باب التَّثَبُّتِ فِي الْحَدِيثِ وَحُكْمِ كِتَابَةِ الْعِلْمِ
حَدَّثَنَا هَدَّابُ بْنُ خَالِدٍ الأَزْدِيُّ، حَدَّثَنَا هَمَّامٌ، عَنْ زَيْدِ بْنِ أَسْلَمَ، عَنْ عَطَاءِ بْنِ يَسَارٍ، عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ " لاَ تَكْتُبُوا عَنِّي وَمَنْ كَتَبَ عَنِّي غَيْرَ الْقُرْآنِ فَلْيَمْحُهُ وَحَدِّثُوا عَنِّي وَلاَ حَرَجَ وَمَنْ كَذَبَ عَلَىَّ - قَالَ هَمَّامٌ أَحْسِبُهُ قَالَ - مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ " .
হাদিসের ইতিহাসঃ-(হাদিসের, ফিকাহ, মাছলা মাছায়েলের উৎপত্তির সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ-)
আল্লাহর রসুল (সা.) মাত্র সাড়ে নয় বছরে প্রায় ১০৭ টি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। এতে প্রতি ৩২ দিনে গড়ে একটি করে অভিযান করতে হয়েছে। এই অভিযানগুলো আয়োজন করতে তাঁর ঐ ছোট্ট জাতিটিকে দিনরাত খেয়ে না খেয়ে পরিশ্রম করতে হয়েছে। তাদের দম ফেলার কোনো অবসর ছিল না। তিনি তাঁর উম্মাহকে জেহাদের মন্ত্রে উদ্দীপ্ত করেছিলেন কোনো সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য নয়। সেটা যদি তাঁর উদ্দেশ্য হতো তাহলে সাড়ে বারো লক্ষ বর্গমাইল এলাকার একচ্ছত্র অধিপতি হয়েও তিনি মাটির ঘরে খেজুর পাতার চাটাইতে ঘুমাতেন না।
মৃত্যুর পূর্বে পুরো জাতিকে তিনি আরব থেকে বাইরে সিরিয়া সীমান্তের মুতা প্রান্তরে যুদ্ধে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তাঁর এন্তেকালের পর আবু বকর (রা.) পাঁচজন সেনাপতির নেতৃত্বে পাঁচ দিকে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে দিলেন। উদ্দেশ্য ছিল মানুষের জীবন থেকে সকল প্রকার অন্যায়, অশান্তি, অবিচার নির্মূল করে দিয়ে সেখানে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শান্তি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষকে অত্যাচারী শাসকদের শোষণ ও অত্যাচারের হাত থেকে উদ্ধার করে মানবতাকে সমুন্নত করা।
.কিন্তু খোলাফায়ে রাশেদুনের পর ধীরে ধীরে জাতির নেতৃত্বের আকিদায় পরিবর্তন আসতে থাকে। তারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে কিন্তু যুদ্ধের উদ্দেশ্য ন্যায়ভিত্তিক সভ্যতা নির্মাণ থেকে বদলে হয়ে যায় সাম্রাজ্যবিস্তার, সম্পদ লুট ও কর আদায়। অর্থাৎ যে অস্ত্রটি তৈরি করা হলো দুষ্টের দমনের জন্য, সেই অস্ত্রটি ব্যবহৃত হতে লাগল ডাকাতির কাজে। কোনো কোনো উমাইয়া খলিফা অমুসলিমদের প্রদেয় যুদ্ধকর বা জিজিয়া প্রদান বন্ধ হয়ে যাবে দেখে ইসলাম গ্রহণ করাই বন্ধ করে দিলেন। এরপর একটা পর্যায়ে এসে সেই জেহাদও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। .
জেহাদ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর জাতির সদস্যদের হাতে অফুরন্ত অবসর। উমাইয়া খলিফা উমর বিন আব্দুল আজিজ (দ্বিতীয় উমর) আদেশ দিলেন হাদিস সংগ্রহ করতে। শুরু হলো হাদিস সংগ্রহ, হাদিস গবেষণা, সেগুলো থেকে মাসলা ও ফতোয়া নির্গত করা, সেগুলো কেতাবে লিপিবদ্ধ করা। জাতি মেতে উঠল দীনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে। আল্লাহর রসুল যে জাতির হাতে তলোয়ার তুলে দিয়ে ঘোড়ার পিঠে উঠিয়ে পৃথিবীর অভিমুখে বের করে দিয়ে গেলেন, সেই জাতি সেই লক্ষ্য বিস্মৃত হয়ে খাতা-কলম নিয়ে পণ্ডিত (Scholar) হওয়াকেই জীবনের উদ্দেশ্য বানিয়ে নিল। জাতির মধ্যে আর আলি (রা.), খালিদ (রা.), দেরার, মুসান্না, তারিক, উখবাহ, কা’কা, মোহাম্মদ বিন কাসিমের মত দ্বিগ্বিজয়ী বীর জন্ম নিল না, জন্ম নিতে শুরু করল বিভিন্ন মাজহাবের প্রবক্তা ইমাম, ফকিহ, মুজতাহিদগণ। তারা ব্যক্তিগত বিভিন্ন আমলের চুলচেরা গবেষণা করে ফতোয়া বের করতে লাগলেন। .
গড়ে উঠল হাদিস, তাফসির, ফেকাহ, উসুলে ফেকাহর কেতাবের পাহাড়। তাদের এই চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দীনের এমন কোনো বিষয় রইল না যা নিয়ে কোনো মতভেদ নেই। প্রথমে হলো শিয়া-সুন্নী। তারপর সুন্নিরা চার ইমামের ব্যানারে চারটি মাজহাবে বিভক্ত হলো- হানাফি, হাম্বলি, মালেকি, শাফেয়ি। তারপর হল ওয়াহাবি, দেওবন্দী। একেক মাজহাব একেক ইমামের হাদিস সংকলনকে বিশুদ্ধ বলে ঘোষণা করে। হানাফিদের যেমন আছে সিয়াহ সিত্তাহ অর্থাৎ বোখারি, মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, নেসায়ী, ইবনে মাজাহ, তেমনি মালেকি মাজহাবের আছে মুয়াত্তা, হাম্বলি মাজহাবের আছে আহমদ শরিফ। শিয়াদেরও চারটি পৃথক ‘বিশুদ্ধ’ হাদিসের সংকলন আছে যাকে বলা হয় কুতুব আল-আরবাহ।
.শিয়ারা বিভক্ত হলো প্রধান জাফরি, ইসনা-আশ’আরি, ইসমাইলিয়া, যায়েদিয়া, আলাভি, আলানি ইত্যাদি বহুভাগে। সুন্নীদের প্রত্যেক মাজহাবের সালাহ (নামাজ) পড়ার পদ্ধতি পৃথক। একসঙ্গে তাহলে নামাজ পড়বেন কীভাবে? তাদের ইমাম পৃথক, মসজিদ পৃথক হয়ে গেল। মানবজাতির ঐক্যের প্রতীক যে কাবা, সেখানে গিয়েও তারা চার মাজহাব চারটি মিম্বর স্থাপন করলেন, চারটি ভিন্ন জামাতে নামাজ পড়া চালু করলেন। তাদের একটু লজ্জাও লাগল না!
.খলিফা নামধারী সুলতানেরা অবসর বিনোদনের জন্য তর্কবিতর্কের আসর চালু করলেন। সেখানে ভিন্ন ভিন্ন মাহজাবের পণ্ডিতরা এসে একে অপরকে বিতর্কে পরাজিত করতেন। তারা ভুলেই গেলেন যে, দীনের কোনো বিষয় নিয়ে মতভেদ তৈরি করা, তর্কাতর্কি করা কুফর, যা ইসলামের সর্বোচ্চ পাপ। আল্লাহ বলেন, আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ় হস্তে ধারণ কর; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। ... আর তাদের মত হয়ো না, যারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং নিদর্শন সমূহ আসার পরও বিরোধিতা করতে শুরু করেছে-তাদের জন্যে রয়েছে ভয়ঙ্কর আযাব। [সুরা ইমরান ১০৩ - ১০৫]
তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ থাকার এমন শত শত কোর’আন ও রসুলাল্লাহর বাণী তাদের পথ দেখাতে পারল না। তারা মনের আনন্দে জাতিটাকে যত দলে ভাগ করার সম্ভব করলেন আর ভাবতে লাগলেন দীনের মহা উপকার করছি। যারা তাদের ধর্মে বিভেদ সৃষ্টি করেছে এবং অনেক দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে উল্লসিত। (সুরা রূম ৩২)
এই সবই হলো দীনের ফিকাহ ও মাসলা-মাসায়েল নিয়ে অতি বিশ্লেষণের ফলে। দীন এতটাই জটিল ও দুর্বোধ্য হয়ে দাঁড়ালো যে সেটা আর আল্লাহর পাঠানো সহজ-সরল সিরাতুল মুস্তাকিম ইসলাম রইল না। জাতির ঐক্য চূর্ণ-বিচূর্ণ করে তারা পণ্ডিত হলেন, ইমাম হলেন। তারা জাতিকে অতি পরহেজগার মুসলিম বানাতে গিয়ে মো’মেনের সংজ্ঞা থেকেই বের করে দিলেন। তারা ভুলে গেল মো’মেনের সংজ্ঞায় আল্লাহ বলেছেন, মোমেন শুধু তারা, যারা আল্লাহ ও রসুলের প্রতি ঈমান আনে, কোনো সন্দেহ পোষণ করে না এবং সম্পদ ও জীবন কোরবান করে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ (সর্বাত্মক সংগ্রাম) করে (সুরা হুজুরাত ১৫)।
[পবিত্র কাবা শরিফে চার মাহজাবের অনুসারীদের জন্য চারটি পৃথক জামাতের স্থান যাকে বলা হত চার ইমামের মাকাম -