দিকই অনিয়ন্ত্রিত, মুক্ত রাখা হয়নি। উদ্ঘাটন আবৃত্তি বিশ্বস্তদের কতটা খেতে হবে, কতটা গভীরভাবে ঘুমাতে হবে এবং কোন যৌন অবস্থানগুলি ঐশ্বরিক অনুমোদন পেয়েছে তা বলেছিল, যাতে তারা শিখেছিল যে সডোমি এবং ধর্মপ্রচারক অবস্থান প্রধান দেবদূত দ্বারা অনুমোদিত, যেখানে নিষিদ্ধ ভঙ্গিগুলি যে সমস্ত মহিলা শীর্ষে ছিল তাদের অন্তর্ভুক্ত। জিব্রাইল আরও কথোপকথনের অনুমোদিত এবং নিষিদ্ধ বিষয়গুলি তালিকাভুক্ত করেছিলেন এবং শরীরের এমন অংশগুলিকে চিহ্নিত করেছিলেন যেগুলি যতই অসহনীয়ভাবে চুলকাতে পারে না কেন আঁচড়ানো যায় না। তিনি চিংড়ি খাওয়ার বিষয়ে ভেটো দিয়েছিলেন, সেইসব উদ্ভট অন্যান্য জাগতিক প্রাণী যা বিশ্বস্তদের কোন সদস্য কখনও দেখেনি, এবং রক্তপাতের মাধ্যমে প্রাণীদের ধীরে ধীরে হত্যা করতে হবে, যাতে তাদের মৃত্যুর সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তারা বুঝতে পারে তাদের জীবনের অর্থ, কারণ এটি শুধুমাত্র মৃত্যুর মুহুর্তে জীবিত প্রাণীরা বুঝতে পারে যে জীবন বাস্তব ছিল, স্বপ্ন নয়। এবং প্রধান দেবদূত জিবরীল একজন মানুষকে কোন পদ্ধতিতে কবর দিতে হবে এবং তার সম্পত্তি কীভাবে ভাগ করা উচিত তা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন, যাতে সালমান পারস্যের সালমান ভাবতে থাকে যে এটি একজন ব্যবসায়ীর মতো এতটা শোনাচ্ছিল ঈশ্বরের কি পদ্ধতি। এটি ছিল যখন তার ধারণা ছিল যা তার বিশ্বাসকে ধ্বংস করেছিল, কারণ তিনি স্মরণ করেছিলেন যে অবশ্যই মাহাউন্ড নিজেই একজন ব্যবসায়ী ছিলেন এবং একজন অভিশপ্ত সফল ব্যক্তি, যার কাছে সংগঠন এবং নিয়ম স্বাভাবিকভাবেই এসেছিল, তাই এটি কতটা সুবিধাজনক ছিল তার উচিত ছিল এমন একজন ব্যবসায়ীর মতো প্রধান দেবদূতকে নিয়ে আসা, যিনি এই উচ্চ কর্পোরেটের ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্তগুলি হস্তান্তর করেছিলেন, যদি অ-সংস্থানিক, ঈশ্বর"।)
সালমান এখানে কেবল জিব্রিলকে অত্যাচার করছে না, একই সাথে পাঠককেও খোঁচা দিচ্ছে। এটা একটা ভ্যালিড সমালোচনা, বিদ্বেষ না। কারও কাছে যদি মনে হয় উপরে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে, তবে তিনি “বিদ্বেষ” না ছড়িয়ে যৌক্তিক সমালোচনা করার একটা ছহিহ তরিকা বাতলে দিলে সংসারের সকল দুষ্টু লেখকদের সুবিধা হত। যারা এরুপ সমালোচনার জন্য রুশদিকে হত্যা করার পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন, তাদের প্রতি রুশদির প্রশ্ন- ধর্মের বিধান কেন সমালোচনার উর্ধ্বে থাকবে? সমালোচনাই যদি করতে না পারবে, তবে লেখক আর বুদ্ধিজীবিদের কাজটা কী?
তাছাড়া এমন তো না যে মুসলিম দুনিয়ায় ইসলামের বিধি-বিধান নিয়ে বিতর্ক হয় না। মুসলিম ধর্মপতিরা তাদের সুড়সুড়ি বন্ধ করার জন্য নারীদের উপর বোরকা-হিজাব চাপিয়ে দিতে চাইলে অনেক মুসলিম নারী তার প্রতিবাদ করছে, ইসলাম নারীদের সন্তান পালনের উপর গুরত্ব আরোপ করলেও মুসলিম বিশ্বের নারীরা এখন স্বেচ্ছায় কর্মক্ষেত্রে যোগ দিচ্ছে। মুসলিম সমাজ যেহেতু প্রতিদিনই নিজেদের বিধি-বিধান নিয়ে প্রশ্ন করছে, তাহলে ওই একই কাজ করার জন্য একজন ঔপন্যাসিকের কল্লা দাবি করতে হবে কেন?
যাই হোক, টেক্সটে ফেরা যাক। আরেকটা প্রচলিত অভিযোগ হল রুশদি নবীর সাহাবীদেরকে গালাগাল করেছেন। স্বপ্নের যেই দৃশ্যে নব সঃ এর সঙ্গীদের “scum” এবং “bums” বলা হচ্ছে, সেগুলো কাফিরদের মুখ নিঃসৃত, লেখকের নয়। জালিমের জুলুমকে বিশদে বর্ণনা না করে কি নিপীড়নকে ফুটিয়ে তোলা যায়? সংশয়ীদের প্রশ্নকে উত্থাপিত না করে কিভাবে আপনি আপনার উপন্যাসে সংশয়কে তুলে ধরবেন?
নবীর স্ত্রীদের নিয়ে করা অভিযোগটাও বিশেষভাবে ব্যাখ্যার দাবি রাখে। জিব্রিলের স্বপ্নের শেষের দিকের দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে যে জাহিলিয়াতে সাবমিশন ধর্ম পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জাহিলিয়া বাসীর জীবনের প্রায় প্রত্যেকটি অংশ ধর্ম পুলিশের পর্যবেক্ষণে চলে আসে (এবং সাধারণ মানুষের মাঝে এক প্রকার অস্থিরতা সৃষ্টি হয়), একে একে প্রত্যেকটি ধর্মবিরোধী উপাদানকে নির্মূল করা হয়। রয়ে যায় শুধু একটি পতিতালয়। এমনিতেই উন্মুক্ত যৌনতায় অভ্যস্ত জাহিলিয়াবাসীর উপর জেন্ডার সেগ্রেগেশন চাপিয়ে দেওয়ায় তাদের ভেতরে চাপা ক্ষোভ ছিল, তার উপর জাহিলিয়ার পুরুষদের দীর্ঘ দিনের প্রিয় এই প্রতিষ্ঠানকে উচ্ছেদ করলে তাদের অবদমিত অস্থিরতা বিষ্ফোরিত হতে পারে, এই ভয়ে এই পতিতালয়কে একটি নির্ধারিত সময়ের জন্য জাহিলিয়াতে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়। এই পতিতালয়ের পতিতারা পুরুষদের উত্তেজিত করার জন্য মাহুন্ডের স্ত্রীদের নাম নেয়, এবং এটাকে ভিত্তি করেই সমালোচকরা ছড়িয়ে দেয় যে রুশদি মোহাম্মদ সঃ এর স্ত্রীদেরকে বেশ্যা বলেছেন। অথচ উপন্যাসে পরিস্কার করেই বলা আছে যে মাহুন্ডের প্রকৃত স্ত্রীরা ঠিকই তাঁর হারেমে “শুদ্ধ” জীবনযাপন করছে, পতিতালয়ের পতিতারা তাঁদের নাম নিয়েছে শুধুই আগত পুরুষদের ফ্যান্টাসিকে তোষণ করার জন্য। এই প্রোভোকেটিভ চিত্রের মাধ্যমে দু’টো বিষয় তুলে ধরা হয়েছেঃ
১) শাসকদের বিলাসী জীবন নিয়ে শোষিতদের ফ্যান্টাসি।
২) পবিত্র আর অপবিত্রতার দ্বন্দ্ব।
হারেম আর পতিতালয়- এই দু’টো জায়গাতেই নারীদেরকে ব্যক্তিগত পুঁজি বা সম্পত্তির মত আলাদা করে রাখা হয়, পার্থক্যটা হল যে হারেমে মালিক থাকে স্থায়ীভাবে একজন আর পতিতালয়ে টাকার বিনিময়ে সাময়ীকভাবে প্রভুত্ব কিনে নেওয়া যায়। এই পতিতালয়ে বা’ল নামক এক কবি আশ্রয় নিয়েছিল, কুরাইশদের আমলে মাহুন্ডকে ব্যঙ্গ করে কবিতা লেখার জন্য মাহুন্ড তার উপর ক্ষেপে ছিলেন। একদিকে পতিতালয়ের মত অপবিত্র জায়গায় নবীর পবিত্র হারেমকে সিমুলেট করা, আরেকদিকে এই একই পতিতালয়ে নবীর সমালোচনাকারী এক অপবিত্র কবিকে আশ্রয় দেওয়া- পবিত্র আর অপবিত্রতার মধ্যকার অস্থিরতাটা তুলে ধরাই এখানে রুশদির উদ্দেশ্য। তবে শেষ পর্যন্ত্য পবিত্রতা অপবিত্রতাকে ধ্বংস করে, মাহুন্ড সবার সামনে পতিতা আর কবির মুন্ডু কর্তন করেন।
(‘পুরোনো দিনে তুমি আবৃত্তিকে উপহাস করতে,’ মাহাউন্ড চুপ করে বলল। 'তাহলে, এই লোকেরাও আপনার ঠাট্টা উপভোগ করেছে। এখন আপনি আমার ঘরের অসম্মান করতে ফিরে এসেছেন, এবং মনে হচ্ছে আপনি আরও একবার লোকদের মধ্যে থেকে খারাপটিকে বের করে আনতে সফল হয়েছেন। বাল বললেন, 'আমি শেষ করেছি। যা ইচ্ছে কর. 'তাই ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তাকে শিরশ্ছেদ করার শাস্তি দেওয়া হয় এবং সৈন্যরা তাকে তাঁবু থেকে হত্যার জায়গার দিকে মারধর করে, সে তার কাঁধে চিৎকার করে বলেছিল: 'বেশ্যা এবং লেখক, মাহাউন্ড। আমরা এমন মানুষ যারা আপনি ক্ষমা করতে পারবেন না।' মাহাউন্ড উত্তর দিল, ‘লেখক ও বেশ্যা। আমি এখানে কোনো পার্থক্য দেখি না।')
পবিত্রতা আর অপবিত্রতার দ্বান্দ্বিকতা সালাদিন চামচা ও জিব্রিল ফারিশতার গল্পেও দেখা যায়। স্যাটানিক ভার্সেস ক্যাচাল নিয়ে লেখা From Fatwa to Jihad বইয়ে লেখক কিনান মালিক বলছেন,
(ফেরেশতা এবং শয়তান। মিথ এবং দানব. এগুলি স্যাটানিক ভার্সেসের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে। সালাউদ্দিন চমছা এবং জিবরিল ফারিশতার লড়াই, নিজেদের এবং একে অপরের সাথে, এটির উপর স্থাপিত সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে মানুষের কল্পনার লড়াই। একটি শয়তান, অন্যটি একটি দেবদূত, তবুও তারা ক্রমাগত তাদের নিজস্ব প্রকৃতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। যখন সালাদিনকে গ্রেপ্তার করা হয়, জিবরিল, দেবদূত, তাকে সাহায্য করতে অস্বীকার করে। দাঙ্গা-বিধ্বস্ত পূর্ব লন্ডনে যখন দুজনের আবার দেখা হয়, তখন জিবরিল আজরাইল হিসাবে আবির্ভূত হয়, যা ফেরেশতাদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক, আগুন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। কিন্তু জিবরিলের দ্বারা তাকে শিকার করা হলেও, দানব সালাদিন একটি জ্বলন্ত বাড়িতে আটকে থাকা পরিবারকে বাঁচাতে তার জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিল।)
রুশদি আমাদের কাছে যা দেখতে চান তা হল শয়তান এবং দেবদূতের মধ্যে পার্থক্যটি তাদের অভ্যন্তরীণ স্বভাবের মধ্যে কম থাকে যা মানুষ তাদের দ্বারা চিহ্নিত করে। ধর্ম যদি মানুষের ইমেজে ঐশ্বরিক ও শয়তান সৃষ্টি করে, সেক্যুলার সমাজ মানুষকে সমানভাবে শয়তান ও ফেরেশতার প্রতিমূর্তি তৈরি করে। উভয় ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ তাদের ফেরেশতা এবং দানবদের মোতায়েন করে তাদের অন্যথায় অযৌক্তিক ক্রিয়াকলাপকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য, সীমানা তৈরি করতে যা লঙ্ঘন করা যায় না।) যা এভাবে ধর্মীয় সেন্টীমেস্ট ব্যবহার না করেও করা যেত। এবং সেটাই মনে হয় বেশি ভাল হতো। আর নিজেকে এমন ভাবে ফেঁসে যেতে হতো না।
পতিতালয়ের দৃশ্যটা মোটেই নবীর স্ত্রীদের হেয় করার জন্য নির্মাণ করা হয়নি, বরং নৈতিকতা ও যৌনতা সম্পর্কিত কিছু ভাবনাকে নাটকীয় রুপ দেওয়া হয়েছে। পতিতালয়টির নাম “হিজাব”- একটা আয়রনি, কারণ এই অপবিত্র গৃহে পবিত্রতাকে সিমুলেট করা হয়। এখানে অবশ্য আমি আরেকটা আয়রনি দেখতে পাই যেটা রুশদি নিজের অজান্তেই তুলে ধরেছেন। মেয়েদের জামাকাপড় নিয়ে ঘুম হারাম করা, মেয়েদের “পবিত্রতা” নিশ্চিত করার গুরুভার বহন করা লোকগুলা নিঃসংকোচেই স্বীকার করে যে তাদের উপর তাদের মস্তিস্কের চেয়ে শিশ্নের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বেশি, ক্ষেত্রবিশেষে শিশ্নই তাদের ঘিলু। জাকির নায়েক যখন দাবি করেন যে মেয়েরা “সংযত” জামা না পড়লে তারা “পাবলিক প্রপার্টি” হয়ে যাবে, তখন তিনি পবিত্রতার ঝান্ডাধারিদের অবচেতন ফেটিশগুলাকে নাঙ্গা করে দেন, তথাকথিত পবিত্রতার ধারণাটার মাঝে অপবিত্রতার প্রতিবিম্ব উদ্ভাসিত করেন- যেই ভাবটা এই গল্পে বারবার উচ্চারিত হয়েছে। এরপরও আপনি আশ্বস্ত না হলে ফেসবুকের ওড়না পেজগুলো ঘুরে আসতে পারেন। যাই হোক, রুশদির উদ্দেশ্য ছিল যৌন সম্পর্কের মধ্যে পরিপৃক্ত ক্ষমতার লড়াইটাকে তুলে ধরা; এই পতিতালয়ে ক্ষমতাহীন পুরুষরা যেন রানীকে অধিকার করার পুলক লাভ করে। এখানেও বিষয়টাকে অন্য ভাবে তুলে ধরা যেত। এভাবে ধর্মীয় সেন্টীমেস্ট ব্যবহার না করেও বিষয়টা সুন্দর করা যেত। এবং সেটাই মনে হয় বেশি ভাল হতো।
এই পর্যন্ত্য পড়ার পর পাঠকের মনে স্বাভাবিকভাবেই যে প্রশ্নটা জাগে- এরকম উত্তেজক ইমেজারি ব্যবহার করার কী দরকার? “মাহুন্ড” নামটা যে মুসলমানদের খেপিয়ে দিবে এটা তো জানা কথা। আসলে এখানে টেক্সটকে প্রেক্ষাপটের বাইরে নিয়ে যাওয়ার কারণে সমস্যাটা সৃষ্টি হয়েছে। উপন্যাসের ভেতরেই সরাসরি এই প্রেক্ষাপটকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, বই না পড়েই চিল্লাচিল্লি করার কারণে প্রতিবাদকারীরা যেটা বুঝতে পারেনি,
(অপমানকে শক্তিতে পরিণত করতে, হুইগ, টোরি, কৃষ্ণাঙ্গরা সবাই গর্বের সাথে পরিধান করতে বেছে নেয় যে নামগুলি তাদের অবজ্ঞায় দেওয়া হয়েছিল; একইভাবে, আমাদের পর্বত আরোহণ, নবী-প্রণোদিত একাকী হতে হবে মধ্যযুগীয় শিশু ভীতিকর, শয়তানের প্রতিশব্দ: মাহাউন্ড)।
উপন্যাসটির একটি কেন্দ্রিয় থিম হল বর্ণবাদী ইংল্যান্ডে অভিবাসীদের অভিজ্ঞতা। এই উপাখ্যানের একটি কেন্দ্রীয় লক্ষ্য হল শত্রুর মুখ থেকে তার ভাষা কেড়ে নেওয়া, অপবাদকে শক্তিতে রুপান্তর করা। “মাহুন্ড” নামটা ব্যবহার করার পেছনে এটা একটা কারণ- যারা একসময় মাহুন্ডকে পাগল বলে অপবাদ দিত এবং মাহুন্ডের ব্যর্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল, তারাই একসময় মাহুন্ডের পদতলে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এ সব বিকল্প ভাবে করলে ভাল হতো। কেননা কারো বিশ্বাস নিয়ে গেম খেলা কোন স্বাধীনতার মধ্যে পরেনা। এবং সে অধিকার কাউকে দেয়া হয় নাই।
আত্মপরিচয় পুনরুদ্ধার করার উপমাটিকে রুশদি অনেক দূর নিয়ে গিয়েছেন। লন্ডনে ল্যান্ড করার সাথে সাথেই সালাদিন চামচা আবিস্কার করে যে তার শিং গজিয়েছে, তার শরীর ক্রমশঃ জানোয়ারের মত হয়ে যাচ্ছে। ঘটনাক্রমে সে অভিবাসন পুলিশের হাতে মার খেয়ে নিজেকে হাসপাতালে আবিস্কার করে। পাশের বিছানাগুলোতে সে অনেকগুলো জানোয়ার দেখতে পায়, অকল্পনীয় সব দৈত্য-দানব। এরা কারা? এরা দাবি করছে যে এরা সব অভিবাসী, এলিয়েন। তদের আশ্রিত দেশ তাদেরকে যে রুপ দিয়েছে, তারা সেই রুপটাই ধারণ করে আছে।
অভিবাসীদেরকে শয়তান আখ্যা দিলেই তারা শয়তান হয়ে যায় না, আর শয়তান যদি আসলেই শয়তান না হয় তবে ফেরেস্তারাও নিশ্চয়ই আসলে ফেরেস্তা নন? এখান থেকেই রুশদি নৈতিকতার এক্সপ্লোরেশন শুরু করেন যেখানে নৈতিকতা পরম কিছু নয়, সদা পরিবর্তনশীল।
উপন্যাসের শিরোনামটাই পুনরুদ্ধারের দাবি চিৎকার করে জানান দিচ্ছে। “তোমরা আমাদের শয়তান মনে কর তো? ঠিক আছে, তোমাদের দুনিয়া সম্পর্কে শয়তানের ভাষ্যটা একটু শুনো”- একারণেই এই বইটি “স্যাটানিক ভার্সেস” বা “শয়তানের ভাষ্য”। যাদেরকে তাদের otherness এর কারণে তাদের আশ্রিত সমাজ দূরে ঠেলে দিয়েছে, এই বইটা তাদেরই ভাষ্য। এই উপন্যাসের এশীয় শিশুরা সগর্বে শয়তানের শিং পরিধান করে ছুটোছুটি করে। তাদের উপর আরোপিত লেবেলটাকে তারা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করে নিয়েছে। এই উপন্যাসে কোরানকে শয়তানের রচনা বলা হয়নি; যুক্তরাষ্ট্রে “ব্ল্যাক” শব্দটা যে প্রক্রিয়ায় বর্ণবাদী অপবাদ হতে সাংস্কৃতিক গৌরবের প্রকাশমাধ্যমে রুপান্তরিত হয়েছিল, এই বইটা সেই প্রক্রিয়ারই স্বাক্ষী।
বইটির মূল বক্তব্যকে এত জঘন্যভাবে বিকৃত করা হয়েছে যে রুশদি আক্ষেপ করে বলছেন যে তাঁর এই সাহিত্যকর্মটি হয়ত চিরতরে ধ্বংস হয়ে গেল। মৌলবাদী ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরাই যেন বইটির অর্থোদ্ধার করার ইজারা নিয়েছেন। সঙ্করীকরণ যেহেতু এই উপন্যাসটির নির্মাণের পেছনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণা, তাই বলাই বাহুল্য যে ইসলাম ছাড়াও আরও অনেক উৎস থেকে উপাদান নেওয়া হয়েছে। প্রাক-খৃষ্টিয় যুগে ইশ্বর আর শয়তানকে একই সত্ত্বা বিশ্বাস করা হত।
বইটির পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে যে দু’টো বই কাজ করেছে তার কোনটার সাথেই ইসলামের সম্পর্ক নেই- উইলিয়াম ব্লেইকের Marriage of Heaven and Hell এবং মিখাইল বুলগাকভের The Master and Margarita। বুলগাকভকে সোভিয়েত রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে নিপীড়িত হতে হয়েছিল, তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়া সালমান রুশদিকেও একই পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। অনুপ্রেরণা হিসেবে আরও কাজ করেছে মহানগরীর প্রতি তাঁর অনুরাগ। একসময় বোম্বে এবং পরে লন্ডনে বসবাসের অভিজ্ঞতা এই উপন্যাসে একটু হলেও ঢুকে পড়েছে,2
(আধুনিক শহর হল বেমানান বাস্তবতার লোকাস ক্লাসিকাস। যতক্ষণ তারা রাত পার করে, ততটা খারাপ নয়। কিন্তু তারা যদি দেখা করে! এটি ইউরেনিয়াম এবং প্লুটোনিয়াম, প্রতিটি অন্যটিকে পচে, বুম করে।)
আধুনিক যুগের একজন শহুরে পুরুষ হিসেবে রুশদির কাছে অনিশ্চয়তাই একমাত্র ধ্রুবক। তরুণ বয়সেই ইশ্বরকে হারালেও তাঁর কিছু আধ্যাত্মিক চাহিদা আছে, এই চাহিদাগুলো তিনি কোন আদি কারণের শরণাপন্ন না হয়েই তুষ্ট করতে আগ্রহী। সারা জীবন নির্ধার্মিক থাকার পরও যখন তাকে “মুরতাদ” ঘোষণা করা হয় তখন তিনি বিচলিত হন, যেই ভাষার সাথে তাঁর কোন সংশ্লিষ্টতা নেই সেই ভাষায় তিনি বর্ণিত হতে চান না। তাঁকে যখন মুরতাদ আখ্যা দেওয়া হয়, তখন তাঁর জন্য যেন একটি মিথ্যা পরিচয় সৃষ্টি করা হয়; বস্তুকে পেছনে ঠেলে যেন ছায়াকে সামনে টেনে আনা হল। মিথ্যা পরিচয় তৈরীর প্রতিযোগীতায় তাঁর বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের জন্য তাঁর উপর ক্ষেপে থাকা ব্রিটিশ মিডিয়াও কম যায় না, অনেক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব তাঁকে ইগোম্যানিয়াক, লোভী, ভন্ড হিসেবে অভিহিত করেছে। তারা এও প্রচার করেছে যে সালমান রুশদি তাঁর ওরিয়েন্টাল নামের জন্য লজ্জিত, তিনি Simon Rushton হিসেবে পরিচিত হতে ইচ্ছুক। আর যেহেতু সালমান রুশদি একজন “উন্মাদ”, তাই তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করলে সেটি তার মিথ্যা প্রতিবিম্বকেই বৈধতা দিবে। তাঁর এই মিথ্যা প্রতিবিম্ব তাঁর বিরুদ্ধে মুসলিম সহিংসতাকে সহায়তা করেছে। মুসলমান বিশ্বে অনেক পত্রিকাতে তাঁকে পশ্চিমপ্রেমী, মেরুদন্ডহীন, লোভী ব্যক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে যে টাকার বস্তার বিপরীতে ইসলাম ধ্বংস করতে বসেছে। হর্হে লুইস বর্হেস, গ্রাহাম গ্রিনের মত লেখকরা লিখেছিলেন যে তাঁদেরই নাম নিয়ে তাঁদের একটি “other” পৃথিবীতে হেটে বেড়াচ্ছে। রুশদি আশংকা করেন যে তাঁর other হয়ত তাঁকেই নির্মূল করে দিবে।
১৯৮৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী আয়াতোল্লাহ খোমেনি রুশদির কল্লা চেয়ে ফতোয়া দেওয়ার কয়েক ঘন্টার মাথায় সাংসদ Keith Vaz রুশদিকে ফোন করে তাঁকে সমর্থন জানিয়েছিলেন, তার মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর তিনি রুশদির মৃত্যু দাবি করা লোক সমাগমের সামনে বক্তৃতা প্রদান করে স্যাটানিক ভার্সেস নিষিদ্ধ করার দাবি জানান। তার এক বছর আগে গার্ডিয়ানের কলামিস্ট হুগো ইয়াং ব্রিটিশ মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে এক অমর বাণী ছেড়েছিলেন, “If not Dagenham, why not Tehran?”, মানে হল “এই দেশ ভাল না লাগলে ফুটো”। ওই একই লোক এক বছর পর মৌলবাদীদের সাথে গলা মিলিয়ে রুশদিকে দোষারোপ করেছিলেন। লর্ড Dacre ঘোষণা করেছিলেন যে রুশদিকে কেউ চিপায় নিয়ে পেটালে তাঁর কিচ্ছু যায় আসবে না। রানা কাব্বানি স্তালিনবাদী ঢংয়ে লিখেছিলেন যে সব লেখককে সমাজের কাছে “জবাবদিহি” করতে হবে। লেখক ব্রায়ান ক্লার্ক Who Killed Salman Rushdie? নামক একটি নাটক লিখে রুশদিকে পড়ার জন্য পান্ডুলিপি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, রুশদির ভাগ্য ভাল সেই নাটক আলোর মুখ দেখেনি। টিভিতে লাইভ অনুষ্ঠানে দর্শকদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল রুশদির বেঁচে থাকা উচিত কিনা, এমনকি এটা ন্যাশনাল ওপিনিওন পোল পর্যন্ত্য গড়িয়েছিল। খৃষ্টান পাদ্রীরাও ইসলামী মৌলবাদীদের পক্ষ নিয়ে বক্তব্য দিয়েছিল, এক John le Carre দাবি করেছিলেন যে রুশদি সবকিছু “জেনে শুনেই” এই কাজ করেছেন। রুশদি সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন করেন- Osip Mandelstam স্তালিনকে নিয়ে কবিতা লেখার সময় কি জানতেন না যে তাঁকে এর জন্য খুন করা হবে? তাহলে কি তাঁকে খুন করা জায়েজ হয়ে গেল? শিক্ষার্থীরা তো সব জেনে শুনেই তিয়েনআমেন স্কোয়ারে প্রতিবাদ করতে গিয়েছিল, তাদের খুন করা কি তাহলে হালাল হয়ে গেল?
রুশদি মনে করেন- বই তার লেখককে নির্বাচন করে, বই সৃষ্টির প্রক্রিয়াটা পুরোপুরি সচেতন হয় না। তিনি সাহিত্যের মাধ্যমে বিশ্বাসের ক্ষমতা ও গ্রন্থ নাযিলের প্রকৃতি নিয়ে ধ্যান করতে চেয়েছিলেন। আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা অতি অবশ্যই একটি জেনুইন অভিজ্ঞতা। একজন পয়গম্বর যদি সত্যই কোন আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন এবং পারলৌকিক জগত বলে যদি কিছু না থেকে থাকে, তবে আসলে ঘটছেটা কী? একজন অবিশ্বাসীর জন্য এটা একটা জটিল প্রশ্ন। এই প্রশ্নটা মাথায় রেখেই তিনি মাহুন্ডের গল্পটি নির্মাণ করেছিলেন। তিনি জানতেন স্যাটানিক ভার্সেসের ঘটনাটা বিতর্কিত, যে মোহাম্মদ নিজেকে একজন সাধারন বার্তা-বাহক দাবি করা সত্ত্বেও তাঁর জীবনচরিতের প্রতি মুসলমানদের সংবেদনশীলতা একটু বেশিই, কিন্তু তিনি ভাবতে পারেননি যে পাঠক জিব্রিলের স্বপ্নের দৃশ্যগুলোর কাঠামো থেকে লেখকের বক্তব্য উদ্ধার করতে ব্যর্থ হবেন। অবশ্য পাঠোদ্ধার করার জন্য তো আগে পাঠ করতে হবে, অনুভূতিতে আঘাত পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকা লোকজনের পাঠ করার ধৈর্য কই!
জাহিলিয়া একই সাথে মক্কা হয়, এবং মক্কা নয়। জাহিলিয়া নির্মাণের জন্য রুশদি কিছু ঐতিহাসিক দলিলের সাহায্য নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু একই সাথে এই শহরে একটি ভারতীয় নগরীর ছায়াও রয়েছে। জিব্রিল যখন লন্ডনে যায়, জাহিলিয়া তখন লন্ডনেরও কিছু অংশ শুষে নেয়। ফিকশন ফ্যাক্ট থেকে যাত্রা শুরু করে, কিন্তু ফিকশন মাত্রই ফ্যাক্ট নয়।
রুশদি আসলে কী কী জানতেন? তিনি জানতেন যে মোহাম্মদ সাঃ একজন রক্ত মাংসের মানুষ, আর দশটা রক্ত মাংসের মানুষের মত তাঁরও নারীপ্রীতি ছিল, মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। তিনি আরও জানতেন যে ইসলাম কোন মতেই সমসত্ত্ব নয়। ইসলামে যেমন কবি ইকবাল, খৈয়াম, ইমাম গাজ্জালির দার্শনিকতা আছে (গাজ্জালিকে অবশ্য ইকবাল, খৈয়ামদের কাতারে ফেলা ঠিক হবে না, আমার তাঁকে কট্টর বৈ কিছু মনে হয়নি), তেমনই ব্র্যাডফোর্ড মসজিদ কাউন্সিলের শাব্বির আখতার কিংবা ইরানপন্থী মুসলিম ইন্সটিটিউটের পরিচালক কলিম সিদ্দিকির সঙ্কীর্ণতাও আছে। জমিদার মির্জা সাইদ আকবর ও গ্রামবাসীর আরব সাগরে ডুব দেওয়ার মুল ঘটনাটাও তিনি জানতেন। এই বিশেষ গল্পটা লেখার সময় রুশদি চেষ্টা করেছিলেন ওই মানুষগুলোর দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিশ্বাসের ক্ষমতাকে অনুভব করতে, কেন কিছু মানুষ স্রেফ বিশ্বাসের জন্য নিঃচিন্তে আত্মহুতি দিতে পারে। রুশদি যদি তাঁর ভবিষ্যত দেখতে পেতেন, তবে কি তিনি উপন্যাসটির কাহিনী বদলে ফেলতেন?
Friedrich Durrenmatt তাঁর The Physicists গ্রন্থে লিখেছিলেন,
What has once been thought cannot be unthought
স্যাটানিক ভার্সেসের ক্যাচালটাকে একটি রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে দেখতে হবে, শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিতে দেখলে হবে না। ভারতে মৌলবাদী সাংসদ সৈয়দ শাহাবুদ্দিন এই ক্যাচালকে পুঁজি করে রাজিব গান্ধীর পতনোন্মুখ সরকারকে এক হাত দেখে নিয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম ভোটারদের ক্ষমতা প্রদর্শন করা। কংগ্রেস সবসময়ই মুসলিম ভোটের উপর নির্ভরশীল ছিল। বইটি নিষিদ্ধ করার পরও কংগ্রেসের সেই যাত্রা রক্ষা হয়নি, শাহাবুদ্দিনদের একারণে বিশ্বাস করতে নেই। এই ক্যাচাল দক্ষিণ আফ্রিকার এপার্থিড বিরোধী ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের মুসলিম ও অমুসলিম সদস্যদের মাঝে বিভেদ গড়ে তুলেছিল। পাকিস্তানে নির্বাচনে মাইর খাওয়ার পর স্যাটানিক ভার্সেসকে আঁকড়ে ধরে ইসলামিস্টরা খেলায় ফিরে আসার পায়তারা করেছিল। বইটা পাকিস্তানে প্রকাশিত হবার আগেই নিষিদ্ধ করার পরও পাকিস্তানের জামায়াত ইসলাম আমেরিকান সংস্কৃতি কেন্দ্র ভাঙচুর করেছিল, রুশদির সাথে আমেরিকান সংস্কৃতি কেন্দ্রের সম্পর্ক কী সেটা তারাই বলতে পারবে। ওই মিছিলে পুলিশ গুলি ছুড়েছিল, হুদা কামে কম পক্ষে পাঁচজন মানুষ মারা গিয়েছিল। ইরানে খোমেনির ফতোয়া সদ্য সমাপ্ত ইরান-ইরাক যুদ্ধের লাখ লাখ ইরানী লাশের থেকে মনযোগ সড়িয়ে নিতে সমর্থ হয়েছিল। ব্রিটেনে অভিবাসীদের প্রতিনিধিত্বের অধিকারের জন্য সেকুলার সংগঠনের সাথে ধর্মীয় সংগঠনের প্রতিযোগীতায় ইন্ডিয়ান ওয়ার্কার্স এসোসিয়েশনের মত সেকুলার সংগঠন এগিয়ে ছিল, কিন্তু এই ক্যাচাল মসজিদগুলোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়। মসজিদগুলো একারণেই আন্দোলনের ইতি টানতে চায়নি, যদিও অনেক সাধারণ মুসলমানের কাছে প্রতিবাদের ধরণটা বিব্রতকর হয়ে পড়েছিল।
স্যাটানিক ভার্সেসের সাহিত্য মান নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, অনেক রিভিউতে দেখলাম বোদ্ধা পাঠকদের কাছেও বইটা দুর্বোধ্য লেগেছে। বক্তব্যের দিক দিয়ে বইটি দলিত অভিবাসী কমিউনিটির পক্ষে একটি শক্ত দলিল হতে পারত, কিন্তু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ক্যাজুয়ালটি হয়ে বইটি ওই একই কমিউনিটির কাছে এখন স্রেফ একটি চপেটাঘাত ছাড়া কিছু না। মোল্লাদের মুঠোবন্দি পাঠকরা একটি সম্পূর্ণ নিরীহ ও হিতার্থী টেক্সটকে টুটি চেপে ধরে বধ করেছেন। একজন লেখকের জন্য তাঁর সৃষ্ট কর্মের এই পরিণতি বোধ করি মৃত্যু পরোয়ানার চেয়েও বড় শাস্তি। যা তার কর্মেল ফল। কেননা এটা তিনি রাতারাতি জগৎ বিক্ষাত হবার জন্যই জেনে বুঝেই করেছেন বলেই আমার মনে হয়, যা কখনোই কাম্য হতে পারে না!
স্যাটানিক ভার্সেস ও শয়তানের উপর ঈমান আনার গল্পঃ-
আলোচনার প্রথম আমি যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করি, ভাই, আপনি কি সালমান রুশদির The Satanic Verses পড়েছেন?
উত্তরটা না দিয়ে, তখন হয়তো আপনি আরও খানিকটা অবাক হবেন, অথবা আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করবেন যে, বইটাতে রুশদি যে ইনফরমেশান ব্যবহার করেছে, সে ব্যাপারে আপনার কি কোনো আপত্তি আছে?
এক্ষেত্রে আমি বলবো, কেন নয়! আলবত আপত্তি আছে।
তখন হয়তো বলবেন, আপনি কি জানেন ভাই সাব, ওই বইতে রুশদি যে ইনফরমেশান ব্যবহার করেছে তার সবটাই কিন্তু ইসলামিক সোর্স থেকেই নেওয়া?
-আমার উত্তর হবে, জ্বী জনাব আমি জানি।
তখন আপনি বলতে পারেন, এসব ইসলামিক সোর্সে কি তবে ভুল ইনফরমেশান দেওয়া আছে?
আমার উত্তর হবে, থাকতেই পারে। দুনিয়ায় কুরআন ছাড়া সকল গ্রন্থ মানুষের লেখা। আর মানুষের লেখায় ভুল থাকাটাই স্বাভাবিক।
এবার হয়তো কথা বলে উঠবেন ভাই, দাঁড়ান দাঁড়ান! সালমান রুশদিকে তো আমি চিনি এবং The SatanicVerses নামক তার বইটার নামও শুনেছি আমি; কিন্তু যেটি বুঝতে পারছি না সেটি হলো আমাদের বিতর্কের বিষয়টা আসলে কি! আপনি তো The Satanic Verses নিয়ে বেশ ঝড়ো আলাপ করছেন। মূল কাহিনিটা আসলে কী?
-আচ্ছা এই কধা, তাহলে আমি বলছি, এবার শুনুন আসল গল্পটা কি!
ইন্ডিয়ান লেখক সালমান রুশদি একটি বই লিখে খুবই বিতর্কিত হয়ে পড়েন। বইটার নাম : The Satanic Verses। রুশদি সেই বইতে কিছু ইসলামিক সোর্স থেকে দলিল টেনে ইসলামকে আক্রমণ করে এবং প্রমাণের চেষ্টা করে যে-কুরআন আল্লাহর কাছ থেকে নাযিল হওয়া নয়; বরং শয়তান থেকে প্রাপ্ত কিতাব। মূলতঃ রুশদি সোর্স হিশেবে উল্লেখ করেছেন, আত-তাবারী এবং ইবনু সাদ-এর মত সীরাতগ্রন্থ সমূহ।
আত-তাবারী এবং ইবনু সাদ-এ মূলতঃ একটি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। ঘটনাটি হলো এরকম, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় যখন দাওয়াত দেওয়া শুরু করলেন, তখন একদিন তিনি কাবা শরীফের প্রাঙ্গণে বসে সদ্য ইসলামে দাখিল হওয়া মুসলিমদের মাঝে বক্তৃতা করছিলেন। সেখানে তখন মক্কার কাবায়, অন্যান্য পৌত্তলিক কুরাইশরাও উপস্থিত ছিল।
ঠিক এমন সময়ে, জিবরাঈল আলাইহিস সালাম ওহী নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আগমন করেন। সেদিন জিবরাঈল আলাইহিস সালাম সূরা নাজম নিয়ে অবতীর্ণ হন। তাবারী এবং ইবনু সাদ বলছেন, সেদিন সূরা নাজমের ১৯ এবং ২০ নম্বর আয়াতের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বাড়তি দুটি আয়াত তিলাওয়াত করেন, যা আদতে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম ওহী হিশেবে নিয়ে আসেননি। এই দুই আয়াত মূলত শয়তান রাসূল সাঃ কে ধোঁকা দিয়ে কুরআনের আয়াতের সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল। পরে জিবরাঈল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ ব্যাপারে সতর্ক করলে, রাসূল সাঃ তা ওহী ছিল না বলে বাদ দেন।
সূরা নাজমের ১৯ এবং ২০ নম্বর আয়াত হলো মুশরিকদের পূজিত সবচেয়ে বড় তিন দেবী, লাত, উযযা এবং মানাতকে নিয়ে। ওই সূরার ১৯ এবং ২০ নম্বর আয়াত হলো, তোমরা কি ভেবে দেখেছ লাত ও উযযা সম্পর্কে? এবং আরেক (দেবী) মানাত সম্পর্কে?
তাবারী এবং ইবনু সাদ বলছেন, এই দুই আয়াতের পরে আরও দুটি বাড়তি আয়াত ছিল, যা পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভুল বুঝতে পেরে বাদ দিয়েছিলেন। সেই আয়াত দুটি এরকমঃ
These are the high-flying ones, whose intercession is to be hoped for! [তারা হলেন খুবই উঁচু পর্যায়ের ক্ষমতাবান দেবী। তাদের কাছে সাহায্যও চাওয়া যায ]
তাহলে, তাবারী এবং ইবনু সাদের বর্ণনা মতে, সূরা নাজমের ১৯ এবং ২০ নম্বর আয়াতের সাথে বাদ পড়া আয়াত দুটো জুড়ে দিলে কি রকম শোনায় এবার দেখা যাক ,
তোমরা কি ভেবে দেখেছ লাত ও উযযা সম্পর্কে?
এবং আরেক (দেবী) মানাত সম্পর্কে?
তারা হলেন খুবই উঁচু পর্যায়ের (ক্ষমতাবান দেবী)
এবং তাদের কাছে সাহায্যও চাওয়া যায।
ইবনু সাদ এবং তাবারীর দাবি, পরের দুই আয়াত শুনে মক্কার মুশরিকরা খুব উৎফুল্ল হয়ে উঠল। তারা ভাবল, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবার তাদের দেবীদের প্রশংসা করলেন। তার মানে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের দেবীদের প্রভু হিশেবে মেনে নিয়েছেন। তাই সেদিন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং অন্যান্য মুসলিমদের সাথে মক্কার মুশরিকরাও সিজদা করেছিল মক্কার কাবা প্রাঙ্গণে।
তাবারী এবং ইবনু সাদের এই রেফারেন্সগুলো পরে ইসলামবিদ্বেষী এবং খ্রিষ্টান মিশনারিরা লুফে নেয়। তারা এই ঘটনাকে সত্য প্রমাণ করার জন্য সূরা ইসরার ৭৩-৭৫ নম্বর আয়াত এবং সূরা হজের ৫২ নম্বর আয়াতকে রেফারেন্স হিশেবে দাখিল করে থাকে।
এটা হলো The SatanicVerses সংক্ষিপ্ত ব্রিফিং ।
এবার আপনি কি বলবেন? বলবেন; মারাত্মক ব্যাপার তো! রুশদি এই ইনফরমেশানগুলো কোথায় পেয়েছে? অবশ্যই আত-তাবারী এবং ইবনু সাদের সীরাতে?
আমি বলবো জ্বী, আত-তাবারী এবং ইবনু সাদের সীরাতে এখন বুঝুন বেপারটা আসলে কোথায়!
আপনার মতামত কি হবে! মতামত হবে, রুশদি এখানে ভুল ইনফরমেশান দিয়ে, মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে, এই তো?
-জি. হ্যাঁ আসলেই বিষয়টা আসলে সে রকমই!
এবার হয়তো আপনি হাসবেন, হয়তো বলবেন আচ্ছা, ধরেই নিলাম যে, সালমান রুশদি ইসলামের কিছুই জানে না বা কিছুই বোঝে না; কিন্তু আপনি কি বলতে চাচ্ছেন. ইবনু সাদ আর আল তাবারীর বর্ণনাও ভুল?
আমি বলবো , আরে ভাই, আমি আগেও বলেছি, ইবনু সাদ হোক বা আত-তাবারী হোক বা অন্য যে-কেউ, তাদের কাছে তো আর ওহী আসত না। যেহেতু তাদের গ্রন্থগুলো আসমানী কিতাব নয়, তাই সেগুলোর মধ্যে ভুল-ভ্রান্তি থাকতেই পারে। অস্বাভাবিক কিছু নয়।
এখন কি বলবেন! হয়তো বলবেন আচ্ছা, ধরেই নিলাম আপনি ঠিক বলছেন। ইবনু সাদ বা আত-তাবারীর বর্ণনা ভুল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন তাদের বর্ণনা ভুল বা আপনার কাছে কেন তাদের বর্ণনাকে ভুল মনে হচ্ছে! কিন্তু কেন? আপনি হয়তো মনে মনে ভাবছেন, ইতোমধ্যে গল্প বেশ জমে উঠেছে। হয়তো অপেক্ষায় আছেন, আমার উত্তরের জন্য। আবার দেখার অপেক্ষা করছেন, এবার আমি কীভাবে কেমন করে আপনার এই ক্রিটিক্যাল প্রশ্নের উত্তর দিই।
আমিও তাই বলছি, জ্বী এ প্রশ্নটা আসতেই পারে। আমিও এক সময় এমনটাই ভেবেছিলাম। ইবনু সাদ বা আত-তাবারীর মতো আলেমরা কি ভূল রেফারেন্স উল্লেখ করতে পারে। পরে বিভন্ন বই বিশেষ করে, পুরান আমলের বই এ এ বিষয়টা নিয়ে স্পষ্ট কিছু চমকপ্রদ তথ্য জানতে পেলাম। সে সময়, তথা বর্তমান সৌদী আরবে সাদা রংঙ্গের সারশ জাতীয় পাখিদের খুব সন্মানের চোখে দেখা হতো। এমন কি সেগুলোকে তাদের কখিত উচুমানের দেবদেবীদের সাথে তুলনা করা হতো, যেমন লাৎ, মান্নাত, উৎজা প্রভৃতি। এবং তাদেরকে পূত পবিত্র ও মনে করা হতো। এদের কে গারনীক বলা হতো যার অর্থ সারশ পাখি। এখানে উল্লেখ্য যে, সে সময়ের সাহিত্য দেখলে দেখতে পাবেন, আরবীতে গারনীকের কিচ্ছা নামে একটি গল্প প্রচলিত আছে। এই গারনীকের বা সারশ পাখির গল্পটা কিন্তু নতুন কোন গল্প নয়, এটা অনেক পুরানো একটা আরবী সাহিত্যর গল্প। যা গারনীকের কিচ্ছা বা সারশ পাখির কিচ্ছা নামে পরিচিত। মজার কথা হলো বেশ অনেক আগেই বিভিন্ন ইসলামী স্কালার গন এ বিষয়টাকে কাউন্টার করেছেন এবং এটাকে তথা গরনীকের কিচ্ছা তথা সারশ পাখির গল্পকে নিছক গল্প বা কিচ্ছা বলেই প্রমান করেছেন। কিন্তু সমস্যা হয়েছে, বই গুলো আরবীতে থেকে যাওয়ায় তা সবার জানা হয় নাই বা নজরে আসে নাই। তা আড়ালেই রয়ে গেছে। রুশদি মূলত সেই গারনীকের কিচ্ছা বা সারশ পাখির গল্পটাকে টেনে বের করে এনে তাতে রংচং লাগিয়ে নতুন ভাবে উপন্যাস হিসাবে রুপ দিয়ে, ইসলামী কিছু বিশেষ চরিত্রের মাধ্যমে তা রুপায়ন তথা সংমিশ্রন ঘটিয়ে ইসলামকে প্রশ্ন বিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। যা কখনোই কারো তথা সভ্য বলে দাবিদার কারো কাম্য হতেই পারে না। যদিও বা বিষয়গুলো বা চরিত্র গুলোকে কাল্পনিক হিসাবে বর্ণনা করেছেন। যা কখনোই উচিৎ হয় নাই।যেটার সঙ্গে মানুষের আবেগ বীবেগ জরিত। যার ফল ও অবশ্য ইতোমধ্যেই ভোগ করছেন।
প্রথমে, আমাদের বুঝতে হবে, ইবনু সাদ এবং আত-তাবারীর গ্রন্থে যা আছে, তা মানুষের রচনা। এর মধ্যে যেমন শুদ্ধ জিনিস, শুদ্ধ বর্ণনা আছে, ঠিক তেমনই ভুল জিনিস, ভুল বর্ণনা থাকাটাও অ-স্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ, ইবনু সাদ বা আত-তাবারী, কেউ-ই রাসূলের যুগের প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন না। তারা রাসূলের জীবনী লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে যেখানে, যার কাছে যা পেয়েছেন, তা-ই লিপিবদ্ধ করেছেন। ভুল-শুদ্ধ কতটুকু, তা নির্ণয়ের চেয়ে আপাতত সংরক্ষণ করাকেই তারা প্রাধান্য দিয়েছিলেন, যার জনৗ আজকের এ দশা।
তাদের রচনায়ও যে ভুল থাকতে পারে, তা তারা নিজেরাও স্বীকার করে গেছেন। আত-তাবারী তার কিতাবের শুরুতেই বলেছেন,
তিনি শুধু তা-ই কিতাবে স্থান দিয়েছেন, যা তার পর্যন্ত পৌঁছেছে। এখন কেউ যদি তার কিতাবে কোনো আপত্তিকর বিষয়াদি খুঁজে পায় যা ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর সাথে সাংঘর্ষিক এবং অন্যান্য সহীহ সূত্রে তা বাতিলযোগ্য দেখা যায়, তাহলে সে-দায় আত তাবারীর নয়, তিনি যার কাছ থেকে পেয়েছেন, কেবলই তার। তিনি এখানে কেবল একজন লিখিয়ে-এর ভূমিকায়। সুতরাং, আত-তাবারীর বর্ণনা যে ভুল হতেও পারে, তা আত-তাবারীই বলে গেছেন। একই কথা, একই ব্যাপার ইবনু সাদ এর ক্ষেত্রেও।
এখন কি বললেন, বলবেন ভুল হতেও পারে মানে এটি প্রমাণিত হয় না যে, তিনি ভুল। ভুল হতেও পারে এর পরের শর্ত কিন্তু সঠিকও হতে পারে। আমরা তাহলে কোনটি ধরে নেব? তিনি ভুল, না শুদ্ধ?
আমি বলবো আলোচনা চলুক, দেখা যাক কী হয় । এর পর আবার শুনুন, সকল ইতিহাসবিদদের মতে, সূরা নাজম নাযিল হয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত প্রাপ্তির পঞ্চম বছরে, রজব মাসে, যে-বছর প্রথম একটি মুসলিম দল আবিসিনিয়ায় হিজরত করে। অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মদীনায় হিজরতের আরও ৮ বছর আগে। এখন সালমান রুশদি এবং খ্রিষ্টান মিশনারিদের দাবি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শয়তান থেকে ওহীপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং পরে আল্লাহ কুরআনের আরও কিছু আয়াতের মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এই ব্যাপারে সংশোধন করে দেন। তাদের দাবি হলো, সূরা হজের ৫২ নম্বর আয়াত নাকি সেদিনের ওই ঘটনা, অর্থাৎ স্যাটানিক ভার্সেস ঘটনার দিনের প্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছে যেখানে বলা হচ্ছে,
"আমি তোমার পূর্বে যে-সব রাসূল কিংবা নবী পাঠিয়েছি, তাদের কেউ যখনই কোনো আকাঙ্ক্ষা করেছে তখনই শয়তান তার আকাঙ্ক্ষায় (প্রতিবন্ধকতা, সন্দেহ-সংশয়) নিক্ষেপ করেছে; কিন্তু শয়তান যা নিক্ষেপ করে আল্লাহ তা মুছে দেন। অতঃপর আল্লাহ তাঁর নিদর্শন সমূহকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। কারণ, আল্লাহ সর্বজ্ঞ, শ্রেষ্ঠ হিকমতওয়ালা।" সূরা হজ্ব আয়াত নম্বর ৫২।
সালমান রুশদি এবং খ্রিষ্টান মিশনারিদের দাবি, এই আয়াত দিয়েই আল্লাহ মুহাম্মদ সাঃ কে তৎক্ষণাৎ সংশোধন করে দেন এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা নাজমের সাথে মিশিয়ে ফেলা ওই আয়াত দুটো বাতিল করে দেন।
শত্রুপক্ষ এই গল্প খুব চাতুরির সাথে বানিয়েছে বলা যায়; কিন্তু ঘাপলা রেখে গেছে অন্য জায়গায়। সেটি হলো, সূরা নাজম নাযিলের সাথে সূরা হজ নাযিলের মধ্যকার সময়ের ব্যবধান। সূরা নাজম নাযিল হয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াত প্রাপ্তির ৫ম বছরে,তথা মক্কায়। সূরাটি মাক্কী সূরার অন্তর্গত। আর সূরা হজ্ব নাযিল হয় রাসূল সঃ নবুওয়াত প্রাপ্তির প্রায় ১২-১৩ বছর পরে, হিজরতের প্রথম বছরে মদিনাতে। সূরাটি মাদানী সূরা।
অর্থাৎ তাদের কথানুযায়ী, রাসূল সাঃ ভুল করেন নবুওয়াত প্রাপ্তির ৫ম বছরে, আর সূরা হজ নাযিল হয় নবুওয়াত প্রাপ্তির ১৩ তম বছরে। দুই সূরার মধ্যে সময় ব্যবধান ৮ বছর।
অর্থাৎ তাদের দাবি অনুযায়ী, রাসূল সাঃ ভুল করেছেন আজ, আর আল্লাহ তা সংশোধন করেছেন ৮ বছর পরে!
আচ্ছা এবার আপনিই বলুন তো, নেহাত পাগল ছাড়া এই গল্প কোনো মানুষ বিশ্বাস করবে? ভুল করেছে আজ আর তা সংশোধন হলো আরও ৮ বছর পরে। তাদের দাবি মানতে গেলে বলতে হয়, এই আট বছরের মধ্যে, রাসূল সাঃ কুরাইশদের দেবীর প্রশংসা করেছেন আবার একইসাথে বর্জনও করেছেন। যা কিনা কালেমায় বলেছেন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই।
একদিকে দেবীদের কাছে সাহায্য চাওয়ার বৈধতা, আবার অন্যদিকে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে তাদের বাতিল করে দেওয়া, এতসব কাহিনি করার পরেও কীভাবে তিনি সেখানে আল আমীন হিসাবে থাকতে পারেন? কি করে সম্ভব; এমন প্রশ্নটা মাথায় আসেনা কেন?
ঠিক আছে। তর্কের খাতিরে ধরেই নিলাম যে, সূরা হাজ্বের সেই সংশোধনী আয়াত আল্লাহ তাআলা আট বছর পরে নয়, ওই রাতেই নাযিল করেছিলেন এবং ওই রাতেই রাসূল সাঃ তার ভুল শুধরে নিয়েছিলেন। ভুল শোধরানোর পরে ওই রাতেই ঘোষণা করলেন যে, লাৎ, উযযা, মানাতের কাছে সাহায্য চাওয়া যাবে না।
খেয়াল করুন, তিনি দিনে বলেছেন এরকম,
তারা হলেন খুবই উঁচু পর্যায়ের (ক্ষমতাবান দেবী); এবং তাদের কাছে সাহায্যও চাওয়া যায ।
আবার রাতে নিজের ওই কথাকে পাল্টে নিয়ে বলছেন, লাৎ, উযযা, মানাতরা বাতিল। তাদের কাছে সাহায্য চাওয়া যাবে না।
অবস্থা যদি সত্যিই এরকম হতো, তাহলে মক্কার কাফির, পৌত্তলিকদের কাছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি একজন ঠগ, প্রতারক ও বেঈমান বলে গণ্য হবার কথা ছিল না? অথচ, ইতিহাসের কোথাও কি তার বিন্দু-পরিমাণ প্রমাণ পাওয়া যায়? যায় না। যাদের সাথে তিনি মুহূর্তেই এতবড় বেঈমানি করলেন, তাদের কারও কাছেই তিনি ঠগ প্রতারক মিথুক সাব্যস্ত হলেন না। ব্যাপারটি খুব আশ্চর্যের নয় কি? রাসূল সাঃ অপমান-অপদস্ত করার এতবড় সুযোগটি কীভাবে তার শত্রুপক্ষ নষ্ট করে বসল? তা ছাড়া, ইতিহাস থেকে জানা যায়, মদীনায় হিজরতের আগের রাতে রাসূল আলী রাযিঃ কে তার ঘরে রেখে যান, যাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গচ্ছিত আমানত যথাযথ ভাবে ফিরিয়ে দেওয়া যায়। ভাবুন তো, যিনি একদিনে দু-রকম কথা বলতে পারেন, তাকে কিন্তু তখনো মক্কার কুরাইশরা বিশ্বাস করছে, ভরসা করে আমানত গচ্ছিত রাখছে। এটা কি ভাবে সম্ভব হলো? তিনি যদি সত্যিই এমন কাজ করে থাকেন, এরপরও মক্কার লোকজনের তার ওপরে এত অগাধ বিশ্বাস স্থাপনের কারণ কী ছিল? আদৌ কি সেদিন Satanic Verses জাতীয় কিছু নাযিল হয়েছিল রাসূলের ওপর? উত্তর হলো, না!
-দ্বিতীয় প্রমাণ হলো, তর্কের খাতিরে যদিও ধরে নিই যে, Satanic Verses সত্য, তাহলে চলুন, সূরা নাজমের আয়াতের সাথে ওই তথাকথিত শয়তানের আয়াত গুলো মিলিয়ে আমরা আরেকবার দেখে নিই :
[৫৩ঃ ১৯] তোমরা কি ভেবে দেখেছ লাত ও উযযা সম্পর্কে?
[৫৩ঃ২০] এবং আরেক (দেবী) মানাত সম্পর্কে?
[৫৩ঃ২১] তারা হলেন খুবই উঁচু পর্যায়ের (ক্ষমতাবান দেবী)
[৫৩ঃ২২] এবং তাদের কাছে সাহায্যও চাওয়া যায়।
[৫৩ঃ২৩] এগুলো তো কেবল (এই যে লাত, উযযা, মানাত এসব) কতকগুলো নাম, যে নাম তোমরা আর তোমাদের পিতৃপুরুষেরা রেখেছ, এর পক্ষে আল্লাহ কোনো প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। তারা তো শুধু অনুমান আর প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করে, যদিও তাদের কাছে তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে পথ নির্দেশ এসেছে।
খেয়াল করুন, ২১ এবং ২২ নম্বর আয়াতের পরে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছ থেকে কোনোরকম সংশোধনী আসার আগেই ঠিক ২৩ নম্বর আয়াতে এসে বলা হচ্ছে, এগুলো (লাত, উয্যা, মানাত ইত্যাদি) তো কেবল কতগুলো নামমাত্র, যা তোমরা (মুশরিকরা) এবং তোমাদের পূর্বপুরুষেরা রেখেছ। এদের (ক্ষমতার) পক্ষে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কোনো প্রমাণ নাযিল করেননি।
বড়ই আশ্চর্যের বিষয়, তাই না? একটু আগে বলা হলো, তারা হলেন খুবই উঁচু পর্যায়ের দেবী। তাদের কাছে সাহায্যও চাওয়া যায়। আবার, তার ঠিক পরেই বলা হচ্ছে, এগুলো তো কেবল কিছু নাম মাত্র, যা তোমাদের মস্তিষ্ক প্রসূত। বিষয়টা দ্বিমুখীতা হলো না! এরকম ডিগবাজি দেওয়ার পরেও যারা একত্ববাদে বিশ্বাস রেখে নতুন ইসলামে এসেছে, তারা কি মুহাম্মদ সাঃ কে ছেড়ে তৎক্ষণাৎ চলে যেত না?
আর কুরাইশরা এত পাণ্ডিত্যের অধিকারী হয়েও এটি বুঝতে পারল না যে, মুহাম্মদ সাঃ তাদের সাথে মাইন্ড গেইম খেলছে?
এবার হয়তো বলবেন, তাহলে, বলা হয় যে, আবিসিনিয়ায় হিজরত করা একটি দল এই ঘটনার কথা শুনে অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক মুশরিকদের দেব-দেবীদের স্বীকৃতি দেওয়ার ঘটনা শুনে ফেরত চলে এলো, তাদের ব্যাপারে কী বলবে?
আমি বলবো, হ্যাঁ, তারা ফেরত এসেছিল ঠিকই; কিন্তু তারা ফেরত এসেছে এই ঘটনা শুনে নয়, অন্য ঘটনা শুনে। নবুওয়াতের ৫ম বছরে তৎকালীন আরবের অন্যতম বীর উমার ইবনুল খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহুর মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ইসলাম গ্রহণের খবর শুনে, মক্কার পরিস্থিতিকে কিছুটা নিরাপদ ভেবে, তারা ফেরত এসেছিল। তথাকথিত Satanic Verses নাযিলের কথা শুনে নয়। প্রত্যেক সহীহ রেওয়ায়েতেই এটার বর্ণনা পাওয়া যায়।
এখন কি বলবেন? অনেক হলো ভাই এবার একটু ঝেড়ে কাশুন তো! আমাদের সেই বহুল আলোচিত ও সমালোচিত স্যাটানিক ভার্সেস এর মূল কাহিনীটি কি তা সংক্ষেপে একবার বলেন তো!
-আমি যদি এবার বলি, কেন আপনি পড়েন নি?
হয়তো বলবেন আরে না! ও সবে আমার সময় নাই বা আগ্রহ নাই , অথবা ও সবে আমার বিশ্বাস নাই তাই পড়ি নাই! তবে কার নিকট যেন শুনেছিলাম। সেটা যেন অন্যরকম ছিল। এবার বলুন তো আপনার মুখ থেকেই একটু শুনি স্যাটানিক ভার্সেস ও শয়তানের ওপরে ঈমান আনার গল্পটা আসলে কি!
-'আচ্ছা ঠিক আছে, শুনুন তাহলেঃ
স্যাটানিক ভার্সেস সার সংক্ষেপ
ইন্ডিয়া থেকে ইংল্যান্ডে উড়ে যাচ্ছে বিমান। প্লেনের সিটে বসে আছে জিবরীল ফারিস্তা আর সালাদিন চামচা। এর মধ্যে জিবরীল ফারিস্তা সেলিব্রিটি মানুষ। বলিউডের নায়ক। সালাদিন চামচাও অভিনেতা, তবে নিজ দেশ ইন্ডিয়ার প্রতি তার মনের বীতশ্রদ্ধ অবস্থা। নিজের পরিবার বিষয়ে আবার তিনি তেমন নন। নিজের বাবাকেও সে দেখতে পারে না। তবে এ মুহূর্তে তাদের দুজনের কারও অবস্থাই সুবিধার মনে হচ্ছে না, কারন, প্লেন হাইজ্যাক হয়েছে সন্ত্রাসিদের দ্বারা। ইংলিশ চ্যানেলের উপরে এসে কোন কারণে প্লেন বিস্ফোরিত হয়ে যায়। অনেক উঁচু থেকে তারা পড়তে থাকে। কিন্তু জাদুকরিভাবে বেঁচে যায় দুজনেই। কিন্তু, তাদের মধ্যে একটা পরিবর্তন হয়ে যায়। তাদের পারসোনালিটি চেঞ্জ হয়ে যায়। জিবরীল ফারিস্তা ধারণ করে ফেরেশতা জিবরাঈল এর পারসোনালিটি। আর সালাদিন চামচা ধারণ করে ইব্লিস শয়তান আজাজিলের পারসোনালিটি। ফারিস্তা তখন নিজের (জিবরাইলের) মেমরিতে হারিয়ে ফেলে বারবার নিজেকে। হারিয়ে যায় ১৫০০ বছর আগের স্মৃতিতে। ফিরে যায় আর নিজেকে আবিস্কার করে একটা জাহিলিয়ার শহরে, যার নাম মক্কায়। সেখানে তাঁর স্মৃতি আবর্তিত হয় মুহাম্মাদ নামের এক লোককে কেন্দ্র করে। সুদর্শন মুহাম্মাদ আর সেখানের প্রভাবশালী আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দের মধ্যে গোপন প্রেমের লক্ষণ দেখে সে। কিন্তু, হিন্দার সাথে আবার অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক আছে মক্কার এক কবির। আবু সুফিয়ান সব জেনেও না জানার ভান করে থাকে। মুহাম্মাদ এর কাছে আয়াত আনার স্মৃতি আছে তাঁর মাথায় এক গুহায়। এরপর থেকে সে এক নতুন ধর্ম প্রচার করছে যার নাম “ইসলাম”; কিন্তু, প্রতিনিয়ত সে প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছে মক্কাবাসীদের কাছ থেকে। প্রতিনিয়ত তার মাথায় খেলা করছে কীভাবে এদেরকে কনভিন্স করা যায়? এরা আল্লাহ্কে মানছে বটে, কিন্তু সাথে সাথে লাত, উজ্জা, মানাত এসব দেবীদেরও পূজা করছে। এদেরকে কীভাবে অনুগত করা যায়? ওসব দেবীদের স্বীকৃতি দিয়ে? এক দিন মক্কার প্রধান উপাসনালয় কাবা ঘরের সামনে সম্মিলিত প্রার্থনা করছে মুহাম্মাদ, যাকে তারা সালাত (নামাজ) নামে ডাকে। তার উপর আসা আয়াত গুলো পাঠ করছে সে। যখন সুরা নাজামের এ আয়াত পর্যন্ত আসল, “তোমরা কি ভেবে দেখেছো লাত, উজ্জা আর মানাত সম্পর্কে?” এর পর সে না থেমেই যেন কারও (ইবলিস?) প্ররোচনায় আরও একটি আয়াত পাঠ করে গেল, “তাদের কাছে আসলেই সাহায্য চাওয়া যায়।” এ কথা শুনেই উপস্থিত মক্কাবাসীরা, কুরাইশ নেতারা উৎফুল্ল হয়ে সম্মিলিত প্রার্থনায় যোগ দিল। আর প্রার্থনা শেষে মুহাম্মাদকে অভিনন্দিত করল। কারন, সে মক্কা বাসির সাথে তার বিরোধ মিটিয়ে ফেলেছে। কিন্তু, অচিরেই সে তার সেই আয়াত, যেটা শয়তান (সালাদিন চামচা?) অনুপ্রবেশ করিয়েছিল তার মনে, সেটা প্রত্যাখ্যান করে নিল। কারন, জিবরাঈল (নায়ক জিবরীল ফারিস্তা নিজে?) এসে তাঁকে ধমক দিয়ে যায় শয়তানের প্ররোচনায় সাড়া দেবার জন্য। তাই বিরোধ আবার শুরু হল। এ দিকে আবিসিনিয়ায় হিজরত রত এক দল মুসলিম এ ই সমঝোতার কথা শুনে মক্কায় ফিরে এসে দেখল পরিস্থিতি কিছুিই বদলায়নি। শুরু হলো নতুন অবোরোধ! পরিস্থিতি এতটাই খারাপের দিকে গেল যে, এক পর্যায়ে মক্কা থেকে পালিয়ে গেল মুহাম্মাদ।
অদূরেই এক নগরী আছে, যার নাম ইয়াস্রিব। সেখানে গিয়ে সে নিজের রাজ্য গড়ে তুলল ধীরে ধীরে। আর সে নগরির নাম হল মদিনা। এরপর যখন বিজয়ীর বেশে সেই মক্কাতেই ফিরে এলো মুহাম্মাদ, তখন সেই বিরোধী কবি পালিয়ে গেল মক্কার সুবিখ্যাত পতিতালয়ে, যেখানে যেখানকার বাসিন্দাদের সাথে তথা পতিতাদের সাথে মুহাম্মাদের স্ত্রীদের মিল পায় সেই কবি। আর এ ভাবেই গল্প এগিয়ে যায়।
এরকম আরও কিছু স্মৃতি দেখতে থাকে জিবরীল ফারিস্তা, সে তখন নিজেদেরকে ইংল্যান্ডে দেখতে পায়! সেখানে সে ত্যাগ করে যায় সালাদিন চামচাকে। চামচাকে গ্রেফতার করে পুলিশ ইংল্যান্ডে অবৈধ অনুপ্রবেশের জন্য। দুজনই তখন মানুষ আর অতিপ্রাকৃত চরিত্রের মধ্যে আটকা পড়ে আছে। জিবরীল ফারিস্তা তখন ইংল্যান্ডে খুঁজছে তার হারানো প্রেমিকা এলিকে। কিন্তু এলি তাকে গ্রহন করতে চায় না তার “মানসিক সমস্যা” এর কারণে। তবে এক সময় সম্ভাবনা দেখা যায় যে, এলি হয়ত তাকে মেনে নেবে।
ওদিকে এক সময়, পুরোপুরি মানুষ হয় চামচা। সে তার পুরো রাগ ঝাড়তে চায় জিবরীল ফারিস্তা এর উপর। কেন সে তাকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল? সে এলির সাথে জিবরীলের সম্পর্ক রিপেয়ারের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে সেটা ধ্বংস করে দেয়। এলি হারিয়ে যায় জিবরীলের জীবন থেকে। ফারিস্তা সব বুঝতে পারে, কিন্তু, সে মাফ করে দেয় সালাদিন চামচাকে।
দুজনেই ইন্ডিয়াতে ফিরে আসে। জিবরীল ফাসিস্তা এরপর ঈর্ষা থেকে হত্যা করে বসে এলি-কে। এরপর নিজে আত্মহত্যা করে। তবে চামচা জিবরীলের কাছ থেকে ক্ষমা পেয়ে এখন ইন্ডিয়াতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। আর, তার বাবার সাথেও তার সম্পর্ক ভাল হয়ে যায়। কেবল থাকে না আর জিবরীল ফারিস্তা। আর এভাবেই শেষ হয়, স্যাটেনিক ভার্সেস কাহীনির।আর এটাই হলো মোটামুটি স্যাটানিক ভার্সেস ও শয়তানের উপরে ঈমান আনার গল্প!
এবার সত্য মিথ্যা বা বাড়া বাড়ীর বিষয়টা আপনিই যাচাই করুন।
এখানে অত্যান্ত একটা গুরুত্ব পূর্ণ কথা হলো এটা যদি বাস্তবতা হয়, তাহলে সুরা নাজমের ১৯ ও ২০ নং আয়াতের সাথে এ কল্পিত আয়াত এলো কোথা হতে।
এর জবাব খুজতে হলে আমাদের বেশ খানিকটা পিছন ফিরে আবার আইয়ামে জাহিলাতের দিকে যেতে হবে। কেন না সে সেখানেই এই ধাঁঁ ধাঁ এর উত্তর মিলতে পারে। আজকের মতো সময়ে ও কিন্তু মক্কায় হজ্ব হতো এবং সে হজ্বেও কিন্তু আজকের মতো তালবিয়া পাঠ করা হতো। আজকের তালবিয়া আমরা জানলেও সে সময়কার তালবিয়া কি ছিল তা আমরা জানি না। এখন প্রশ্ন হলো সে তালবিয়াটা আসলে কি ছিল?
আমরা যদি একটু খুজে দেখি তাহলে দেখতে পাবো সে সময়টাতে যে তালবিয়া ছিল তা হলো, “ওয়াল্লাত, ওয়াল উযযা ওয়া মানাত আল সালিসাহ আল উখরা, ফা ইন্নাহুন্না আল গারানীক্ব আল 'উলা ওয়া ইন্না শাফা'তাহুন্না লা-তুরতাজা৷”
যার অর্থ হলো, "লাত, উজ্জা, মান্নাত এরা সবাই খুব উচু স্তরের গারনিক, সুতরাং তাদের শুপারিশ আশা করা যেতেই পারে।"
ব্যপারটা একেবারে মিলে যায়! মানে সেইম টু সেইম সেই কল্পিত আয়াতের মতো। সুতরাং বোঝার অপেক্ষা রাখেনা এটা আসলে কোথা হতে এলো।
সুতরাং আর একবার দেখুন, তখনকার সেই তালবিয়া ছিল- “ওয়াল্লাত, ওয়াল উযযা ওয়া মানাত আল সালিসাহ আল উখরা, ফা ইন্নাহুন্না আল গারানীক্ব আল 'উলা ওয়া ইন্না শাফা'তাহুন্না লা-তুরতাজা৷”
মানে যার অর্থ হলো, লাত, উজ্জা, মান্নাত এরা সবাই খুব উচু স্তরের গারনিক, সুতরাং তাদের শুপারিশ আশা করা যেতেই পারে।
এবার আপনিও চিন্তা করুন, ও সত্য মিথ্রা যাচাই করুন। আসলেই স্যাটানিক ভাসরসেস একটা মিথ্যে ও বানোয়াট গল্প ছাড়া কছিুই নয়। যেখানে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই।
ভাল থাকবেন। ধন্যবাদ।
মোঃ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (এম এস এস)
============================